মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনারঃ পর্দার আড়ালে এক উম্মে সাহেরা খাতুন

লিখেছেন লিখেছেন শুভ কবি ২৫ জুলাই, ২০১৫, ০৯:২৩:১৮ রাত

ভাষা আন্দেলনের প্রথম শহীদ রফিক। তিনি মানিকগঞ্জের সন্তান। শ্রদ্ধাভাবে তাকে বুকে ধারন করে মানিকগঞ্জবাসী তথা সারা দেশবাসী। তিনি আমাদের গর্ব। আর তার গর্বে আমরা গর্বিত। জাতি হিসাবে এটা আমাদের খুব বড় সম্মানের যে, পৃথিবীতে এক মাত্র আমরাই জাতি যারা, ভাষার তরে জীবন দিয়েছি।ভাষা শহীদদের জন্য শ্রদ্ধা লয়ে নির্মিত শহীদ মিনার। ১৯৫৪ সালে মানিকগঞ্জে নির্মিত হয়েছিল এ জনপদের প্রথম শহীদ মিনার। তবে তার পিছনে রয়েছে আরেক ইতিহাস। এই ইতিহাসের যিনি সাক্ষ্য বহন করছেন তিনি হলেন, উম্মে সাহেরা খাতুন। এই শহীদ মিনারের মত কাল গর্ভে তিনিও হারিয়ে গেছেন। অনেকেই জানেনা তার সেই অবদানের কথা।

১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। তৎকালীন ছাত্র-জনতা উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মান করনের জন্য। নির্মিতও হয়ে যায় বেশ কিছু শহীদ মিনার। কিন্তু তৎকালীনপাকিস্তানী সরকারের রোষানলে সেগুলোর একটিও মাথা উচু করে দাড়িয়ে থাকতে পারেনি। ভেঙে ফেলা হয় সবকটি শহীদ মিনার। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর স্বপ্ন অধরা রয়ে যাবার শঙ্কা জেগে উঠে। কিন্তু ছাত্র নেতৃবৃন্দ ছিল তাদের মননে অনড়। শহীদ মিনার হবেই। শুরু হল জায়গার সন্ধান। অবশেষে মিলে গেল । এগিয়ে এলেন যুক্তফ্রণ্ট সরকারের সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের সহধর্মিণী উম্মে সাহেরা খাতুন।

মানিকগঞ্জ জেলা শহরের এস.কে গার্লস স্কুলের সামনেই সাহেরা খাতুনের বাড়ি। ছাত্র নেতৃবৃন্দ তাঁর বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় রাস্তা ঘেঁষে শহীদ মিনারনির্মানের প্রস্তাবনা সাহেরা খাতুনের কাছে উত্থাপন করেন । সরকারের সেই মুহূর্তের লালাভ আখির কথা সাহেরা খাতুন ভালোই জানতেন। তারপরও কাল বিড়ম্বনা না করে অনুমতি দিলেন‘শহীদ মিনার হবে।

দিনটি ছিল ২০ই ফেব্রুয়ারি। পরেরদিনই শহীদদিবস। যে করেই হোক যত ছোটই হোক শহীদ মিনার হবে। ছাত্র নেতারা বুলেট গতিতে ইট,বালু,সিমেন্ট যোগার করে ছোট্ট একটি ইটের স্তম্ভের আকারে শহীদ মিনার তৈরী করলেন সেই দিনের মধ্যেই। মানিকগঞ্জ শহরে শহীদ মিনার নির্মান করা হয়েছে এ খবর পৌঁছাতে দেড়ি হয়নি প্রশাসনের কাছে। সে সময়ের এসডিও ছিলেন এ.কে.দত্ত চৌধুরী। তিনি বিপুল সংখ্যক পুলিশ নিয়ে হাজির হলেন শহীদ মিনার গুড়িয়ে দেয়ার জন্য। তবে এসবের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন সাহেরা খাতুন। অসীম সাহসে সেই পুলিশ বাহিনী এবং শহীদ মিনারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেন সিংহির মত।হুংকার দিয়ে বললেন,” আমার জায়গায় আমি শহীদ মিনার বানিয়েছি। কার সাহস তা ভাঙে?” তার এই হুংকার ও যৌক্তিক কথায় থেমে গেলেন এসডিও এবং পুলিশ বাহিনী। তারা আর সাহেরা খাতুনকে সড়িয়ে দিয়ে শহীদ মিনার ভাঙার সাহস পেলেন না



২১ফেব্রুয়ারি,১৯৫৪,ছাত্রজনতার ঢল নেমেছিল এই শহীদ মিনারের বেদীতে। ফুলে ফুলে রঙ্গিন হয়ে গিয়েছিল শহীদ মিনারের বেদী। কিন্তু ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের পর এ শহীদ মিনারটি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় পাকহানাদার বাহিনী।

১৯৭২ সাল। দেশ স্বাধীন হবার পর ঠিক একই স্থানে একইঅবয়বে পুনরায় গড়ে তোলা হয় শহীদ মিনারটি।এটিই মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার। ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভাষা দিবসের মূল অনুষ্ঠানমালা,শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন সবই হয়েছে এই শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করেই। শুধু তাই নয়। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারে বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের প্রেরণারও উৎসও ছিল এই শহীদ মিনার। কিন্তু ২০০৭ সালে মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যযালযের মাঠের পাশে প্রশাসনের উদ্যোগে মানিকগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মিত হলে প্রায় পরিত্যক্ত হযে যায় প্রথম তৈরি সাহেরা খাতুনের শহীদ মিনারটি। অযত্ন আর অবহেলায় ভেঙে যায় ইটের গাঁথুনীর ছোট্ট শহীদ মিনার। যদিও সাংস্কৃতিক কমী-সংগঠকদের দাবির মুখে মানিকগঞ্জ পৌরসভা মূল শহীদ মিনারটির আদল বদলে দিয়ে সিরামিক টাইলস লাগিয়ে নতুন করে এটাকে গড়া হয়।

দুঃখ আর পরিতাপের কথা হল, প্রথম শহীদ মিনারের সম্মানটুকু তাকে আর ফিড়িয়ে দেয়া হয়নি। একুশে ফেব্রুয়ারির দিনে আশে পাশের পাড়ার ছেলে মেয়েরা ছাড়া কেউ খোঁজ রাখেনা মিনারটির,ফুলশূন্য লয়ে বেদীটি পরে থাকে। সবচেয়ে চেয়ে বড় কষ্টের বিষয়,মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার নির্মানের পিছনে পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে থাকা অসীম সাহসী নারী সেই উম্মে সাহেরা খাতুনকে ভাষার দিবস কেন কোন উপলক্ষ্যেই স্মরণ করেনা কেউ গত ৪ যুগ ধরে। এ সময়ে তাঁরস্মরণে একটি স্মরণসভাও হয়নি মানিকগঞ্জে।

শহীদ রফিক যেমন তার তাজা রক্ত ঢেলে নিজেকে দিয়েছিলেন ভাষার তরে আর সেই রক্তিম আভাকে জমিনে শ্রদ্ধা জানাতে সাহেরা খাতুনের অবদানও তেমন চিরকাল অম্লিন। এ শহীদ মিনারের পাশেই বাঁধানো কবরে শায়িত আছেন শ্রদ্ধেয় উম্মে সাহেরা খাতুন এবং তাঁর স্বামী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস।



বিষয়: বিবিধ

৯৫০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

331576
২৫ জুলাই ২০১৫ রাত ১০:০৫
হতভাগা লিখেছেন : ভাষা শহিদদের জন্য আমরা গর্বিত । তাদের জন্য আমরা দোয়া করতে পারি , আল্লাহর কাছে তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করতে পারি ।

তবে কোন মূর্তি বানিয়ে সেটা করলে তাতে উনাদের কোন লাভ হবে না বরং যারা দোয়া করছে মূর্তিকে ঘিরে তারা সরাসরি আল্লাহর সাথে শিরক করার অপরাধে অপরাধী হবে।
২৫ জুলাই ২০১৫ রাত ১০:৩৪
273853
শুভ কবি লিখেছেন : মূলত ইতিহাস তুলে ধরাই ছিল এই লিখার সারাংশ Happy

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File