উপদেষ্টাদের তৎপরতা নিয়ে নানা বিতর্ক
লিখেছেন লিখেছেন সাইয়েদ ইকরাম শাফী ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ১০:১২:২৭ রাত
দেশের সাম্প্রতিক বিষয় ও আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে নিয়ে তার ইউটিউব চ্যানেলে একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন। এতে ইলিয়াস হোসেন আইন উপদেষ্টার দিকে অনেকগুলো অভিযোগের তীর ছুড়েছেন। এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার ড. আসিফ নজরুল একটি সংবাদ সম্মেলনে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন।
তবে বেশকিছু নিয়োগের বিষয়ে ইতিমধ্যে দেশে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হলো: ১. বাম ঘরানার জামিল আহমেদকে শিল্পকলা একাডেমির ডিজি নিয়োগ। ২. প্রথম আলোর ফারুক ওয়াসিফকে পিবিআই ডিজি নিয়োগ। ৩. ডেইলী স্টার অনলাইন বাংলা ভার্সনের সম্পাদক গোলাম মতুর্জাকে যুক্তরাষ্ট্রে ও্ বিবিসি বাংলাদেশ প্রতিনিধি আকবর হোসেনকে যুক্তরাজ্যে প্রেস মিনিস্টার নিয়োগ। আকবর হোসেন এক সময় ডেইলি স্টারে কাজ করতেন। ৪. মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ও শেখ বশির উদ্দিনকে উপদেষ্টা নিয়োগ। এসব নিয়োগে ড. আসিফ নজরুল ও প্রথম আলো-ডেইলি স্টার মিডিয়া গোষ্ঠীর প্রভাব খাটানোর বিষয় স্পষ্ট।
আইন উপদেষ্টা এসব মিডিয়ার প্রভাবে প্রভাবিত হয়েই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন বলে জোড়ালো অভিযোগ আছে।
ইলিয়াস হোসেনের তথ্য নিয়ে আমাদের বিতর্কে যাবার দরকার নেই। এ দুটি মিডিয়ার সাংবাদিকদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
শিল্পকলা একাডেমির ডিজি নিয়োগ করার জন্য বাম ঘরানার বাইরে অনেক যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। সেটা না করে আসিফ নজরুল তার পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ করেছেন। এ নিয়োগের পর বিশিষ্ট লেখক হুমায়ুন আহমেদের ২য় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের অভিনন্দন জানানোর বিষয়টি সবার চোঁখে পড়েছে। শাওন আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক। যে কোনো ব্যক্তি আওয়ামী লীগের সমর্থক হতেই পারে। এতে কারো সমস্যা নেই। বড় সমস্যা হলো আওয়ামী অপশাসনামলে খুন, ধর্ষণ, সীমাহীন লুটপাট ও বিদেশে টাকা পাচারের বিষয়ে এসব কথিত শিল্পী-সংস্কৃতি সেবীরা একেবারেই নিরব ভূমিকা পালন করেছেন। দুনিয়ার কোনো দেশের শিল্পী-সংস্কৃতি সেবীদের মধ্যে এমন ভূমিকা দেখা যায় না। মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ও শেখ বশির উদ্দিনকে উপদেষ্টা নিয়োগের পর Too add fuel to the fire অর্থাৎ আগুনে ঘি ঢালা হয়েছে।
৩০ নভেম্বর রাতে রাজধানী ঢাকার কাওরান বাজার থেকে বিতর্কিত সাংবাদিক মুন্নী সাহা জনতার হাতে আটক হন। পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছে। জানা যায় মুন্নী সাহার নামে ৪ টি হত্যা মামলা আছে। ধরে নিলাম তিনি সরাসরি খুন করেননি। খুনের প্ররোচনা ও মদদ দিয়েছেন। খুনের মদদ ও প্ররোচনা দেয়া দেশের প্রচলিত আইনে ফৌজদারী অপরাধ। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের নামে পরিকল্পিত ভাবে সেনা অফিসারদের হত্যাকান্ডের সময় এ মুন্নী সাহার ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। মুখোশপরা বিডিআরের ইউনিফর্ম পরা সন্ত্রাসীদের লাইভ ইন্টারভিউ প্রচার করে ঘটনাকে ভিন্ন ভাবে প্রবাহিত করার গুরুতর অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। বিডিআর দরবার হলের নৃশংস হত্যাকান্ডের অন্যতম প্রধান স্বাক্ষী মুন্নী সাহা। তাকে এভাবে ছেড়ে দেয়া উচিত হয়নি। এ ঘটনায় অনেকে আসিফ নজরুলের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন।
এটা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট যে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার মিডিয়া গোষ্ঠী সরকারের মাথার ওপর পুরোদমে ছড়ি ঘুরাতে শুরু করেছে। এ মিডিয়া গোষ্ঠী ২০০৭ সালের ১/১১ সরকারের মাথার ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে। সে সরকারকে নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করেছে এ দুটি মিডিয়া। এ বিষয়ে সে সময়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক সিরাজুর রহমান, সাদেক খান, আজিজুল হক বান্না, মাহমুদুর রহমান এবং তরুণদের মধ্যে আমি প্রচুর লেখালেখি করে সরকারকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছি। এরপরও সে সরকার নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশে দীর্ঘমেয়াদী সঙ্কট তৈরী করে গেছে।
হাজার হাজার ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দিয়ে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ১/১১ সরকার ও বর্তমান সরকার যে একই ধাঁচের নয় সেটা নিশ্চয় নতুন করে বলার দরকার নেই। প্রশ্ন হলো: ১/১১ সরকারের প্রেতাত্মারা কেন এ সরকারের ঘাঁড়ে চেপে বসবে?
রাজনৈতিক নেতা, আলেম সমাজ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক মিডিয়াগুলোর নিষ্ঠুর তথ্য সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজেও এসব মিডিয়ার তথ্য সন্ত্রাসের শিকার হয়েছি। এরপরও আমরা কোনো মিডিয়া নিষিদ্ধের পক্ষে নই। যে কোনো মিডিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন হতে হবে বৃদ্ধিবৃত্তিক ও নিয়মতান্ত্রিক। এ বিষয়ে ভুল করলে ছোট বিষয়কে বড় করে প্রচার চালিয়ে শত্রুরা দেশের ক্ষতি করতে চাইবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল বার্তা পৌছানো হবে। বিষয়টি সব মহলের মাথায় রাখতে হবে। প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস ইতিমধ্যে বিবৃতি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারের ওপর মানুষের ব্যাপক সমর্থন আছে এবং থাকবে। যে কোনো সরকারের জন্য জনসমর্থন সবচেয়ে বড় শক্তি। অথচ উপদেষ্টাদের অযোগ্যতার কারণে সরকার জনগণের ব্যাপক জনসমর্থনকে কাজে লাগাতে পারছে না। উপদেষ্টাদের অনভিজ্ঞতা, কাজের গতিহীনতা ও স্মার্টনেসের অভাবের বিষয়টি সব মহলে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জরুরি ভিত্তিতে উপদেষ্টা পরিষদ রিশাফল করা দরকার।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলে আমরা নিষ্ঠুর জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমাদের পরিবার-পরিজন নির্যাতিত হয়েছেন। শত শত সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবী জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। সরকারের কাজের গতিহীনতা ও বিতর্কিত নিয়োগের কারণে অনেকেই আশাহত হয়েছেন। ইলিয়াস হোসেন একজন সেরা অনুসন্ধানী সাংবাদিক। একজন সাংবাদিক হয়েও যুক্তরাষ্ট্রে তাকে উবার চালাতে হয়। ইলিয়াস হোসেনের সততা ও দেশপ্রেম নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আমাদের সবার লক্ষ্য ছিল অপশাসনের পুরোধা ইন্ডিয়ার পুতুল দানব হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া। সে কঠিন কাজে আমরা কামিয়াব হয়েছি। এখন আমাদের প্রধান কাজ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পুনর্গঠন, প্রশাসন ও বিচার বিভাগে ব্যাপক রদবদল ও সংস্কার করা। বিচার বিভাগে রদবদল তেমন হয়নি বললেই চলে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া এমনকি হত্যা মামলার প্রধান আসামী এখনো বিচারপতির আসনে বহাল রয়েছেন। বিতর্কিত বিচারপতিদের অপসারণের সমস্যা কোথায়? জরুরি রদবদল হওয়া দূরের কথা অপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে নতুন সমস্যা তৈরী করা হচ্ছে। সবকিছু ছাত্রদের আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করতে হবে কেন?
হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন পাকাপোক্ত করার প্রধান ভূমিকায় ছিল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, লুটেরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও মিডিয়া। মিডিয়ার লিডারশিপ ছিল প্রথম আলো-ডেইলি মিডিয়া গোষ্ঠীর হাতে। সে বিতর্কিত মিডিয়া গোষ্ঠী হাজার হাজার মানুষের রক্তের বিনিময়ে গঠিত সরকারের ঘাড়ে চেপে বসলে বিষয়টি কেমন দেখাবে? প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে মানুষের ব্যাপক ক্ষোভ আছে। কেন এ ক্ষোভ এ বিষয়টি আসিফ নজরুল জানেন না এমন নয়।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সজ্জন ও জ্ঞানী ব্যক্তি। আমি অতি নগণ্য মানুষ। তাকে নসিহত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে সত্য কথাগুলো আমাদের সবাইকে বলতে হবে। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পেছনে কোটি কোটি ছাত্র-জনতার পাশাপাশি আমাদেরও অনেক স্যাক্রিফাইস আছে। যা আগেই বলা হয়েছে।
অনায়াসেই বলে দেয়া যায় যে, ব্যাপক জনসমর্থন সরকারের উপদেষ্টাদের স্মার্টনেসের অভাবে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরণের ক্ষোভ তৈরী হচ্ছে। এটা হওয়া একেবারেই উচিত নয়। আমরা ভেবেছিলাম হাসিনার পতনের পর আমরা অন্তত ৬ মাস আনন্দ-উৎসব করব। সরকারের চার মাস মেয়াদ হতে না হতেই উপদেষ্টারা নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করছেন। অথচ আমাদের সবার দায়িত্ব দেশের পাহাড়সম সমস্যা কমানোর জন্য একযোগে কাজ করা।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল নিজেই বিতর্কিত নিয়োগের মাধ্যমে সমস্যা তৈরী করেছেন। সুতরাং সমাধান তাকেই বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে ফ্যাসিবাদী শাসনের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সাথে তার ঘনিষ্টতার কারণে সঙ্কট শুধু বাড়বে।
প্রথম আলোকে নিষিদ্ধ করার দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। একই ভাবে এ দুটি মিডিয়া সরকারের ঘাড়ে চেপে নিয়োগ-পদোন্নতিতে প্রভাব খাটাবে সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথম আলো-ডেইলি স্টারকে তাদের নিজেদের অবস্থানে থাকতে দেয়া উচিত। অতীতের অপতৎপরতার বিষয়ে অনুশোচনা হলে ভাল। না হলে তাদের পথে তারা আর আমাদের পথে আমাদেরই থাকতে হবে।
লেখক: গল্পকার, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
E-mail:
বিষয়: বিবিধ
৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন