ইমাম বুখারী'র (রহ.) সংক্ষিপ্ত জীবনী-(৬ষ্ঠ অংশ)
লিখেছেন লিখেছেন মুসলমান ২৮ জুন, ২০১৫, ১১:০৫:১৫ সকাল
বুখারী শরীফ
বুখারী শরীফের পূর্ণ নাম আল জামিউল মুসনাদুস সহীহুল মুখতাসারু মিন উমূরি রাসূলিল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহী ওয়া আয়্যামিহী। হাদীসের প্রধান প্রধান বিষয়সমূহ সম্বলিত বলে একে ‘জামি’ বা পূর্ণাঙ্গ বলা হয়। কেবল মাত্রও সহীহ হাদীসে সন্নিবেশিত বলে ‘সহীহ’ এবং ‘মারফূ’ ‘মুত্তাসিল’ হাদীস বর্ণিত হওয়ার এর মুসনাদ নামকরণ করা হয়েছে।
সকল মুহাদ্দিসের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত এই যে, সমস্ত হাদীসগ্রন্থের মধ্যে বুখারী শরীফের মর্যাদা সবার ঊর্ধ্বে এবং কুরআন মজীদের পরেই সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ গ্রন্থ। এক লাখ সহীহ ও দুই লাখ গায়ের সহীহ মোট তিন লাখ হাদীস ইমাম বুখারী (রঃ)-এর মুখস্থ ছিল। এ ছাড়া তাঁর কাছে সংগৃহীত আরও তিন লাখ, মোট ছয় লাখ হাদীস থেকে যাচাই-বাছাই করে তিনি দীর্ঘ ষোল বছরে এ গ্রন্থখানি সংকলন করেন। বুখারী শরীফে সর্বমোট সাত হাজার তিনশত সাতানব্বইটি হাদীস সংকলিত হয়েছে। ‘তাকরার’ বা পুনরাবৃত্তি (যা বিশ্বের প্রয়োজনে করা হয়েছে) বাদ দিলে এই সংখ্যা মাত্র দুই হাজার পাঁচশত তের-তে দাঁড়ায়। মু’আল্লাক ও মুতাবা’আত যোগ করলে এর সংখ্যা পৌছায় নয় হাজার বিরাশিতে। বুখারী শরীফের সর্বপ্রধান বর্ণনাকারী ফারাবরী (রঃ)-এর বর্ণনা অনুসারে বিখ্যাত ভাষ্যকার হাফিয ইবন হাজার (রঃ) কতৃক গননার সংখ্যা এখানে প্রদত্ত হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণনাকারী ও গণনাকারীদের গণনায় এ সংখ্যার তারতম্য পরিলক্ষি ত হয়।
উপরে বর্ণিত সুক্ষ যাচাই-বাছাই ছাড়াও প্রতিটি হাদীস সংকলনের আগে ইমাম বুখারী গোসল করে দু’রাকাত সালাত আদায় করে ইসতিখারা করার পর এক-একটি হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। এরূপ কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের ফলে অন্যান্য হাদীসগ্রন্থের তুলনায় সারা মুসলিম জাহানে বুখারী শরীফ হাদীসগ্রন্থ হিসেবে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পেরেছে। জমহূর মুহাদ্দিসের বুখারী শরীফের বর্ণিত প্রতিটি হাদীস নিঃসন্দেহে সহীহ ও গ্রহণযোগ্য।
বুখারী শরীফ সংকলনের জন্য ইমাম বুখারী (রঃ)-এর উদ্বুদ্ধ হওয়ার কারণসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যে, তাঁর বিখ্যাত ওস্তাদ ইসহাক ইবন রাহওয়ায়হ (রঃ) পরোক্ষভাবে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ তোমারদের মধ্যে কেউ কি এমন নেই, যে ‘ গায়ের সহীহ হাদীস’ থেকে ‘সহীহ হাদীস’ বাছাই করে একখানি গ্রন্থ সংকলন করতে পারে?
ইমাম বুখারী (রঃ) একবার স্বপ্নে দেখেন যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর দেহ মুবারকের উপর মাছি এসে বসছে আর তিনি পাখা দিয়ে সেগুলকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। তা’বীর বর্ণনাকারী আলিমগন এর ব্যাখ্যা দিলেন যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর সহীহ হাদীসসমূহ ‘গায়ের সহীহ’ হাদীস থেকে বাছাইয়ের কাজ স্বপ্ন দ্রষ্টা দ্বারা সম্পাদিত হবে। তখন থেকেই ইমাম বুখারীর মনে এরূপ একটি গ্রন্থ সংকলনের ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠে এবং তিনি দীর্ঘ ষোল বছরের অক্লান্ত সাধনার পর তা সমাপ্ত করতে সক্ষম হয়। এই গ্রন্থ প্রনয়নে তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সহীহ হাদীসের একখানি উচ্চাঙ্গের গ্রন্থ রচনা করা এবং তাঁর সে উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে সফল হয়েছে। এ গ্রন্থের হাদীস সন্নিবেশের পর তিনি চিন্তা করলেন যে, অধ্যায়নের সাথে সাথে যাতে লোক এর ভাবার্থ ও নির্দেশিত বিধানবলী সম্পর্কে অবহিত ও উপকৃত হতে পারে তজ্জন্য হাদীসসমূহ তিনি বিভিন্ন অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত করে ‘তরজমাতুল বাব’ বা শিরোনাম কায়েম করেন। যেহেতু দীন-ই-ইসলামের শিক্ষা ব্যাপক ও বিস্তৃত, তাই এর বিধানাবলীর পরিসীমা নির্ধারণ করা দুষ্কর। পক্ষান্তরে ইমাম বুখারী (রঃ) কর্তৃক সংকলিত হাদীসগুলোর সংখ্যা সীমিত। এই সীমিত সংখ্যক হাদীস দ্বারা দীন-ই ইসলামের ব্যাপক ও বিস্তৃতি শিক্ষার দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন দুষ্কর। তাই ইমাম বুখারী (রঃ) সংকলিত হাদীসগুলি দ্বারা ব্যাপক বিধানাবলীর দলীল কায়েম করতে গভীর জ্ঞ্যান ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁকে ইশারা বা ইঙ্গিতের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছে। ফলে বুখারী শরীফ অধ্যয়নে তারজমাতুল বাব ও বর্ণিত হাদীসের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা আলিমদের দৃষ্টিতে একটি কঠিন সমস্যা ও প্রধান বিবেচ্য বিষয়।
বুখারী শরীফ প্রনয়নের পর থেকে আজ এই পর্যন্ত এই কঠিন সমস্যার সমাধান করতে মুহাদ্দিস, ফকীহ ও আলিম সমাজকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। শিরোনামের এই রহস্য ভেদ করতে প্রত্যেকেই স্বীয় জ্ঞ্যান-বিবেকের তুণ থেকে তীর নিক্ষেপে কোন কসুর করেন নি, তবুও মুহাক্কিক আলিমদের ধারণায়, আজও কারো নিক্ষিপ্ত তীর থেকে তীর নিক্ষেপ কোন কসুর করেন নি, তবুও মুহাক্কিক আলিমদের ধারণায়, আজও কারো নিক্ষিপ্ত তীর লক্ষ্যস্থল ভেদে সর্বক্ষেত্রে পুরোপুরি সমর্থ হয় নি। এজন্য বলা হয়ে থাকে ‘ফিকহুল বুখারী ফী তারাজিমিহী’ অর্থাৎ ইমাম বুখারী (রঃ)-এর জ্ঞ্যান-গরিমা ও বুদ্ধি-চাতুর্য তাঁর গ্রন্থের তরজমা বা শিরোনামের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। পরবর্তীকালে মহিষীগণ এই লুক্কায়িত রত্ন যথাযথ উদ্ধারের সর্বশক্তি ও শ্রম ব্যায় করেও পূর্ণভাবে সফলকাম হতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বিষয়: বিবিধ
১২৪৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন