মঙ্গল শোভাযাত্রা ও হেফাজত
লিখেছেন লিখেছেন সাইয়েদ ইকরাম শাফী ১৩ এপ্রিল, ২০১৭, ১১:৩৫:৫৯ রাত
স্বাভাবিক ভাবেই ইংরেজী ক্যালেন্ডারে দিন শুরু হয় রাত বারোটার পর। হিজরী বা আরবী ক্যালেন্ডারে দিন শুরু হয় সন্ধ্যায়। মোঘল আমলে খাজনা পরিশোধে এ নিয়ে প্রজাদের মধ্যে দেখা দেয় বড় রকমের জটিলতা। এ জটিলতা নিরসনে সম্রাট আকবর বাংলা সনের ক্যালেন্ডার তৈরীর উদ্যোগ নেন। সম্রাট আকবর তার দরবারের প্রখ্যাত জ্যোতিষ আমির ফতেফ উল্লাহ সিরাজীকে বাংলা ক্যালেন্ডার প্রণয়নের দায়িত্ব দেন। ফতেফ উল্লাহ সিরাজী বহু গবেষণা, পরিক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই শেষে একটি সুন্দর বাংলা ক্যালেন্ডার প্রণয়নের কাজ শেষ করেন। হিজরি ৯৯২ ইংরেজি ১৫৮৫ সালে প্রণীত এ ক্যালেন্ডারের নাম দেয়া হয় তারিখ ই ইলাহি। এটাই বর্তমানে বাংলা সন হিসেবে পরিচিত। সম্রাট আকবরের গদিতে বসার মুহুর্তকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য হিজরি ৯৬৩ এবং ইংরেজি ১৫৫৬ সাল থেকে তারিখ ই ইলাহির গণনা শুরু করা হয়। তারিখ ই ইলাহি চালু বা বাংলা ক্যালেন্ডার চালু করার পর খাজনা আদায়ের জটিলতা নিরসন হয়। এ তারিখ ই ইলাহিই হলো আজকের বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ হলেও ইন্ডিয়ার বাঙ্গালী হিন্দু এমনকি বাংলাদেশের হিন্দুরাও এ ক্যালেন্ডারের হিসাব মানে না। আমি যতটুকু জানি বাংলাদেশের হিন্দুরা নববর্ষ পালন করে সম্রাট আকবর আমলে প্রণীত বাংলা সনের একদিন পর। কেন এটা হলো-সেটা খুব কম লোকই গভীর ভাবে চিন্তা করে। দ্বীন ই ইলাহি ধর্ম চালু করার কারণে সম্রাট আকবর মুসলিম মানসে খুবই বিতর্কিত সম্রাট হিসেবে পরিচিত। যতোই বিতর্কিত হোক সম্রাট আকবর ছিলেন একজন নামধারী মুসলমান। তাই মুসলমান আমলে প্রণীত বাংলা ক্যালেন্ডার হিন্দুরা মানবে কেন? বাংলা ক্যালেন্ডারের আদি ইতিহাস লিখতে হলো এ জন্যই যে, বাংলা বর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখে কথিত “মঙ্গল শোভাযাত্রা” কে রাষ্ট্রীয় ভাবে উদযাপনের জন্য সরকারি ভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কথিত মঙ্গল শোভাযাত্রা’র! ইতিহাস:
জানা যায় মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্যোক্তা যশোরের ‘চারুপাঠ’ নামের একটি সংগঠন। ১৯৮৬ সালে তারা ২১ ফেব্রুয়ারি স্টাইলে যশোরে এটা চালু করে। কথিত এ শোভাযাত্রার জন্য তারা শহরে আল্পনা আঁকে। অশরীরী আত্মা, বিভিন্ন ধরণের পাখি এবং বাঘের মুখোশ পরা শুরু করে। এ বৈশাখী শোভাযাত্রাই ঢাকার চারুকলায় এসে আজকের রাষ্ট্র ঘোষিত মঙ্গল শোভাযাত্রায় পরিণত হয়েছে। ১৯৮৯ সালের আগে বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামেও কোনো কিছুইর অস্তিত্ব ছিল না। এভাবে ডাকঢোল পিটিয়ে “পহেলা বৈশাখ” উৎসব পালনের রেওয়াজ ছিল না। সাদা-সিধে ভাবেই বাংলা নববর্ষ উৎযাপন করা হতো। ১৯৮৯ সালে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নাম দিয়ে ইন্ডিয়ার পশ্চিম বঙ্গের মঙ্গল শোভাযাত্রার আমদানী করেন শিল্পী তরুণ ঘোষ। জানা যায়, তরুণ ঘোষ পশ্চিম বঙ্গের বরোদা আর্ট ইন্সটিটিউটের ছাত্র ছিলেন। বরোদায় নতুন বছরকে বরণ করার জন্য নানা ফোক মোটিফ, মুখোশ ও খেলনার আয়োজন করে। সে কনসেপ্ট আদমানী করে তরুণ ঘোষ এটাকে ঢাকা ইউনিভার্সিটির চারুকলা ইন্সটিটিউটে সাজিয়ে তুলেন। এদেশের কিছু হুজুগে মানুষ এটা নিয়ে সীমাহীন মাতামাতি শুরু করে। এটা মুলত পশ্চিম বাংলার কিছু এলাকার কালচার। কথিত ধর্মনিরপক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ও ‘বাম’ ঘরানার কিছু বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিসেবীকেই চারুকলা ইন্সটিটিউট-এর পয়লা বৈশাখের ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’র দেখা যেতো। ১৯৮৯ সালে শিল্পী তরুণ ঘোষের উদ্যোগে আনন্দ শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন করা হয় । এতে লক্ষ্মীপেঁচা, বাদুর, বাঘ, বানর, হনুমান ও রাক্ষস-খোক্ষসসহ, প্রায় দেবদেবী ও রাক্ষস-খোক্কস, অসুর, হালে রাজাকার প্রতিকৃতি, মুখোশ বিচিত্র সব জন্তু-জানোয়ারের মুখোশ পরে মিছিল করা হয়। মূলত: হিন্দুরা গনেশ পুজার সময় “মঙ্গল শোভাযাত্রা”র আয়োজন করে। আবার বড় কোনো কাজ যেমন মন্দির নির্মাণ বা বিগ্রহ স্থাপনের সময় দেবতার অনুগ্রহ লাভের আশায় মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। তারই অনুকরণে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশে নববর্ষ পালনের নামে “মঙ্গল শোভাযাত্রা”য় যেভাবে বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের মুখোশ পরে আনন্দ উৎসব ও লাফালাফি কালচার চালু করা হয়েছে-এটা কখানো বাংলাদেশের সংস্কৃতি বা উৎসব হতে পারে না। ইতিহাস পাঠ করেই জানা যাচ্ছে যে, বাংলার সমতলের সাধারন মানুষ কখনো এরকম উৎসব পালন করেনি। অন্যদিকে ১৯৯৩ সালে “১৪০০ সন উদযাপন পরিষদ” আয়োজিত নববর্ষ বরণ কর্মসূচি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে “মঙ্গল প্রদীপ” কালচার চালু হয় শেখ হাসিনার হাত দিয়ে। এরপর বাংলা একাডেমিতে “মঙ্গল ঘন্টা”ও বাজিয়েছিলেন তিনি। সে সময় থেকে মঙ্গলপ্রদীপ নামের জাতি বিনাশী অপসংস্কৃতি চালু হলো বাংলাদেশে। এখন দেখছি হিন্দুত্ববাদী ইন্ডিয়াকে খুশি করার জন্য অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হরহামেশা “মঙ্গল প্রদীপ” জ্বালানো হচ্ছে। এসব হিন্দুয়ানী কীর্তি এবছর থেকে সারা বাংলাদেশে সরকারি ভাবে পালন করা হবে। যা ইতিমধ্যে সরকারি নির্দেশ জারি করা হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন “যে ব্যক্তি কোনো ধর্মের মানুষের (ধর্মীয় আচারের) অনুকরণ বা সাদৃশ্য গ্রহণ করবে, সে তাদের অন্তর্ভূক্ত হবে”-সুনানে আবু দাউদ।
অর্থাৎ দেশ তথা মুসলমানদের ঈমান-আকীদা বিনাশী অপতৎপরতা চালানো হবে রাষ্ট্রের টাকা-পয়সা খরচ করে। এ সরকারের কাজই হলো ইসলাম ও জাতিবিনাশী তৎপরতা চালিয়ে ইন্ডিয়াকে খুশি করা। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনধারার সাথে এগুলো কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়।
বাংলার ইতিহাসের সামান্য আলোকপাত:
পাল রাজত্বের অবসানের পর দ্বাদশ শতকে বহিরাগত সেনরা এ দেশ দখল করেছিল। কর্ণাটকের অধিবাসী সেনরা ছিল কট্টর হিন্দু ব্রাহ্মণ। এ দেশে এসে এ ব্রাহ্মণরাই বৌদ্ধদের নির্বিচারে হত্যা করে। বৌদ্ধমন্দিরে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা। তারা সংস্কৃতকে রাজভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। নতুন করে চালু করা হয় জাতিভেদ প্রথা। এরা সংস্কৃতিকে হিন্দু মন্দিরের অভ্যন্তরে নিয়ে যায়। দেবদেবীর পূজা উপলক্ষে মঙ্গল প্রদীপের প্রবর্তন করে। মন্দিরের মধ্যে হোম ও আরতি হতে থাকে এবং কাঁসার ঘণ্টা প্রবর্তিত হয়। নিঃসন্দেহে বলা চলে, কাঁসার ঘণ্টা ও মঙ্গল প্রদীপ হচ্ছে একটি সাম্প্রদায়িক এবং পূজার সাথে অঙ্গাঙ্গী যুক্ত একটি বিজাতীয় অনুষ্ঠান।
ড. মুহম্মদ এনামুল হক (মুসলিম বাঙলা সাহিত্য) ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত এ দেশের মুসলিম প্রশাসনকে গ্রহণযোগ্য তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন : ১. তুর্কি আমল : ১২০১ থেকে ১৩৫০ খ্রি:, ২. স্বাধীন মুসলিম বাংলা : ১৩৫০ থেকে ১৫৭৫ খ্রি ও ৩. মুঘল আমল : ১৫৭৬ থেকে ১৭৫৭ খ্রি।
সারা মধ্যযুগ ধরে এ দেশে একচ্ছত্র রাজত্ব করেছে ইসলাম। তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত হতে শুরু করে। এ ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রভাবকে উৎপাটন করে এর স্থানে জায়গা করে নিয়েছিল ইসলাম। ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিকতা ও সহনশীলতা হয়ে উঠলো অদম্য, তেজশ্বি ও অপ্রতিরোধ্য শক্তি। ৬০০ বছরের অধিক বেশি সময় এ দেশের প্রশাসনের ভাষা হিসাবে বহাল ছিল ফারসি। ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ফারসি বিদ্যমান ছিল। এ কারণে বাংলা ভাষায় ফারসি-আরবি ভাষার শব্দ ভান্ডার বেশ মজবুত ভাবে অবস্থান করে নিয়েছে। যা আজো অপ্রতিরোধ্য মহিমায় বিদ্যমান। জাতীয় অধ্যাপক মরহুম সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, ‘‘আমাদের দেশের কিছুসংখ্যক মেরুদণ্ডহীন, পরজীবী এবং ধর্মচেতনাশূন্য এবং ইতিহাস বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ কিছু মূর্খ লোক এ দেশের কোনো কোনো সংস্কৃতি অনুষ্ঠানে মঙ্গল প্রদীপের আয়োজন করে এবং কাঁসার ঘণ্টা বাজায়। আমি সুস্পষ্টভাবে ইতিহাসের ধারা অনুসরণ করে জানাতে চাই যে, মঙ্গল প্রদীপ এবং কাঁসার ঘণ্টা সম্পূর্ণরূপে পৌত্তলিক এবং সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি। তাছাড়া এগুলো কোনোক্রমেই এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ধারার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। যারা মুখোশ পরে কোনো আনন্দ উৎসব করতে চান, তারা তা করুন। তাদেরকে আমি বাধা দিতে চাচ্ছি না। তবে ইতিহাস অনুসরণ করে যে সত্যটুকু পাওয়া যায় তা হচ্ছে, এ সমস্ত অনুষ্ঠান নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের গাজনের এবং হরি উৎসবের সাথে যুক্ত। গাজনের মেলায় ডোম, মেথর এবং চণ্ডাল শ্রেণীর লোকেরা নানাবিধ বহুরূপী সঙ সেজে তাদের উৎসব করতো। আমাদের মধ্যে কেউ যদি ডোম, মেথর এবং চাড়ালের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে চান তা তারা নির্বিঘ্নে করতে পারেন। আমরা তা কৃপামিশ্রিত ঘৃণার সাথে তা অবলোকন করবো।’’
(সাপ্তাহিক বিক্রম, বর্ষ ৬, সংখ্যা-১৯, ১৯-২৫ এপ্রিল, ১৯৯৩) ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এ দেশে প্রথম আসে তুর্কি মুসলমান। ১৩৪২ সালে সুলতান সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এ অঞ্চলে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন। ২৩৪ বছর এ সালতানাত স্বাধীন সার্বভৌম ছিল। দিল্লিকে কোনো ধরণের নজরানা না দিয়েই তিনি দেশ শাসন করতেন। সর্বশেষ স্বাধীন সুলতান ছিলেন সুলতান দাউদ শাহ, ১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই মুঘলদের সাথে লড়াই করে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। এ হচ্ছে স্বাধীন বাংলার সামান্য ইতিহাস। এর পরের ইতিহাস খুবই করুণ। এরপর শুরু হয় দখলদারিত্ব, আধিপত্য ও মুসলমানদের চরিত্রের অধোঃপতনের ইতিহাস। বৌদ্ধদের উৎসব বৌদ্ধরা পালন করবে। খৃষ্ঠানদের উৎসব খৃষ্টানরা পালন করবে। হিন্দুদের ধর্ম, সংস্কৃতি-উৎসব হিন্দুরা পালন করুক বা করবে এটাই স্বাভাবিক। এতে কেউ তো কখনো বাঁধা দেয়নি। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি ইসলাম থেকেই উৎসরিত। ইসলাম অন্য ধর্মাবলম্বীর ধর্ম পালনে বাঁধা দেয় না। ৯২ ভাগ ইসলাম ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত দেশে কেন হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি মঙ্গল শোভাযাত্রা, মঙ্গল প্রদীপ, মঙ্গল ঘন্টা বাজানোর কালচার চালু করা হচ্ছে-তা একেবারেই পরিস্কার। এসব হলো বাংলাদেশকে রামরাজ্য বানানোর প্রাইমারি প্র্যাকটিস বা পরীক্ষামূলক তৎপরতা। প্রাইমারী প্র্যাকটিস সফল হলে এটা স্থায়ী ভাবেই কায়েম করা হবে। এটাই হলো বর্তমান ব্রাহ্মণ্যবাদী ইন্ডিয়ার মদদপুষ্ট জন প্রতিনিধিত্বহীন সরকারের পলিসি।
মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে নিরব থাকবে হেফাজত:
পরিবর্তন ডটকম-এর রিপোর্ট অনুযায়ী "সরকারের সাথে চলমান সুসম্পর্কের পথ ধরে মঙ্গল শোভাযাত্রা ইস্যুতে আপাতত ‘চুপ’ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হেফাজতে ইসলামসহ বেশকিছু ধর্মভিত্তিক দল।" সেটা আমরা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম অনেক আগে থেকেই। সরকার হেফাজতে ইসলামসহ কথিত কওমীপন্থি মৌলভীদের সাথে আতাতের চেষ্টায় আছে। অবশেষে সেটা পুরোপুরি সত্য হয়ে গেলো। আমার মতো অতি নগণ্য একজন মানুষের আন্দাজ সত্য হয়ে যাবে সেটা ভাবিনি। এ আতাতের অন্যতম কারণ কথিত ইসলামপন্থিদের দূরদর্শিতা ও সচেতনতার অভাব। অবশ্য এর পেছনে সরকারের কূট ও অপকৌশলও কম দায়ী নয়। জানা যায় ২০১৩ ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরের গণহত্যার পর হেফাজত আমির আহমদ শফির ছেলের নামে কয়েকটি মামলা হয়। এ মামলা দায়ের করে সরকার এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করেছে। মূলতঃ এ মামলাই সরকার-হেফাজত আতাত সম্পন্ন হতে ভূমিকা পালন করেছে। এর সাথে যোগ হয়েছে কিছু জমি ও নগদ টাকার প্রলোভন। মূলতঃ শাপলা চত্বরের গণহত্যার পরই সরকার হেফাজতের সাথে আতাতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে দৈনিক মানবজমিনে ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল প্রকাশিত রিপোর্টটি পড়লেই সেটা জানা যাবে। রিপোর্টটি হলো: “রেলওয়ের ৩২ কোটি টাকার জমি গিফট দেয়া হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম নেতা আল্লামা শফীকে। হাটহাজারী মাদরাসার নামে দু’বছর আগেই জায়গাটিতে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি আল্লামা শফীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে সরকারের একটি পক্ষ জায়গাটি তার জন্য ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়েছে। সর্বশেষ রেলওয়ের জায়গাটি নিজেদের জন্য বরাদ্দ চেয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন আল্লামা শফী। সরেজমিন হাটহাজারী মাদরাসার অদূরে স্টেশনের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে গিয়ে দেখা যায়, ৩০০-র বেশি খুঁটি দিয়ে রেলের ১৬০ কাঠা জমিতে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে হাটহাজারী মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। তাতে লেখা হয়েছে ‘লিজ সূত্রে এ জমির দখলদার মালিক হাটহাজারী বড় মাদরাসা’। অন্যদিকে রেলের মালিকানাধীন পুকুরে সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছে ‘মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে এ পুকুর ও স্টেশন এলাকার উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম পাশের ২.৬৪ একর (১৬০ কাঠা) কৃষি জমি ও পুকুর দখলদার মালিক দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা’। স্থানীয় সূত্র মতে, এই জায়গার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩২ কোটি টাকা। হেফাজতে ইসলামের আমীর শাহ আহমদ শফী হাটহাজারী মাদরাসার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের একটি সূত্র জানায়, জমি দেয়ার বিষয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে হেফাজতকে জমি দেয়ার ব্যাপারে সরকারের উপর থেকে চাপ আছে। এই বিষয়ে হেফাজতের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়েছিল। বর্তমানে সেই মামলা প্রত্যাহার ও জমি দেয়ার ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। অথচ এর আগে ২০১২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি রেল মন্ত্রণালয়ের ভূমি শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব আশরাফুজ্জামান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের জমিজমা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী আল্লামা শাহ আহমদ শফীর আবেদনটি বিবেচনা করার কোন সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে বিষয়টি আপনাকে অবহিত করা হলো। এ বিষয়ে পূর্বাঞ্চল রেলের প্রধান ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা কামরুল আমিন আবেদন করার সত্যতা তুলে ধরে বলেন, ‘শফী হুজুর বছর দুই এক আগে জায়গা পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। তবে তাকে লিজ দেয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কোন ধরনের সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত না হওয়ায় পুকুর-জমি সবই অবৈধভাবে দখল করে আছে হাটহাজারী মাদরাসার লোকজন।’ অন্যদিকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক বলেন, ‘হাটহাজারী মাদরাসার নামে ওই জায়গা বরাদ্দ আছে। এখন বিষয়টি তদারকের জন্য মাদরাসার একজন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’ এ বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘একটি মহল হেফাজতের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। তারা নানাভাবে হেফাজতের বদনাম করছে।’ সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার পর এই জায়গা নিয়ে নমনীয়ভাব পোষণ করছে সরকার-এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আল্লামা শফীকে সরকার ভয় পায়। সরকারের সঙ্গে কোন ধরনের আঁতাত করছেন না তিনি। অনেকে বলেন শফী হুজুরের প্রতি সরকারের মনোভাব ঠাণ্ডা। আর তাই তিনি কোন কর্মসূচি দিচ্ছেন না। বিষয়টি সত্যি নয়। আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো। কোন প্রলোভনে গলবে না হেফাজত।’ ‘সরকারের সঙ্গে আমাদের কোন বিরোধ নেই। নেই কোন শত্রুতা। তারা আমাদের ভুল বুঝলে আমরা কষ্ট পাবো। এখানে ভুল বোঝাবুঝি হোক তা আমরা চাই না। ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।’ হেফাজতে ইসলামের প্রধান আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর এমন বক্তব্য নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের লালদিঘীতে অনুষ্ঠিত দলের দু’দিন ব্যাপী রেসালত সম্মেলনে ভোল পাল্টে নিজেদের সঙ্গে সরকারের সুসম্পর্ক রয়েছে বলে প্রকাশ্যে জানিয়েছেন এই নেতা। অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসে শ’ শ’ আলেম-ওলামা ও সাধারণ মানুষ তার বক্তব্য শুনে হতভম্ব হয়ে যান।” (মানবজমিন ১৯ এপ্রিল ২০১৪) কিছু জমি, নগদ টাকা ও নেহায়েত ব্যক্তি স্বার্থে হেফাজত এখন বিজাতীয় ও হিন্দুত্ববাদী কালচার “মঙ্গল শোভাযাত্রা” নিয়ে চুপ থাকবে!
কওমী মাদ্রাসার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে কবে? ধোকাবাজির একটা সীমা থাকা দরকার:
ইসলামী লেবাসধারী কিছু পীর ও মাজার ব্যবসায়ীরা কয়েকদিন ধরে সরকারের গুণ গেয়ে গেয়ে যেন হয়রান হয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকার নাকি কওমী মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কতো মিথ্যা ও ধোকাবাজি কল্পনা করা যায়? অথচ প্রকৃত ইতিহাস বলছে কওমী মাদ্রাসার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিগত জোট সরকারের আমলে। ২০০৬ সালের ২২ আগস্ট এ স্বীকৃতি দেয়া হয়। একই শর্তে কওমী মাদ্রাসা সনদের মান ঘোষণা করা হয় ২০০৬ সালে। এর ৭ দিন পরেই মান ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপণ জারী করা হয়। বাস্তবায়নের জন্য আলেমদের সমন্বয়ে ১৯ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করা হয়। কওমী মাদ্রাসা বোর্ড গঠন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি পাঠায়। দাওরায়ে হাদীস সার্টিফিকেটকে মাস্টার্স সমমানের মর্যাদা দেয়া হয়। এরপর অনেক দাওরায়ে হাদীস সার্টিফিকেটধারী মাস্টার্স সমমর্যাদা নিয়ে চাকরিতে যোগ দেন। কতিপয় মাওলানা নামধারী পীর ও মাজার ব্যবসায়ী জ্বলন্ত সত্যাকে অস্বীকার করে মিথ্যাচার করছেন এবং শেখ হাসিনার গুণ গান গাইছেন। এদের কি বলা যায়?
বিএনপি কি শিক্ষা নেবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান জন প্রতিনিধিত্বহীন সরকারের দুঃশাসন, অপশাসন, রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে তান্ডব চালানোর পেছনে বিএনপি’র সিদ্ধান্তহীনতা ও নানা দূর্বলতা বহুলাংশে দায়ী। নিজেদের ভাল কাজের কথাও দলটি জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারছে না। ১২ এপ্রিল হয়ে যাওয়া বিএনপি চেয়ারপার্সনের সংবাদ সম্মেলন টিভিতে প্রচারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। এ জন্য কোনো টিভি চ্যানেল বিএনপি চেয়ারপার্সনের ভাষণ সম্প্রচার করেনি। চারিদিক দিয়েই মহা এক বিপদসঙ্কুল সময় পার করছে দলটি। বহু বিজ্ঞ বিশ্লেষক নিজস্ব মিডিয়া তৈরীতে জোর দেয়ার জন্য বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু সে পরামর্শ গুলো কি কানে নিয়েছে বিএনপি? যদি কানে নিতো তাহলে বিএনপি’র এমন পরিণতি হতো না। বিএনপি’র শিক্ষা হবে কবে?
বিষয়: রাজনীতি
১৩৯৬ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন