সেক্যুলার অর্থ ব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব:
লিখেছেন লিখেছেন ওসমান গনি ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০২:৪৬:২৩ দুপুর
অর্থনীতি মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগে একটি অপরিহার্য নিয়ামক শক্তি। জীবনের উত্থান-পতনে অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। আমাদের গ্রহে যেদিন থেকে মানব প্রাণের স্পন্দন শুরু হয় ঠিক সেদিন থেকেই মানুষ অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলা করতে শুরু করে। পৃথিবীর প্রথম মানুষ ও নবী হযরত আদম আ.কে বেঁচে থাকার তাগিদে সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেই থেকে শুরু করে অদ্যাবধি মানুষের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের সংগ্রাম ও অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা ও চিন্তা-ভাবনা থেমে নেই।
শুধুই অভাব অপনোদনে নয় বরং জীবনকে অধিকতর নিরাপদ ও সুখকর করার জন্য তথা জীবনের ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির জন্য মানুষের এ প্রচেষ্টা আধুনিককালে আরও বেগবান হয়েছে। বস্তুত,আর্থিক বিষয় ও ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের চিন্তার অবধি নেই। কি আয় করবে,কীভাবে আয় করবে, কি ব্যয় করবে ও কীভাবে ব্যয় করবে? তাছাড়া কী উৎপন্ন করবে কিংবা বন্টন ব্যবস্থা কী রকম হবে তাও আলোচনার বিষয় হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। মানবজাতির ইতিহাসে এ সব বিষয় এবং আরও অনেক বিষয় কেন্দ্রীয় আলোচনার বিষয় বস্তু হিসেবে পরিচিহ্নিত হয়ে আসছে। সমাজের কল্যাণ সাধনই এ সব কিছুর মুখ্য উদ্দেশ্য এটা আপাত দৃষ্টিতে বলা যায়। তবে কল্যাণের মৌলিক উপাদান ও অর্জনের বিষয়ে যথেষ্ট মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এখানে স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক এবং নীতি নির্ধারণের ক্ষত্রে প্রাধান্য কার সে বিষয়েও মতের ভিন্নতা লক্ষ্যণীয়। এক দল মানব সৃষ্ট মতবাদ নিয়ে সন্তুষ্ট, অপর দল সৃষ্টি-কর্তাকে আইনের মূল উৎস হিসাবে পরিচিহ্নিত করতে বদ্ধপরিকর। তারপরও অভিপ্রায় লক্ষ্য ও কর্ম-কৌশলে একটি নির্মোহ প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে সব সময়।
মূলত আঠার শতক থেকে বর্তমান নিয়ন্ত্রিত ধারার উন্মেষ ঘটে। যার মধ্য ত্রিধারার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও নিজস্ব চিন্তাধারা, মিল-অমিল ভিত্তির উপর প্রতিষ্টিত আলাদা আলাদা কৌশল অবলম্বনের বিষয় প্রণিধানযোগ্য। তবে অতি সম্প্রতি অর্থনীতিতে যে মন্দা ও তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে ও যার ফলে প্রত্যেকটি দেশেই বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকায় ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যে টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ও অনেকগুলো ব্যাংক দেওলিয়া হয়ে যাচ্ছে তা অর্থনীতিবীদ ও সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলেছে। দেশগুলো অর্থনৈতিক ও বহির্দেশীয় ভারসাম্যহীনতা মোকাবেলা করছে। বর্তমানে এই দুই এর ব্যবধানকে কমিয়ে মৌলিক চাহিদা পূরণ, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয়-সম্পদ বন্টনে বৈষম্য হ্রাস করার একটি সমন্বিত কৌশল অবলম্বনের কথা বলা হচ্ছে। অপর পক্ষে, প্রচলিত অর্থ ব্যবস্থায় নৈতিক-ধর্মীয় মূল্যবোধকে অস্বীকার করার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ধর্মীয় অনুশাসনকে উপেক্ষা করা এ সকল মতবাদের অন্যতম লক্ষ্য। বস্তুত,এ সব অর্থ ব্যবস্থায় কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও শেষ পর্যন্ত ধর্মনিরেপক্ষতাবাদী তথা সেক্যুলার কর্ম পদ্ধতির উপর বর্তমান তিন ধারার অর্থনীতি প্রবর্তিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই তিন প্রচলিত অর্থ ব্যবস্থা হলো:
১। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা,
২। সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা ও
৩। দুই অর্থ ব্যবস্থার যুক্ত ফল বা মিশ্র অর্থনীতি।
পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা:
বিশেষজ্ঞদের মতে বস্তুত বর্তমান বিশ্বে পুঁজিবাদ বলতে কিছুই নেই। দীর্ঘকাল ধরে পরিবর্তন পরিমাজর্নের ফলে নতুন নতুন পদক্ষেপ সংযোজিত হয়েছে ফলে পুঁজিবাদ তার আসল অবয়বে এখন আর নেই। এত পরিবর্তনের পরও পুঁজিবাদ ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের অনেক দেশই পরিবর্তিত ব্যবস্থার অনুশীলন করছে। তারা লাভ-লোকসান, পুুরস্কার ও ভাতা প্রদানে যোগ্যতা ও কর্মের সমন্বয়ের কথা বলছে। ব্যক্তি তার প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের একচেটিয়া সুবিধা বা সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণে এখানে বাধা নেই। অর্থাৎ, জন স্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ কিংবা নিয়মতান্ত্রিকতার বাধ্যবাধকতা নেই। এভাবে সম্পদের পাহাড় গড়তেও সমস্যা নেই। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ টিবর সিটোভস্কি বলেন, “একদিকে প্রাণহীন বিশাল প্রাচুর্য, অন্যদিকে দারিদ্র বিশৃঙ্খলারই বহিঃপ্রকাশ”। এইচ জি ওয়েলস বলেন, “ক্যাপিটালিজম কী, তাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে, সে সর্ম্পকে আমাদের কারো স্বচ্ছ ধারণা নেই। আমরা শুধু বলব, এটি একটি কৃত্রিম ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা, একটি জটিল ঐতিহ্যগত প্রয়োগ, অনিয়ন্ত্রিত অর্জনেচ্ছু শক্তি এবং বিকৃত সুবিধা ও জীবনের অপচয়”। ডেলটনের ভাষায়, “পুঁজিবাদ ভোগবাদের ফসল, অমানবিক ও অন্যায্য এক সমাজ, সামাজিক বৈষম্য, মালিক- শ্রমিক, ভূস্বামী ও প্রজা এবং শাসক-শাসিতের মধ্যে দ্বন্দ”। এ অর্থ ব্যবস্থা দরিদ্র বিশ্বের অবস্থা পরিবর্তনে সক্ষম হয় নি এটা বাস্তবতা। এখানে ধনী আরও ধনী হওয়ার সূযোগ সৃষ্টি হচ্ছে আর গরিব দিন দিন ফতুর হয়ে যাচ্ছে।
সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা:
সমাজতন্ত্রীক ব্যবস্থায় সরকার পণ্যের উৎপাদন এবং বন্টনে হস্তক্ষেপ করে থাকে। এ হস্তক্ষেপের ফলে সর্বত্র একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করে। এ অর্থ ব্যবস্থায় সরকার সম্পদের মালিকানার অজুহাতে সরাসরি হস্তক্ষেপ ও সমাধানে ব্রতী হয়। এক কথায়, ভূমি এবং মূলধন রাষ্ট্রের হাতে রেখে সরকার পরিচালনার চেষ্টা করে, এতে বহুমাত্রিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। ঢালাওভাবে জাতীয়করণের ফলে সর্বত্র বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করে। ব্যক্তি মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ না থাকায় শ্রমিক শ্রেণি কর্মোদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে ও উৎপাদন হ্্রাস পেতে থাকে।
মিশ্র অর্থনীতি:
এই অর্থনীতিতে অপর দুই অর্থ ব্যবস্থার সমন্বয়ের ব্যর্থ প্রয়াস চালানো হয়েছে। যার ফলে এখানেও একটি গোঁজামিল, বিশৃঙ্খল ও এলোমেলা অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। দ্বি-মুখী নীতির ফলে বাস্তবায়নযোগ্য কোনো একক নীতিই এখানে জোড়ালোভাবে প্রতিফলিত হয় না। এটি একটি বড় সমস্যা। উপরোল্লিখিত তিন অর্থ ব্যবস্থার প্রতিটিতেই সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে বিবিধ সমস্যা মোকাবেলা করতে গিয়ে এক এক সময় এক এক বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে। এভাবে এ সব মতবাদের অবয়ব মূল থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। তারপরও তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য গঠনমূলক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় নি। ধনী দেশগুলোতে প্রচুর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হলেও কাংখিত লক্ষ্য অর্জনে তথা সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে ও সামষ্টিক দারিদ্র বিমোচনে বিশ্বের অন্য দরিদ্র দেশের কথা দুরে থাক নিজ দেশেও তারা সফলতা অর্জন করতে পারে নি।
চীন, ভারত, রাশিয়া, আমেরিকা কিংবা ইউরোপে এ সময়ে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করছে। খোদ ভারতে চল্লিশ কোটি লোক দারিদ্র সীমার নিচে বাস করছে ও দেশটিতে বর্তমানে কোটি কোটি লোক বেকার। এখনও তারা সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা মোকাবেলা করে সফলতা অর্জন করতে পারে নি, যার ফলে সে সব দেশে সামাজিক অস্থিরতা ও অপরাধ প্রবণতা হু হু করে বাড়ছে। আর্থিক অসঙ্গতি, বেকারত্ব ও সামাজিক বৈষম্যের কারণে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রীস, ইটালী ও ফ্রান্সে কিছুদিন পূর্বে মান্দা ও ভয়াবহ দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়েছিল। আমেরিকায় ব্যাংক ব্যবস্থা হুমকির মুখোমুখি। একা আমেরিকাতে ৪০০-৫০০ ব্যাংক ২০০৮-২০১৩ সালের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর শুনা যায়। ব্যাংকগুলোর ‘স্ট্রেস ট্রায়াল’ চলছে সে সব দেশে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সে দেশের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষায় ‘মূমুর্ষ অবস্থায়’ নিপতিত হয়েছে। এ বিশৃংখল অবস্থা দেখে কিসের আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়।
বাস্তবিকই সেক্যুলার অর্থনীতির এ সব বিষয় হিসাবে নিলে ব্যক্তি স্বার্থ ও সমাজকল্যাণের পুঁজিবাদ-সমাজতান্ত্রিক মতবাদে যে যথেষ্ট শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। বাস্তব অবস্থা হলো, প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠায় এ সব ব্যবস্থা সে দিকে অমনোযোগিতার কারণে ও পারঙ্গমতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্যক্তি স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত বাজার ব্যবস্থার অদৃশ্য হাত সবকিছুকে সুবিধাবাদিতায় আড়ষ্ট করে ফেলেছে যা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গেছে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ইউরোপীয় রেনেসাঁ আন্দোলন পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থাকে বিপুলভাবে প্রভাবান্বিত করে। খৃষ্টীয় বিশ্বাস সে যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। খৃষ্টান পাদ্রীদের অযৌক্তিক-অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও কর্মকা- যুক্তিবাদী আধুনিক মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে। এ আন্দোলনের নায়কেরা খ্রীষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাসের বদলে যুক্তিকে প্রাধান্য দিতে থাকে। প্রকৃতই এ খ্রীষ্টীয় ধর্মে কোনো অর্থনৈতিক মতবাদ লক্ষ্য করা যায় না। তবে তারা তথাকথিত যুক্তিকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে স্রষ্টার অস্থিত্ব, আত্মার অমরত্ব ও পারলৌকিক জীবন সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টিতে ইন্ধন যুগিয়েছে। এদের মধ্যে ক্লাসিক চিন্তাবিদ লক, হিউম, বার্কলি ও ক্যান্ট অন্যতম। এ সমস্ত নৈরাশ্যবাদী অর্থনীতিবীদ ও দার্শনিকদের মন্তব্য-বক্তব্য ও বানোয়াট প্রচারণার ফলে সামাজিক ডারউইনবাদের ধারণা আরও উস্কে দিলো, যেখানে বলা হলো অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম, তথা শ্রেণি সংগ্রাম এবং যোগ্যতমের বেঁচে থাকার অধিকার। এভাবে সামাজিক ডারউইনবাদ অর্থনীতিতে অনুপ্রবেশ করে নৈতিকতা ও ন্যায়নীতির চিরন্তন ধারা ও ধারণাকে পাল্টে দিলো। এই বক্তব্যের সার কথা হলো, অর্থনীতি তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হবে। নৈতিক মূল্যমান এখানে কোনো বিচার্য বিষয় নয়। এভাবে নৈতিকতা ও ন্যায়নীতির সংজ্ঞা ওলট-পালট হয়ে গেল। ধনীরা বিবেকের দংশন ও দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত থাকল তথা মুক্তি পেল। দরিদ্র ও বেকার লোকদের অলস উদ্যমহীন ও অসৎ প্রবৃত্তির বলে মনে করা হলো।
পুঁজিবাদের আর এক নাম বস্তুবাদ। বস্তুবাদে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা প্রনিধানযোগ্য। এ দর্শনের মূল কথা হলো বস্তুই মহাবিশ্বের মৌলিক সৃষ্টির ভিত্তি। কোনো উন্নততর উদ্দেশ্য লক্ষ্য বা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারা কর্তৃক মহাবিশ্ব চালিত নয়। তাদের বক্তব্য হলো, প্রত্যেক কিছুকেই বস্তুর ভিত্তি ও প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যা করতে হবে। তাদের মতে সম্পদ, দৈহিক ভোগ ও ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য সুখ হচ্ছে সর্বোচ্চ বিষয়, যা মানুষ অর্জন করতে পারে। লক এর ভাষায় মানব চরিত্র হলো ‘টেবুলা রাসা’ অর্থাৎ, যার কোনো চরিত্র বলতে কিছুই নেই। মার্কস, ফ্রয়েড, ওয়াটসন প্রমুখ অর্থনীতিবিদ মানুষের মনকে পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত বলে অভিহিত করেছেন। এ সব অর্থ পূজা ও লোভ-লালসার নিন্দা জানিয়ে কুরআন ঘোষণা করছে, “তোমাদেরকে বেশি বেশী অর্থ সম্পদ সঞ্চিত করার চিন্তা চরমভাবে নিমগ্ন করে রেখেছে। কবরে পা দেয়া পর্যন্ত এ চিন্তায় তোমরা বিভোর থাক। কখনও নয় অতি শ্রীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। (সূরা আত তাকাসুর: ১-৩)
এ সব মতবাদে ধর্মীয় মূল্যবোধের স্বকীয় শক্তিকে অস্বীকারের ফলে ধর্মীয় অনুশাসনকে দুর্বল করার ব্যর্থ প্রচেষ্ঠা চালানো হয়। যার ফলে স্রষ্টার সৃষ্টি সকল মানুষের সমতার ধারণাটি ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।
বস্তুবাদে ধর্মীয় অনুশাসন মানার বাধ্যবাধকতা না থাকায় নৈতিকতার বিষয়টি এখানে শিথিল হয়ে পড়ে। অপরদিকে, দার্শনিক টয়েনবি বলেন, ‘আসল কথা হলো ধর্ম মানুষের মাঝে সামাজিক দায়িত্বানুভূতিকে ধ্বংসের পরিবর্তে বৃদ্ধি করে থাকে’। তার সাথে তাল মিলিয়ে এরিয়েল ডুরান্টও জোরালোভাবে বলেন, ‘ধর্মের সাহায্য ব্যতিরেকে কোনো সমাজ উচ্চ নৈতিক মান বজায় রাখতে পেরেছে ইতিহাসে তার কোনো নজির নেই’। দুঃখের বিষয়, ইসলামকেও এখানে অন্যান্য ধর্মের সাথে গুলিয়ে ফেলার মিথ্যা প্ররোচনা সৃষ্টি হয়। অথচ প্রচলিত অর্থে ইসলাম ইহুদী,হিন্দু কিংবা খ্রীষ্টান ধর্মের মত কোনো ধর্ম নয়। বরং, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ বলেন, ‘আমার নিকট একমাত্র মনোনীত ও গ্রহণযোগ্য জীবন বিধান হচ্ছে ইসলাম’। অর্থনীতিসহ জীবনের সকল দিক ও বিভাগের বাস্তব, কল্যাণকর ও সুন্দর ব্যাখা রয়েছে ইসলামে যা চিন্তাশীল মানুষের মন-মননকে জাগিয়ে তোলে ও আলোড়িত করে।
পুঁজিবাদে বন্টন ব্যবস্থা স্বচ্ছ নয়, সমতাভিত্তিক কিংবা ন্যায়সংগতও নয়। এক কথায়, সম্পদের সুষম বন্টন ব্যবস্থা এখানে উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপস্থিত। এমনকি বাধাবন্ধনহীনভাবে সম্পদের পাহাড় গড়তেও সমস্যা নেই এ পদ্ধতিতে। এখানে মুনাফার স্তুপকে স্ফীত করে তুললেও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের অপরিহার্য প্রয়োজন মেটানের কোনো বাধ্যবাধকতা কিংবা জরুরি ব্যবস্থা নেই। এ সময় কিছু সংখ্যক মানুষ তথা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানদের হাতে সীমাহীন অর্থ ও সম্পদ আবর্তিত হতে থাকে। অভাবী ও ভাগ্যাহত মানুষের ন্যুনতম অধিকার প্রাপ্তিও তখন অনিশ্চিত থাকে। প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন ও বন্টনে পুঁজিবাদে কড়াকড়ি নেই। এ ক্ষেত্রে এ মতবাদ সমাজে ন্যায় নীতি প্রদর্শনে সমর্থ হয় নি। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অর্থ সম্পদ যেন কেবলমাত্র তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়।’ (সূরা হাঁশর: ৭)।
বস্তুত বন্টন ব্যবস্থায় অদক্ষতা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। উপরন্তু, নৈতিকতার বালাই না থাকায় ধনীরা ‘টাকা যার জগৎ তার’ মনোভাবে পরিচালিত হয়। ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজে গরিবদের অধিকার স্বীকৃতির পরিবর্তে তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখা হয়। পুঁজিবাদে অত্যাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয় চাহিদাকে আলাদাভাবে দেখার অবকাশ নেই। যার ফলে মুদ্রাস্ফীতি, ঘাটতি ও মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়ে সমাজে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।
এ দুই ব্যবস্থা অগ্রাধিকার নির্ণয়ের চেয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। বিত্তশালীদের কদর এখানে সবচেয়ে বেশী। এটি অনেকটা তেলা মাথায় তেল দেয়ার মতই। মানবিক বিষয়টা মূখ্য বিষয় নয়। এ মানসিকতার কারণেই ধনী রাষ্ট্রগুলো গরিব রাষ্ট্রগুলোর জন্য তেমন কিছু করছে না। অথচ এটা তাদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল। তাদের আচরনে প্রতীয়মান হয় যে, প্রত্যেক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার ও অগ্রাধিকার নির্ণয়ে পুঁজিবাদ আন্তরিক নয়, যার ফলে গরিব বিশ্ব দূর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক টানাপোড়নে জর্জরিত। বস্তুত তথাকথিত বিশ্ব ব্যবস্থার নামে গরিব দেশগুলোকে শোষণ করা হচ্ছে, এ রকম দাবি উড়িয়ে দেয়ার মত নয়। বরং এটা দিবালোকের মত সত্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
ভারত-আমেরিকা-ইসরাইল তিন অক্ষশক্তি এবং চীন, রাশিয়া ও ইউরোপ সারা পৃথিবীর প্রায় ৮৫% প্রতিরক্ষা ব্যয় সংগঠিত করছে। এমন কি ঐ সমন্ত দেশ বাকী বিশ্বে অস্ত্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে। যার ফলে ঐ সব দেশ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার এ খাতে অপচয় করছে। তারা এভাবে রাজনৈতিক আধিপত্য ও অর্থনৈতিক শ্রেষ্টত্ব বজায় রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নিজেরা নামছে ও অন্যদের নামিয়ে সীমাহীন দূর্ভোগ ও যুদ্ধবিগ্রহ লাগিয়ে অমানবিক কর্মের জন্ম দিচ্ছে। এশিয়া আফ্রিকায় যখন ভয়াবহ দুর্র্ভিক্ষ চলছে তখন তারা সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে অর্থ-সম্পদ অপচয়ের উল্লাসে মেতে উঠেছে। অথচ এ সন্ত্রাসবাদ তারাই সৃষ্টি করছে এমন অভিযোগও রয়েছে যা চিন্তাশীল মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। এতে মনে হয়েছে দরিদ্র বিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন লোকের সীমাহীন দারিদ্রের ব্যাপারে তাদের লোক দেখানো প্রবণতা আছে তবে প্রকৃত মাথা ব্যথা নেই, যা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। অথচ এ সব গরিব লোকদের জন্য ধনী দেশগুলোর অনেক দায়িত্ব ছিল।
প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ভোগবাদী সমাজ মদ, জুয়া ও বেশ্যাবৃত্তির পিছনে হাজার কোটি ডলার নষ্ট করছে। অতি সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিল গেটসসহ বর্তমান বিশ্বের মাত্র কয়েকজন ধনী লোকের সম্পদের পরিমান প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার আর যার মাধ্যমে বিশ্বের সকল দরিদ্র মানুষের ৪ বার অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। ইসলাম এ রকম সীমাহীন সম্পদ অর্জনের প্রচেষ্ঠাকে গ্রাহ্য মনে করে না উপরন্তু যাকাত প্রথার মাধ্যমে একে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। অপরপক্ষে ইসলাম লাগামহীন ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয়কে গ্রাহ্যতা দেয় নি, অশ্লীলতা ও জেনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এ সব হারাম কাজে ব্যয় করাও হারাম করা হয়েছে। কুরআন এগুলোকে অপচয় বলে আখ্যা দিয়েছে ও বলছে ‘অপচয়কারী শয়তানের ভাই’। অর্থাৎ, শয়তানের মত অপচয়কারীরাও দোজখের বাসিন্দা হবে।
নিউটনের সুত্রের মত অর্থনীতিকে গাণিতিক উপায়ে সমাধান করতে গিয়ে বিশ্ব জনমত সম্পর্কে যান্ত্রিকতার ধারণাকে সমাজ বিজ্ঞানের উপর অর্পণ করা হয়েছে। জড় পদার্থের মত মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো মানুষ কেবল ব্যক্তি স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হবে। জেভনস্ এর ভাষায় মানুষের সমগ্র আচরণ স্বীয় স্বার্থ ও উপযোগিতা দ্বারা যান্ত্রিকভাবে পরিচালিত। এড্যাম স্মীথ এর মতে অদৃশ্য হাত সমাজের স্বার্থ রক্ষা ও নিশ্চিত করবে। তাছাড়া এখানে নৈতিক মূল্যবোধের সাথে অর্থনীতির সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করেছে। তাদের মতে অর্থনীতিতে মানবিকতা বা আদর্শিক মতবাদের কোনো স্থান নেই। এ মতবাদকে পজিটিভিজম বলা হয়।
পুঁজিবাদের তিক্ত ফল এই যে পশ্চিমা বিশ্ব নিজের আখের ঘোচানোর ব্যবস্থা করেছে সব সময়। এভাবে দরিদ্র বিশ্বের বিশাল জনগোষ্ঠীকে দাসানুদাসে পরিণত করা হয়েছে। এ সব বিবেকহীন কর্মকান্ডের জন্য ইংল্যান্ডের টমাস কার্লাইল, রাস্কিন ও চার্লস ডিকেন্স এবং আমেরিকার হেনরী জর্জ এর মত বিশ্ব বিখ্যাত চিন্তাবিদগণ ‘লেইজেস ফেয়ার’ (যেমন চলছে তেমন চলুক) নীতির স্বার্থপর মতবাদকে সাংঘাতিকভাবে আক্রমন করে কলম যুদ্ধ চালিয়ে যান। কার্লাইল অর্থনীতিকে ডিসমিসাল সাইয়েন্স তথা ‘ব্যক্তি স্বার্থ সমাজ স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্থ করে না’ মতবাদের বিরোধিতা করেন। হেনরী জর্জ বিত্ত ও দারিদ্রের বৈপরিত্যকে নিন্দা করেন। এখানে সমতাভিত্তিক বন্টন ব্যবস্থার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। উপরন্তু, সমাজে বৈষম্যমূলক বিতরণ ব্যবস্থা প্রবর্তিত। এখানে বিত্ত বেসাতির মালিক উচ্চ শ্রেণির অঙ্গুলী হেলোনীতে অর্থনীতি চলে। স্যামুয়েল্সন স্বীকার করে বলেন, ‘সম্পদ ও আয় বন্টনের নীতি ও তত্ত্ব এখনো স্থীতিশীলতা লাভ করে নি’।
পুঁজিবাজারে ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের ট্র্যাজেডি হচ্ছে, কতিপয় পুঁজিপতির লাগামহীন স্বার্থসিদ্ধির ও সূযোগ দানের বিনিময়ে সমাজের সিংহভাগ মানুষের অধিকতর সুযোগ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত রাখা। এতে করে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ ও স্বার্থপরতার আবির্ভাব, প্রচলন ও প্রসার পারিবারিক ঐতিহ্য ও শৃঙ্খলাকে দূর্বল করে দেয়, যার ফলে বিবাহ বন্ধনের বাইরে যৌন অনাচার সৃষ্টি হয়। নারীরা তখন ভোগ্য পণ্যের মত ব্যবহৃত হতে থাকে। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই প্রতারণামূলক যৌন অনাচারে লিপ্ত হয়। এভাবে পরিবার প্রথা বিলুপ্ত হতে থাকে। সমষ্টিগত বন্ধন ও ঐতিহ্যের শিকল থেকে মানুষকে মুক্তির নামে একটি উশৃঙ্খল, উলঙ্গ ও যৌনবাদী সমাজের জন্ম দেয় এভাবে। এ সমস্ত কারণে পশ্চিমা দুনিয়া সামাজিক মানুষের পরিবর্তে বর্তমানে চক্ষু লজ্জাহীন রোবট মানুষে পরিণত হয়।
পশ্চিমা জগত ও প্রতীচ্যের ভোগবাদী সমাজ বাহ্যিকভাবে যত সাফাই গাক না কেন, ভিতরে ভিতরে তুষের আগুনের মত জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে; তা আর বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। এদের সমাজে কিশোরী গর্ভপাত, পিতৃহীন, অপরাধী ও মাদকাসক্ত, অলংঘনীয় বেকারত্ব ও হতাশার দুষ্টচক্রে নিপতিত হয়ে তিলে তিলে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি বণী আদম। চাকচিক্যময় সমাজ ব্যবস্থায় হয়তোবা তা বুঝার উপায় নেই। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতি হলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্দশা লাঘবে চরম ব্যর্থতা। আর এর প্রতিক্রিয়ায় সমাজবাদী অর্থ ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছিল। এ ব্যবস্থাও প্রবল ধর্মনিরপেক্ষ আবহে লালিত ও এদের দৃষ্টিভঙ্গিও পুজিবাদের মতই ধর্মনিরপেক্ষ বরং এক ধাপ এগিয়ে কট্টর নাস্তিক্য ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। এ ব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার আয় ও সম্পদের অসম বন্টনের দুষ্ট চক্রকে দায়ী করে একটি নিয়ন্ত্রণমূলক উৎপাদন বন্টনের কথা বলে থাকে।
সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার উৎস মূল হলো মার্কসবাদ। মার্কসবাদ মূলত বিভিন্ন নাস্তিক্য মতবাদের সমন্বিত মতবাদ। এগুলো হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ ও মুক্ত চিন্তা, হেগেলের দ্বান্দিক বস্তুবাদ, ফুয়েরবাকের বস্তুবাদ, মিচেলের শ্রেণি সংগ্রাম তত্ত্ব ও এ্যডাম স্মিথের অর্থনৈতিক দর্শন। কার্লমার্কস ধর্মনিরপেক্ষ তথা নাস্তিক্যবাদী ধ্যান-ধারণার উন্মেষ ঘটান। এই দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ধর্মের সমালোচনাই সকল সমালোচনার ভিত্তি। মার্কস শ্রেণি বিচ্যুতি, শোষণ, শ্রেণি সংগ্রাম, মজুরি দাসত্ব ও অর্থনৈতিক নির্ণয়বাদের প্রবর্তন করেন, তবে তার সমস্ত চিন্তাধারা অবোধগম্য ও অস্পষ্টতায় ভরা। পুঁজিবাদের মত এখানেও এক শ্রেনির সুবিধাবাদী, ধনিক-বনিক, বুর্জোয়া শ্রেনির উন্মেষ ঘটে অবলীলাক্রমে। বরং ক্ষেত্র বিশেষে তা আরও জঘন্যভাবে প্রকাশ পায়।
মার্কস ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যমূলক মানব প্রকৃতিকে তথা মানব চরিত্রের অন্তর্নিহিত নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকারের মাধ্যমে ব্যক্তির অফুরন্ত মেধা, মনন ও কর্মশক্তিকে ম্লান করে দিতে প্রয়াস পায়। তার এই মতবাদকে নরম্যান গ্যারাস অগ্রাহ্য করেন। মার্কসের এ ধারণা তারই বস্তুবাদী ধারণার তাত্ত্বিক বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অপরপক্ষে, তার এলিনেশন সম্পর্কিত ধারণাটি অন্যভাবে চিত্রিত হয়েছে। এ সমস্থ ব্যাখা মার্কসীয় মতবাদের অস্পষ্টতা ও অসামঞ্জস্যতা আরও প্রকট করে তোলে।
এলিনেশন প্রক্রিয়ার মূল প্রতিপাদ্য হলো ইউরোপীয়দের শান্তিপূর্ণ সমাজ পরিবর্তনের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন সাধন করা। জনগণ কর্তৃক বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ ও ব্যক্তি মালিকানাধীন সকল উৎপাদন-উপকরণের জাতীয়করনের মাধ্যমে প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ধারণা বর্তমান বিশ্বে উদ্ভট হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। উপরন্তু, একটি শ্রেণিকে অবলুপ্ত করে প্রলেতারিয়ান ডিক্টেটরশীপ তথা সর্বহারা শ্রেণির বিজয় সাধনের তথাকথিত ধারণা হালে পানি পায় নি। কেন না, উদ্দেশ্য সৎ থাকলেও তার প্রয়োগ-পদ্ধতি, পন্থা ও কৌশল ছিল ভ্রান্ত ও ত্রুটিপূর্ণ।
মার্কস বুর্জোয়া শ্রেণির উচ্ছেদ ও উৎপাদন-উপকরণ রাষ্ট্রীয়করণের কথা বললেও যৌক্তিক বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতে এলিনেশন প্রক্রিয়ার অবসান নিশ্চিতকরণ ও তার মাধ্যমে কীভাবে শোষণহীন ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব তা প্রমাণ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তার এ মতবাদ শেষ পর্যন্ত বলার জন্য বলায় রূপান্তরিত হয়। তিনি দ্বান্দ্বিক দর্শন তথা ধনশালীদের শ্রেণি শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে সে শ্রেণির মানষকে হত্যা, ধ্বংস ও বলপূর্বক সম্পদ দখলসহ জংলী ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করে কীভাবে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব তা প্রমাণ করতে পারেন নি। বরং তার এ মতবাদ সা¤প্রতিক সময়ে অসার প্রমাণিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, আধুনিক বিশ্বের যে সকল দেশে মার্কসীয় মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে সব সমাজেও এলিনেশন প্রক্রিয়ায় সমাজ পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয় নি। পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ ও খোদ রাশিয়া তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ মতবাদ মানুষের উপর আস্থাহীনতা, স্রষ্টার উপর অবিশ্বাস ও শ্রেণি সংগ্রামের নামে শ্রেণিতে শ্রেণিতে সংঘাত লাগিয়ে দেয়া ছাড়া বড় কিছু অর্জন করতে পেরেছে বলা যাবে না, যার ফলে এ মতবাদের উপর অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি মালিকানা ক্ষুন্ন হওয়ায় জনগণ রাষ্ট্রকে ও রাষ্ট্র জনগণকে আড় চোখে দেখতে থাকে। কাজে ফাঁকি ও অমনোযোগী হওয়া নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। বিপ্লবোত্তর সময়ে মার্কসীয় দর্শন তথাকথিত আশার বাণী তথা সম্পদের সুষম ও দক্ষ বন্টন নিশ্চিত করার শ্লোগান মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। এখানে পরকালীন জীবনের চিন্তার অভাবের কারণে মানুষ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে ও যন্ত্রমানবে পরিণত হয়, আর মনুষ্যত্বের বিলোপ ঘটে। এই দর্শনের আরো একটি চিন্তাধারা হলো সামাজিক-আর্থিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অনুমান ভিত্তিক ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হওয়া; বিশেষ করে মানব জীবনের অস্থিত্ব, আগমন ও প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব ও প্রত্যাখানের ফলে উৎপাদন, বন্টন, দক্ষতা ও সমতা সৃষ্টির সকল লক্ষ্যই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
উৎপাদনকারী, শ্রমিক, ভোক্তা কিংবা পরিচালকের মধ্যে বিশেষ করে রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়, যার ফলে সততা ও দক্ষতার সাথে নিঃস্বার্থভাবে কর্ম পরিচালিত হয় না। মানুষ রাষ্ট্র প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে না। ক্ষমতার অপব্যবহার অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলতে থাকে। সত্যি কথা হলো, জোর-জবরদস্তি করে কিংবা শাস্তি দিয়ে মানুষের চিরন্তন ভোগ ও লিপ্সা উপেক্ষা করা যায় না। অথচ, ধর্ম ও নৈতিক মূল্যবোধ একটি সমাজকে অনেক বেশি পরিশীলিত করে গড়ে তুলতে সক্ষম। এ বিশ্বাসটি এখন সত্যে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর মধ্য এশীয় দেশগুলোতে ধর্ম-কর্মের বিদ্যুতগতিতে পুনরুজ্জীবন ও প্রসার মানুষের চিরন্তন আকুতির বহিঃপ্রকাশ বলেই মনে করা হচ্ছে, যাকে এতদিন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অবদমিত করে রাখা হয়েছিল।
নৈতিক মূল্যবোধের নির্বাসনের ফলে পরষ্পর বিপরীতধর্মী স্বার্থের সমন্বয় নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কেন না, আর্থ সামাজিক লক্ষ্য অর্জন ও উৎপাদন উপকরণের বন্টনে ইনসাফ ও সততার দৃষ্টান্ত স্থাপনে চাহিদার সাথে মূল্যবোধের চেতনা অবশ্যম্ভাবীরূপে যুক্ত হতে হবে। সামাজিক জীব হিসাবে মানুষ বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-কর্ম ও বিশ্বাসে বিভক্ত আর তা হাজার হাজার বছর ধরে চলমান। হয়তোবা সত্য-মিথ্যা ধর্মের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তথাপি এই ধর্ম বিশ্বাসকে উচ্ছেদ করা কখনও সম্ভব নয়। অথচ পুঁজিবাদের মত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও ঐশী বিধানের কোনো স্থান নেই, বরং এক ধাপ এগিয়ে ওরা ইসলাম ধর্মকে টার্গেট বানিয়ে নিয়েছে ও বলে ধর্ম আফিমের মতই। যার ফলে, জনগণকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
ব্যক্তির সহায় সম্পদ কুক্ষিগত করে রাষ্ট্র সামাজিক বিপ্লব সাধন করবে এটা অবাস্তব ধারণা। অতএব, ঐশী নির্দেশনার উপর ভিত্তি করে সমাজ ব্যবস্থা নির্মিত নয় এমন সমাজে ব্যক্তি তার স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিতে চাইবে না কোনক্রমেই। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নামে কিছু মানুষের উপর বিশাল জনগোষ্টীর আর্থিক ব্যবস্থা ন্যস্ত করা বিপজ্জনক বলেই ধরে নেওয়া যায়। পুঁজিবাদের মত এখানেও বরং কিছুটা বেশি অদক্ষ ও অসম বন্টন ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়। সোভিয়েত যৌথ খামার ব্যবস্থার করুণ চিত্র দেখলেই তা সহজে অনুমান করা যায়। কর্মক্ষম জনশক্তির এক-তৃতীয়াংশ কৃষি খাতে নিয়োজিত থাকার পরও সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রায়শই খাদ্য ঘাটতির কথা শোনা যায়। আন্তরিকতার অভাব ও অদক্ষতার ফলে উৎপাদনে ধ্বস নামে ও সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৬০-৭০ সালের ৫.২% প্রবৃদ্ধির ধারা বর্তমানে শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। সমাজতান্ত্রিক দেশে মিডিয়া সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকায় এখানকার সব বিষয় সহজে প্রকাশিত হয় না, যার ফলে অনেক কিছু অজানাই থেকে যায়।
গণমাধ্যম স্বাধীন না হওয়ায় প্রকৃত অবস্থা কখনও জানা সম্ভব নয়। এতে এক প্রকার গোলকধাঁধার সৃষ্টি হয়। সামাজিক বৈষম্য ও শ্রেণি বিভক্তির ধারা পুঁজিবাদের মত সমাজতান্ত্রিক সমাজেও লক্ষ্যণীয়। শ্রমিক তার ইচ্ছেমত কর্ম শিবির পরিবর্তন করতে পারে না। এমনকি অভিযোগের কোন সুযোগ রাখা হয় নি। রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র তাই পুঁজিবাদী সমাজ থেকেও অধিকতর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। উৎপাদন-উপকরণ হতে শ্রমিক শ্রেণির বিচ্ছিন্নকরণ এখানেও বিদ্যমান। যার ফলে, শোষণের সকল সুযোগ ও বৈশিষ্ট্য চলমান থাকে সর্বদা। এখানে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মত সমাজের উপরের স্তরের লোকেরাই উচ্চ আয় ও বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। শ্রমিক শ্রেণির সন্তান-সন্ততি শ্রমিক হয়েই বেড়ে উঠে ও সৌভাগ্যের মুখ দেখার সুযোগ নেই। শিক্ষা ব্যবস্থা অবৈতনিক হলেও শ্রমজীবি মানুষের সন্তানদের উচ্চ প্রযুক্তি সম্পন্ন শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
বৈষম্যহীন সমাজের যে স্বপ্ন কার্ল মার্কস দেখেছিলেন, তার সফলতা দেখা গেল না মোটেও। ব্যর্থতার কারণ সুস্পষ্ট। লক্ষ্যের সাথে দর্শন ও কৌশলের কোনো মিল না থাকায় যা হবার তাই হলো। তথাকথিত সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হলো না। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও প্রকৃত গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি ও দমন-নিপীড়নের ফলে সর্বস্তরে হতাশা আরও বেগবান হতে থাকে। সেভিয়েত অর্থনীতিবিদ জর্জ আর্বাতভ বলেন, ‘নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিতে এলোমেলোভাবে বাজার অর্থনীতির কিছু দিক সংযোজনের চেষ্টা টেলিফোনের খুঁটিতে আঙ্গুর গাছের কলম লাগানোর মতই ব্যর্থ হয়েছে’। বস্তুত আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠন ও প্রেরণার ক্ষেত্রে নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে যা পুজিবাদের মত সমাজবাদেও উপেক্ষিত হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, মুদ্রাস্ফীতি ও শ্রমিক অসন্তোষের যাঁতাকলে নিপিষ্ট হচ্ছে সমাজবাদী দেশগুলো। বর্তমানে বেকারত্বের ভারে সে সব দেশ নুইয়ে পড়ার উপক্রম। বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের দিক থেকে এ সমস্ত দেশ ভয়াবহ অবস্থায় নিপতিত।
বস্তুত প্রচলিত এ সব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনিবার্য ফলশ্র“তিতে মানুষে মানুষে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করল। সব চেয়ে আশ্চর্য্যরে বিষয় হলো সারা দুনিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকা- গুটিকয়েক রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ইচ্ছা অনিচ্ছার বিষয়ে পরিণত হলো। এতেই স্পষ্ট বুঝা যায়, বর্তমান ধারার অথনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্ব সংস্থায় কী রকম চরম বৈষম্য ও অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করেছে। অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যপ্রাচ্যের জন্য মায়াকান্না আছে। অথচ এশিয়া, আফ্রিকার বিশাল হতদরিদ্র ও অধঃপতিত জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে কোনো ভূমিকা নেই।
সেক্যুলার অর্থনীতির আরেকটি ব্যর্থতা হলো মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে আন্তরিক নয় কিংবা সক্ষম নয় এবং বাস্তব কোনো এজেণ্ডাও নেই। সমৃদ্ধ দেশগুলো এত বেশি সম্পদ পুঞ্জিভূত করে রেখেছে যে বাকি দুনিয়াকে এমনকি নিজ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে তারা গোলামে পরিণত করেছে। পৃথিবীতে বর্তমানে ২০২টি স্বাধীন রাষ্ট্র রয়েছে। ভ্যাটিকানের মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ও রাশিয়ার মত বিশাল রাষ্ট্রও রয়েছে। রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া ও তাইওয়ানকে বাদ দিলে বাকি প্রায় সবগুলো রাষ্ট্রই তৃতীয় বিশ্বভূক্ত উন্নয়নশীল দেশ। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের ওআইসিভূক্ত ৫৭টি রাষ্ট্রের মধ্যে একটিও শিল্পোন্নত রাষ্ট্র নেই। দূর্ভাগ্যের বিষয় সমগ্র মুসলিম বিশ্ব সেক্যুলার অর্থনীতির গ্যারাকলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। বর্তমান পৃথিবীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ, অর্থাৎ ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ কোনো না কোনভাবে দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত। অপরপক্ষে, অনেক ধনী রাষ্ট্র তাদের উদ্বৃত্ত খাদ্য নষ্ট করে অথবা সাগর বক্ষে ফেলে দেয়ার কথাও শোনা যায়।
দু’বেলা খাদ্য জোগাড় করতে পারে না এমন লোকের সংখ্যাও কোটি কোটি। উন্নত বিশ্ব কৌশলে দরিদ্র দেশগুলোকে শোষণ করছে এ রকম অভিযোগ উড়িয়ে দেয়ার মত নয়। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে সেক্যুলার ব্যবস্থায় কোনো কর্মসূচী নেই এটাই মূল কথা,যা এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে পাক কুরআন বলে, ‘অতএব যে আমার স্মরণে বিমুখ এবং কেবল পার্থিব জীবনই যাদের লক্ষ্য, তাদের নিকট থেকে আপনি মুখ ফিরিয়ে নিন’। (সূরা আনজুম: ২৯)। কুরআন এ সব নৈরাজ্যবাদীদের সম্পর্কে আরো বলছে, ‘নিশ্চয়ই এরা শুধু পার্থিব জীবনকেই ভালোবাসে এবং এ কঠিন দিবসকে (পরকাল) পশ্চাতে ফেলে রাখে।’ (সূরা দাহর: ২৪)।
উল্লেখ্য, এ সব অর্থব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হলো সুদ। আর সুদের কারণে এর ব্যর্থতা আরও তরান্বিত হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদদের অনেকে মন্তব্য করেছেন। অপরপক্ষে, সুদকে ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ও সাথে সাথে বর্জনের নির্দেশ দিয়েছে। কুরআন বলে, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল, আর সুদকে করেছেন হারাম’ (সূরা আল বাকারা: ২৭৫)। সুদ হলো সেক্যুলার অর্থনীতির নিয়ামক শক্তি।
সুদের কুফল:
১) সুদ বিনিয়োগ হ্রাস করে এবং বিনিয়োগকে অনুৎপাদনশীল খাতে ঠেলে দেয়। মূলধন গঠনকে পিছিয়ে রাখে, পুঁজিকে অলস রাখতে সাহায্য করে। এমনকি সুস্থ ও কল্যাণকর পথে পুঁজি কমিয়ে দেয়, সঞ্চয়কারীদের মধ্য অলসতা সৃষ্টি করে, উৎপাদন হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে পণ্য সামগ্রীর চাহিদা কমে যাওয়া ও অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়। এভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হতে থাকে। সুদের হার শূন্যের কোটায় না নেওয়া পর্যন্ত প্রকৃত শিল্পায়ন সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।
২) সুদ সমাজে লোভ-লালসা ও কৃপণতা সৃষ্টিতে ইন্ধন যোগায়। রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি ও বিদেশ নির্ভরতা বৃদ্ধি করে। এভাবে এককেন্দ্রিকতার উদ্ভব হয় ও সমাজে ঘৃণা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। সুদ নৈতিক অবক্ষয় সাধনে সহায়তা করে, মানুষের জীবনী শক্তি ক্ষয় ও কর্মক্ষমতা হ্রাস করে। সামাজিক জুলুম ও রাজনৈতিক অনাচারের প্লাটফরম তৈরি হয় এভাবে।
৩) সুদ বাংলাদেশের সমাজ জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলেছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুদের বিষ বাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে এখন ৪০% লোক দারিদ্র সীামার নিচে বাস করে। এদের মধ্যে ২০% হত দরিদ্র। ব্যাংকগুলো কৃষি ঋণের মাধ্যমে ও এনজিওগুলো দারিদ্র বিমোচনের নামে স্বাধীনতার দীর্ঘ প্রায় ৪ দশক ধরে সুদকে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। এ সব ঋণ বিতরণ ব্যবস্থা আসলে কি গ্রামীণ অর্থনীতিতে তেমন কোন পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে? দরিদ্র মানুষ যুগ যুগ ধরে দরিদ্রই রয়ে গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের দিকে সারা দেশের গরিব মানুষ স্রোতের মত ধাবিত হচ্ছে। স্বাধীনতার দীর্ঘ পরিক্রমায় প্রবৃদ্ধির হার ৫-৬% এর উপরে উঠানো গেল না। গ্রামের অভাবগ্রস্থ লোকেরা গ্রামীণ ব্যাংক সহ অন্যান্য সুদি ব্যাংক থেকে উচ্চ হারে ঋণ নিয়ে তা শোধ করতে না পেরে তারা পুনরায় আরেকটি ঋণ নেয়, এভাবে কয়েকটি ঋণ নিয়ে ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে জায়গা জমি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। আর জায়গা জমি না থাকলে শেষ পর্যন্ত নিজের কিডনী/ লিভার বিক্রয় করে তা শোধ করে অথবা আত্মহননের পথ বেচে নেয়।
দেশপ্রেমের অভাব, অসৎ নেতৃত্ব, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা, সামাজিক বৈষম্য, ঘুষ, দুর্নীতি এবং সুদ নির্ভর অর্থ ব্যবস্থা সব কিছুকে স্থবির করে দিয়েছে। এরপরও আমাদের হুশ হলো না। ভয়ংকর অবস্থা হলো সুদের অভিশাপ থেকে আলেম-ওলামা, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে কোনো মানুষই মুক্ত হতে পারছে না। কোন না কোনভাবে সুদ আমাদের জীবনে, কর্মে অনুপ্রবিষ্ঠ হচ্ছে ও সব কিছুকে তিলে তিলে ছারখার করে দিচ্ছে। সুদ আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায়, অস্থি-মজ্জায় প্রবিষ্ট হয়ে দুষ্ট চক্রের মত সব কিছু তছনছ করে দিচ্ছে। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘যদি তোমরা সুদ ছেড়ে না দাও তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ছ. তরফ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা রইল’। (সূরা আল বাকারা: ২৭৫)।
৪) এদেশে মহাজনী প্রথার মাধ্যমে সুদ ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করেছে। স্বর্ণালংকার বন্ধক রেখে অথবা মহাজনের নিকট থেকে চড়া সুদে ঋণ নেয়ার প্রচলন এদেশে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। অনেক সময় বন্ধকী সম্পদ লোপাট হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর এদেশের লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ মহাজনের নিকট থেকে বন্ধকী স্বর্ণ ফেরত নিতে না পারায় নিঃস্ব হয়ে পড়ে। তাছাড়া বন্ধকী স্বর্ণ ও ঋণ যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হলে বন্ধকী সম্পদ মহাজনদের হাতে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়, এই নীতি ভয়াবহ। এ সমস্ত আত্মঘাতি সুদি কারবার দেশের বৃহত্তর জনগোষ্টীর স্বার্থে সরকারের এখনই বন্ধ করে দেয়া উচিৎ। তার বিপরীতে গরিব মানুষের জন্য সুদ মুক্ত ঋণ বা কর্জে হাসানা প্রবর্তন করা জরুরি। নতুবা বিপর্যয় অনিবার্য বলতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে সর্বাগ্রে গরিব মানুষগুলোকে সুদের যাঁতাকল খেকে উদ্ধার করতে হবে।
৫) সুদ মুদ্রা স্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। অলস অর্থ এবং তার বিপরীতে প্রদত্ত সুদের কারণে কিছু মানুষের হাতে অতিরিক্ত টাকা আসতে থাকে ও বাজারে জিনিষপত্রের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, ফলে গরিব মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায় ও দারিদ্র বেড়ে যায়।
এতক্ষণের আলোচনা থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সুদ নির্ভর সেক্যুলার অর্থব্যবস্থা বর্তমান বিশ্বে কাঙ্খিত উন্নতি-অগ্রগতি অর্জনে সমর্থ হয় নি। উপরন্তু, এ সব ব্যবস্থায় ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণে। সমৃদ্ধির সোনার হরিণ সুদূর পরাহত। এখন ইসলামী অর্থনীতির যৌক্তিক গ্রহণযোগ্য কিছু বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দুই প্রাক্তিক ও সমার্থক অর্থনীতির বিপরীতে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা অধিকতর সমতা ভিত্তিক ও বাস্তবতার নিরিখে দারিদ্র বিমোচনে কার্যকর। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মুহাম্মদ আলী বলেন, ‘The adaptation of western secular economic theory and practice will not help us in achieving our goal of creating a happy and contented people. We must work with our destiny in our own way and present to the world and economic system base on the true Islamic concept of equality of mankind and social justice. We will thereby be building our mission as Muslims and giving to humanity the message of peace which alone can save it and secure the welfare, happiness and prosperity of mankind.Õ ’ অর্থাৎ, পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও তার বাস্তবায়ন আমাদের সমাজে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন ও সুখী-সমৃদ্ধ মানুষ সৃষ্টিতে কখনও কার্যকর হবে না। আমাদেরকে আমাদের নিজস্ব পন্থা-পদ্ধতি অনুসরণ করে এগুতে হবে, যার ভিত্তি হবে সঠিক ইসলামী চিন্তা-চেতনা, সমতা ও সামাজিক ন্যায় বিচার। সুতরাং, মুসলিম হিসাবে আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে এবং মানব স¤প্রদায়কে শান্তির পয়গাম পৌঁছাতে হবে, যার মাধ্যমেই কেবল অর্থনীতির সুরক্ষা ও মানব কল্যাণ নিশ্চিতকরণ ও সুখী সমৃদ্ধ মানব জাতি গঠন সম্ভব।
ইসলামী অর্থনীতির মূল উৎস হলো, আল্লাহর কুরআন ও সুন্নাতে নববী ছ., অতঃপর ইজমা ও কিয়াস। শরীয়াহ আইন মানুষের জন্য অধিকতর কল্যাণধর্মী এটা বলাই বাহুল্য। কেননা, তার প্রবক্তা হলো স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তিনি মানুষের বর্তমান, অতীত এবং ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। সেই হিসাবে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধানই বাস্তব, সময়োপযোগী ও কল্যাণমূখী হবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
এ প্রসঙ্গে ইমাম গাজালী রহ. বলেন, “শরীয়াহর গূঢ় উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে তাদের আকিদা-বিশ্বাস, জীবন পদ্ধতি, বুদ্ধিবৃত্তিক, সন্তান-সন্ততি ও সম্পদের সংরক্ষণ করা। যা কিছূ এই পাঁচটি বিষয় সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করে তাই জনস্বার্থ বলে গণ্য হবে এবং সেটাই কাম্য”। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. ওমর চাপড়া বলেন, “প্রত্যেকটি সমাজেরই স্বীকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবকল্যাণ আর প্রত্যেকটি পদ্ধতিরই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে।” তবে কল্যাণের মৌলিক উপাদান কী এবং কীভাবে লক্ষ্য অর্জিত হবে সে সম্পর্কে মত পার্থক্য থাকতে পারে। ইসলাম এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধারণা পোষণ করে, যা বিদ্যমান সেক্যুলার ব্যবস্থাগুলো থেকে মৌলিকভাবে আলাদা। এই চেতনার উৎস হচ্ছে শরীয়াহ যা থেকে ঐ ব্যবস্থার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কৌশলের উদ্ভব হয়েছে।
‘বর্তমান বিশ্বে প্রভাবশালী ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদগুলোর মত ইসলামের লক্ষ্য (মাকাসিদ আল শরীয়াহ) মৌলিকভাবে জড় ও বস্তুগত নয়; বরং এর ভিত্তি হচ্ছে, মানবকল্যাণ (ফালাহ) ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন (হায়াতে তায়্যিবাহ); যাতে ভ্রাতৃত্ব ও আর্থ সামাজিক সুবিচারের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং সকল মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় একটি মৌলিক বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা নিহিত রয়েছে’। ‘ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মিক উন্নতি হলো মানুষের কল্যাণের অপরিহার্য উপাদান’। এ প্রসঙ্গে Nigel Lawson বলেন, ‘মানুষ হলো নৈতিক জীব এবং নৈতিক ভিত্তি ছাড়া কোনো রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না’। এভাবে বলা যায়, নৈতিক সংশোধনের পথ অবলম্বন ব্যতিরেকে দক্ষতা ও সমতার সংজ্ঞা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। ইমাম ইবনে আল কাইয়েম শরীয়াহ বিধিমালার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, ‘শরীয়াহর ভিত্তি হচ্ছে মানুষের জ্ঞান এবং পার্থিব জগৎ ও পরকালের কল্যাণ সাধন আর কল্যাণ নিহিত রয়েছে সার্বিক ন্যায় বিচার, দয়া, সুখ সমৃদ্ধি ও জ্ঞানের মধ্যে। যেখানে ন্যায় বিচারের পরিবর্তে নির্যাতন, দয়ার স্থলে কঠোরতা, কল্যাণের পরিবর্তে কার্পণ্য এবং জ্ঞানের বদলে মূর্খতা স্থান পায়, সেখানে শরীয়াহর কিছুই করার নেই’।
এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, যদি নৈতিক মানদ- ছাড়া দক্ষতা সংজ্ঞায়িত হয়; তাহলে এ সব ব্যতীত ন্যায় বিচার ((Equity) আরও কঠিন হবে’। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমরা রাসূলগণকে সুষ্পষ্ট নিদর্শন সহকারে প্রেরণ করেছি এবং তাদের উপর অবতীর্ন করেছি কিতাব ও ন্যায়-নীতি যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে’। (সূরা হাদিদ: ২৫)। এ প্রসঙ্গে Marshal Hodson বলেন, “ইসলামী ধ্যান-ধারণার একটি সহজবোধ্য চেতনা আছে বরং ইহার প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো অতি সহজেই এগিয়ে নেওয়া যায়”। অনেক বিশেষজ্ঞ চিন্তাবিদ ইসলামী অর্থনীতিকে সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন। যেহেতু, এ অর্থনীতি ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সমাধান ও বিশ্লেষণ করে থাকে। এ অর্থনীতি বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত কোনো মানুষের সমস্যা নিয়ে কথা বলে না বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য বিশ্বাসের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ দিক নির্দেশনা প্রদান করে থাকে।
এর দর্শন হলো কর্ম, সততা , ন্যায়-নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের ফল। এ প্রসঙ্গে কুরআন ঘোষণা করছে, ‘আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়’ (সূরা রা’দ: ১১)। অর্থাৎ, কর্মোদ্দীপনা ও দক্ষতাই কেবল মানুষকে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। কর্ম নির্ধারিত হবে তাওহীদের ভিত্তিতে। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়, এ বিশ্বকে সচেতনভাবে পরিকল্পনা মাফিক সৃষ্টি করেছেন এবং তা হঠাৎ করে বা দূর্ঘটনাবশত সৃষ্টি হয় নি। আল্লাহর একত্ববাদের উপর ভিত্তি করেই ইসলামী অর্থনীতির কর্মকৌশল ও দর্শন গড়ে উঠেছে। এখানে নিশ্চয়ই একটি উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল রয়েছে এবং তা হচ্ছে তিনি সবকিছূর সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন। প্রত্যেক ভালো মন্দের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার হবে। তার কাছ থেকে মানব জাতি পৃথিবীতে এসেছে এবং নির্দিষ্ট সময়ের পর প্রত্যেকটি মানুষকে আবার তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে, যেখানে ভালো-মন্দের জররা জররা বিচার হবে।
কুরআন বলে, ‘তিনি জমিনকে তোমাদের জন্য বাধ্যগত ও বশীভূত করে দিয়েছেন। অতএব, তোমরা এর প্রশস্থতার উপর চলাচল কর এবং আহার কর তাঁর প্রদত্ত জীবিকা থেকে আর জেনে রাখ তোমাদের আবার জীবিত হয়ে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে’। ( সূরা মুন: ১৫)। সকল সম্পদই যেহেতু আল্লাহ প্রদত্ত সেহেতু মানুষ এর মূল মালিক নয়। সে শুধু আমানতদার, পাহারাদার ও ভোগদখলকারী। ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জন্য নয়, বরং সকলের উপকারের জন্য নিবেদিত। কুরআন বলে, “তিনিই সে সত্ত্ব¡া যিনি সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের জন্য যা কিছু জমিনে রয়েছে সবটুকুই”। মোদ্দা কথা হলো, বৈধভাবে সম্পদ অর্জন জরুরি। সম্পদ বৈধ হলেও ইচ্ছামত তথা আমানতদারীর খেয়ানত হয় এমনভাবে ব্যয় করা যাবে না। আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ ধ্বংস কিংবা অপচয় করার কোনো অধিকার মানুষের নেই। আল্লাহ বলেন, “অর্থ ব্যয়ের সীমা লঙ্ঘন কর না। আল্লাহ অপব্যয়কারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরা আন আম: ১৪১)।
মূলনীতি হলো বৈধ আয়ের সীমারেখা নির্ধারিত রয়েছে। ইসলাম ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু সে মালিকানা সীমাহীন ভোগ বিলাসে মত্ত হওয়ার পক্ষে নয়। অপরপক্ষে, বৈধ পন্থায় অর্জিত সম্পদ ও আল্লাহর পথে ব্যয় করতে হবে। কুরআন বলে, ‘লোকেরা আপনার কাছে জানতে চায় তারা আল্লাহর পথে কী পরিমাণ ব্যয় করবে। আপনি বলুন, তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত।’ (সূরা আল বাকারা: ২১৯)। ইসলাম এই প্রয়োজনের সীমারেখাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা আনতে হলে ব্যক্তির চরিত্র গঠন ও মন-মানসিকতার সংশোধন অপরিহার্য। বৈধ পন্থায় অর্জিত সম্পদে ইসলাম স্বীকৃতি দিয়েছে, তবে অবৈধ ও হারাম পন্থায় সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ইসলামী অর্থনীতির আরেকটি অন্যতম মূলনীতি হলো সর্বক্ষেত্রে সুদ বর্জন ও লাভ লোকসান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করা। হারাম পন্থায় ইসলামী অর্থনীতি পরিচালিত হতে পারে না, এটি একটি মৌলিক বিষয়। তাছাড়া, ভোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আহার কর, পান কর, সীমা লঙ্ঘন কর না। আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আ-রাফ: ৩১)।
ইসলামী অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হলো, মানুষে মানুষে বৈষম্য বিলোপ করে ন্যায় ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। মানুষের উপর মানুষের প্রভুত্বকে উৎখাত করে সকল মানুষ আল্লাহর সৃষ্ট জীব আর এ জন্য সকলের সাথে সমান ব্যবহার করতে হবে। অতিরিক্ত লোভ ও অর্থ পূজাকে ইসলাম কখনও গ্রাহ্য করে নি। তাছাড়া, সম্পদের সমতাভিত্তিক নয় ইনসাফভিত্তিক পূর্ণ বন্টনের ঘোষণা দিয়েছে। উপরন্তু, প্রয়োজনীয় ব্যয় করার ক্ষেত্রে বাধা দেয়া হয় নি বরং কৃপণতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে সম্পদ কুক্ষিগত করা যাবে না। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও দীর্ঘদিন মজুদ করা হারাম। ৪৫ দিনের উপর নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুদ করে রাখা যাবে না। পারস্পরিক দায়বদ্ধতা অন্যতম বৈশিষ্ট। সরকার ও জনগণ উভয়ে উভয়ের পরিপূরক হিসাবে কাজ করবে। বল্গাহীন লাভ ও দখলদারী নীতি পরিহার করার কথা বলা হয়েছে। জুলুম পরিত্যাগ ও ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে হবে। সকল মানুষের জন্য সম অধিকার সৃষ্টি তথা সম সুযোগ সৃষ্টি ও ধনী দরিদ্রের ব্যবধান ঘোচানোই লক্ষ্য। বিধিবদ্ধ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যেমন রয়েছে তেমনি স্বেচ্ছাচারিতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ঠিক রেখে নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করে।
বস্তুত শ্রেণি সংগ্রাম নয় সুস্থ প্রতিযোগিতা ও পারস্পরিক সহমর্মিতায় উদ্দীপ্ত হওয়া মৌলিক বিষয়। সেক্যুলার অর্থনীতিতে শ্রেণি সংগ্রামকে উস্কে দিয়ে অবৈধ ফায়দা হাসিলের প্রবণতা ইসলাম গ্রহণ করে নি মোটেও। তাছাড়া, হারাম পণ্য উৎপাদন-বিপনন ইসলামে নিষিদ্ধ। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো পণ্যও উৎপাদন-বিপনন হারাম। এভাবে সমাজে একটি সুস্থ ও সুন্দর অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা ও তার সুফল প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া ইসলামী অর্থনীতির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
এতক্ষণের আলোচনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সেক্যুলার অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতিকে টালমাটাল করে তুলেছে ও বাস্তবিকই এ অর্থনীতি বিশ্ব মানবতাকে সঠিক গন্তব্যের কাছে কিনারেও ধাবিত করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দা ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা এ ব্যবস্থার অসারতাকে প্রকট করে তুলেছে। এ জন্যই সেক্যুলার অর্থনীতির যাঁতাকল থেকে বিশ্ববাসীকে বাঁচাতে হবে। এ লক্ষ্যে ইসলামী অর্থনীতির প্রচার ও প্রসারে একযোগে কাজ করতে হবে ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা সেক্যুলার অর্থ ব্যবস্থার বিপরীতে একটি সুষম, ন্যায়ভিত্তিক ও গরিববান্ধব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে ইতোমধ্যে বিশেষ করে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ও সফলভাবে এগিয়ে চলছে। এমতাবস্থায়, ইসলামী অর্থ ও ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাস্তবায়নে মুসলিম সমাজকে জোরালোভাবে এগিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর বর্তমান অর্থনৈতিক যুগ সন্ধিক্ষণে ইসলামী অর্থনীতিকে আল্লাহর দর্শন ও মতবাদ হিসাবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল রাষ্ট্র ও সমাজ শেষ রক্ষাকবচ হিসাবে গ্রহণ করবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
তথ্য সুত্র:
ইসলামী অর্থনীতি- সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী রহ.
ইসলামী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ- ড. ওমর চাপড়া।
Failure of Secular Economics- John W. Robbins
সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা ও মুসলিম সমাজ- এম. ওসমান গণি।
সুদ, সমাজ, অর্থনীতি- শরীফ হোসাইন।
সুদ নিষিদ্ধ- মাওলানা তকী ওসমানী।
বিষয়: বিবিধ
২৪৫৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন