আশুরাঃ আমাদের শিক্ষা ও করণীয়
লিখেছেন লিখেছেন ওসমান গনি ০৯ জুলাই, ২০১৫, ০৬:৪৩:৪৩ সন্ধ্যা
মহরম, রজব, যিলকদ্ ও জিলহজ্ব এই চার মাসকে আল্লাহতায়ালা পরম সম্মানিত ও পবিত্র বলে কুরআনুল করিমে উল্লেখ করেছেন। হারাম বা পবিত্র মাস হিসাবে মহররমের নাম উল্লেল করে প্রচ্ছন্নভাবে মহররমের ঘটনাসমূহের গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন মহান আল্লাহ। প্রাচীন আরবরা মহরমের ১০ তারিখ দর্শণার্থীদের জন্য কাবার দরজা খোলা রাখেতো। নবী করিম (স.) বলেন ইয়াহুদীরা আশুরার দিন একটা রোজা রাখতো, আর তোমরা মহররম মাসের ১০-১১ দুই দিন দুটো রোজা রাখো। মুসলিম শরীফে আছে রমজানের পর আল্লাহর নিকট সবচেয়ে মর্যাদাবান রোজা হচ্ছে আশুরার রোজা। মুসা (আ .)ও সে দিন রোজা রেখেছেন। ইতিহাস সাক্ষী আরো অসংখ্য ঘটনার জন্ম দশই মহররম। আমাদের জানা দরকার যে, ইমাম হোসাইন (রা.) এর আত্মদানের উদ্দেশ্য কি ছিল? তিনি কি নিজের স্বার্থ-বিত্তের জন্য জীবন বিলিয়ে দিলেন নাকি ইসলামী মূল্যবোধকে উচ্চকিত করার জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। ইমাম ছিলেন নবীজির অত্যন্ত আদুরে নাতি নবীজি (স.) বলেন আমি হোসাইনের অংশ আর হোসাইন আমার অংশ। প্রকৃত পক্ষে নবীজি(স.)এর প্রতিষ্ঠিত দ্বীনকে রক্ষার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া দ্বিতীয় কোন অভিলাষ ইমামের ছিলনা। ইমাম হোসেন (রা.) বলেছেন, আমি সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধের জন্যই এই বিপ্লবে অংশ গ্রহণ করেছি।সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে ইসলামকে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন তিনি আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমাদেরকে সে পথ অনুস্মরণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করে গেছেন।
ইমাম হোসেন (রা.)না ছিলেন শিয়াদের না ছিলেন সুন্নীদের তিনি ছিলেন মুসলমানদের নেতা। মুসলমানেরা শিয়া সুন্নী নামে কেন অভিহিত হলেন আমার জানা নেই। আফসোস আমরা কেন মুসলমান নামে অভিহিত হতে পারলাম না এখনো। বাস্তব কথা হলো এই বিয়োগান্তক ঘটনার প্রাক্কালে মুসলমানদের মধো শিয়া/সুন্নী বিভাজন ছিলনা । এখন কেনইবা থাকবে আমাদের বোধগম্য নয়। আজকে কোটারী স্বার্থে যারা ইমামকে ব্যবহার করছেন তারা জানে না ইমাম এসব কিছুর উর্দ্ধে ছিলেন। শিয়া নেতাদের উচিৎ ইসলামের স্বার্থে তাদের দল উপদলগুলোকে নত্ব বিধান সৃষ্টি ও অতিরঞ্জিত বিষয়গুলো থেকে বিরত রাখা, কেন না তাদের কোনো কোনো মতবাদ ক্ষেত্র বিশেষে ইসলাম খারিজের পর্যায়ে চলে যায়। বাজি ফাটানো কিংবা মাতম অথবা রক্ত ঝরানোর মত বাড়াবাড়ির নাম আশুরা নয়। ইসলাম তা এসব কোনোভাবেই গ্রাহ্য করেনা।
বিশ্ব কবি আল্লামা ইকবাল বলেন ‘ইসলাম জিন্দা হোতাহে হার কারবালা কি বাদ’ অর্থাৎ প্রতি কারবালার পর ইসলাম জেগে উঠে। সত্যি কথা “ASHURA revived the Islamic values” অর্থাৎ ইসলামী মূল্যবোধকে আশুরা জাগিয়ে তোলে।কিন্তু আমাদের অবস্থান কোথায় ভাবা দরকার। দূর্ভাগ্যের বিষয় সমগ্র মুসলিম জাতী আপাদমস্তক হিপোক্রেসিতে নিমজ্জিত।দূর্ভাগ্যের বিষয় আজ আমরা সারা দুনিয়ায় নিজেদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলা খেলছি। এর থেকে এখনই পরিত্রাণ খোজা মিল্লাতের স্বার্থেই জরুরী। আল্লাহ বলেন ‘লিমা তা কুলুনা মালা তাফআলুন’ অর্থাৎ তোমরা যা করোনা তা বলো কেন? । প্রকৃতপক্ষে মুসলমানেরা মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল(স.)এঁর পথ দূরে সরে গেছেন।আল্লাহ বলেন, তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক থাকতেই হবে যারা মানব জাতিকে কল্যাণের পথে আহবান করবে সৎ কাজের আদেশ দিবে ও অসৎ কাজ প্রতিরোধ করবে। সুরা আল ইমরান-১০৪। আল্লাহ্ আরও বলেন ওয়াতাসিমু বিহাবলিল্লাহি জামিয়াও ওয়ালা তাফাররাকু। তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করো আর পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।অথচ আমরা যেন জেনে শুনেই বিচ্ছিন্নতার পথে ,বিরোধের পথে ও বিভক্তির পথে এগুচ্ছি।
এতক্ষণের আলোচনায় আমরা মিল্লাতের অধপতনের কারণ জানতে পেরেছি এখন ষড়যন্ত্রের উৎসমূল খোজে বের করতে হবে আর সেখানেই প্রতিঘাত করতে হবে। মনে রাখতে হবে জিহাদ মানে যুদ্ধ বা হানাহানি নয়, জিহাদ মানে স্ট্রাইভ এণ্ড স্ট্রাগল অর্থাৎ সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রানপণ চেষ্টা করা । আল্লাহ বলেন ‘ইয়া আইয়্যুহাল্লাযীনা আমানু উদখুলু ফিসসিলমি কাফফা, ওয়ালা তাত্তাবিয়্যু খুতুওয়াতিশ শাইতান। ইন্নাহু লাকুম আদুয়ুম মুবিন’। অর্থাৎ হে ঈমানদারেরা ইসলামের মধ্যে পুরোপুরি দাখিল হও আর শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না, কেন না শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। আফসোস তাগুত মসলমানদের সবকিছু জবরদখল করে নিয়েছে। বাঁচার পথ খুজতে হবে জিততে হবে এ যুদ্ধে। মুসলিম নেতৃবৃন্দ তাদের জাতীয় পরিচয় অবলুপ্ত করে নিজ জনগোষ্ঠীকে ইন্দো-মার্কিন-যায়নবাদীদের হাতে তুলে দিয়েছে সারা বিশ্বে তা রুখতে হবে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় একছত্র আধিপত্য ব্যতিরেকে জাতীয় গৌরব ফিরে পাবার স্বপ্ন সূদুর পরাহত।
মুসলমানেরা আজ চরিত্র, বৈশিষ্ট হারিয়ে জীর্ণ-শীর্ণ জাতীতে পরিণত হয়েছে, তাদেরকে সঠিক পথে ফেরাতে হবে । এ দায়িত্ব আলেম-ওলামাদের, বুদ্ধিজীবিদের, শিক্ষতদের সকলের। জাতীয় গৌরব পূনরুদ্ধারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ধর্মীয় কোন্দল অপনোদনে সচেষ্ট হতে হবে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের বৃহদাংশ দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। আর তখনকার অব্স্থা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।আর সে অবস্থার পূনরাবৃত্তি আমরা দেখতে চাই না।
এখন আমাদের করণীয় বিষয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হবো। দূর্ভাগ্য যে আশুরার শিক্ষা ছিনতাই হয়ে গেছে বহু আগেই পুনরুদ্ধার ব্যতিরেকে বাঁচার পথ নেই। ইয়াহুদীদের কাছে আশুরা জাতীয় মুক্তি দিবস হিসেবে পরিচিত ও পালিত হয় এখনো।আমাদের দিনটিকে বিপর্যয় দিবস হিসেবে পালন করতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের প্রস্তুতি নিতে হবে। স্নরণ রাখতে হবে কোনো কোনো সময় জীবন মৃত্যুতে পরিণত হয় আর মৃত্যু জীবনে পরিণত হয় নিজে নিজেই। ইমাম হোসেনে (রা.) এর মৃত্যুটাও সে রকম, এটি মৃত্যু নয় যেন নতুন জীবনের আলো। আল্লাহ বলেন ওয়ালা তাকুলু লিমাইয়াকতালু ফি সাবিলিল্লাহি আমওয়াত, যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে শহিদ হয়েছে তাদেরকে মৃত বলো না। হিকমা ও উত্তম যুক্তির ভিত্ততে মুক্তির পথ অনুসন্ধানের কথা বলেছেন মহান আল্লাহ। মনে রাখতে হবে ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবন ও একতায় সন্তরণ এবারের আন্দোলন হওয় দরকার। আল্লাহ বলেন মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল কাফিরদের প্রতি কঠোর আর নিজেদের মধ্যে রহম দিল।
মূল কথা হলো ইতিহাস চর্চা ও ইতিহাসের শিক্ষা অনুশীলন থেকে সরে গেছি আমরা। এ সময় সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন ও জনসংযোগ বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরী। বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্য পূনস্থাপন করতে হবে, এজন্য জ্ঞান বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে সততার অনুপম নজরানা পেশ করতে হবে, কথা ও কাজে মিল রখতে হবে। সত্য ও মিথ্যার দ্বন্ধে সত্যের সপক্ষে অবস্থান নির্ঝণ্ঝাট হতে হবে, সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত বস্তুত মিথ্যা অপসৃত হবেই। সকল রকমের অহংকার, শিরক-বিদআত মুক্ত, বৈষম্যহীন, ও তোষামোদ বিমুখ তথা স্বচ্ছ ও পুত পবিত্র জীবন যাপনের অংগীকার করতে হবে। জাতীয় শত্রু-মিত্র চিহৃতকরণ ও সে হিসাবে পদক্ষেপ জরুরী।
এসময় একদল সুশৃংখল, স্থিরচিত্ত, ধৈর্যশীল, দৃঢ়প্রত্যয়ী, অসীম সাহসী, জ্ঞানবান ও আল্লাহর প্রতি নিরেট তাওয়াক্কুল মানুষের বেশী বেশী দরকার। শত্রুর মোকাবেলায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতি ও সতর্ক থাকা এ মুহুর্তের প্রধান করণীয় বলে আমার মনে হয়েছে। রাহমানের উদ্দেশ্যে তারই কথা থেকে শেষ কমিটমেন্ট পেশ করেই শেষ করছি।‘মম জীবনের ধ্যান আরাধনা সকল কর্ম সাধনা বেদনা সকল জীবন মরণ আমার তোমারে সফিনু আমি হে মোর জগৎস্বামী’।
---------------০----------------
বিষয়: বিবিধ
১৪৯৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন