মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী: জীবন ও কর্ম মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃত মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী:
লিখেছেন লিখেছেন ওসমান গনি ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৫:২৩:৫০ বিকাল
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী:
জীবন ও কর্ম
জন্ম: ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে ২২ আগষ্ট চট্টগ্রাম জেলার সাবেক পটিয়া, বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলার বারামা গ্রাম। মৃত্যু: ১৯৫০ খ্রীষ্টাব্দে ২৪ অক্টোবর। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এতিমখানার সামনে কদম মোবারক কবরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত। পিতার নাম মুন্সি মোঃ মতিউল্লাহ, মাতার নাম রহিমা বিবি। চট্টগ্রামের আরেক নাম ইসলামাবাদ। সেই হিসাবে মৌলানা তাঁর নামের সাথে ইসলামাবাদী গ্রহণ করতেন। শৈশবে কুরআন শিক্ষা ও বাল্য শিক্ষা পাঠের মাধ্যমে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয়। তাঁর পিতা ছিলেন ফার্সি ভাষায় সুপন্ডিত। তিনিও ঘরোয়া পরিবেশে ফার্সি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। লেখা পাড়ায় তার অদম্য আগ্রহের কারনে তাঁর পিতা তাঁকে কলকাতায় উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য প্রেরন করেন। সেখানে তিনি হুগলী সরকারি মাদ্রাসায় ভার্তি হন। ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে হুগলী মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ন হন। মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল স্যার ডেলিনন রস ও অধ্যাপক এ এইচ হালী তার প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন। তিনি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করলেও নিজ চেষ্টায় বাংলা শিখেন। তাছাড়া আরবী, উর্দূতেও যথেষ্ঠ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। কলকাতায় মাওলানা আবুল কালাম আযাদের পিতা মাওলানা খায়ের উদ্দীন এর সান্নিধ্য লাভ করেন। শিক্ষা জীবন শেষে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। রংপুরে মুন্সিপাড়া মাদ্রাসা ও বাগদুয়ারা মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। সে সময় বাংলা- আসামে বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসা স্থাপনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কলকাতা থাকাকালীন সময়ে তাঁর উপর মাওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী, স্যার সৈয়দ আহমেদ খান, নওয়াব আব্দুল লতিফ ও জামাল উদ্দীন আফগানী প্রমুখ বিশ্ব মুসলিম মনিষীদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মোদ্যেগের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। মাওলানা জৈনপুরীর আদর্শে ইসলাম প্রচার, স্যার সৈয়দ আহমেদ খানের আদর্শে মুসলিম জাগরন, নওয়াব আব্দুল লতিফের আদর্শে শিক্ষা বিস্তার ও জামাল উদ্দিন আফগানীর আদর্শে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধে অনুপ্রাণিত হন এবং তার আলোকে কর্ম জীবন শুরু করেন।
উল্লেখ্য মুসলমানদের হাত থেকে ভারতবর্ষের ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে যাওয়ার পর মুসলমানেরা ইংরেজদের চরম দমন ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে মুসলমানদের অভ্যুত্থান স্থবির হয়ে পড়ে। সে সময় মুসলিম সমাজ এক দূর্বিসহ অবস্থায় নিপতিত হয়। জাতির সেই দূর্দিনে স্যার সৈয়দ আহমেদ খান এর সাথে মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী এগিয়ে আসেন। তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ইংরেজদের উগ্র মনোভাব কিছুটা স্থিমিত হয়ে আসে। প্রকৃতপক্ষে মাওলানা ছিলেন মুসলিম জাতিসত্তার অন্যতম নেতা। তাঁর সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে তিনি মুসলিম জাতিকে সচেতন করতে সচেষ্ট হন। মুসলিম জাগরনের প্রেরনায় উদ্বুদ্ধ মাওলানার কর্মজীবন ছিলো ঘটনাবহুল ও বৈচিত্রময়। তিনি একাধারে রাজনীতিক, ইসলাম প্রচারক, লেখক, সাংবাদিক, সমাজসেবক, বিশিষ্ট বাগ্মী ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন। ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন।
মাওলানা ছিলেন মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে নিয়ে কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক সুলতান পত্রিকা প্রকাশ করেন। অনেক চড়াই উৎরাই এর পর ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে সাপ্তাহিক সুলতান দৈনিক সংবাদপত্র হিসাবে নবরুপে আত্ম প্রকাশ করে। ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দে মাওলানা ইসলামাবাদী ও অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় আঞ্জুমানে উলামায়ে বাংলা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি ছিলেন তার যুগ্ম সম্পাদক। তিনি জামায়াতে উলামায়ে হিন্দ এর বঙ্গীয় প্রাদেশিক শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম কন্ফারেন্সের আয়োজন করেন। ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর প্রচেষ্টায় মুসলিম সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি হাবলুল মতিন পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে আল ইসলাম পত্রিকা প্রকাশে মুখ্য ভূমিকা রাখেন এবং সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে দৈনিক আমির পত্রিকা প্রকাশ করেন। মাওলানা রাজনৈতিকভাবে প্রথমদিকে কংগ্রেসের সাথে জড়িত থাকলেও পরবর্তীতে ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে খেলাফত আন্দোলন এ যোগ দেন। ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে কৃষক প্রজা পার্টির টিকেটে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য আইন সভা থেকে প্রাপ্ত ভাতা তিনি কবি সাহিত্যিকদের কল্যাণার্থে বিতরণ করেন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের কদম মোবারক সংলগ্ন এতিমখানা প্রতিষ্ঠিত করেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার লক্ষে ১৯৪২ সালের বাংলা- আসামের মুসলমানদের সহায়তায় তিনি গোপন বিপ্লবী দল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৪ সালে বৃটিশরা তাঁকে বাংলা থেকে বহিষ্কার করে লাহোর কারাগারে অন্তরীণ করে রাখা হয়। ১৯৪৫ সালে তিনি মুক্তি পান।
মাওলানা ইসলামাবাদীর স্বপ্ন ছিলো মুসলিম জাতীকে শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে নেয়া। সেই লক্ষ্যে চট্টগ্রামে একটি আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি কর্মপ্রচেষ্টা শুরু করেন। সেকালে বেসরকারী বা ব্যক্তি উদ্যোগে ও বৈরী পরিবেশে এ ধরনের চিন্তা চেতনা সত্যিই অকল্পনীয় ছিলো। সাবেক পটিয়া ও বর্তমান আনোয়ারা থানার দেয়াং পাহাড়ে ছয়শত একর জমি সংগ্রহ করতঃ ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। এলাকায় বিখ্যাত ব্যক্তি আনোয়ার আলী খান ও ইলিয়াস আলী খাঁ থেকে এই জমির অংশ দান হিসাবে গ্রহণ করেন। তাছাড়া এর অপর অংশটি সরকার থেকে লীজ গ্রহন করেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে সর্বভারতীয় কংগ্রেস সেক্রেটারী মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মত নেতাকেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পট পরিদর্শনে আনতে সক্ষম হন। আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকল্পে জনমত তৈরিতে তিনি দী মুহাম্মদী পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি করেন। প্রাথমিক ভাবে তিনি সেখানে স্কুল ও খামার প্রতিষ্ঠা করেন। এই আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি বাংলা উলামা পরিষদ থেকে সম্মতি গ্রহন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল তৈরিতে তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়সহ পৃথিবীর অন্যান্য বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। ১৯১৫ সালে চট্টগ্রামের প্যারেড ময়দানে মুসলিম নেতৃবৃন্দের সম্মেলন ডাকেন ও বিশ্ববিদ্যালয় গঠনতন্ত্র অনুমোদন করেন ও একই বছর শের-এ-হিন্দ মাওলানা শওকত আলী দেয়াং পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। দূর্ভাগ্যক্রমে তার মৃত্যুর পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলন স্থবির হয়ে পড়ে। আমরা নতুনভাবে মাওলানার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে গৃহীত এ বিশাল সম্পদ বর্তমানে কোরীয় ইপিজেড এর মধ্যে লীন হয়ে যায়। এ সম্পদ উদ্ধারে সরকারকে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য আহবান জানাচ্ছি। মাওলানা ইসলামাবাদী ছিলেন মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত ও মুসলিম বাংলা সাংবাদিকতার অন্যতম পথ প্রর্দশক। মুসলিম জাতিকে জাগিয়ে তোলার জন্য এবং তাদের মধ্যে আত্মসচেতনাবোধ সৃষ্টির মানসে তিনি ব্যাপক লেখালেখি শুরু করেন। জীবনের দীর্ঘ পরিক্রমায় তিনি ৪২ টির মত গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলোর মধ্যে ১. ভারতে মুসলিম সভ্যতা ২. সমাজ সংস্কার ৩. ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমান ৪. ইসলাম জগতের অভ্যুত্থান ৫. ভারতে ইসলাম প্রচার ৬. সুদ সমস্যা ৭. ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানদের অবদান (৩ খন্ডে) ৮. ইসলামী শিক্ষা ৯. কুরআন ও বিজ্ঞান ১০. আত্মজীবনী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
পরিশেষে বাংলা একাডেমীতে সংরক্ষিত অথবা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতঃ পুস্তক আকারে প্রকাশের জন্য বাংলা একাডেমীর প্রতি আমরা উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। তাছাড়া মাওলানার স্বপ্ন অনুযায়ী দেয়াং পাহাড়ে আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেহাত হওয়া সম্পত্তি উদ্ধারে ব্যবস্থা গ্রহণ ও সেখানে একটি আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বর্তমান সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে দাবী জানাচ্ছি।
মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃত মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী:
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন মাওলানা তাঁর ক্ষরুধার লেখনী দিয়ে নির্যাতিত নিপিড়িত ও বিদ্বস্ত মুসলিম জাতিকে উজ্জীবিত ও উদ্দীপ্ত করার প্রয়াস চালাতে থাকেন। মুসলমানদের হাত থেকেই ভারতবর্ষের আযাদী কেড়ে নেয় চতুর ইংরেজরা। স্বাভাবিক কারণেই মুসলমানেরা তখন ইংরেজদের প্রধান প্রতিপক্ষ বা শত্র“ হিসেবে চিহ্নিত হতে থাকলো। পরাধীনতার প্রথম প্রহরে সংখ্যাগরিষ্টরা ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরন করতে দেখা যায়নি। উপরন্তু সহযোগিতা করার বদনাম আছে । তারও একটা সংগত কারণ ছিল। ইতিহাসের পাঠক তা সহজেই উপলদ্ধি করতে পারেন। সে যাই হোক মুসলমানেরা যে নির্যাতিত ও ইংজেদের প্রধান টার্গেটে পরিণত হয় তা মুসলিম নেতৃবৃন্দ সহজেই উপলদ্ধি করতে সক্ষম হন। তারা এও বুঝতে পারেন যে মুসলমানদের অনগ্রসরতার অন্যতম কারন হলো আধুনিক শিক্ষায় অনগ্রসরতা ও পারস্পরিক একতার অভাব। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় হিসাবে মিডিয়ার সহযোগিতা একান্ত দরকার ।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় ছিল মুসলমানদের হাতে কোন মিডিয়া তথা পত্র-পত্রিকা ছিলনা তখন। বিশেষ করে পূর্ব বাংলায় এ সমস্যাটা আরও প্রকট ছিল। অথচ ঊনিশ ও বিশ শতকে পত্রিকার ক্ষমতা ছিল অবিসংবাদিত ও নিরঙ্কুশ। সমস্যায় জর্জরিত ও পিছিয়ে পড়া মুসলিম জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে তাদের কাছে পত্র পত্রিকার মালিকানা ও পরিচালনা শক্তি অর্জন অতীব জরুরী। এই সত্য বিষয়টি মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী অক্ষরে অক্ষরে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।
তিনি মূলত ছাত্র অবস্থায় লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। পরবর্তীতে সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করেন। তিনি ১৯১৩ খৃষ্ঠাব্দে আঞ্জুমানে ওলামায়ে ইসলাম বাংলা ও আসামের মুখপাত্র আল ইসলামের সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন । এটি পূর্ব বাংলার প্রথম মুসলিম বাংলা পত্রিকা । তিনি পত্রিকাটি প্রকাশনা ও সম্পাদনা শুরু করেন। তাঁর সম্পাদিত আল ইসলাম পত্রিকায় তারই লেখা কুরআন ও বিজ্ঞান প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় । এ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি অর্থনৈতিক ভাবে ও শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া মুসলিম জাতিকে এগিয়ে যাবার প্রেরনা যোগাতে থাকেন। এভাবে চতুর্দিকে মাওলানার নাম ছড়িয়ে পড়লো । পরবর্তীতে জাতিকে দূর্দশার হাত থেকে রক্ষার ব্রত নিয়ে তিনি সাপ্তাহিক ছোলতান পত্রিকায় যোগদান করেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রম,সাধনা আর ত্যাগের বিনিময়ে এই পত্রিকাটি পরবর্তীতে দৈনিক ছোলতানে পরিণত হয়। তিনি ছিলেন উক্ত পত্রিকার স্বার্থক সম্পাদক। এই পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে তিনি নিপিড়িত ও নিষ্পেষিত বাংলা ভাষাবাসী মানুষের অধিকার আদায়ে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি নব দিগন্তের সূচনা করেন। তিনি আন্জুমানে ওলামায়ে বাংলা,ইসলাম মিশন ও খাদেমুল ইনসান সমিতি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ সেবায় ব্রতী হন ।তিনি দৈনিক হাবলুল মতিনের বাংলা সংস্করণ সম্পাদনা করেন। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ‘ইসলামাবাদ’ নামে একটি মাসিক পত্রিকাও বের করেন ।
১৯১৪ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি গঠনে তার অবিস্মরনীয় অবদান ছিলো। সে বছর তিনি সীতাকুন্ড মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন । এই সময় মিসরের আল মিনার ,আল এহরাম ও আল বিলাদ পত্রিকায় আরববী ভাষায অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয় । তিনি বিভিন্ন উর্দু পত্রিকায়ও লেখালেখি করতেন । তিনি বিশ্ব মুসলিমের জন্য চিন্তা করতে থাকেন । তার অক্লান্ত পরিশ্রম,সাধনা আর ত্যাগের বিনিময়ে জাতিকে দূর্দশার হাত থেকে ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপর তিনি অনেকগুলো প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। তিনি ছিলেন অসংখ্য গ্রন্থের রচয়িতা। তার মধ্যে ভূগোল শাস্ত্রে মূসলমান, ভারতে মুসলিম সভ্যতা , ভারতে ইসলাম, মুসলমানদের অভ্যুথান, সমাজ সংস্কার , ইসলাম ও জেহাদ, ইসলাম ও রাজনীতি,সুদ সমস্যা ,শিক্ষা কর সহ অসংখ্য পুস্তক রচনা করেন। খেলাফত আন্দোলনের তিনি ঘোর সমর্থক ছিলেন ও খেলাপতের পতনের কারনেই মুসলমানদের অধঃপতন এ বিষয়ে তিনি জনগনকে লেখালেখির মাধ্যমে সচেতন ও আলোকিত করতে থাকেন। মুসলমানদের মধ্যকার অনৈক্য ,শিরক ও বিদয়াতের কঠিন পরিণতি সম্পর্কে সজাগ করা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি কলম সৈনিক ছিলেন। শিক্ষা প্রসারে তার অবদান অবিস্মরনীয়। কদম মোবারক এতিম খানা তারই গড়া প্রতিষ্ঠান। দেয়াঙের পাহাড়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা তার স্বপ্ন ছিলো যা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। মাওলানা ইসলামাবাদী সম্পর্কে আকরাম খাঁ বলেন “ ইসলামাবাদীকে স্মরণ করার অর্থ হলো আজ জাতি তার অতীতকে ভালোবাসতে আরম্ভ করেছে এবং অতীতের সংগ্রাম দেশ, নায়ক, মনীষি ও কৃতী মহাপুরুষের প্রতি সশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। সমাজ সংস্কার ও ঐতিহাসিক সত্যের অনুসন্ধানে মুসলমানদের সকল রকম উন্নতি প্রচেষ্টায় সংবাদপত্রের সম্পাদক ও পরিচালনায় ও আজাদী সংগ্রামে তার নেতৃত্ব, ত্যাগ, নিরলস কর্তব্যপরায়নতার কথা কোনদিন দেশ ও জাতি ভুলতে পারবেনা। তিনি ছিলেন নিজ আদর্শ ও ধর্মের প্রতি অগাদ বিশ্বাসী ও অনুরাগী। শত বিপদ আপদের মধ্যেও তিনি আদর্শকে বিসর্জন দেননি। তিনি অকাতরে দুঃখ দূর্দশা সইতে পারতেন।”
মাওলানা নিজের সম্পাদিত পত্রিকা ছাড়াও অন্যান্য পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। ১৩৩৪ সালের কার্তিক মাসে প্রথম প্রকাশিত মাসিক মোহাম্মদীর ১ম সংখ্যায় তার লেখা ইসলাম ও শাসন অধিকার বিষয়ক একটি গবেষনাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে তিনি মুসলিম জাতির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য শাসন ব্যবস্থায় ইসলামের বিধি বিধান প্রতিষ্ঠার কথা সুন্দর ভাবে তুলে ধরেন। ধূর্ত ইংরেজ জাতির হিন্দু মুসলিম বিবেধ সৃষ্টির অপপ্রয়াস ও হিন্দুদের উসকিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে তিনি শক্ত হাতে কলম ধরেন। মাওলানা সম্পর্কে আকরাম খাঁ বলেন পত্রিকার মাধ্যমে মাওলানা ঘুমিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে জাগ্রত করার জন্য কাগজকে শক্তিশালী অস্ত্রের মত মনে করতেন। পরবর্তীতে তিনি সমাজ সেবায়ও আত্মনিয়োগ করেন। তিনি নিঃস্ব বিপন্ন ও দুঃখী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। তাদের জন্য লিখতেন এবং তাদের সাহায্যে সব সময় এগিয়ে আসতেন। তিনি আত্মভোলা ও অতীত বিস্মৃতির মুসলিম মানসকে উচ্চকিত করার জন্য বই লিখেছেন। মুসলিম জাতির জন্য তার দরদ ভরা মন তাদের সুখে দুঃখে চেতনাদীপ্ত হৃদয় সত্যিই অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে। এরকম কর্ম চাঞ্চল্য ও জাতীর গৌরবের মহানায়ক এ বাংলায় কয়জন আছে। হাতে গোনা মহৎ প্রান কিছু মহান ব্যাক্তিত্বের মধ্য তিনি প্রথম সারির সিপাহসালার।
মাওলানা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য ১৯৪৪ সালে ১৩ অক্টোবর কারা বরন করেন। ১৯৪৫ সালে মুক্তি পান। বৃটিশরা ডিভাইড এন্ড রুল এই নীতিতে ভারতবর্ষকে শাসন করতো এবং হিন্দু মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াতে সিদ্ধহস্ত ছিল। মাওলানা এ চক্রান্ত বুঝতে পেরেছিলেন হাঁড়ে হাঁড়ে। অত্যন্ত ধীশক্তিসম্পন্ন এই মহাপুরুষকে নিয়ে তেমন বেশী প্রচার প্রচারনা নেই আমাদের দেশে। প্রবাদ আছে, যে দেশে গুনীর কদর নেই সেদেশে গুনী জন্মায়না। দেশবাসী যেন সে প্রবাদ বাক্যকে সত্যে পরিণত করতে চায়। নতুবা মাওলানাদের মত দেশ কাঁপানো ব্যক্তিদের নিয়ে তেমন কোন মাতামাতি নাই কেন ? রাষ্ট্রীয় প্রচার যন্ত্রগুলো এখানে অনুদার।এ জাতির ঐতিহ্য জাতীয় বীরদের বিষয়ে মিডিয়াও আগ্রহী নয় তেমন। মনে হচ্ছে আমাদের চিন্তা চৈতন্যে বৈকল্য ধরেছে।আমরা নিজেদের ছেয়ে পরদেশীদের চর্চা বেশী করছি কিনা খতিয়ে দেখা দরকার।
মাওলানা বহুবিধ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। একাধারে সাহিত্য সাংবাদিকতা, শিক্ষাবিস্তারে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা বিজ্ঞ ও প্রতিবাদী ও যুক্তিবাদী আলেম ছিলেন তিনি। মুসলমানদের কল্যানে নিবেদিত এই মানবটি বাংলা বিহার উড়িষ্যা আসাম সহ সারা ভারত বর্ষ চষে বেড়িয়েছেন। জেল জুলুম অত্যাচর নীপিড়নের শিকার হয়েছেন বহুবার। তারপরও তার কলম থামেনি। সত্য পন্থা ও সত্য পথ থেকে বিন্দু পরিমান বিচ্যুত হননি। এ মহান পুরুষ সম্পর্কে কয়জনই বা জানে। বাংলা একাডেমি বলেন সরকার বলেন আমাদের জাতীর এ মহানায়কদের সম্পূর্ন ভূলে গেছেন। এটা অন্যায় অমানবিক। এরকম তুচ্ছ তাচ্ছিল্য মেনে নেয়া যায়না। আমরা তার ৬৭ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে তার অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি গুলো পুস্তকাকারে প্রকাশের দাবী জানাচ্ছি। এরকম একটা উদ্যেগ বাংলা একাডেমি অনেক আগে নিয়েছিলো, সেটি বন্ধ হলো কেন জানিনা। নতুন ভাবে এটি শুরু করা হোক। তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এদিনে।
বিষয়: বিবিধ
২৭৭৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন