পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ৪০ দিন অথবা ৪ মাসের জন্য করে ঘুরে মুসলিম ভাইদের আল্লাহ্ তা’লার দিকে ডাকার ব্যপারে ইসলামের বিধান কি?
লিখেছেন লিখেছেন মুসলমান ১৩ অক্টোবর, ২০১৫, ১১:৫৮:৩৪ সকাল
উত্তরঃ সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা’লার।
“তাবলীগ জামায়াত” এমন একটা দল, যারা ইসলামের জন্য কাজ করছে। আল্লাহ্ তা’লার পথে মানুষকে ডাকার ব্যাপারে তাঁদের চেষ্টাকে অস্বীকার করা যায়না। কিন্তু অন্য আরো অনেক দলের মতই তাঁদেরও কিছু ভুল রয়েছে, এর মধ্যে কিছু বিষয়ে ভুলের ব্যাপারে উল্লেখ করা দরকার। এই বিষয়গুলো নিচের মত করা সাজানো যেতে পারে, তবে এটা মনে রাখতে হবে যে , এই ভুল গুলো পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিভিন্ন পরিবেশ আর সমাজের উপর ভিত্তি করে তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠেছে। যে সমাজে জ্ঞান এবং জ্ঞানী ব্যক্তির আধিক্য রয়েছে এবং ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতে’র আলেমদেরও বিস্তৃতি রয়েছে,সেখানে তাঁদের ভুলগুলো তুলনামূলক অনেক কম। অন্য সমাজে তাঁদের ভুলগুলো অনেক বড় পর্যায়েরও হতে পারে। তাঁদের উল্লেখযোগ্য কিছু ভুল হলো,
১। ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতে’র আকীদা অনুসরণ না করা। তাঁদের কিছু সদস্য এমনকি তাঁদের কিছু নেতাদের থেকে এটা পরিষ্কার ভাবে জানা যায়।
২। তাঁরা ‘শরিয়াহ’র মৌলিক জ্ঞানের দিকে মনযোগ দেয়না।
৩। তাঁরা কুরআনের কিছু আয়াতের এমন ভুল ব্যাখ্যা করেছে যা আল্লাহ্ তা’লা বুঝাতে চান নি । যেমনঃ তাঁরা জিহাদের আয়াতগুলোকে ‘দাওয়ার জন্য বাইরে বের হওয়া’ বলে অনুবাদ করে। এই আয়াতের ‘খুরুজ’ শব্দটি যা শুধু ‘বাইরে বের হওয়া’ বুঝায়, তাঁরা সেটিকে ‘দাওয়া’ শব্দ যোগ করে “দাওয়ার জন্য বাইরে বের হওয়া” বলে অনুবাদ করেছে।
৪। দ্বীনের দাওয়াতের কাজে ‘বাইরে বের হওয়াটা’কে তাঁরা নিয়ম বানিয়ে ইবাদাতের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তাই তাঁরা ভুল ভাবে কুরআনের কিছু আয়াত যেগুলোতে কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যা রয়েছে; সেগুলোকে উল্লেখ করে তাঁদের এই বানানো নিয়মের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছে। এই নিয়ম, যা তাঁরা মনে করেন যে কুরআন দ্বারা প্রমাণিত, তা প্রায় সব দেশ এবং সব ধরণের পরিবেশে ব্যপক ভাবে প্রচলিত।
৫। তাঁরা এমন কিছু কাজ করেন যা ‘শরিয়াহ’ এর বিরুদ্ধে যায়। যেমন, দাওয়াহ এর কাজে বাইরে বের হবার সময় একজনকে দুয়া করতে লাগিয়ে দিয়ে বের হওয়া। তাঁরা মনে করেন, তাঁদের দাওয়াহ সফল বা ব্যর্থ হওয়াটা নির্ভর করে এই লোকের দুয়াটা কত আন্তরিক ছিল তার উপর।
৬। তাঁদের মধ্যে ‘দুর্বল’ এবং জাল হাদীসের ব্যপক প্রচলন রয়েছে, যা আল্লাহ্র পথে মানুষকে যারা ডাকবে, তাঁদের সাথে একেবারেই বেমানান।
৭। তাঁরা মানুষকে মন্দের ব্যাপারে সাবধান করেনা। বরং তাঁরা মনে করেন, ভালোর দিকে ডাকাটাই যথেষ্ট। আমরা দেখেছি, তাঁরা মানুষের মধ্যে প্রচলিত খারাপ কাজ গুলোর ব্যাপারে তাদের নিষেধ করেনা যদিও এই উম্মাতের স্লোগান হলো,
“তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকবে যারা মানুষকে ইসলামের দিকে ডাকবে, ভালো কাজ (তাওহীদ এবং সব ফরয বিধান পালন) করতে বলবে এবং খারাপ কাজ (শিরক-কুফর এবং আল্লাহ্ যা নিষেধ করেছেন) থেকে বিরত থাকতে বলবে। আর তাঁরাই সফলকাম দল” – সুরা আল ইমরানঃ ৩/১০৪
সতরাং সফল তাঁরাই যারা ভালোর দিকে ডাকার পাশাপাশি মন্দ থেকেও নিষেধ করে। যারা শুধু যেকোন একদিকে মানুষকে ডাকে, তাঁরা সফল নয়।
৮। তাঁদের কেউ কেউ আত্মপ্রশংসা আর ওদ্ধত্য প্রদর্শনে লিপ্ত হয় যা তাঁদের অন্যের দোষ খুঁজে বেড়াতে উদ্বুদ্ধ করে। এমনকি তাঁরা উম্মাতের আলেমদের সমালোচনায় ও লিপ্ত হয় এবং তাঁদেরকে ঘুমন্ত আলেম আর অকর্মণ্য বলেও গালি দেয় এবং নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়ায়। আপনারা তাঁদেরকে দেখবেন যে তাঁরা তাঁদের ভ্রমনের ব্যপারে কথা বলে, কিভাবে তাঁরা গেল,কি কি দেখলো আরো অনেক কিছু। আসলে এটা (তাঁদের ভ্রমণ) তাঁদেরকে কোন ফলাফল ই দিচ্ছেনা, যা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি।
৯। তাঁরা আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদ করা এবং জ্ঞান অর্জন করার চাইতে দাওয়াহ এর কাজে বাইরে বের হওয়াটাকে বেশি নেকির কাজ মনে করেন। যদিও জিহাদ এবং ইলম হাসিল করা ফরয হয় (অথবা কখনো কারো কারো উপর ফরয, সবার উপর নয়)।
১০। তাঁদের কেউ কেউ ফতওয়া দেবার মত দুঃসাহস দেখায় এমনকি তাফসীর আর হাদীসও আলোচনা করে। কারণ, তাঁরা সবাইকেই মানুষের সামনে বক্তব্য দেবার অনুমতি দেয়। যা তাঁদেরকে শরিয়াহ’র ব্যপারে কথা বলার অন্যায় সাহস যোগায়। তাই দেখা যায়,তাঁরা আহকাম, হাদীস এবং কুরআনের আয়াত নিয়ে কথা বলে অথচ এই বিষয়ে তাঁদের কিছুই পড়াশুনা নেই বা না তাঁরা কোন বিজ্ঞ আলেমের থেকে শিখেছে। অথচ তাঁদের অনেকেই নতুন মুসলিম হয়েছে অথবা কিছুদিন হলো ইসলাম পালন শুরু করেছে।
১১। তাঁদের কেউ কেউ স্ত্রী এবং সন্তানের অধিকার কে অবজ্ঞা করে। আমরা এই ব্যাপারের গুরুত্ব নিয়ে ৩০৪৩ নং (ইংরেজি) ফতোয়াতে আলোচনা করেছি।
এ কারনে উলামায়ে কেরাম মানুষকে তাঁদের সাথে বের হবার অনুমতি দেন না, একমাত্র তাঁদের ই অনুমতি দেন যারা তাঁদেরকে জ্ঞানের মাধ্যমে সাহায্য করতে চান এবং তাঁদের ভুলগুলোকে শুধরে দিতে চান।
আমাদের উচিত হবেনা গণহারে মানুষকে তাঁদের থেকে দূরে সরানো, বরং আমাদের উচিত হবে তাঁদের ভুলগুলো শুধরে দেয়া এবং উপদেশ দেয়া যেন তাঁরা তাঁদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারেন এবং কুরআন সুন্নাহের আলোকে নিজেদের সংশোধন করে নিতে পারেন।
‘তাবলীগ জামায়াত’ নিয়ে নিচে আলেমদের কিছু ফতোয়া দেয়া হলো-
১- শায়খ আব্দুল আ’জিজ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
“তাবলীগ জামায়াত” এর আকীদা বিষয়ে সঠিক বুঝ নেই। তাই তাঁদের সাথে বের হওয়া জায়েজ নয়, তবে তিনি যেতে পারেন যার জ্ঞান রয়েছে এবং ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতে’র আকীদার উপর সঠিক বুঝ আছে, যাতে করে তিনি তাঁদের দিক নির্দেশনা এবং উপদেশ দিতে পারেন এবং ভালোকাজে তাঁদের সংগী হতে পারেন, কারণ তাঁরা খুবই কর্মঠ। কিন্তু তাঁদের আরো জ্ঞান দরকার এবং এমন কারো দরকার যিনি তাঁদের তাওহীদ আর সুন্নাহের জ্ঞান শেখাবেন। আল্লাহ্ আমাদের সকলকে ইসলামের সঠিক বুঝ দিয়ে ধন্য করুন এর উপর আমাদের অটল রাখুন”- মাজমু ফতোয়া আল শায়খ ইবনে বায, ৮/৩৩১
২- শায়খ সালেহ আল ফাওযান হাফিজাহুল্লাহ বলেন,
“আল্লাহ্র রাস্তায় বের হওয়া এমন ভাবে বের হওয়া বুঝায় না যেভাবে ইদানিং তাঁরা বের হচ্ছেন বা বুঝাচ্ছেন। আল্লাহ্র রাস্তায় বের হওয়া মানে হলো যুদ্ধের জন্য বের হওয়া। আল্লাহ্র রাস্তায় বের হওয়া বলতে তাঁরা যা বুঝাচ্ছেন এটা একটা বিদআত যা সালাফ আস সালেহীনদের থেকে বর্ণিত হয়নি।
মানুষকে আল্লাহ্র দিকে ডাকার জন্য কোন দিন নির্ধারণ করে নেয়া যাবেনা। বরং একজন লোক তাঁর সাধ্যমত , কোন সময় (যেমন ৪০ দিন বা তার কম বেশী) নির্ধারণ না করেই মানুষকে আল্লাহ্তা’লার দিকে ডাকবে।
একইভাবে, একজন দ্বীনের দায়ীর জ্ঞান থাকতে হবে। কারো জন্য মানুষকে আল্লাহ্র দিকে ডাকা জায়েজ হবেনা যদি সে অজ্ঞ হয়। আল্লাহ্ বলেন, “বলুন ( হে মুহাম্মাদ!), এটা আমার পদ্ধতি; আমি মানুষকে আল্লাহ্ তা’লার দিকে ডাকি (তাওহিদের দিকে) সুনিশ্চিত জ্ঞান সহকারে” – সুরা ইউসুফ ১২/১০৮
জ্ঞান এই কারনে লাগবে, কারণ যিনি আল্লাহ্র দিকে মানুষকে ডাকবেন তাঁকে অবশ্যই জানতে হবে কোনটা ফরয, কোনটা মুস্তাহাব, কোনটা হারাম আর কোনটা মাকরুহ। তাঁর অবশ্য জানতে হবে শিরক, গুনাহ, কুফর, অনৈতিকতা এবং অবাধ্যতা সম্পর্কে। তাঁকে জানতে হবে কি করে মন্দ কে প্রতিহত করতে হয়।
যে বের হওয়া মানুষকে মৌলিক জ্ঞান অর্জন থেকে বিরত রাখে , সেটা ভুল। কারণ, ইসলামের মৌলিক জ্ঞান অর্জন করা ফরয। আর এটা একমাত্র পড়াশুনার মাধ্যমেই শিখা সম্ভব, অনুপ্রেরণা দ্বারা নয়। এটা ভ্রান্ত সূফীদেরই একটি প্রচলিত গল্প। কারণ জ্ঞান ছাড়া আমল করাটা হলো বিভ্রান্তি আর পড়াশুনা ছাড়া জ্ঞানার্জনের আশা করা হলো একটা মিথ্যা আশা” – ছালাত মিহাযারাত-ফিল ইলম-ওয়াল-দাওয়া
আল্লাহ্ ই ভালো জানেন।
অনুদিত
ইসলামকিউএ
মূল ফতোয়াঃ http://islamqa.info/en/8674
অনুবাদ কৃতজ্ঞতাঃ নুর উদ্দিন আল-মাসুদ
বিষয়: বিবিধ
১৩৫৩ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার কিন্তু ব্লগিং বন্ধ করে দিতে পারে।
মুসলমানের কান্ড দেখে অবাক ও ব্যথিত হলাম
আপনি তাদেরকে কাফের ধরণের কিছু বলার চেষ্টা করতে পারেন। অথবা তারা ইসলাম মেনে চলছে এই দুঃখে আপনি ইসলাম ত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু তাবলীগের কিছুই হবে না ভাই। চেষ্টা করেও লাভ নাই। অনেকে হাল ছেড়ে দিয়েছে। আপনিও ছেড়ে দেন। আর তাবলীগে কিছু দিন সময় দেয়ার পরে যদি কিছু বলতে চান তাহলে হয়ত আপনার বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন