‘‘ম্যানার্স এন্ড এটিকেট ও প্রোটোকল’’
লিখেছেন লিখেছেন ওসমান গনি ০৮ জুলাই, ২০১৫, ০৬:২১:৪১ সন্ধ্যা
ইংরেজীতে একটি প্রবাদ বাক্য আছে “Courtesy cost nothing”। এটি একটি যথার্থ বচন বৈ কি? তাহলে চলুন আমরা একটু ভাবি ম্যানার্স বলতে কি বুঝি। ইংরেজীতে ম্যানার্স শব্দের অর্থ বাংলায় সামাজিক রীতিনীতি বা প্রথা বলা হয়েছে। মূলতঃ মানুষের অন্তরের বাহ্যিক অভিব্যক্তিকেই ম্যানার্স বলা হয়ে থাকে। মানুষ ব্যবহারিক জীবনে যা কিছু করে কিংবা প্রদর্শন করে তাই ম্যানার্স। একে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন কিম্বা স্বাভাবিক বা প্রকৃতিগত আচরনের বহি:প্রকাশও বলা হয়ে থাকে। এক কথায় যদি বলি তাহলে বলা যায় এটি হলো জীবন সম্পর্কে ব্যক্তির চমৎকার দৃষ্টিভঙ্গি। এ বিষয়ের আরও একটু গভীরে যদি সন্তরন করি তাহলে দেখতে পাবো ব্যক্তির সাধারন জ্ঞান ও তার চারিত্রিক বৈশিষ্টের উজ্বলতার সুপ্রকাশ হলো ম্যানার্স।
এবার চলুন এটিকেট নিয়ে কথা বলি। এটিকেট বলতে আসলে কি বুঝায়? এটিকেট শব্দের অর্থ হলো বিশেষ পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের সৌন্দর্যমণ্ডিত কোমল ভাব-ভঙ্গি, আদব-কায়দা ও বাহ্যিক আচরন। এটি হলো কিছু প্রতিষ্ঠানিক নিয়ম পদ্ধতি। একে মূলতঃ কিছু রীতিনীতি বা আইন কানুনও বলা হয় যা সামাজিক অথবা অফিসিয়াল জীবনের জন্য প্রযোজ্য। এটিকে প্রথাগত আইনের সমষ্টিও বলা যায়। যদি বলি অলিখিত আইন-কানুন তাও সত্য তবে মানুষের জন্য কল্যানজনক। বস্তুতপক্ষে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা যদি যর্থাথ এটিকেট মেনে আচার ব্যবহার করেন তাহলে এটি একটি সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভুমিকা পালন করতে পারে।
বস্তুত মানব মন্ডলী একে অপরকে দৈনন্দিন কাজ কর্মে ছাড় দেবে, সহযোগিতা করবে , বিবাদ বিসম্বাদ এড়িয়ে চলবে,একে অপরকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহন করবে এটিই স্বাভাবিক এবং এটিই নিয়ম হওয়া উচিৎ। সংঘাত বন্ধে সকলে সহনশীল আচরন করবেন ও একত্রে কাজ করবেন এটাই প্রতিষ্ঠানের দাবী। অপরের বক্তব্য ও অধিকারের প্রতি সচেতন ও সম্মান প্রদর্শন করা সহকর্মীদের কর্তব্য। প্রার্থীর বক্তব্য মনযোগ দিয়ে শুনা উচিৎ। আল্লাহ বলেন ‘প্রার্থীকে তিরস্কার করো না’। যারা ছায়েল(প্রার্থী) তাদেরকে ধমক দেয়া কিম্বা তাড়িয়ে দেয়া যাবে না। এক কথায় আচার আচরণের দিক থেকে সর্বেোচ্চ কোমলতা প্রদর্শন করে সুনাগরিক হিসাবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা ও মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদা রক্ষা করে চলার বিকল্প নেই।
আপনি ব্যবহারে, কথনে, বসবাসে, যাত্রায় ও আচরনে সুন্দর কিছু প্রদর্শন করতে পারেন। সকল আবস্থাতে নিজেকে মানিয়ে চলার অভ্যাস আপনাকে এগিয়ে নেবে। সংস্কৃতিতে একটি কথা আছে ‘ফলেন পরিচিয়তে’। আপনার আচার-ব্যবহার অনেকের মাঝে আপনাকে আলাদা ভাবে উপস্থাপন করবে। ম্যানার্স এন্ড এটিকেট একটি মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্টকে ফুটিয়ে তুলে। মনে রাখতে হবে সৌজন্যতায় খরচ নাই বরং অনেক অর্জন আছে। অফিসে আদালতে অনেক সময় অনেক গ্রাহককে আমরা তার চাহিদা মত সুবিধা দিতে পারিনা । তাতে কি? তার সাথে হাসি-খুশি আলোচনা ও ভাল ব্যবহার করেও আমরা তাকে সন্তুষ্ট করতে পারি । কর্মকর্তার একটি আন্তরিক হাসি অনেক সময় রেগে যাওয়া গ্রাহককে বাগে নিয়ে আসতে সাহায্য করে। তার সাথে বন্ধুসূলভ ও সহনশীল আচরণ করা কর্তব্য। আমাদের সীমাবদ্ধতার কথা তাকে বুঝিয়ে বলতে পারি। এভাবে একটি রুক্ষ পরিবেশকে আমরা শান্ত করতে পারি অতি সহজেই।
যে কোনো প্রতিষ্ঠানে একটি সুন্দর পরিবেশ দরকার। সুন্সাদর পরিবেশের জন্য সার্বিক পরিবর্তন ও জরুরি , এ পরিবর্তমন মন-মননে পরিবর্তন, শিক্ষায়,ব্যবহারে, প্রয়োগে পরিবর্তন সৃষ্টি করা দরকার। নিজেদের মধ্যকার মনোমালিন্য সুন্দর ও গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার অভ্যাস সৃষ্টি করা গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে আমাদের আঙ্গিনায় আগত সকল ব্যক্তিই আমাদের গ্রাহক, তারা আমাদেরকে সেবা করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে আমাদেরকে ধন্য করেছেন। গ্রাহকদের অনেক চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে । যে সমস্ত কর্মচারীদের ইগো প্রবলেম আছে তাদেরকে চিহিত করে শান্ত করার প্রচেষ্টা চালানো জরুরি। দেশী বিদেশী অনেক গবেষনায় গ্রাহকদের প্রতিষ্ঠান ত্যাগের অন্যতম কারণ হিসাবে খারাপ আচরণের কথাই বলা হয়েছে। সুতারাং নিজেদের মধ্যে এবং বহিরাগতদের সাথে সুন্দর আচরণের নজির স্থাপন করতে দোষ কি?
পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য আপনি সকল মানুষের সাথে সমান ব্যবহার করুন এটি আল্লাহরও নির্দেশ, পক্ষপাতিত্ব পরিত্যাগ করুন, বৈষম্য রোধ করুন, মানুষের মান সম্মানে আঘাত লাগে এমন কাজ থেকে বিরত থাকুন,এটি হক্কুল ইবাদ। বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সভ্যতা গড়ে তুলুন তাহলে মানুষ হিসাবে আপনি শ্রেষ্ঠত্বের কাতারে সমাসীন হবেন এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমরা যদি প্রত্যেকে দায়িত্ব সচেতন হই ও আজকের কাজকে গতকালকের চেয়ে উন্নত করি তাহলে পরিবেশ সুন্দর হতে বাধ্য। প্রতিযোগিতামূলক ভাবে গ্রাহকদের ও নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করা কল্যাণকর হিসেবে বিবেচিত হবে। কেউ যেন মনে না করে যে,আপনি কাউকে ভালবাসেন আর কাউকে ভালবাসেন না। এটি আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে তাহলে এটি মারাত্মক ভুল হবে। অপনি পরিবেশকে অশান্ত করে তুললেন এভাবে। আমাদের মধ্যে আরেকটা মারাত্মক ব্যাধি কাজ করে যা আমাদের সকল ভাল কাজকে ধীরে ধীরে নস্যাৎ করে দেয় আর তা হলো ক্রোধ। ক্রোধ সম্বরন করার শক্তি অর্জন করা মুমিনের দায়িত্ব। এটি শয়তান থেকে সৃষ্ট রোগ। ক্রোধে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বিচার বুদ্ধি লোপ পায়। একটি প্রবাদ বাক্য আছে না ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন’। সুতারাং কথায়, কথায় কারণে অকারণে রেগে যাওয়ার অভ্যাস বদলাতে হবে নচেৎ এটি আমাদেরকে ধ্বংস করে দিবে।আল্লাহ বলেন ‘আমি ধৈর্যশীলদের সাথে আছি’।
আপনার নিছক নিজের স্বার্থের জন্য পছন্দ-অপছন্দ বিভক্তি সৃষ্টি করতে পারেন না। মনে রাখতে হবে আপনি যদি মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন,কাউকে অপমানিত করেন, মনে কষ্ট দেন, বৈষম্য করেন তাহলে তিনি আপনার সামনে চুপ করে থাকলেও মনে মনে আপনার অমঙ্গল কামনা করবে। অপরের সম্মান ও ইজ্জত আব্রুর প্রতি নজর রাখা ঈমানের দাবী। মনে রাখতে হবে অপরের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। পরের হক নষ্ট করা যাবেনা। অপরের প্রতি সম্মান বোধ ও তার অধিকারের প্রতি যত্বাবান হওয়া সব সময় বিবেচনায় আনতে হবে। কারো অবর্তমানে সমালোচনা করা তথা গীবত করা অন্যায়,এটিকে কুরআন মৃত ভাইয়ের গোস্ত খাওয়ার মতই গর্হিত কাজ বলে ঘোষনা দিয়েছে। হাদিস শরিফে আছে,এক মুমিন আর এক মুমিনের নিকট আয়না স্বরূপ। আয়নায় যে রকম নিজের শরীরের বা চেহারার সব কিছু দেখতে পাওয়া যায় তেমনি এক ভাই অন্য ভাইয়ের ভাল-মন্দ আয়নায় দেখার মতই শোধরিয়ে দিয়ে উক্ত ভাইকে সংশোধন করবেন এটাই কাম্য। গীবত চোখলখোরি ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম, এর থেকে নিজেদের রক্ষা করা উচিৎ। নচেৎ আমাদের সকল পূণ্য কাজ নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যাবে এরকম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে। সুতরাং এসব বিষয়ে সাবধান হতে হবে।
আমরা টেলিফোন ব্যবহারে ও অফিস রুম সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখার ব্যাপারে চমৎকার সব কিছু করতে পারি। ভিআইপিদের আমাদের আঙ্গিনায় স্বাগত জানাতে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা জরুরী। এজন্য প্রটোকল অফিসার চিহ্নিত করে রাখা যায়। কাপড় চোপর পরিধানে পরিপাটি ও শালিনতা বজায় রাখা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে দরকার। সময় ব্যবহারে যত্নশীল হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। অযথা গসিপিং ও আড্ডা দেয়া থেকে বিরত থাকা উচিৎ। কাগজ পত্র, কলম, পেনসিল ব্যবহারে যত্নবান হওয়া দরকার। অপচয় করা কোনক্রমে সমিচিন হবে না। পানি, বিদ্যুৎ , টয়লেট পেপার, কম্পিউটার ব্যবহারে যত্নবান হলে অনেক টাকা সাশ্রয় করা যায়। একদিনে একজন একটি খামও যদি অপচয় থেকে বাঁচাতে পারি তাহলে সারা বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ খাম বাঁচাতে সক্ষম হবো।এটি চাট্টি খানি কথা নয়।এভাবে আমরা কোটি কোটি টাকা খরচ সাশ্রয় করতে পারি। ওভারটাইম করার ক্ষেত্রেও আমরা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার নজরানা পেশ করতে পারি। অনেক সময় কাজে অ-কাজে অনেক কাগজের অপচয় হয়, সেটি কিভাবে রোধ করা যায় চিন্তা করা উচিৎ।
শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন সফলতা বয়ে আনে। মনে রাখতে হবে দুনিয়ার জীবন শেষ নয়। পরকালীন জীবনে এক জররা ভাল ও এক জররা মন্দের বিচার হবে। বস্তুত আপনার সকল ভাল মন্দ ব্যবহার দু’জন সম্মানিত লেখক কর্তৃক লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেই দৃষ্টিকোন থেকে পরিকল্পিত ও পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের দিকে এগুতে হবে। আমরা কি জররা ভুল করি? নাকি পুকুর চুরি করি । অথচ এসব আমরা বুঝিনা। আমরা সারাক্ষন বলি কিন্তু মানিনা। বলার জন্য বলি কিনা ভেবে দেখা উচিৎ। আক্ষরিক অর্থেই সর্বক্ষন আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকা উচিৎ। আল্লাহ বলেন ”তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যেভাবে ভয় করা উচিৎ এবং মুসলমান হওয়া ছাড়া মৃত্যুবরণ করো ন “।
আমাদের হক্কুল ইবাদ কি জানা দরকার। এটি টাকা পয়সার ক্ষেত্রে যেমন সত্য তেমনি কারো সম্মান পাওয়ার হকের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। সতীর্থদের মধ্যে কারো দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকালেন, কারো দিকে ঘৃনার দৃষ্টিতে তাকালেন এটি অন্যায়-অপরাধ। ইসলাম তিন জনের মধ্যে দু’জনের কানাঘুষাকে পর্যন্ত নিষেধ করেছেন। মানুষের মনে কষ্ট লাগে এমন আচরণ থেকে নিজেকে নিবৃত রাখতে হবে। এটিও পরের হক নষ্ট হিসাবে বিবেচিত হবে।
মানুষকে সাহায্য করার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। আল্লাহ্ মুসলমানদের লক্ষ্য করে বলেন ‘‘আমি তোমাদেরকে সারা দুনিয়ার মানুষদের কল্যানের জন্য সৃষ্টি করেছি’’। এজন্য সুশৃঙ্খল জীবন পদ্ধতি অনুসরন করতে হবে। সে হিসাবে রাসূল (স) এর জীবনই উত্তম আদর্শ হিসাবে মেনে নিতে হবে। সুন্দর আচার-আচরণ,আদব-কায়দা ও নম্রতা- ভদ্রতা একজন মানুষের শরাফত বাহ্যিক অলংকার। এটি পরকালীন জীবনে উচ্চ মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখবে। আত্ম সমালোচনা করার শক্তি অর্জন করতে হবে, ব্যবহারে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এজন্য ভাল মন দরকার। সাদা মনের মানুষ হওয়া দরকার। একটি পরিকল্পিত জীবন দরকার।
পরিশেষে বলবো জীবনের উদ্দেশ্য লক্ষ্য এখনই ঠিক করে নিতে হবে। জীবনকে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (স) আদেশ নিষেধের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে। দুনিয়ার জীবনকে পরকালীন মুক্তির নিমিত্তে সাজাতে হবে। প্রতি মূর্হুতে নিশ্বাসে বিশ্বাসে আল্লাহকে হাজের নাজের জেনে জীবন পরিচালনায় কঠোর শপৎ নিতে হবে। আল্লাহর দাসত্বকে কবুল করতে হবে,তাগুতকে না বলতে হবে। এক খোদার স্থলে হাজারো খোদা সৃষ্টির অপপ্রয়াস রোধ করতে হবে। প্রতিটি মানুষের মাঝে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে। কেউ কারো প্রভু না সেজে বন্ধু হয়ে যদি কাজ করা যায় তাহলে একটি সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হতে বাধ্য আর তখনই একটি শাশ্বত চিরন্তন মনুষ্য উপযোগী গ্রহ আমরা উপহার দিতে সক্ষম হবো। মনে রাখতে হবে সত্য-মিথ্যার দন্ধেসত্যকে গ্রহণ করতে হবে এতে কোন সমযোতা হবে না । কুরআন বলে ‘‘সত্য সমাগত মিথ্যা হোক অপসৃত বস্তুতঃ মিথ্যা অপসৃত হবেই’’।
বিষয়: বিবিধ
২৯৬৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চমৎকার ও সুন্দর একটি লেখার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। জাজাকাল্লাহু খাইরান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন