বর্মী সেনাদের হাতে ধর্ষণ-গণহত্যার নির্মম শিকার আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিম: নিরব, বিতর্কিত ও ধর্মযাজকের ভূমিকায় জাতিসংঘ।
লিখেছেন লিখেছেন সাইয়েদ ইকরাম শাফী ২১ নভেম্বর, ২০১৬, ১০:৪৪:১০ রাত
মিয়ানমারের মুসলিম অধ্যুষিত আরাকান হালের (রাখাইন) রাজ্যের গ্রাম গুলোতে পাঁচ দিনের হামলায় অন্তত ৬৯ জন রোহিঙ্গা হত্যার কথা স্বীকার করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। বিগত 1 সপ্তাহের সেনা অভিযানে কমপক্ষে 30 হাজার মানুষ ভিটা-বাড়ী উচ্ছেদ হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আসা শত-শত রোহিঙ্গা সীমান্তে আটকা পড়েছেন বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গাদের এক নেতা ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি-কে জানিয়েছেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী দমন-পীড়নের হাত থেকে বাঁচতে ২০০ রোহিঙ্গা রাখাইন প্রদেশ থেকে পালিয়ে আসে বাংলাদেশ সীমান্তে। বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি সোমবার তাদের পুশ-ব্যাক করে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ওই রোহিঙ্গা নেতা আরও বলেন, ২০০ আটকা পড়া রোহিঙ্গার বেশির ভাগই নারী ও শিশু। ‘তারা একটা নিরাপদে বাঁচার একখণ্ড জায়গা চান। তাদের ফিরে যাওয়ার কোনও জায়গা নেই।’ এদিকে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ৬৯ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। এসময় নিরাপত্তা বাহিনীর ১৭ জন সদস্যও নিহত হন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। নিহত রোহিঙ্গাদের ‘সহিংস হামলাকারী’ বলেও ওই বিবৃতিতে দাবি করা হয়। আরাকান (রাখাইন) প্রদেশে সম্প্রতি শুরু হওয়া বিদ্রোহ দমনের অংশ হিসেবে চালানো অভিযানে ওই হতাহতের ঘটনা ঘটে বলে সেনাবাহিনী দাবি করে। রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, সেনাবাহিনী সেখানে বেসামরিক অধিবাসীদেরকে হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণও করেছে এবং গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ৬৯ জন নিহতের কথা বললেও ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি-র এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, ‘নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।’ সহিংসতা সম্পর্কে মিয়ানমারের দেওয়া তথ্য ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ বলেও বিবিসি-র ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ২০১২ সালে ওই রাজ্যের জাতিগত দাঙ্গায় শতাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম নিহত হওয়ার পর সাম্প্রতিক সপ্তাহ গুলোতে সেখানে চরম উত্তেজনা দেখা গেছে। অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এলাকায় সন্ত্রাসীদের সমন্বিত হামলায় নয় পুলিশ সদস্য নিহত হয়। দুই দিনের মাথায় ১১ অক্টোবর মঙ্গলবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম আরও ১২ জনের মৃত্যুর কথা জানায়। তারা দাবি করে, প্রায় ৩০০ মানুষ পিস্তল এবং ধারালো অস্ত্র নিয়ে সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালায়। পরে সেনাবাহিনী পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। মিয়ানমার সরকার কথিত এইসব সংঘর্ষকে হামলাকারীদের খোঁজে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ হিসেবে অভিহিত করছে। তবে, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা ঘটনা তদন্ত ও ঘটনাস্থল পরিদর্শনের কথা বললেও মিয়ানমার সরকার সেখানে কাউকে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। এতেই বুঝা যায় রোহিঙ্গাদের আক্রমণে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হবার ঘটনা বানোয়াট। রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে নতুন করে ক্র্যাকডাউন শুরু করার জন্য এ ঘটনা সাজানো হয়েছে বলে মনে করেন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা। মানবাধিকার সংগঠন গুলোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী রাখাইন রাজ্যে জাতিগত দমন পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সেখানে ঘর-বাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে। শিশু নির্যাতন চালানো হচ্ছে সমান তালে। নারীদের ধর্ষণসহ নানান ধরণের শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। এসব অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হচ্ছে অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে। এ পরিকল্পনার মূলে রয়েছে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী। শনিবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বরের মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় মংগদাউ জেলার তিনটি গ্রামের ৪৩০টি ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘নতুন স্যাটেলাইট ইমেজ রোহিঙ্গা গ্রাম গুলোতে ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞের নিদর্শনই কেবল প্রকাশ করেনি বরং এটাও নিশ্চিত করেছে যে আমরা আগে যা ভেবেছিলাম পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ’। সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার গানশিপ ব্যবহার করে হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে এএফপি। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সরকারি স্বীকৃতি নেই। এএফপি-র প্রতিবেদনে দেখা যায়, সেখানে মিয়ানমারের সেনা প্রধানের যে বিবৃতি ছাপা হয়েছে, সেখানে নিহত রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। সোমবার মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর তরফ থেকে এ বিষয়ক একটি ফেসবুক পোস্টে ২৩৪ জন বাঙালিকে গ্রেফতারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সোমবার বাংলাদেশের টেকনাফ শরণার্থী শিবির থেকে ১৯ বছর বয়সী রোহিঙ্গা তরুণ মোহাম্মদ তৌহিদ ফোনে এএফপি-কে জানান, ‘তারা (সেনাবাহিনী) আমার চোখের সামনে আমার বোনকে গুলি করে হত্যা করেছে। হামলা চালানোর সময় আমি গোবরের নিচে লুকিয়ে ছিলাম। রাত গভীর হওয়ার পর আমি সেখান থেকে সীমান্তে পালিয়ে আসি।’ ওই তরুণ আরও বলেন, ‘আমি আমার মা-কে বাড়িতে একা ফেলে এসেছি। তিনি বেঁচে আছেন কিনা, আমি তাও জানি না।’ তিনি আরও জানান, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের শতশত ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।
চরম বিতর্কিত ও মুসলিম বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক ভূমিকায় নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি:
প্রসঙ্গত: আরাকান (রাখাইন) রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না মিয়ানমার সরকার। সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা মনে করে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশ থেকে সেখানে গিয়ে বসতি গড়েছে। নিজ দেশে তাদের উল্লেখ করা হচ্ছে, ‘বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে। বর্মী মগ ও বৌদ্ধদের এ ধারণা শুধু অমূলক নয়-রীতিমত ইতিহাসকে অস্বীকার করার সামিল। রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে। তাদের চলাচলে বিভিন্ন নিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আরাকানের রাজধানী আকিয়াবের ইউনিভার্সিটিতেও তারা লেখাপড়া করার সুযোগ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে লেখাপড়া করার সুযোগ বঞ্চিত রোহিঙ্গা মুসলিমরা শিক্ষা-দীক্ষায় আশঙ্কাজনক ভাবে পিছিয়ে পড়েছে। গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসবার পরও এই বাস্তবতার বদল ঘটেনি। বরং নির্বাচনের আগে-পরে ফাঁস হয়েছে খোদ সু চির মুসলিম বিদ্বেষের নানা দিক। নির্বাচনে তিনি কোন মুসলমানকে প্রার্থী করেননি। গত সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্যাসি’র 1151 প্রার্থীর মধ্যে একজনও মুসলমান ছিল না। ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়টিও অস্বীকার করেন সুচি। রোহিঙ্গা নিধনের বিষয়ে নিরব ভূমিকা পালন করায় মারাত্মক প্রশ্নের মুখে পড়েছে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সুচির গ্রহণ যোগ্যতা। রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যার বিষয়ে নিরব ভূমিকা নেয়ায় সু চির নোবেল পুরস্কার বাতিলের দাবি জানিয়েছেন ইন্দোনেশিয়া ভিত্তিক একটি সংগঠন (change.org) চেঞ্জডটওআরজি । সুচি’কে দুনিয়ার শান্তির জন্য হুমকি আথ্যা দিয়ে শান্তিতে পাওয়া তার নোবেল পুরস্কার বাতিল করার আবেদন করেছে সংগঠনটি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করার অভিযোগ করে সংগঠনটি। মূলত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে সোচ্চার হয়েছে এ সংগঠন। এছাড়া ২০১৩ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সু চির এক মন্তব্যকে সামনে এনেছেন তারা। বিবিসি টুডে’র এক উপস্থাপককে উদ্দেশ্যে করে সু চি বলেছিলেন, ‘একজন মুসলমানকে সাক্ষাৎকার দিতে হবে, সেটা আগে থেকে আমাকে কেউ জানায়নি।’ওই দিন মিসাল হুসেইন নামে এক মুসলিম উপস্থাপকের সু চির সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা ছিল।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে বর্মী সামরিক জান্তা:
আরাকান ছিল একটি সমৃদ্ধ ও স্বাধীন রাজ্য। রোহিঙ্গা মুসলিমরা সে আরাকান রাজ্যের আদি বাসিন্দা। রোহিঙ্গা মুসলিমদের দুর্ভোগ শুরু হয় বহু আগে। 1784 সালে বর্মী রাজা বোদা পায়া তার ছেলের নেতৃত্বে আরাকানে বিপুল সংখ্যক সৈন্য পাঠায় আরাকানে। বোদা পায়ায় সৈন্যরা সেখানে ব্যাপক লুটতরাজ, নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণহত্যা চালায়। সে সময় 1 লক্ষধিক রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করা হয়। সে থেকে আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমদের গুরুতর সঙ্কটের শুরু। যা আজো চলছে। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ ও জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ প্রায় দু’হাজার বছর আগে থেকে বিভিন্ন সময়ে ধর্ম প্রচার, বাণিজ্য ও যুদ্ধ বিগ্রহের শিকার হয়ে পূর্ব এশিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী ‘রোসাঙ্গ’ বা আরাকান রাজ্যে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে। রোসাঙ্গ বা আরাকান বর্তমান মায়ানমার রাষ্ট্রের একটি প্রদেশ বা রাজ্য। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। এটা সারা দুনিয়ার কাছে ঐতিহাসিক ভাবে স্বীকৃত বিষয়। তবে বর্মী সরকার সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ট বৌদ্ধ ও মগরা সেটা স্বীকার করে না। ১৯৭৭ সালে সামরিক সরকার শুরু করে ‘অপারেশন নাগামিন’ বা ‘ড্রাগন রাজ’। এই অপারেশনে অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করার নামে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায় মায়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় রাখাইন মগরা। ১৯৭৮ সালের মে মাসের মধ্যে কম পক্ষে দুই লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম মায়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।।মিয়ানমানের সামরিক জান্তা 1978 সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে।
আরাকানের প্রকৃত ইতিহাস:
বাংলায় ইসলাম আগমনের সময়কাল থেকেই আরাকানে ইসলামের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চল দীর্ঘকাল ব্যাপী আরাকানের অংশ হিসেবে শাসিত হওয়ার কারণে চট্টগ্রাম থেকেই আরাকানের বিভিন্ন স্থানে ইসলামের সুমহান বাণী সম্প্রসারিত হতে থাকে। পরবর্তীতে ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দে মিঙসুয়ামুঙ ওরফে নরমিখলা যার মুসলিম নাম ছিল মুহাম্মদ সুলায়মান শাহ কর্তৃক আরাকান পুনরুদ্ধারের পর থেকে আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এমনকি আরাকানের রাজধানী লংগ্রেত থেকে ম্রোহঙ এ স্থানান্তর করা হলে সেখানকার প্রায় সকল অধিবাসীই মুসলিম ছিলেন এবং ম্রোহংয়ের অধিবাসীদেরকেই রোহিঙ্গা নামে আখ্যায়িত করা হয়। বর্তমানে রোহিঙ্গা বলতে আরাকানের মুসলমানদেরই ধরে নেয়া হয়। কেননা রোহিঙ্গারাই ছিলেন আরাকানের প্রধান মুসলিম জন গোষ্ঠী। ব্রিটিশ আমল থেকে রাজ্যটি বার্মার অংশ থাকার কারণে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বার্মা স্বাধীনতা লাভের সময় বার্মার অংশ হিসেবে থেকে যায়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আরাকান রাজ্যটি কখনো বার্মার, কখনো আরব ও বাঙালির স্বাধীন রাজ্য হিসেবে শাসিত হয়েছে। দু’হাজার বছরের ইতিহাসে মুসলিম, বৌদ্ধ, মগ ও বাঙালিদের শাসনকাল ছিল অনেক বেশি।
আরাকানে মুসলমানদের আগমন:
আরাকান চন্দ্র বংশীয় রাজবংশের সংরক্ষিত ইতিহাস ‘রাদ জাতুয়ে’র বর্ণনা মতে রাজা মহত ইং চন্দ্রের রাজত্ব কালে (৭৮৮-৮১০) একটি আরবীয় বাণিজ্য বহর আরাকানের রামব্রী উপকূলে আঘাত খেয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। জাহাজের আরোহীরা ভাসতে ভাসতে উপকূলে এসে ভিড়লে পর রাজা মহত ইং চন্দ্র তাদের স্থায়ী ভাবে আরাকানে বসবাসের অনুমতি দেন। পরবর্তীতে এসব মুসলিম নাবিক পেশা ত্যাগ করে আরাকানি রমণী বিয়ে করে স্থায়ীভাবে আরাকানে বসবাস শুরু করেন। ধারণা করা যায় ধ্বংস প্রাপ্ত বাণিজ্য বহর থেকে ভেসে আসা আরবীয় মুসলমানদের এই বড় দলটির মাধ্যমেই আরাকানে মুসলিম আধিপত্যের বিস্তার ঘটে। তবে কেউ কেউ মনে করেন ইসলামের আবির্ভাবের আগে থেকে পর্তুগিজ বণিকদের পাশাপাশি আরব বণিকরা চট্টগ্রাম ও আরাকানে তাদের বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলেন। তখন থেকেই আরাকানে আরবি ও মুসলিম প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে আরাকান ও পার্শ্ববর্তী দ্বীপ সমূহে মুসলমানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তারা আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল বলে অনেক গবেষকদের ধারণা। খ্রিস্টীয় সপ্তম ও অষ্টম শতকের আরবীয় ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকরা বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী ‘রুহমী’ নামক একটি রাজ্যের পরিচয় তুলে ধরেছেন। ‘রুহমী’ রাজ্যের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বর্তমান আরাকান রাজ্যই আরবীয়দের কাছে ‘রুহমী’ নামে পরিচিত ছিল। ‘রুহমী’ দেশের বাদশার সঙ্গে বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের উল্লেখও ইতিহাসের বিভিন্ন সূত্রে রয়েছে।
মুসলিম শাসনের সূত্রপাতঃ
খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের দু’শ বছর পর গৌর অধিপতি হন সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ। এ সময় আরাকানে রাজ্যত্ব করছিলেন ম্রাউক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মেং সোয়া মউন নামান্তরে নরমিখলা। ১৪০৪ খ্রিস্টাব্দে চব্বিশ বছর বয়সে নরমিখলা সিংহাসনে আরোহণ করেন। তৎকালীন বার্মার সামন্ত রাজারা একজোট হয়ে বার্মার রাজা মেং-শো-আইকে আরাকান আক্রমণ করার জন্য আমন্ত্রণ করেন। ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা মেং-শো-আই ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে আরাকান আক্রমণ করেন। এতে নরমিখলা পরাজিত হয়ে প্রাণ ভয়ে বাংলার রাজধানী গৌরে এসে সুলতান জালাল উদ্দিন শাহের আশ্রয় গ্রহণ করেন। আরাকান বার্মার অধিকার ভুক্ত হয়। সুদীর্ঘ চব্বিশ বছর গৌরে অবস্থান করে তিনি মুসলমান ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, বিজ্ঞান প্রভৃতিতে প্রচুর জ্ঞান অর্জন করেন। স্বদেশ উদ্ধারের জন্য নরমিখলার সাহায্য প্রার্থনার অনুরোধে গৌরের সুলতান জালাল উদ্দিন শাহ ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে ওয়ালী খানের নেতৃত্বে এক সৈন্য বাহিনী পাঠান। ওয়ালী খান বর্মি বাহিনীকে বিতারিত করে আরাকান পুনরুদ্ধার করার পর বিশ্বাসঘাতকতা করে আরাকান রাজ নরমিখলাকে বন্দি করে নিজেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বন্দিদশা থেকে কোনোক্রমে পালিয়ে নরমিখলা গৌরে এসে সুলতান জালাল উদ্দিন শাহকে সব কথা খুলে বলেন। পরবর্তী বছর ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দে জালাল উদ্দিন শাহ, সিন্দিখান নামক অপর এক সেনাপতির নেতৃত্বে পুনরায় একটি সৈন্যবাহিনী দিয়ে নরমিখলাকে স্বদেশ উদ্ধারে সাহায্য করেন। এটিই ছিল ইতিহাসে প্রথম বাংলা-বার্মা যুদ্ধ। ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে গৌরের করদ রাজ্য হিসেবে নরমিখলা আরাকানের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং সোলায়মান শাহ নাম ধারণ করে ম্রউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত একশ বছর আরাকান বাংলার করদ রাজ্য হিসেবে নিয়মিত কর প্রদান করত। যুদ্ধের সময় গৌর থেকে আগত সব সৈন্যকে আরাকান রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য স্থায়ী ভাবে রাখা হয়। তারা কোনো দিন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেনি। এরা আরাকানে আগত মুসলমানদের একটি বৃহৎ অংশ।
মোঘলদের আগমন ও চট্টগ্রামে আধিপত্য:
আরাকানে মুসলমানদের আগমনের অন্যতম তৃতীয় কারণ ছিল মুগল সম্রাট শাহজাহান ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে অসুস্থ হয়ে পড়লে পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে উত্তরাধিকার যুদ্ধ। যুদ্ধে প্রথম মুরাদ আওরঙ্গজেবকে সহযোগিতা করলেও পরে বন্দি হন। দিল্লি থেকে বিতারিত হন দারাশিকো। সিংহাসন দখলের জন্য বাংলা থেকে দিল্লি অভিমুখী শাহ সুজার সঙ্গে ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে সাজুয়া নামক স্থানে আওরঙ্গজেবের বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শাহ সুজা বাংলার দিকে পলায়ন করেন। মুগল সেনাপতি মীর জুমলা তাকে ধাওয়া করলে শাহ সুজা চট্টগ্রামের পথে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে সপরিবার ও দলবল অনুচর বাহিনী নিয়ে আরাকানে পালিয়ে যান। আরাকানের তৎকালীন রাজা সান্দা-থু ধর্ম্মা প্রথম তাকে রাজকীয় সম্মান দেখিয়ে গ্রহণ করেন। শাহ সুজার মূল্যবান সম্পদ ও অপূর্ব সুন্দরী কন্যা আমেনাকে দেখে সান্দা-থু ধর্ম্মা পাগল হয়ে ওঠেন। আমেনাকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠালে মুগল বংশীয় শাহ সুজা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এ নিয়ে শাহ সুজার সঙ্গে সান্দা-থু ধর্ম্মার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে শাহ সুজা পরাজিত হলে ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ মর্মান্তিক ঘটনায় ক্ষিপ্ত মুসলমানদের সঙ্গে শুরু হয় রাজার সংঘাত। নিজ ভ্রাতার মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ সম্রাট আওরঙ্গজেব বিচলিত হয়ে পড়েন। প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খানকে নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম দখল করার জন্য। চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজার অধীন। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম দখল করেন। নবাব শায়েস্তা খান কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত অধিকার করে আর অগ্রসর হননি। অগ্রসর হয়ে গোটা আরাকান দখল করলে আজ আরাকান থাকত চট্টগ্রামের মতো বাংলাদেশের অংশ। বর্মী রাজের আরাকান দখল, নির্যাতন অতঃপর মুক্তিসংগ্রাম : চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে চলে আসা দীর্ঘদিনে আরাকানি সামন্ত রাজাদের মধ্যে দেখা দেয় মত বিরোধ। একে অপরের ক্ষমতা দখল সহ্য করতে পারেনি। কতিপয় সামন্ত রাজা একত্রিত হয়ে ঘা-থান-ডির নেতৃত্বে বার্মায় গিয়ে বার্মার রাজা বোদা পায়াকে আরাকান আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান। সামন্ত রাজা ঘা-থান-ডি ও বার্মার রাজার মধ্যে চুক্তি ছিল যে, বার্মার রাজা বোদা পায়া আরাকানের স্বাধীন সত্ত্বা অক্ষুন্ন রাখবেন এবং ঘা-থান-ডিকে আরাকানের স্বাধীন রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দিবেন। বিনিময়ে ঘা-থান-ডি বার্মার রাজাকে বার্ষিক কর প্রদান করবেন। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজা বোদা পায়া তার ছেলের নেতৃত্বে এক শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে আরাকান আক্রমণ এবং দখল করেন। বোদা পায়া আরাকান দখলে নেয়ার পর আগের প্রতিশ্রুত সব চুক্তি অস্বীকার করেন। আরাকানকে বার্মার অংশে পরিণত করা হয়। ঘা-থান-ডিকে রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পরিবর্তে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। অতি অল্প দিনের মধ্যেই বোদা পায়ার দখলদার সৈন্যরা আরাকানে ব্যাপক নির্মম, বর্বর ও পাশবিক অত্যাচার চালান। তের বছরের মধ্যে রাজ্যের দুই-তৃতীয়াংশ অধিবাসী পালিয়ে সীমান্তবর্র্তী পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। বর্মীদের অত্যাচার ও নির্যাতনে তখন নাফ নদীর পানি আরাকানিদের মৃতদেহে ভরে ওঠে। তখন থেকেই শুরু হয় আরাকানি রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যা ও শরণার্থী সমস্যা। এ থেকেই শুরু হয় আরাকানি বা রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম। বর্মী সৈন্যদের অত্যাচারে ঘা-থান-ডি এক বিরাট অনুচর বাহিনী নিয়ে সপরিবারে আরাকান ত্যাগ করে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেন। ঘা-থান-ডির আগমনের পর আরাকানি বিদ্রোহীদের শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং মুক্তিযুদ্ধ জোরদার হয়। ঘা-থান-ডির মৃত্যুর পর তার পুত্র সিনপিয়া মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। তুমুল সংগ্রামের মাধ্যমে একমাত্র রাজধানী ম্রোহং ছাড়া সমগ্র আরাকান সিনপিয়া বাহিনী দখল করে নেন। রাজধানী ম্রোহং অবরোধ করার পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অসহযোগিতা ও চরম বিশ্বাসঘাতকতা, গোলাবারুদের ঘাটতি ও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে আক্রমণ স্তিমিত হয়ে আসে। এতে পরাজয় বরণ করে সিনপিয়া পুনরায় পালিয়ে কোম্পানির অধিকৃত পর্বত এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিপদসংকুল পরিবেশে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে সিনপিয়া মৃত্যুবরণ করেন।
ব্রিটিশদের আরাকান ও বার্মা দখল:
বিদ্রোহী নেতা সিনপিয়ার মৃত্যুর পর ব্রিটিশ বার্মার দুই মিত্র শক্তি অভিন্ন স্বার্থের কারণে শত্রু শক্তিতে পরিণত হয়। সত্তর বছরের ইতিহাসে ব্রিটিশ বার্মার মধ্যে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ ছাড়াও বড় ধরনের যুদ্ধ হয় তিনটি। প্রথম যুদ্ধেই ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ বাহিনী আরাকান দখল করে নেন। অবশেষে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে সমগ্র বার্মা ব্রিটিশ দখলে চলে আসে। পরাজিত রাজা থিব আত্মসমর্পণ করলে ব্রিটিশ সরকার তাকে ভারতে নির্বাসিত করে।
রাজনৈতিক মূল্যায়নে রোহিঙ্গাদের অধিকার:
গত প্রায় দুই হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় ব্রিটিশ শাসনের আগে বার্মা আরাকান শাসন করেছে দু-দফায় মাত্র ৬৬ বছর (১৪০৬-১৪৩০ খ্রি. ও ১৭৮৪-১৮২৬ খ্রি.) পক্ষান্তরে আরাকান স্বাধীন রাজশক্তি বার্মা শাসন করেছে প্রায় একশ বছর। আরাকান বাংলার করদ রাজ্য ছিল একশ বছর। (১৪৩০-১৫৩১ খ্রি.) ব্রিটিশ কর্তৃক একশ বাইশ বছর। বাকি সময় স্বাধীন ভাবে শাসিত হয়েছে মুসলিম, বৌদ্ধ ও মগ রাজ বংশের মাধ্যমে। ব্রিটিশদের কাছ থেকে ১৯৪৮ সালে বার্মার স্বাধীনতার পরবর্তী সময় ছাড়া আরাকানের ওপর বার্মার সুশাসনের প্রমাণ নেই। আরাকানিদের ওপর বার্মার শাসন মানেই হত্যা, লুণ্ঠন, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ইতিহাস। ভাগ্যের চরম নির্মমতায় আরাকানের এক সময়কার মুসলিম বাঙালি রাজশক্তির বড় অংশ এখন রোহিঙ্গা শরণার্থী। এ সমস্যার শুরু ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বর্মী রাজা বোদা পায়া কর্তৃক আরাকান দখলের পর । ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে আরাকান স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী নেতা সিনপিয়ার মৃত্যুর দু’শ বছর পরেও আরাকানি রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কোনো সুরাহা হয়নি। মায়ানমারের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী আরাকানি জনগণ ও রোহিঙ্গা শরণার্থীর ওপর যে নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে তা বিশ্ব ইতিহাসে এক করুণ অধ্যায়। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা পূর্ব পুরুষদের ভিটে-বাড়ি থেকে বিতারিত হয়ে এখন অনাহার পুষ্টিহীনতা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। রোহিঙ্গারা জন্ম সূত্রে আরাকানের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের জীবনে এ দূর্ভোগের পিছনে নিন্মোক্ত কারণ উল্লেখ করা যায়: প্রথমত, রোহিঙ্গারা দীর্ঘ হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় আরাকানের রাজ সভাসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ অধিকার করে থাকলেও তারা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র কোন ধারা সৃষ্টি করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে বর্মী রাজ বোদা পায়া কর্তৃক ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান দখলের পর আরাকানের সর্বময় ক্ষমতা বর্মীদের হাতে চলে যায়। তারা পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাসহ আরাকানী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে হত্যা করে। অবশিষ্টদের অনেকেই প্রাণ ভয়ে বাংলায় পালিয়ে আসে। ১৮২৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধের মাধ্যমে আরাকান দখল পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়ে দেশের বাইরে অবস্থান করে। এ সময়ে সিনপিয়াসহ অনেক আরাকানী নেতা স্বদেশ পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম পরিচালনা করলেও বিভিন্ন কারণে তারা ব্যর্থ হয়। ফলে বাংলায় আশ্রিত রোহিঙ্গাসহ আরাকানে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা নেতৃত্বের দিক থেকে আরো পিছিয়ে পড়ে।
বৃটিশ আমলে আরাকান:
দ্বিতীয়ত, ১৮২৬ সালে আরাকানে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তারা রোহিঙ্গাদেরকে বাহ্যিক কিছু সুযোগ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করে। শাসক গোষ্ঠী নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রয়োজনেই আরাকানের প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্র ছাড়াও কৃষি, ব্যবসায় প্রভৃতি কাজের জন্য বাংলায় আশ্রিত রোহিঙ্গাসহ আরাকানীদের স্বদেশে বসবাসের সুযোগ প্রদান করে। এ সময় রোহিঙ্গাদের নেতৃস্থানীয় শিক্ষিত শ্রেণীর অনেকেই আরাকানে ফিরে না গিয়ে বাংলার কক্সবাজার ও বান্দরবান অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। মধ্য বিত্ত ও নিম্ন বিত্ত শ্রেণীসহ কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরে গেছে। তবে তারা নেতেৃত্বের ক্ষেত্রে নতুন করে কোন অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। রোহিঙ্গারা আরাকানের স্বাধিকার আন্দোলন শুরু করলে তাদের উপর নিপীড়ন শুরু হয়। এর ফলশ্রুতিতে একটা গ্রুপ সশস্ত্র হয়ে পড়ে। অতঃপর তাদের উপর চালানো হয় ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা।
রোহিঙ্গা মুসলিমদের এথনিক ক্লিনজিং বা জাতিগত নির্মূলের কৌশল ও বর্মী সামরিক জান্তার আরাকানের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন রাজ্য নামে নামকরণ:
রোহিঙ্গা মুসলিমদের এথনিক ক্লিনজিং বা জাতিগত নির্মূলের অংশ হিসাবে বর্মী সামরিক জান্তা 1977 সালে শুরু করে অপারেশন নাগামিন বা ড্রাগন রাজ। এ অভিযানে বর্মী সেনাবাহিনী ও স্থানীয় রাখাইনরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নির্মম নির্যাতন, দমন-পিড়ন শুরু করে। এ অপারেশনে বর্মী সেনাবাহিনী হাজার-হাজার রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করে। এ সময় প্রায় 5 লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিমকে তাদের পৈত্রিক ভিটা-বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেয় বর্মী সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী স্থানীয় রাখাইন বৌদ্ধ মগরা। এ প্রেক্ষাপটে ১৯৭৮-৭৯ সালে প্রায় তিন লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা সমূহের চাপ ও বাংলাদেশের তখনকার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কূটনৈতিক তৎপরতায় বিষয়টির আপাতঃ বাহ্যিক সমাধান নিশ্চিত হয়। এরপর বর্মী সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের নিঃশেষ করে দেবার জন্য পুনরায় নতুন কৌশল অবলম্বন করে। এর অংশ হিসাবে বর্মী সামরিক জান্তা 1989 সালে আরাকানের নাম পরিবর্তন করে রাখাইন নামে এর নামকরণ করা হয়। ১৯৮২ সালে বিতর্কিত বর্ণবাদী নাগরিকত্ব আইন ঘোষণা করা হয়। এ আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভাসমান নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রোহিঙ্গাদের কাছে কালো আইন হিসেবে বিবেচিত এ আইনে তাদের সহায়-সম্পত্তি অর্জন, ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করা হয়। প্রতিরক্ষা সার্ভিসে যোগদানে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণ কিংবা সভা-সমিতির অধিকারসহ সার্বিক নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার সীমিত সামর্থ্য নিয়েই অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ত্রাণ কার্যক্রমসহ আশ্রায়ন ক্যাম্প তৈরী করে আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতায় বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তথাপিও রোগ-শোক, অনাহার-অর্ধাহারে নাফ নদী পেরিয়ে আসা অসংখ্য লোক প্রাণ হারায়; যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ।
মায়ানমারে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর মূল হোতা “আশিন ওয়াইরাথু”।
Ashin Wirathu. মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর বর্বর নির্যাতনের প্রধান আসামী! ২০১০ সালে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়ে তার ২৫ বছরের সাজা হয়। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভ করে। মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই আবার সে পুরোদমে মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে থাকে। সে নিজেকে মায়ানমারের “ওসামা বিন লাদেন” হিসেবে প্রচার করে!! তখন থেকে ইউটিউব ও ফেসবুকের মত মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে থাকে সে।২০০১ সালে সে মুসলিম বিদ্বেষী গোষ্ঠী “969 movement” এ যোগ দেয়। তার বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উৎপীড়ন চালানোর জন্য প্রচারণা চালানোর গুরুতর অভিযোগ আছে। অথচ সে নিজেকে একজন শান্তি প্রিয় ধর্মজাজক হিসেবেই দাবি করে! অবশ্য সে প্রকাশ্যে মুসলমানদের শত্রু বলে দাবি করে!২০১৩ সালের জুন মাসে প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনের কাভার পেজে তাকে “The Face of Buddhist Terror” হিসেবে অভিহিত করে একটি তথ্যভিত্তিক লিড রিপোট প্রকাশ করা হয়!“তুমি দয়ামায়া-ভালোবাসায় পরিপূর্ন হতে পারো, কিন্তু তুমি পাগলা কুত্তার পাশে ঘুমাতে পারো না”–মুসলিমদের উদ্দেশ্য করে বলা তার বচন! সে আরো বলে যে আমরা যদি দুর্বল হয়ে যাই-তবে, আমাদের ভূমি একদিন মুসলিমদের হয়ে যাবে!
রোহিঙ্গা মুসলিমদের ব্যাপারে বর্তমান সরকারের চরম বিতর্কিত ভূমিকা:
অতীতে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও কৌশল অবলম্বন করে দ্বি-পক্ষীয় ভিত্তিতে এ সমস্যার সমাধান করে। কারণ: রোহিঙ্গা সমস্যার প্রেক্ষাপটে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ। আরাকানী মুসলমানদের সাথে হাজার বছরের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক ও ধর্মীয়সহ বহুমাত্রিক বন্ধন রয়েছে। এ ভ্রাতৃত্ব সুলভ বন্ধনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে মানবতার স্বার্থে রোহিঙ্গা সমস্যাকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিশ্বের নিকট গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরতে হবে বাংলাদেশকেই। মূলত: আরাকানে মুসলিম জাতি সত্বা বিনাশ করে একক ভাবে মগ রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়েই রোহিঙ্গাদেরকে বসত-বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। মায়ানমারের বিভিন্ন স্থান থেকে মগদের এনে আরাকানে প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ প্রেক্ষাপটে স্বাধীন আবাস ভূমি ছাড়া রোহিঙ্গাদের মুক্তির বিকল্প কোন পথ নেই। চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য কিছু কিছু সংগঠন কাজ করলেও মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার মত সাংগঠনিক ও বৈপ্লবিক শক্তি কোনটিই তাদের নেই। রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে বর্তমানে চলমান বর্মী সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউনের সময় চরম বিতর্কিত ভূমিকা পালন করছে বর্তমান সরকার। নির্যাতন, নিপীড়ন ও গণহত্যার মুখোমুখি হয়ে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় চাইছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা। বর্তমান সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা ও অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশে বাঁধা দিয়ে আবার মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠাচ্ছে। এটা শিকারী বাঘের হাত বেঁচে আসা মানুষকে আবার বাঘের কাছে ফেরৎ পাঠানোর সামিল। বাংলাদেশ সরকারের এ ভূমিকা শুধু মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন নয়-রোহিঙ্গা মুসলিমদের ব্যাপারে চরম নিষ্ঠুর আচরণ ছাড়া আর কিছু নয়। যা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রীতি ও প্রথা বিরোধী। এটা তারা কখনো আশা করে না।
ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলিম এটাই কি রোহিঙ্গাদের অপরাধ? তাদের সমস্যা কি সমাধান হবে না?
সচেতন মহলের জানা থাকার কথা যে, খ্রিষ্টানদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষায় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়াকে টুকরো করে পূর্ব তিমুরকে স্বাধীন করা হয়েছে জাতিসংঘের উদ্যোগে। একই ভাবে আফ্রিকা মহাদেশের বৃহৎ মুসলিম দেশ সুদানকে টুকরো করে দক্ষিণ সুদানকে স্বাধীন করা হয়েছে জাতিসংঘের্ উদ্যোগ ও তত্বাবধানে। খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, দুনিয়ার যে কোনো দেশে মুসলমানরা নির্যাতিত, নিপীড়িত ও গণহত্যার শিকার হলে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন গুলোর তেমন তৎপরতা চোখে পড়ে না। এই যে দেখুন কাশ্মীরের ঘটনা। সেখানে দখলদার ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী প্রতিনিয়ত কাশ্মীরীদের নির্যাতন, নিপীড়ন চালাচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে তরুণ-যুবকদের। শিশু ও মহিলাদের শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। মহিলাদের সম্মান, শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণ করা হচ্ছে। কাশ্মীরের সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের কোনো তৎপরতা ও উদ্যোগ চোখে পড়ে না। শুধু মাঝে-মধ্যে নরম ভাষায় বিবৃতি দেয়। এটাকে অনেকটা রবীন্দ্র সংগীতের সুর বলা যায়।
দুর্বৃত্তের ভূমিকায় বাংলাদেশের মিডিয়া ও সাংবাদিক নামধারী ব্রাহ্মণ্যবাদের এজেন্টরা:
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চলমান ক্র্যাকডাইনের ব্যাপারে শুধু বিতর্কিত নয়-চরম দায়িত্বহীনতা ও রীতিমত দুর্বৃত্তের ভূমিকা পালন করছে বাংলাদেশের মিডিয়া। রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্মম, নিষ্ঠুর নির্যাতন, নিপীড়ন, গণধর্ষণ ও গণহত্যার ঘটনার বিষয়ে কোনো বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট প্রকাশ করছে না বর্তমান জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকারের নির্লজ্জ সমর্থক মিডিয়া গুলো। মুসলিম অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় উদাসীনতার জন্য বাংলাদেশের আওয়ামী-বাম সমর্থক মিডিয়া গুলোকে অনেক বিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ব্রাহ্মণ্যবাদী মিডিয়া হিসাবে অভিহিত করে। প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, চেচনিয়া, আরাকানসহ দুনিয়ার কোনো দেশে মুসলমানরা নির্যাতিত-নিপীড়িত হলে এসব মিডিয়া কোনো বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট প্রকাশ করে না। উল্টো নির্যাতন-নিপীড়ন, ধর্ষণ ও গণহত্যার ঘটনা গুলোকে নেতিবাচক হিসাবে উপস্থাপন করে। মিয়ানমার (বার্মায়) রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে চলমান নির্মম, নিষ্ঠুর নির্যাতন-নিপীড়ন, গণধর্ষণ ও গণহত্যার ঘটনার বিষয়েও এসব মিডিয়া নিজেদের চিরাচরিত চরম উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতন-নিপীড়ন, গণধর্ষণ ও গণহত্যার ঘটনা নেতিবাচক হিসাবে উপস্থাপন করছে এসব মিডিয়া। এ বিষয়ে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিভিন্ন সোস্যাল নেটওয়ার্কেই শুধু কিছু সঠিক খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে। সাংবাদিক নামধারী বর্তমান সরকারের নির্লজ্জ সমর্থক জনৈক ব্যক্তি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন: “২০১৩-এর জুনের পর গত অক্টোবর পর্যন্ত দীর্ঘদিন রাখাইন রাজ্য শান্ত ছিল। কোন সংঘাত ছিল না। ৯ জন বার্মিজ পুলিশ মারার পরও তেমন কড়া অ্যাকশান ছিল না। ১৭ জন বার্মিজ সেনাকে মারার পর কড়া অ্যাকশান শুরু হয়। সবার সহ্যের সীমা থাকে। এই ধরনের ঘটনা যদি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে ঘটতো তাহলে কি হতো। আমাদের সেনিবাহিনী পুরা পার্বত্য জেলা তাবা বানিয়ে দিত। শত শত নয় হাজার হাজার পাহাড়ির লাশ পড়ত। সম্ভবত ১৯৯২ সালে ২ জন সেনা সদস্য নিহত হবার ঘটনায় খাগড়াছড়িতে শত শত পাহাড়িকে মাইকিং করে মাঠে ডেকে এনে ব্রাশ ফায়ার করা হয়”। কি মিথ্যাচার! কি নির্লজ্জপনা দেখুন! নিজ দেশে বাস করে সেনাহিনীর বিরুদ্ধে চরম মিথ্যাচার! এদের কি বলে সম্বোধন করা যায়। বর্মী সেনাবহিনীর অপকর্মের সহযোগী দুর্বৃত্ত? জালিম রাখাইন বৌদ্ধ মগদের দোসর?
অকর্মা ও অপদার্থ ওআইসি:
আরাকানে বর্মী সেনাবাহিনীর হাতে চরম, নিষ্ঠুর নির্যাতন-নিপীড়নের ব্যাপারে আরো বেশি বিতর্কিত ভূমিকা পালন করছে 57 সদস্য বিশিষ্ট মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোপারেশন (ওআইসি)। জন্ম সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েব সাইটে বলা হয়েছে: “The cause of Palestine and Al-Quds Al-Sharif is the central issue of the Organization of Islamic Cooperation (OIC) due to its religious and political stature , and since it is the main reason behind the Organization’s creation following the wanton burning of Al Aqsa Mosque in 1969. the OIC considers Al-Quds Al-Sharif an integral part of the Occupied Palestinian territory since 1967, and do support the Palestinian people to enable them to exercise their right to full sovereignty over the city of Al-Quds, the capital of the state of Palestine, and to maintain its human cultural heritage and its own Arab identity, and protect its Islamic and Christian sanctuaries”. বাংলা তরজমা: “প্যালেস্টাইন ও আল-কুদুস আল-শরীফ এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মর্যাদাই হলো ওআইসি’র প্রধান বিষয়। ইসরাইল কর্তৃক 1969 সালে আল-কুদুস আল-শরীফে আগুন লাগানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ওআইসি’র প্রতিষ্ঠা। ওআইসি অগ্রাধিকার ও মত পোষণ করে যে, আল-কুদুস 1967 সালে ইসরাইল অধিকৃত প্যালেস্টাইনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ওআইসি আরো সমর্থন করে যে, আল-কুদুসে প্যালেস্টাইনের জনগণের পূর্ণ সার্বভৌম অধিকার ভোগ করবে এবং আরব পরিচয়ের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি বজায় রাখবে। নিরাপদ রাখা হবে ইসলামিক ও খ্রীষ্টানদের ধর্মীয় স্থান।” অনেক বিজ্ঞ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক ওআইসি নামের এ প্রতিষ্ঠানটিকে একটি অকর্মা ও অপদার্থ প্রতিষ্ঠান হিসাবে সম্বোধন করতে শুরু করেছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে ওআইসি’র আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা। ইন্ডিয়ার একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্য কাশ্মীরে দখলদার ইন্ডিয়ান সেনারা প্রতিনিয়ত চরম ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। সেখানে তরতাজা যুবকদের হত্যা করছে ইন্ডিয়া সেনাবাহিনী। নির্যাতন করা হচ্ছে শিশুদের। শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, অপদস্থ, শ্লীলতাহানী ও রেপ করা হচ্ছে মহিলাদের। ইসরাইলী সেনা কর্তৃক প্যালেস্টাইনের আল-কুদুস মসজিদে আগুন লাগানোর ঘটনার পর ওআইসি’র জন্ম। অথচ প্যালেস্টানের সমস্যা সমাধানে চরম ভাবে ব্যর্থ ওআইসি। প্যালেস্টাইন ও কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে নির্লিপ্ততা। একই ভাবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতন, নিপীড়ন, গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের মতো বর্বর-জঘন্য ঘটনার ব্যাপারে নিরবতা ও নির্লিপ্ততা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে ওআইসি নামের প্রতিষ্ঠানটির গ্রহণ যোগ্যতাকে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো: ওআ্ইসি’র কাজ কি? এর প্রয়োজনীয়তাই বা কি?
রোহিঙ্গা মুসলিমদের সমস্যা সমাধানে নিরব ও ধর্মযাজকের ভূমিকায় জাতিসংঘ:
বর্মী সরকারের অসহনীয় নির্যাতনের হাত থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাঁচানোর জন্যে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা সমূহের কার্যকর কোনো তৎপরতা নেই। রোহিঙ্গা মুসলিমরা দুনিয়ার সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী এ ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব সেরেছে জাতিসংঘ। রোহিঙ্গা মুসলিমদের গুরুতর মানবিক ও তাদের জীবন-মরণের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠানের নিরবতা শুধু দুঃখজনক নয়-চরম উদ্বেগের বিষয়ও বটে। এখন প্রশ্ন হলো সারা দুনিয়াতে মুসলিমরা নির্যাতন, নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার হতে থাকবে-আর জাতিসংঘ শুধু রবীন্দ্র সংগীতের সুরে বিবৃতি দিয়ে অপরাধী দেশ গুলোকে নির্দেশ দিয়েই দায়িত্ব সারবে? বর্মী সেনাদের হাতে নিষ্ঠুর গণহত্যার শিকার আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমদের ব্যাপারে জাতিসংঘের বিবৃতির স্টাইলটা দেখুন: জাতিসংঘ বলেছে “উভয় পক্ষকে সংযত হবার জন্য”। এটা অনেকটা ধর্মযাজকের উপদেশের মতো। আরাকান রাজ্যে শুধু একটি পক্ষই অর্থাৎ বর্মী সরকার, সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাখাইন বৌদ্ধ মগরা ঘটনা ঘটাচ্ছে । রোহিঙ্গা মুসলিমরা শুধু নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ ও গণহত্যার শিকার হচ্ছে মাত্র। এখানে জাতিসংঘ উভয় পক্ষ কোথায় পেল? জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বলেছেন, “মিয়ানমার হলো দুনিয়ার সবচেয়ে অসভ্য দেশ।” মগের মুল্লুক বলে কথিত মিয়ানমার যে, দুনিয়ার সবচেয়ে অসভ্য দেশ-সেটাতো সবাই কম-বেশি জানেন। এসব বিবৃতি কি রোহিঙ্গা মুসলিমদের সমস্যা সমাধান করবে? রবীন্দ্র সংগীতের সুর ও ধর্মযাজকের আদলে শুধু বিবৃতি দেয়াই কি জাতিসংঘের কাজ? জাতিসংঘের মূল দায়িত্ব কি? এ প্রশ্ন শুধু আমার নয়-সারা দুনিয়ার শান্তিকামী ও মানবতাবাদী মানুষের। পরিশেষে এ টুকুই বলবো যে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গুলোর উচিত হবে মমত্ব ও দায়িত্ব্ বোধ নিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সমস্যা সমাধান ও তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার পুনরোদ্ধারে কার্যকর ভূমিকা পালন করা।
তথ্য সহায়তা:
• আবিদ বাহার, পিএইচডি, ইউনিভার্সিটি প্রফেসর, কানাডা
• আহমেদ আফগানী
• আল-জাজিরা অনলাইন
বিষয়: বিবিধ
১৯১৬ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমরা আজ পশুর চেয়েও অধম। তাই এই দুর্গতি দুর্দশা।
সর্বাবস্থায় ভালো থাকুন এই প্রার্থনা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন