একটি কার্যকর সাংস্কৃতিক বিপ্লব: সমস্যা ও সম্ভাবনা
লিখেছেন লিখেছেন সফেদক্যানভাস ২২ জুন, ২০১৫, ১০:৩৫:৪৫ রাত
আমাদের যারা সব দিক দিয়ে পরিপূর্ণ একটি আদর্শিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখি তাদের চিন্তার জগৎটা দিন দিন কেবলই সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। প্রতিটি মূহুর্ত রাজনীতৈক সমস্যার বাইরে তারা আর কিছুই ভাবতে পারছে না। অবস্থা এমন হয়েছে যে- দাড়ালে, বসলে, খেতে, ঘুমাতে সবখানে শুধু রাজনীতির বাইরে তারা আর কিছুই দেখতে পারছেনা। রাজনীতির বাইরে আর কোনো সমস্যা থাকতে পারে সেটি যেন স্বীকার করতেও অনীহা।
অথচ রাজনীতির পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তণের অন্যান্য উপকরণগুলো নিয়েও যে সমান গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে সে উপলব্ধি ভোতা। প্রকৃত পক্ষে একটি জাতীকে যদি বিদ্যমান আদর্শ থেকে বের করে এনে নতুন একটি আদর্শের রঙে গড়ে তুলতে হয় তাহলে সবার আগে প্রয়োজন সে জাতীর মধ্যে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। কারণ সংস্কৃতি দ্বারা একটি জাতীকে যত বেশি প্রভাবিত করা সম্ভব তা অন্য কোনো উপায়ে সম্ভব নয়। অথচ এই উপলব্ধিটা আমাদের কর্ণধারদের মধ্যে যেন আসেই না। একটু লক্ষ করলেই দেখা যায় ইসলাম বিরোধী শক্তি ইসলামী আদর্শকে ঘায়েল করতে সর্বপ্রথম যে অস্ত্রটি ব্যবহার করে তা হলো কালচারাল অস্ত্র। অথচ এ বিষয়ে আমাদের কোনো উদ্বেগই নেই। তারপরও আমাদের যতটুকু বা হচ্ছে তার মান দেখলে ভাড়ামী ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। দেশের আপামর জনতার চাহিদার সাথে মোটেও যায় না। সেখানে আন্তর্জাতিক মানতো কল্পনাতীত। বেশিরভাগ শিল্প কর্মেরই না আছে কোনো শিল্প মান না আছে বাণজ্যিক মান। একটি শিল্পকর্ম যদি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম টিকে না থাকে তাহলে এ ধরনের শিল্পকর্ম প্যারালাইস্ট। শিল্প কর্ম হতে হবে বৈশ্বিক মানে উন্নত; হতে হবে মডারেট ও সার্বজনিন। অধিক সংখ্যক মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য। হতে হবে অতি মাত্রায় প্রফেশনালিজমের মানে উন্নিত। তা না হলে দায়সারা গোছের শিল্প কর্ম দিয়ে সমাজ পরিবর্তণ সম্ভব নয়।
আমি দেখেছি আমাদের মধ্যে এমন অসংখ্য প্রতিভাবান লোক রয়েছে যাদেরকে দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের শিল্প কর্মও তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য দরকার দৃষ্টি ভঙ্গির একটু পরিবর্তন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা অন্যান্য কাজে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যায় করা হচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে অর্থ ব্যয় করার সময় যত এলার্জী। ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশে কোনো কর্মসূচী নিলেই তখন আর কন্ট্রিবিউটর বা স্পন্সর পাওয়া যায় না। এমন কি যারা এই আদর্শে বিশ্বাস করে তাদের অবস্থা আরও খারাপ।
এছাড়া আরও একটি বড় সমস্যা হলো অতিমাত্রায় অজ্ঞতাপ্রসুত ফতোয়াবাজি। মাঝে মাঝে দেখা যায় এখনো কিছু লোক ১৮ শতকের মত অযৌক্তিক ফতোয়াবাজি করে। এ শতাব্দিতে এসেও যদি সিদ্ধান্ত নেয়া না যায় গানে মিউজিক হবে কিনা..? তাহলে তো বলার কিছু থাকে না। কারণ একটি পরিপূর্ণ সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে থাকতে হবে গান, আবৃত্তি, মুখাভিনয়, নাটক, শর্ট ফিল্ম, ফুল ফিল্ম সব সব কিছু। আর মিউজিকের ব্যবহার যদি করতে না জানি তবেতো নাটক- সিনেমা বানানো সম্ভব নয়। কারণ নাটক বা সিনেমার প্রতি পরতে পরতে রয়েছে মিউজিক ব্যবহার। এটি ছাড়া ঐ সিনেমা বা নাটক কখোনো বিশ্ব মানের শিল্প মানের হওয়া সম্ভব নয়। তাই মিউজিকে দক্ষ হয়ে ওঠা বা ভালো মিউজিক ডিরেক্টর তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। এটি অস্বীকার করা আত্মপ্রতারণার শামীল।
একইসাথে আমি মনে করি শিল্প কর্মকে যদি প্রফেশনালীজম না থাকে তাহলে বর্তমানের গ্লোবালাইজেশনের যুগে শিল্প ও শিল্পী কোনোটিই টিকে থাকা সম্ভব নয়। কারণ কিছুদিন পর পরই শিল্পিরা হারিয়ে যাচ্ছে কখনো পেটেরে দায়ে কখনো বা নানামুখী সীমাবদ্ধতার কারণে। অথচ নীতিনিধারকদের মধ্য থেকে এটিকে প্রোফেশনালিজমের মধ্যে নিয়ে আসার কোনো প্রচেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে না। এর মধ্যেও যারা সুস্থ্য সংস্কিৃতির চর্চা করছেন বলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের যোগ্যতা থাকলেও রয়েছে অসংখ্য গোড়ামী। আমার দেখা মত এই পর্যন্ত ইসলামী সংস্কৃতি চর্চা করে এমন এক জন শিল্পী বা অভিনেতাকে পেলাম না যিনি তার নিজের ভাষা বাংলাকে প্রমিত উচ্চারণে বলতে পারেন। সুতরাং এসব শিল্পী দিয়ে ভাড়ামী ছাড়া আর কি বা হতে পারে? আর এ কারণে তাদের শিল্পকর্মগুলো বিরোধী পক্ষের সীমাহীন শক্তিশালী ও আগ্রাসী অপসংস্কৃতির সামনে ধানের চিটার মত উড়ে যাচ্ছে।
এখানে ভাববার অবকাশ নেই যে আমি রাজনীতির বিরোধীতা করছি। কোনো সমাজে একটি সফল আদর্শিক বিপ্লব তখনই ঘটবে যখন রাজনীতির পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি উপাদান বা অনুসঙ্গকেই সেই আদর্শের আদলে রাঙ্গানো যাবে। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে। আমি জানি যে আমার এই কথাগুলো নতুন কথা নয়। তবে মূল কথা হলো এখন পর্যন্ত যে ধরনের বা মানের সাংস্কৃকি কর্মকাণ্ড পরিচলনা করা হচ্ছে বা হয়েছে তা দিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। কারণ এগুলোর না আছে কোনো শিল্প মান না আছে আধুনিক বা যুগোপোযোগী চাহিদার আলোকে খাপ খাওয়ানোর মত ক্ষমতা। এ প্রেক্ষপটে আমাদের ভাববার সময় এসেছে আমাদের সংস্কৃতিকে কোন মানে নেয়া দরকার। যারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ভাবতে চায় তাদেরকে স্বাধীনভাবে ভাববার সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের চিন্তা-চেতনা ও কর্মকাণ্ডকে যদি সবসময় রাজনৈতিক নেত্রিবৃন্দের চিন্তার প্রভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে ব্যুমেরাং হয়ে যাবে। শিল্প সাধনায় কোনো সাধক বের হয়ে আসবে না। কিছু দিনের জন্য আবেগে পড়ে কিছু মানুষ আসবে। তার পর যথারীতি হারিয়ে যাবে।
সুতরাং আর সমালোচনা নয়, এখনই ভাববার সময় এসেছে আমরা করণীয় কি হওয়া উচিৎ। মোদ্দা কথা হলো শুধু রাজনীতি বিদদের দিকে তাকিয়ে থেকে নয় বরং অসংখ্য সীমাবদ্ধতার মধ্য থেকেও আমাদের যার যে অবস্থান থেকে এক একটি প্রতিষ্ঠানের মত ভুমিকা নিয়ে হয়ে কাজ করতে হবে। তাহলেই সম্ভব একটি কার্যকর সংস্কৃতিক বিপ্লব।
বিষয়: বিবিধ
১২১১ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন