সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা
লিখেছেন লিখেছেন ওসমান গনি ০৭ জুলাই, ২০১৫, ০৪:১৬:৪৩ বিকাল
সংবাদপত্র একটি অতি সংবেদনশীল এবং শক্তিশালী গণ মাধ্যম। বর্তমান ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অভাবনীয় অগ্রগতির পরও এই শিল্পের গুরুত্ব অথবা চাহিদা কোনক্রমেই কমে নি বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। সংবাদপত্র মূলত আন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগ এর সম্প্রসারিত রূপ। অর্থাৎ, গণ মাধ্যম তথা সমাজ ও সভ্যতার সুতীক্ষ্ম অভিব্যক্তি। কাজেই আধুনিক সভ্যতার অক্ষরালোকিত কোনো সমাজ বা জাতি সংবাদপত্রহীন জীবন কখনও কল্পনা করতে পারে না। ঊনিশ শতকের বিখ্যাত সাংবাদিক জে এ ব্রাডস সংবাদপত্রকে মানব ইতিহাস ও সভ্যতার এক অপরিহার্য নিয়ামক হিসাবে চিত্রিত করেছেন। তার দৃষ্টিতে সংবাদপত্রহীন মানবজীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বিভীষিকাময়। বিশ্ববিখ্যাত লেখক-সাংবাদিক হেমিংওয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় বলেছিলেন জীবনের সকল সৌভাগ্য ও বঞ্চনা প্রতিদিনের ঘটনার মধ্যেই থাকে সেগুলো কখনও আমরা নিরাসক্ত খবর হিসাবে পরিবেশন করি অথবা জীবনবোধে উজ্জীবিত হয়ে গল্পে রূপান্তরিত করি। মূলত সংবাদ হচ্ছে জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
আমাদের দেশের সংবিধানে সীমাহীন স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। চিন্তা ও চৈতন্যের স্বাধীনতা প্রদানেও এ দেশের সংবিধান কার্পণ্য করে নি। এটি ১৯৭৮ সালে প্রণীত ইউনেস্কোর গণ মাধ্যম ঘোষণার সাথে সম্পর্কযুক্ত। যেখানে বিশ্ব শান্তি ও সহমর্মিতা অব্যাহত রাখার স্বার্থে, মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সংরক্ষণে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। তবে আমাদের সংবিধানের মত শর্তহীন স্বাধীনতা পৃথিবীর অনেক দেশের সংবিধানে স্বীকৃত নয়। এতদসত্ত্বেও স্বাধীনতার পর এদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর কত বিপর্যয় এসেছিল তার ইয়ত্তা নেই। তখন সংবাদপত্রকে অনুশাসনের নামে তার অস্থিত্বের উপর আঘাত এসেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকল বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে সংবাদপত্রের আংশিক বিজয় সূচিত হয়েছিল।
এই তো সেদিন মাত্র ১৯৯০ সালে প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স এর বিবিধ কালাকানুন আংশিকভাবে বাতিল করা হয়। সুখের কথা সংবাদপত্রের কন্ঠরোধকারী অনেক কালাকানুন এখন আর নেই। গড়পড়তা সেন্সরশিপও নেই বললেই চলে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে এদেশে সে সময়ে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের উপর মারাতœক নিপীড়ন ও হুমকি উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এটি গণতন্ত্র ও জাতীয় উন্নয়নের জন্য শুভ লক্ষণ ছিল না। বর্তমানে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। সংবাদপত্রের কতটুকু স্বাধীনতা দরকার তাই নিয়ে বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। যেমন ইংল্যান্ডে যীশুর বিরুদ্ধে কিছু লিখার অধিকার সাংবাদিকদের নেই। ব্লাশফেমী আইনের মাধ্যমে খৃষ্টানদের প্রভু যীশুকে সকল কিছুর উর্দ্ধে রাখা হয়েছে। সৌদি আরবে, পাকিস্তানে আইনের মাধ্যমে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ ছ. এর বিরুদ্ধে কটাক্ষকারীদের কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
কিন্তু আমাদের দেশ তার ব্যতিক্রম। এদেশের পত্র পত্রিকায় মাঝে মধ্যে ইসলাম ধর্ম ও প্রিয় নবীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা হয় এবং তা অন্যায়ভাবেই চলছে। তাতে সাংবাদিকদের গায়ে আঁচড় দেয়ারও কারো সাধ্য নেই। তবে র্বতমান সময়ে আমলে সাংবাদিকরা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বশেী কছিু লিখার সাহস করে না। যারা তাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছে তাদের রহোই দেয়া হয় ন। সীমাহীন নিপীড়নের স্বীকার হতে হয়েছে অনেককে। এদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নামে যেমন চলছে সীমাহীন পক্ষপাতদুষ্টতা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আদর্শের বিরুদ্ধে নোংরা প্রচারণা, হলুদ সাংবাদিকতা তেমনি চলছে সত্যনিষ্ঠ সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার হীন প্রচেষ্টা। আমরা সংবাদপত্রের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা চাই। তবে এ স্বাধীনতা যেন গণ মানুষের আদর্শ ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে তথা সাম্রাজ্যবাদী ও সম্প্রসারণবাদী শক্তির পক্ষে নিবেদিত না হয়।
সংবাদপত্রের একটি প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে স্বাধীন চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করা, স্বাধীনতার পরমানন্দকে সম্প্রসারণ করা এবং সমাজের মানুষের স্বপ্ন, সাধ, চিন্তা, আর্তি, আকুলতা প্রকাশে যথাযথ ভূমিকা রাখা। সংবাদপত্রে জীবনের সান্নিধ্য থাকবে, জীবনকে সুন্দরতম উপায়ে অবলম্বন করবে তবে জীবনের পূর্ণ কর্মকা-ের আচ্ছাদন থাকবে না। জনগণকে সামাজিক সমস্যাগুলোতে আগ্রহী এবং সংশ্লিষ্ট করা সাংবাদিকদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি হওয়া উচিৎ প্রধান মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্যের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করা এবং জনগণের প্রতিটি সমস্যার সংশ্লিষ্ট বিষয়কে অগ্রাধিকার এবং প্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্বাসগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট প্রতিবেদন তৈরি করা। একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিক কোনো ঘটনাকে, সেটি জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক হোক অথবা কারো বোধ-বিশ্বাস তথা ধর্ম বিষয়ক হোক, শুধুমাত্র একটি চাকচিক্যময় রিপোর্ট প্রকাশের সুযোগ নিয়ে মিথ্যা বাহবা কুড়ানোর সস্তা বিষয় হিসাবে বিবেচনা করবে না এবং জাতীয় নৈতিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব মনে করে কাজ করবে যার মাধ্যমে একটি ফলপ্রসু আলোচনার দ্বার উদঘাটিত হবে।
সমাজে উত্তেজনা সৃষ্টির অভিপ্রায়েও সংবাদ রচনা করা যায়। কিন্তু তা যথার্থ সাংবাদিকতা হয় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো পত্রিকার সস্তা জনপ্রিয়তার সাথে সৎ সাংবাদিকতার দ্বন্দ্ব চিরন্তন। আবার প্রাণহীন নিশ্চেতন সংবাদ পরিবেশনায় পাঠকের হৃদয় মনে আগ্রহ সৃষ্টি করা যায় না। জীবনের সকল সৌভাগ্য এবং বঞ্চনা প্রতিদিনের ঘটনার প্রতিচ্ছবি। সেগুলোকে আমরা কখনও খবর হিসাবে পরিবেশন করি, জীবন আগ্রহী হয়ে গল্প হিসাবে পর্যবসিত করি। এখানেই সাংবাদিকতার আসল স্বার্থকতা। সাংবাদিক ডিজরেলী বলেন, সময় সংবাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে সত্যনিষ্ঠতা তারও চেয়ে মূল্যবান।
সাংবাদিকতা একটি কঠিন ও মহান পেশাও বটে। সৎ সাংবাদিকের কোনো বন্ধু নেই এবং দেশ-কাল-পাত্র নেই। তারা জগৎ সভার এক এক জন পরীক্ষক প্রভাবক। সামাজিক অনাচার ও বৈপরিত্যের বিরুদ্ধে সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। মানবতার অতন্দ্র প্রহরী সাংবাদিকরা দেশ ও জাতির শেষ ভরসা। তাদের তৃতীয় নয়ন সব সময় রেডিওএকটিভ নয়ন হয়ে ঘটনার গভীরে গিয়ে সত্য উদঘাটনে পারঙ্গম হবে এটাই পাঠক সমাজ আশা করে। আমাদের দুঃখ হয় তখন, যখন কেউ কেউ সাংবাদিকতার নীতিমালা অগ্রাহ্য করে অসত্য সংবাদ পরিবেশনে ব্রতী হন। অনেকে মনে করেন ‘জনশ্রুতি রয়েছে’ বা ‘লোকে মনে করছে’ অথবা এ রকম শোনা যায় এ জাতীয় কিছু অস্পষ্ট, সন্দেহজনক এবং গোঁজামিল ধরনের শব্দাবলী ব্যবহার করে নিন্দাবাদমূলক বা উদ্দেশ্যমূলক রিপোর্ট কিংবা সংবাদ নির্দোষ তথা বৈধ হয়ে যায়। এ ধারণা সঠিক নয়। দায় দায়িত্বহীন, হাওয়া থেকে পাওয়া অথবা আপন মস্তিষ্ক প্রসূত বানোয়াট, কাল্পনিক প্রতিবেদন তৈরি করা সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার বরখেলাপ। অনেক সময় অর্থ লোভ, সরকারের পক্ষে অবস্থান অথবা ভয়ে, বিদেশি প্রভাব ও পেশাগত অসততা সত্যতা বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সাংবাদিকেরা যেমন সংবাদ পরিবেশন করেন তেমনি নানাবিধ আলোচনা, সমালোচনা, মন্তব্য এবং অভিমতও তারা লিখে থাকেন। এক্ষেত্রে আমরা বলব, নীতিগতভাবে সাংবাদিকেরা সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে বাধ্য। বাধ্য এ জন্য বলছি যে, সর্ববাদীসম্মতরূপে সাংবাদিকদের কাজ হলো ঘটনার যথার্থ সত্য বিবরণ প্রকাশ করা, রটনা প্রচার নয়। কেননা, মানুষ প্রকৃত ঘটনা জানতে চায়। লেখার অধিকার যেমন সাংবাদিকের রয়েছে, তেমনি সত্য ও পক্ষপাতহীন ঘটনা জানার অধিকার যে জনগণের থাকবে না সেটা কীভাবে আশা করা যায়? নিরেট সত্যকে আবিষ্কার এবং জানার আকুতি মানুষের চিরন্তন-স্বাভাবিক মনের দাবি ও সহজাত প্রবৃত্তি। দুনিয়ার কোথায় কী ঘটছে তা জানবার জন্য যে কৌতুহল সেটা মানব হৃদয়ের চিরন্তন বিষয় ও একান্তই মানবিক। মানুষের এই কৌতুহলদীপ্ত বাসনা, মনের তৃষ্ণা মেটানোর দায়িত্ব হলো সংবাদপত্রের। আর এ সংবাদপত্রের আসল ভিলেন হলেন সাংবাদিক বন্ধুরা।
আমরা মনে করি যাদের মন অসুস্থ তাদের নজর উত্তেজনার দিকে। তারা সংবাদ পরিবেশনায় সুঁড়সুড়ি দিয়ে হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়, কৃত্রিম আনন্দ পেতে চায়। কিন্তু এ কাজ সংবাদপত্রের নয়, সাংবাদিকের নয়। এ সব সাংবাদিকতা নয়, হলুদ সাংবাদিকতা। এ কাজ নিচ ও হীন। জনগণ চায় সত্য সংবাদ, আসল ঘটনা, রটনা নয়। মনে রাখতে হবে নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে অস্বীকারের মধ্যে কোনো গৌরব নেই। অথচ বিলেতের মত আধুনিক ধর্মহীন দেশেও খ্রীষ্ট-ধর্ম অথবা তাদের ধর্মগুরু যীশুর নামে কোনো কুৎসা রটনা করা যাবে না। এ জন্য গ্রীস এবং ইংল্যান্ডে ব্লাসফেমী আইনের মাধ্যমে সমালোচনাকারীদের শাস্থির বিধান রয়েছে। কই এ জন্য তো আমরা গ্রীস অথবা ইংল্যান্ডকে খ্রীষ্ট মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসাবে সমালোচনা করি না। কিন্তু এ দেশের পত্র পত্রিকা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আদর্শের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যেই কি যে সব লিখছে আমরা কি তা কখনও ভেবে দেখেছি দরদ দিয়ে নিরপেক্ষভাবে ? বাস্তব কথা হলো সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের চেতনাদীপ্ত মনোভাবের প্রতিফলন ঘটবে সাংবাদিকতায় এটাই তো স্বাভাবিক।
আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে, আসল লুকিয়ে নকলের চর্চা করা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা নয়, কিংবা সর্বজন নন্দিত বিষয়ে বলতে পারার অধিকার থাকাও সমীচিন নয়। আবার দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যৌক্তিক কোনো বিষয়ের উপর সত্য প্রকাশের প্রতিবন্ধকতাও মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের সংবিধানে যুক্তিসংগত সীমাবদ্ধতার আওতায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। এতে করে সাংবাদিকতায় দায়িত্বশীলতা বাধ্যতামূলক হয়েছে। সাবেক প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি সুলতান হোসেন খান বলেন, “সব সভ্য দেশেই চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু সে স্বাধীনতা অবাধ ও সীমাহীন নয়। ব্যক্তি স্বাধীনতার অপব্যবহারের ফলে সংবাদপত্রে মিথ্যা প্রশ্রয় পেলে সমাজের বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। উন্নত দেশে শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিকেরা দুষ্ট সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের বর্জন করে থাকে”। এ প্রসংগে বিশিষ্ট সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমদ বলেন, “সম্পাদকের দায় দায়িত্ব বিরাট। অথচ আমাদের দেশে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানকে এমন সব লোক শুধু টাকার জোরে দখল করে নিচ্ছে যারা সাংবাদিকতার ‘স’ পর্যন্ত জানে না। সমস্থ নষ্টের মূল এইসব লোক।’’ তিনি আরও বলেন, “পুঁজি নৈতিকতা ও স্বাধীনতার স্বার্থক সমন্বয় ঘটলেই সংবাদপত্র তার ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে পারে।”
সাংবাদিকেরা বিধিবিধান মেনে চলছেন কি না তা দেখার বিষয় সম্পাদকের, মালিকের নয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এরকম চিন্তা-চেতনা নেই বললেই চলে। ভূঁইফোড় কালো টাকায় রাতারাতি গজিয়ে উঠা পত্রিকাসমুহের নিকট নীতি নৈতিকতা বলতে কিছুই নেই। তারা স্বার্থ আর সুবিধা ছাড়া কিছুই চিনে না। পুঁজির সাথে নৈতিকতা ও স্বাধীন চিন্তার স্বার্থক সমন্বয় নাও ঘটতে পারে। এও হতে পারে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা এক নয়। তবে ন্যূনতম বিধিবিধান আর নীতি জ্ঞানকে তোয়াক্কা না করে রাতকে দিন আর দিনকে রাত করে সংবাদ পরিবেশন করা কেমন সাংবাদিকতা? সত্যকে গোপন করে মিথ্যাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রং লাগিয়ে প্রচার করা সাংবাদিকতার কোনো স্তরে পড়ে? সংবাদ পরিবেশনায় একদেশদর্শীতা, আর তিলকে তাল বানানোর কেরামতি সচেতন পাঠক সমাজ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে এটাই স্বাভাবিক। অনেক সময় সাংবাদিকতার লেবাস পরে অনেকে কত যে নিচতা, হীনতা, দীনতা আর সংকীর্ণতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত তা বলতেও লজ্জা হয়। দলাদলি আর হানাহানির পরিবেশ সৃষ্টি করে মহৎ কিছু অর্জন কিংবা জাতির কোনো কল্যাণ করা যায় না। আমাদের দেশে বর্তমানে সাংবাদিকতার নামে যা চলছে তাকে অরাজকতা বলা ছাড়া উপায় নেই। অথচ দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা গণতন্ত্রকে সুসংহত আর উজ্জীবিত করতে পারে।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের সংবাদপত্র শিল্পের অঙ্গনে এ রকম দুষ্ট চক্রের আবির্ভাব আর স্বার্থ-চিন্তার সরব আমদানি ইদানিং কালের। সংবাদপত্র শিল্পকে শুধু মুনাফাখোরী শিল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চক্রান্ত রুখা দরকার সকলের। কোনো অবস্থাতেই সাংবাদিকতার দায় দায়িত্বের কথা বিস্মৃত হওয়া যায় না। এ পর্যায়ে সাংবাদিকেরা জাতিকে কোনো সঠিক পথ দেখানোর পরিবর্তে, বিকৃত ও মরীচিকাময় আপাত লোভনীয় স্রোতধারাকে আরও বেগবান করে তোলে। অথচ ইতিহাসের সত্যের মুখোমুখী হলে দেখা যাবে আমাদের পূর্বসূরী বিদগ্ধ গুণীজনেরা ঐতিহ্যের যে সম্ভার আমাদের জন্য রেখে গেছেন, তার কাছে স্বার্থ-চিন্তার এ প্রসঙ্গ একেবারেই নগণ্য।
ইংরেজ শাসনামলে বেঙ্গল গেজেট, ইন্ডিয়া গেজেট, ক্যালকাটা গেজেট, হরকরা প্রভৃতি সাময়িকীর কোনটিই ব্যবসায়িক স্বার্থ-বুদ্ধি নিয়ে প্রকাশিত হয় নি। ১৮১৮ সালে দিকদর্শন, সমাচার দর্পণ এবং বাংলা ভাষাভাষীদের দ্বারা পরিচালিত বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্র ‘বাঙাল গেজেটটি’ প্রকাশ পায়। এ সব পত্রিকার সবগুলোরই লক্ষ্য ছিল জন হিতার্থে স্ব-স্ব মতের প্রকাশ ঘটানো এবং বিভিন্ন তথ্য ও সংবাদের ম্যাধমে মানবতার কল্যাণ সাধন করা। এভাবে এক হিসাবে দেখা যায় ১৯০০ সাল নাগাদ ১০৫০ টির মত পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়। মুনাফা চিন্তার দিক থেকে এ পত্রিকাগুলোর একটিও সম্ভবত এমন ছিল না যার জন্য প্রকাশক, সম্পাদক ও সাংবাদিকেরা শ্রম ও সময় ব্যয় করতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে, স্ব-স্বার্থের নিরঙ্কু বিকাশের পরিবর্তে দেশ ও জাতির বৃহত্তর হিতৈষণার লক্ষ্যে প্রবল আবেগ আর আকাংখা থেকেই পত্রিকাগুলো আত্মপ্রকাশ করে। বিশ শতকের শুরু থেকে ৪০ এর দশক পর্যন্ত কেবল মুসলমানদের হাতেই শতাধিক পত্র-পত্রিকা প্রকাশ পায়। এ সব পত্রিকার বিভিন্নভাবে লক্ষ্যের কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও স্বদেশ ও স্ব-জাতির কল্যাণ কামনায় তাদের লক্ষ্য ছিল, এক ও অভিন্ন। সাংবাদিকতা এখানে ছিল সত্য ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক। দূর্বল ও অসহায়ের অন্যতম অবলম্বন।
সংবাদপত্র শিল্প হচ্ছে সমবায়ের মত। সমাজের মানুষেরা যেমন সংবাদপত্রহীন থাকতে পারে না, তেমনি সাংবাদিকেরা যেমন খুশি তেমন লিখা কিংবা পাঠকের স্বার্থকে উপেক্ষা করতে পারে না। সাংবাদিকতায় পাঠকের গুরুত্ব অপরিসীম। জনগণের সার্বিক ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোই এর মূল লক্ষ্য। আমাদের জানতে হবে পাঠক কি চায়? কেন তারা সংবাদপত্র পড়ে? ঝপযৎধস এর মতে পাঠক দুটো কারণে সংবাদপত্রের আসল শক্তি অস্থিত্ব নিশ্চয়তার প্রাণ পুরুষ। তাই পাঠকের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে সাংবাদিকতার উদ্দ্যেশকে ঠিক করতে হয়। সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য চারটি। তা হলো- জ্ঞাপন, শিক্ষণ, প্রভাবন ও প্রমোদন। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে সত্য জ্ঞাপন। জানবার দুর্নিবার ইচ্ছা মানুষের সহজাত চিরন্তন। এই জানবার আগ্রহ থেকেই সপ্তদশ শতক থেকে শুরু হয় সংবাদপত্রের তথা সাংবাদিকতার যাত্রা। দেশের মানুষের মন-মেজাজ, চিন্তা চেতনা, প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্ধিতা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেশ-বিদেশের ব্যবহারিক ও বৈষয়িক জীবনের কৌতুহলোউদ্দীপক ঘটনা সমাজের সদস্যদের জানিয়ে দেয়াই সংবাদপত্র শিল্পীর প্রধান দায়িত্ব। তাছাড়া জনগণকে বিবিধ জাতীয়-আন্তর্জাতিক বিষয়ে শিক্ষাদান করাও সাংবাদিকতার অন্যতম উদ্দেশ্য।
মার্কিন মুল্লুকে সংবাদপত্রকে শিক্ষার উপকরণ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সাংবাদিকেরা জনগণকে তাদের বস্তুনিষ্ঠ ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করবে এটাই তো স্বাভাবিক, জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দেবে তারা। পত্র পত্রিকা জনগণকে প্রমোদনের ব্যবস্থাও করতে পারে। তবে তা পরিশীলিত ও মার্জিত হওয়া বাঞ্চনীয়। মানবীয় প্রবৃত্তিগুলোর ন্যায়ানুগ উন্মেষ ও উন্মোচনের মাধ্যমে সুস্থ বিনোদন চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সাংবাদিকতা একটি চমৎকার সংস্কৃতিমনা সমাজ বিনির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। পাঠকের সকল দূর্বল দিকগুলোকে সাংবাদিকতার নামে পাঠকের মনোজগৎকে বিকৃত ও রুগ্ন করার অসুস্থ প্রতিযোগিতার নাম সাংবাদিকতা নয়। সামাজিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের অগ্রণী ও সাহসী ভূমিকা জাতিকে আরও সুসংহত ও শক্তিশালী করবে। যদি কেউ শুধু অশ্লীলতা ও বক্তৃতা সর্বস্ব কিছু প্রকাশের বাসনা পোষণ করে তা হবে সাংবাদিকতার নীতি বহির্ভূত।
দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা একটি জাতির স্বচ্ছ-দর্পণ স্বরূপ। জাতীয় জীবনের সকল অন্ধকার, অশ্লীলতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দায়িত্বশীলতা একটি বলিষ্ট পদক্ষেপ। জাতিকে সঠিক পথ দেখানোর নিয়ামক শক্তি হচ্ছে সাংবাদিক বন্ধুরা। দেশে দেশে তারাই স্ব-জাতিকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং হানাহানির চরম অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা করে। বলিষ্ট ও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতাই একটি শোষণহীন, সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই সুশীল সমাজের দাবি সাংবাদিকতার নামে হানাহানি আর দলাদলি বন্ধ হোক। নতুন প্রজন্মকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে হবে। গর্বিত জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শপথ গ্রহণ করতে হবে সকলে মিলে। আমরা যেন সাংবাদিকতার আদর্শ-নিষ্ঠাকে জলাঞ্জলি দিয়ে কোনো অবস্থাতেই অর্থ-সম্পদ আর ক্ষমতার লোভে অশুভ শক্তির দাবার গুটিতে পরিণত না হই। এদেশ ও জাতির মান-সম্মান আর আত্মমর্যাদাবোধকে কোনো কিছুর বিনিময়েই বিকিয়ে না দেই তথা ভুলুন্ঠিত না করি। কোনো অবস্থাতেই দায়িত্বশীলতার সীমারেখা অতিক্রম করার অপপ্রয়াস না চালাই। সাংবাদিক বন্ধুরাই সংবাদপত্রের মাধ্যমে একটি জাতির অন্তরাত্মাকে আলোকিত করতে পারে। ঘুমন্ত জাতিকে উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত করতে পারে। এমন কি তার অন্তর্নিহিত সত্যকে সুন্দরভাবে আবিস্কার করতে পারে। জাতীয় মানসলোককে সম্ভ্রম এবং প্রতিপত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে জাতিকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে পারে। স্বাধীন সংবাদপত্র ও দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার এটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিষয়: বিবিধ
১৬০০ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন