সরকারের জঙ্গি ট্রাম্প কার্ড: ঘাতকের ভূমিকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী
লিখেছেন লিখেছেন সাইয়েদ ইকরাম শাফী ২১ মার্চ, ২০১৭, ০৪:২৮:৫৪ বিকাল
জঙ্গি বিরোধী অভিযান-গুলশান থেকে শুরু:
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্ট-এ কথিত জঙ্গি হামলার পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দেশে একের এর রহস্যজনক জঙ্গি বিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। এসব অভিযানের না আছে কোনো স্বচ্ছতা-না আছে কারো কাছে কোনো জবাবদিহিতা। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা থাকার কথাও নয়। কারণ এ সরকার জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় অাসেনি। একদলীয় তামাশার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় টিকে আছে। গুলশানের পর রাজধানীর শ্যামলী ও নারায়ণগঞ্জে এ ধরণের জঙ্গি বিরোধী অভিযান চালানো হয়েছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকার আশকোনা হাজি ক্যাম্পের পাশে র্যাব-এর নির্মাণাধীন সদর দফতরের ভেতরে কথিত এক জঙ্গি আত্মঘাতি হামলা চালায়। এরপর পুরো এলাকায় অভিযান চালায় র্যাব। এসময় আবু হানিফ মৃধা ওরফে হানিফাকে গ্রেফতার করা হয়। তবে গ্রেফতারের বিষয়টি র্যা ব প্রথম থেকেই অস্বীকার করে আসছিলো। এ ব্যাপারে একটি ইংরেজী দৈনিকে বলা হয়েছে:
'Hanif picked up on Feb 27'
Claims family of the man who died in Rab custody
Hanif Mridha who, according to Rab, died in its custody hours after being detained near Friday's suicide blast spot at the capital's Ashkona, was actually picked up by a group of people claiming to be detectives in Narayanganj's Siddhirganj late last month, his family has alleged.
His friend Sohel Hossain Montu, who was accompanying him at that time, was also picked up, and he still remained missing, Hanif's family and friends claimed yesterday.
Hanif's brother Halim Mridha said he filed a general diary with Siddhirganj Police Station on March 4, stating that the two were held in Siddhirganj on February 27.
Asked, Mohammad Rasel, a sub-inspector at the police station, confirmed the GD filing but declined to comment further on the matter. “The investigation is on … I cannot say more,” he said.
Hanif, who is from Barguna's Amragasia village, had been living with his family in the capital's Rayerbazar area for around eight months.
He was involved in transport business in the capital, and owned three Turag Paribahan buses and a car.
Halim yesterday said they learnt from media reports that a person named Hanif died in Rab custody. Later, they went to the Bimanbandar Police Station and confirmed that the deceased was indeed his brother Hanif.
Talking to this correspondent on Saturday, Mufti Mahmud Khan, director of Rab's Legal and Media Wing, said they detained Hanif Friday afternoon near Rab's Ashkona barrack where a suicide bomber blew himself up on Friday.
At about 4:30pm, some Rab members saw Hanif trying to run away from a restaurant in the area. They detained him and took him to a Rab camp where he complained of chest pain, said the Rab official.
“He was taken to Kurmitola General Hospital where doctors declared him dead around 5:45pm,” he added.
Yesterday, Hanif's wife Kulsum Begum told reporters at her Rayerbazar house that Hanif and his friend Sohel, a furniture trader, went to Barisal on February 24 to attend a religious programme of Charmonai Pir.
On February 27, they boarded a launch to return to Narayanganj, and got down at a terminal near Kanchpur Bridge, she said.
“Our driver Jewel took our private car to Kanchpur Bridge to pick Hanif.”
After Jewel reached there, he saw a group of seven to eight people whisk Hanif and Sohel away by a HiAce microbus, Kulsum said quoting the driver.
Several other members of the group posing as detectives then forcibly boarded the private car. They pointed firearms at Jewel and asked him to keep driving. As the car reached Purbachal area, they forced Jewel to get down and then drove off, she said.
Kulsum further said that later at night, a group of men came to their house by a HiAce microbus. They identified themselves as law enforcers and took away Hanif's motorbike. Halim said that more than two weeks after Hanif was picked up, several men in plain clothes and one in Rab uniform brought his brother to the house by a white HiAce microbus on March 15. The man in Rab uniform was wearing a badge that read “Iqbal”.
They forced Hanif to sign two cheques for Tk 6.70 lakh, and then took him away, he alleged.
Some of Hanif's neighbours told this correspondent that they saw some people, who identified themselves as law enforcers, bring Hanif to his house on March 15, and then take him away. Daily Star, 20 February, 2017.
বাংলা তরজমা:
‘২৭ ফেব্রুয়ারি হানিফকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়’
র্যা ব-এর কাস্টডিতে নিহত ব্যক্তির পরিবারের দাবি:
র্যা ব সদর দপ্তরের ফোর্সেস ব্যারাকে আত্মঘাতী হামলার পর সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতারের পর নিহত মো. হানিফ মৃধাকে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় বলে দাবি করছে পরিবার। এ নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি)ও করা হয়েছিল। এখনো খোঁজ নেই তাঁর সাথে থাকা বন্ধু মো. সোহেল হোসেন মন্টুর। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এস.আই মোহাম্মদ রাসেল বলেন, হ্যা, আমি জানি এ ব্যাপারে একটি জিডি হয়েছিল। তবে, আমি এর বেশি কিছু বলতে পারব না। বিষয়টি তদন্তাধীন। এ ব্যাপারে র্যা ব-১ এর লে. কর্ণেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, র্যা ব সদর দপ্তরের ফোর্সেস ব্যারাকে আত্মঘাতী হামলার দিন মুন মুন কাবাবের পাশে কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিল। র্যা ব-এর গাড়ি দেখে পালানোর সময় সন্দেহভাজন হিসেবে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। র্যাব অফিসে নেওয়ার পরই বুকে ব্যথা শুরু হলে তাঁকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। জানা যায়, হানিফের গাড়ির ব্যবসা ছিল। তাঁর তুরাগ পরিবহনের তিনটি বাস ও একটি প্রাইভেট কার রয়েছে। তাঁর বাড়ি বরগুনার আমতলীর আমড়াগাছিয়ায়। তার বন্ধু সোহেলের গুলশান-২ নম্বরে পুরোনো ফার্ণিচারের ব্যবসা রয়েছে। রায়েরবাজারে হানিফের বাসায় তাঁর স্ত্রী মোছাম্মৎ কুলসুম বেগম বলেন, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বরিশালে চরমোনাই পীরের মাহফিলে গিয়েছিলেন হানিফ ও সোহেল। সেখান থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁরা লঞ্চে ফিরে আসেন। নামেন কাঁচপুর সেতুর কাছে। তাঁদের আনতে প্রাইভেট কার নিয়ে যায় চালক জুয়েল। সেখানে গিয়ে জুয়েল দেখতে পান সাত-আটজন নিজেদের ডিবি পরিচয় দিয়ে হানিফ ও সোহেলকে হাইয়াস গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। আর কয়েকজন এসে প্রাইভেট কারে উঠে জুয়েলকে অস্ত্র ঠেকিয়ে চালাতে বলে। এরপর তারা জুয়েলকে মারধর করে পূর্বাচলে ফেলে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। এ ঘটনায় হানিফের ভাই মো. হালিম মৃধা সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ৪ মার্চ জিডি করেন। হালিম বলেন, গত ১৫ মার্চ সকাল নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যে র্যা ব-১ এর একটি গাড়ি ও সাদা রঙের একটি হাইয়াস গাড়ি তাদের বাসায় আসে। রায়েরবাজার শাহ আলী গলির মুখে র্যা ব-এর গাড়িটি দাঁড়ায়। আর সাদা গাড়িটি বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। সাদা গাড়ি থেকে চার-পাঁচজন হানিফকে সাথে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করে। এরপর বাসার লোকজনের সামনে কুলসুমকে বলে, আপনার স্বামী একটি অন্যায় কাজে সহযোগিতা করেছে। এরপর হানিফের ব্র্যাক ও ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের চেক বই এনে ৬ লাখ ৭০ হাজার টাকার চেকে সই করিয়ে নেয়। হানিফের বেয়াই রেজাউল ইসলাম বলেন, বাসায় আসা লোকজনের মধ্য একজনের গায়ে র্যা ব-এর পোশাক ও হাতে অস্ত্র ছিল। তাঁর বুকের মধ্যে নেমপ্লেটে ইকবাল লেখা ছিল। এ ছাড়া আর কারও নাম-পরিচয় জানানো বা বলা হয়নি। হানিফকে সাথে নিয়ে আবার চলে যায়। যাওয়ার সময় বাসায় রাখা পালসার ব্র্যান্ডের একটি মোটরসাইকেলও নিয়ে যায়। হানিফের কয়েকজন প্রতিবেশী সাংবাদিককে জানান যে, ১৫ মার্চ তারা দেখতে পান বেশ কয়েকজন লোক হানিফকে সাথে নিয়ে তাদের বাসায় আসেন। তারা নিজেদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দেয় এবং হানিফকে আবার তাদের সাথে করে নিয়ে যায়।
ডেইলি স্টার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭।
১৮ ফেব্রুয়ারি হানিফ মৃধার পরিবার টেলিভিশনে জানতে পারেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে হানিফ নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। তখন তাঁরা সেখানে যান। পরিচয় দেখে নিশ্চিত হন এই ব্যক্তি তাঁদেরই হানিফ। বিমানবন্দর থানায় গেলে পরিদর্শক (তদন্ত) এজাজ শফী মোবাইল থেকে লাশের ছবি দেখালে তাঁরা হানিফের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হন। ময়না তদন্তের পর লাশ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। এদিকে হানিফ মৃধার বন্ধু সোহেলের বড় মামা মো. বাবু মোবাইলে জানান, সোহেলের বাড়ি বরগুনার তালতলীর ছোট বাইজরাতে। এখানে যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে থাকতেন। এখনো তাঁর কোনো খোঁজ নেই।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হানিফ মৃধাকে পাঁচটার দিকে বিমানবন্দর থানা পুলিশের একটি গাড়িতে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় সাথে র্যা ব-এর চারটি গাড়ি ছিল।
ছেলেকে ফিরে পেতে সোহেল হোসেন মন্টুর মায়ের আকুতি:
এদিকে মো. হানিফ মৃধার বন্ধু সোহেল হোসেন মন্টুকে ফিরিয়ে দিতে আকুতি জানিয়েছেন তাঁর মা মমতাজ বেগম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘এক মায়ের এক ছেলে ফিরিয়ে দিন।’ মমতাজ বেগম জানান, সোহেল তাঁর একমাত্র সন্তান। ২০ ফেব্রুয়ারি উত্তরায় র্যা ব-১ কার্যালয়ের বাইরে একটি জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিকের সাথে কথা হয় মমতাজ বেগমের। তিনি বলেন, ১৯৭৪ সালে ছেলের জন্ম। ছেলের এক বছরের মাথায় স্বামীর সাথে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর তিনি ছেলেকে নিয়ে বরগুনা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ভিক্ষা করে ছেলেকে বড় করেন। আজিমপুরে একটি স্কুলে এসএসসি পর্যন্ত পড়িয়েছেন ছেলেকে। ২০০৬ সালে বিয়ে দেন। ছেলের ঘরে এখন এক নাতি রয়েছে। সোহেল হোসেন গুলশান-১ এ পুরোনো ফার্নিচারের ব্যবসা করেন।
হানিফের পরিবারের দাবি, হানিফের সাথে সোহেলকেও র্যা ব ধরে নিয়ে গেছে। হানিফ ও সোহেলের নিখোঁজের বিষয়ে ৪ মার্চ হানিফের ভাই মো. হালিম মৃধা সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় জিডি করেন। নিখোঁজের ঘটনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মমতাজ বলেন, হানিফ আর সোহেল বন্ধু। তাঁরা হানিফের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, হয়তো তাঁর ছেলেও র্যা ব-১ এর হেফাজতে আছে। হানিফের মৃত্যুর বিষয়টি জানার পর এখন মমতাজ বেগম তাঁর ছেলের বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। মমতাজ বলেন, এর মধ্যে একদিন একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসে। জানতে চায়, আপনি কি মন্টুর (সোহেলের ডাক নাম) মা? ‘হ্যাঁ’ বলে জবাব দেন মমতাজ। ওপাশ থেকে কে বলছেন জানতে চাইলে বলেন প্রশাসনের লোক। পরে ফোন দেবেন। কিন্তু কোনো ফোন আসেনি। তিনি বলেন, ‘হানিফের পরিবারের সাথে র্যািব যোগাযোগ করেছে কিন্তু আমাদের সাথে করেনি। তাই আমার ছেলে কোথায়-কেমন আছে কিছুই জানি না। আমি প্রধানমন্ত্রী ও র্যা বকে অনুরোধ করছি, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন।’ সোহেল ও হানিফের পরিবারের অভিযোগের বিষয়ে র্যা ব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম রোববার বলেছিলেন, এ ঘটনার সাথে র্যা ব-এর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তারপরও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মমতাজ বেগম, সোহেলের স্ত্রী নিপা ও তাঁর চার বছরের ছেলে আবির হোসেন মাহিন এবং তাঁদের আত্মীয় আবদুল জলিল র্যা ব-১ কার্যালয়ে এসেছেন।
প্রথম আলো, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তুলে নেয়া এবং পরে অস্বীকার:
অনেকদিন থেকে আইন-শঙ্খলা বাহিনী তথা পুলিশ-র্যাব এর বিরুদ্ধে অহরহ অভিযোগ আসছে যে, তারা সাদা পোশাকে বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে উঠিয়ে নিয়ে যান। পরে এসব লোকের আত্মীয়-স্বজনরা সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করলে তাদের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়। একই ভাবে হানিফ মৃধাকে আটকের পরও অস্বীকার করা হয়েছিল। একটু ভাল ভাবে খেয়াল করলে সহজেই বুঝা যায় যে, জঙ্গি বিরোধী অভিযানগুলো এবং আত্মঘাতি হামলার ঘটনাগুলো খুবই রহস্যজনক। কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, এসব ঘটনা ফেব্রিকেটেড। জঙ্গি বিরোধী অভিযানের স্ক্রিপ্টগুলো একেবারে কাঁচা হাতের। তাই মানুষ এসব আর বিশ্বাস করছে না। এসব অভিযানের বিষয়ে মানুষের বিন্দুমাত্র আগ্রহও নেই। আশকোনায় হামলা সম্পর্কে পুলিশ প্রথমে বললো, আত্মঘাতি ব্যক্তির পড়নে ছিল কালো রঙের পাঞ্জাবি, গলায় একটি নীল রঙের গেঞ্জি বাঁধা ছিল এবং মাথায় ছিল একটি ক্যাপ। পরে আবার সে বক্তব্য পাল্টে বলা হয়েছে, পড়নে সাদা শার্ট কালো প্যান্ট, সাথে একটা কালো ব্যাগ ছিল! এদিকে ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, তাদের কাছে তথ্য ছিল, কারা পরিকল্পনা করে ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। খুব ভালো কথা পুলিশ জানে কারা এসব আত্মঘাতি ও্ জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে। পুলিশ জানার পরও আগে থেকে কেন এসব হামলা ঠেকানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বা হলো না? নাকি জেনে-শুনেই আত্মঘাতি ও জঙ্গি হামলা করার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে? পত্র-পত্রিকা ও অবাধ ফ্রি স্কাই-এর সুযোগে মানুষ দুনিয়ার সব জঙ্গি ও আত্মঘাতি হামলার খবরাখবর পড়ছে-শুনেছে এবং ছবি দেখছে। কেউ কি কখনো দেখেছে বা শুনেছে-নির্জন জায়গায় কোনো আত্মঘাতি হামলার ঘটনা ঘটেছে? কোনো আত্মঘাতি হামলাকারী নির্জন এলাকায় হামলা করতে গেছে বা হামলা করে শুধু নিজে নিহত হয়েছে? কয়দিন আগে দেখলাম এক ব্যক্তি প্রাইভেট কার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট-এর বাসভবন ও অফিস হোয়াইট হাউজে প্রবেশের চেষ্টা করেছে। মার্কিন পুলিশ তার উপর হামলা বা গুলি কোনো কিছুই করেনি। তাকে শুধু আটক করেছে মাত্র। অথচ রাজধানীর খিলগাঁওয়ে র্যাব পোস্ট অতিক্রম করার সময় সিগন্যাল অমান্য করায় এক যুবককে হত্যা করেছে র্যাব। হত্যার পর কাহিনী ফাঁদা হলো-সে যুবকের কাছে বোমা ছিল। অথচ পোস্টমর্টেমে তার শরীরে ৭টি গুলির আলামত পাওয়া গেছে। হত্যা না করে র্যাব কি এ যুবককে আটক করতে পারতো না? পারবে কি করে র্যাব-এর যে সততা, সুনাম ও পেশাদারিত্ব ছিল সবই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। র্যাবতো এখন শুধু ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে।
জুয়েল রানা আত্মঘাতি হামলাকারী নয়:
এদিকে জানা যায়, রাজধানীর আশকোনায় আত্মঘাতি হামলাকারী হিসেবে জুয়েলে রানার নাম প্রচার করা হলেও সে এখনো জীবীত আছে। জুয়েল রানা নামের সে যুবক একটি দৈনিক পত্রিকা অফিসে হাজির হয়ে বলেছে: ‘আমার নাম জুয়েল রানা। আমি কোনোদিন র্যাব অফিসে যাইনি। আত্মঘাতীও আমি নই। আমি তো মরিনি।’ রবিবার রাত ১০টায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ অফিসে সশরীরে হাজির হয়ে এক যুবক ঠিক এভাবেই নিজের পরিচয় দেয়। সে বলে, র্যাব অফিসে আত্মঘাতী জঙ্গি হিসেবে পত্র-পত্রিকায় আমার নাম ও ছবি দেখে হতবাক হয়েছি। কিভাবে আমার ছবি ও নাম-ঠিকানা এলো বুঝতে পারছি না। ’জুয়েলের এমন দাবির পর নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে আশকোনায় নির্মাণাধীন র্যাব সদর দফতরে আত্মঘাতি যুবকটি কে? নিহত যুবকের আঙ্গুলের ছাপের সাথে এ জুয়েল রানার জীবন বৃত্তান্ত মিললই বা কেমন করে? এমন নানা প্রশ্ন এখন নতুন করে সামনে চলে এসেছে। র্যাব কর্মকর্তাদেরও ভাবিয়ে তুলেছে বিষয়টি। একজনের ব্যক্তিগত তথ্যের সাথে আরেকজনের তথ্যের অবিকল মিল কিভাবে সম্ভব? তবে র্যাব কর্মকর্তারা সন্দেহ করছেন, আত্মঘাতী যুবক জুয়েল রানার তথ্য দিয়ে নিজের আইডি করেছিল। তাহলে এ ক্ষেত্রে দায়ী এনআইডি কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়টিরও এখন খোঁজখবর চলছে। জুয়েল রানার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। তিনি মুন্সীগঞ্জের একটি ক্লিনিকে চাকরি করতেন। চাকরির সুবাদে স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন মুন্সীগঞ্জেই। দুটি সন্তান রয়েছে তার। রবিবার রাতে জুয়েল যখন বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে এসে কথা বলছিলেন, তখন তার চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। তিনি বারবার জানতে চাইছিলেন, তার কোনো সমস্যা হবে কি না। তিনি জানান, র্যা ব তাদের ভাঙ্গার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিয়েছে। বাবা-মাকে নিয়ে গেছে র্যাব দফতরে। মোবাইল ফোনে র্যাব কর্মকর্তারা তার সাথে কথা বলেছেন। যেতে বলেছেন তাদের অফিসে। রবিবার রাতেই র্যাব-এর ডাকে তিনি উত্তরায় র্যাব কার্যালয়ে যান। গতকাল র্যাব-এর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, জুয়েল রানা তাদের কাছেই আছে। কিছু বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জুয়েল রানা জানান, পাঁচ বছর আগে তার এনআইডি কার্ড সায়েদাবাদ এলাকা থেকে হারিয়ে যায়। এরপর তিনি আর কার্ডটি তোলেননি। এ ব্যাপারে তিনি একটি জিডিও করেছিলেন। তারও ধারণা, আইডি কার্ডটি কেউ হয়তো পেয়ে ব্যবহার করছে। যে কোনোভাবেই হাতের আঙ্গুলের ছাপও পরিবর্তন করে নিয়েছে। আশকোনায় আত্মঘাতী যুবকের লাশ চার দিন ধরে পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। শুরুতে পিরোজপুরের আমিরন বেগম নামের এক মহিলা আত্মাহুতি দেওয়া যুবককে তার ছেলে দাবি করলেও পরে তিনি নিজ অবস্থান থেকে সরে আসেন। দ্বিতীয় দফায় নিহত ওই যুবক ফরিদপুরের ভাঙ্গার জুয়েল রানা, এ বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত করেই বলেছিলেন কয়েকটি সংস্থার সদস্যরা। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের (এনআইডি) ডাটাবেজে নিহতের আঙ্গুলের ছাপ জুয়েলের সঙ্গে মিলে যায়। এর পরই রাতে ফরিদপুরের ভাঙ্গার গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হয় জুয়েলের বাবা-মাসহ পরিবারের আট সদস্যকে। তবে জুয়েলের চাচা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের পরিবারের আটজনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এটা সত্যি। আমরাও মনে করেছিলাম নিহত ওই যুবকই হয়তো জুয়েল। তবে ২০ ফেব্রুয়ারি সকালে জুয়েলের ফোন আসায় আমরা চমকে গেছি।’ এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র্যাব-এর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার জুয়েল রানা নামের যুবকের সাথে আশকোনায় হামলাকারী নিহত যুবকের আঙ্গুলের ছাপ মিলে যাওয়ার বিষয়টি আমাদেরও ভাবিয়ে তুলছে। এখন জুয়েলের বাবা-মায়ের সাথে নিহত যুবকের ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হবে। পুরো বিষয়টি এনআইডি কর্তৃপক্ষও অবহিত রয়েছেন।’ জানা যায়, ১৮ ফেব্রুয়ারি রাতেই ফরিদপুর ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদাহা আদমপুরের শেখবাড়ি থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জুয়েলের পরিবারের আট সদস্যকে নিয়ে যায়। এ ঘটনার পর থেকে এলাকাবাসীর মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। পরদিন বেলা ৩টার দিকে জুয়েলের বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের স্থানীয় পাখুরিয়া বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দেওয়া হয়।
একটি মিথ্যাকে ধামাচাপা দিতে অারো ১০টি মিথ্যা বলা:
উত্তরার আশকোনায় র্যাব কার্যালয়ে আত্মঘাতি হামলার বিষয়ে ভবিষ্যতে হয়তো আরো অনেক কাহিনী শুনতে হবে! একটা মিথ্যাকে ধামাচাপা দিতে ১০/১২টি মিথ্যা বললেও হয় না। বর্তমানে বাংলাদেশের আইন-শৃঙখলা বাহিনীর অবস্থাও হয়েছে সেরকম। এ সরকারের আমলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মানুষ হত্যার ঘটনা এখন ডাল-ভাত হয়ে গেছে। নুন (লবণ) এক সময় খুব সস্তা ভোগ্য পণ্য ছিল। কিন্তু খুন এখন নুনের চেয়ে সস্তা হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই। জঙ্গি অভিযানের নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সীতাকুন্ডে কথিত জঙ্গি বিরোধী অভিযান “অপারেশন এ্যাসল্ট”-এর পর মাত্র আট মাস বয়সী এক শিশুর লাশের ছবি দেখে খুব কষ্ট হলো-যা এ মূহুর্তে শব্দ দিয়ে সাজানো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ৮ মাসের সে শিশুর নাম ইমাম হোসেন। এ শিশু কথিত দম্পতি জঙ্গি কামাল ও জোবাইদার সন্তান। জঙ্গি অভিযানের নামে ৮ মাসের শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যার অনুমোদন দেয়া যায় কি? নিজের মনকে কোনো মতেই বুঝাতে পারছি না। একটি স্বাধীন দেশে কি হচ্ছে এসব? বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী সীতাকুন্ডে কথিত জঙ্গি বিরোধী অভিযানে নিহত কামাল ও জসিম আপন খালাতো ভাই। ৮ মাস আগে থেকেই তারা নিখোঁজ ছিল। এ সরকারের আমলে যতোগুলো জঙ্গি বিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে এবং জঙ্গি তকমা এঁটে যাদের হত্যা করা হয়েছে-তাদের প্রত্যেকের কাহিনী একই রকম। অর্থাৎ তারা নিখোঁজ অবস্থায় জঙ্গি হিসেবে ট্রেনিং নিলো এবং গড়ে তুললো জঙ্গি আস্তানা! আমাদের অতি দক্ষ আইন-শঙ্খলা বাহিনী সে আস্তানা ঘেরাও করে তাদের লাশ বানিয়ে ছাড়লো। এ যদি হয় বাস্তব অবস্থা তাহলে তো সারা দুনিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বাংলাদেশে এসে জঙ্গি বিরোধী অভিযানের ট্রেনিং নিতে হবে! বিগত ৭ বছরের বেশি সময় ধরে দেশে বহু আলোচিত অপরাধ ও হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। শত শত আলোচিত ঘটনার মধ্যে অন্যতম হলো: সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকান্ড এবং বহুল আলোচিত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকান্ড। গত বছর ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসের একটি জঙ্গল থেকে তনুর লাশ পাওয়া যায়। এসব আলোচিত একটি ঘটনারও সঠিক ক্লু উদঘাটন করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। পারেনি এসব ঘটনার ফাইনাল রিপোর্ট আদালতে দাখিল করতে। অথচ দেখুন আমাদের অতি দক্ষ ও চৌকষ এসব বাহিনী কথিত জঙ্গি বিরোধী অভিযানে আশাতীত সাফল্য দেখাচ্ছে!
অতীতে দেশে জঙ্গি বিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে কিন্তু এরকম অস্বচ্ছতা ছিল না:
অতীতেও দেশে জঙ্গি বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে চিহ্নিত জঙ্গি নেতা জমিয়তুল মুজাহেদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমানসহ আরো অনেক জঙ্গিকে। শায়খ আবদুর রহমান আওয়ামী যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজমের আপন ভগ্নিপতি। পুরোপুরি স্বচ্ছতার সহিত আইনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এসব জঙ্গি নেতাদের গ্রেফতার করে শাস্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন জঙ্গি অভিযানের নামে নিরীহ মানুষ এমনকি ৮ মাস বয়সী শিশুকে পর্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এটা কি সমর্থনযোগ্য? কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, আইন-শৃঙখলা বাহিনীর চরম দলবাজ কতিপয় অফিসার প্রমোশন, বিভিন্ন পুরস্কার ও নগদ টাকার প্রত্যাশায় পুলিশ হেডকোয়ার্টারে বসে এসব নানা অপকর্মের স্ক্রিপ্ট লিখছে এবং অভিযানের নাটক সাজাচ্ছে। এক ব্যক্তির ক্ষমতা লিপ্সা ও লোভের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে পুরো রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙখলা বাহিনী। এখন তারা ঘাতকের ভূমিকা পালন করছে। এর ফলাফল কখনো ভাল হতে পারে না। কিন্তু যারা এসব করছে তারা একেবারেই ভুলে গেছে যে, আইন-শৃঙখলা বাহিনীর পোশাক, রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র কেনা হয় দেশের মানুষের ট্যাক্স-এর টাকা দিয়ে। সুতরাং একদিন না একদিন জণগণের ট্যাক্স-এর টাকায় কেনা রসদ, গুলি ও অস্ত্রশস্ত্রের হিসাব দিতে হবে। কথিত জঙ্গি অভিযানের নামে যেসব মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে-তাদের রুহ একদিন ঠিকই জেগে উঠবে।
বিষয়: রাজনীতি
১৩০৯ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন