আলেমদের বিভক্তি নয়, ঐক্য চাই।
লিখেছেন লিখেছেন শাহমুন নাকীব ফারাবী ৩০ মে, ২০১৬, ০১:২১:৫৫ রাত
ইংরেজ শাসনাধীন নিখিল ভারতে প্রশাসনিক সুবিধা মুসলিমদের চেয়ে হিন্দুরা তুলনামূলক বেশিই পেত! কারণ হিসেবে বলা যায়, হিন্দুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা! শুধুমাত্র মুসলিম শাসন অবসানের নিমিত্তে যে হিন্দুরা ইংরেজদের শাসনকে স্বাগত জানাল সেই সাথে ইংরেজ শাসনকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে হিন্দুরা স্বজাতির সাথে গাদ্দারি করল, তাদেরকে তো একটু সুবিধা দিতেই হয়!
সেই সুবিধা নিয়ে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করেন। বর্তমানে ভারতের আরএসএস যাকে ‘ঘরে ফেরা’ বলে থাকে! অর্থাৎ তাদের দাবিনুসারে, ভারতে বসবাসকারীরা সকলেই হিন্দু! কিন্তু মুসলিম শাসনের অধীনে হিন্দুরা মুসলিম হয়ে গেছে। তাই পুনরায় তাদেরকে হিন্দু বানানোর আন্দোলনকে ‘শুদ্ধি আন্দোলন’ বা ‘ঘরে ফেরা’ আন্দোলন বলা হয়। সেই শুদ্ধি আন্দোলন শুরু হলে অনেক মুসলিম পরিবারকে জোর করে হিন্দু করা হয়। তুলনামূলক গরিব মুসলিমদেরকেই মূলত টার্গেট করা হয়। এই আন্দোলন শুরু হবার পর ১৯২৬ সালের ডিসেম্বরে একজন জিন্দাদিল মুসলিম তরুনের হাতে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ নিহত হন। আর শ্রদ্ধানন্দ নিহত হবার পরপরই হিন্দুরা মুসলিমদের জিহাদ নীতি নিয়ে অপপ্রচার শুরু করে। এমনকি অহিংস আন্দোলনের নেতা গান্ধিজী বলেন, “ ইসলাম এমন পরিবেশে জন্মলাভ করেছে যে, তার চূড়ান্ত শক্তির উৎস আগেও তরবারি ছিল এখনও তরবারিই আছে। অতীতে তরবারির সাহায্যে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে; এবং বর্তমানেও তাই হচ্ছে”।
হিন্দুদের এমন নেক্কারজনক অপপ্রচারে মুসলিমরা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। তখন দিল্লি শাহী মসজিদের ইমাম মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জওহর জুম্মার খুতবায় বলেন, “আহ! হায় আল্লাহ! আজ যদি ভারতবর্ষে এমন কোন আল্লাহর বান্দা থাকতো, যে তাদের হীন প্রচারনার দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিত আর ইসলামের জিহাদনীতির উপর একটি প্রামান্যগ্রন্থ রচনা করে ইসলামের প্রকৃত রূপ তুলে ধরত। তাহলে কতোই না ভাল হতো”। সেই দিনের জুম্মায় উপস্থিত ছিলেন ২৪ বছরের এক টকবগে যুবক। নামায শেষে বাড়ি ফেরার পথে তিনি ভাবলেন, সেই ব্যক্তিটি কি আমি হতে পারি না?
এই ভাবনা আসার পর তিনি, আল্লাহর উপর ভরসা করে চেষ্টা শুরু করলেন। প্রথমেই তিনি গীতা রামায়ন ও মহাভারত পড়ে শেষ করেন। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর তিনি বাইবেল এবং তালমুদ পাঠ করেন। এরপর তিনি মাওলানা আশফাকুল আলম কান্ধলভী রহঃ এর নিকট তিরমিযী এবং মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিক রহঃ পাঠ শেষ করেন। এসমস্ত বই থেকে তিনি প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে জিহাদের উপর বই লিখতে শুরু করেন। সেই বই এ ছিল, ইসলামী জিহাদের কারণ,উদ্দেশ্য ও ব্যপ্তি বর্ণনা করেন। তিনি সেখানে প্রমাণ করেন, “ইসলামী জিহাদ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার পথে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সুসংগঠিত এবং ধারাবাহিক প্রচেষ্ঠা। এটা কখনই কোন হিংসাত্নক এবং অন্যায় রক্তপাত ঘটায় না। ইসলামী জিহাদ মজলুম মানবতার রক্ষা কবচ, কোনো গোপন সন্ত্রাসী তৎপরতা নয়। এটা উন্নতি ও অগ্রগতির নিয়ামক শক্তি, পর্দার আড়ালের কোন কাজ নয়। এ জিহাদ যুদ্ধ ও শান্তির ইসলামী নীতি। মুসলিম মুজাহিদরা তো দুশমনদের রক্ষাকারী ও আশ্রয়দাতা হিসেবেই অন্য ভূখন্ডে পদানত করে। যুদ্ধবন্দিদের মানবাধিকারের ব্যাপারে ইসলাম আপোষহীন এবং অতুলনীয়। ইসলামের মুজাহিদরা তো নারী-শিশু-বৃদ্ধ এবং রোগীদের কিছু বলবে না এবং সাথে সাথে ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে”।
সেই বিখ্যাত বইটির নাম “আল জিহাদ ফিল ইসলাম” এবং এই বিখ্যাত বইটির লেখক উপমহাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী রহঃ। এই বইটি প্রকাশিত হবার পরই আল্লামা ইকবালের সাথে উস্তাদ মওদূদী রহঃ এর পরিচয় ঘটে। সেই সময়ে নিখিল ভারতের একজন বিখ্যাত আলেম উস্তাদ মওদূদী রহঃ সম্পর্কে বলতে গিয়ে আল্লামা ইকবালের একটি কবিতার উদাহারণ প্রদান করেন। সেই কবিতার বাংলা তরজমা করলে দাড়ায়,
“ সকল দিকেই মু’মিনের নবীন প্রাণের বান
কথা আর কাজে যে আল্লাহতে পূর্ণপ্রাণ।
এ রহস্য কেহই জানে না
দৃশ্যতঃ সে ক্বারী, বাস্তবে কুরআন”।
উল্লেখ্য উস্তাদ আবুল আ’লা মওদূদী রহঃ এর এই বইটি তখন গোটা ভারত বর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। আর এটি গোটা ভারতবর্ষে ছড়ানোর গুরু দায়িত্বপালন করে তৎকালীন দেওবন্দ আলেমগন। অথচ পরবর্তি সময়ে এই দেওবন্দ আলেমগণ উস্তাদ মওদূদীকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। যা এখনও কোন কোন ক্ষেত্রে শোনা যায়। বাস্তবিক অর্থে যা খুবই দুঃখজনক। একজন ব্যক্তির ভুলত্রুটি থাকতেই পারে! কিন্তু সেই অপরাধে তাকে কাফির বলা সমুচীন নয়।
অন্যদিকে উস্তাদ মওদূদী রহঃ কে জামায়াত ইসলামের দলীয় সম্পদে পরিনত করাকেও বিচক্ষনতার কাজ বলে মনে করিনা! কারণ তিনি এমনই একজন ব্যক্তিত্ব এবং আলেমেদ্বীন যিনি গোটা মুসলিম বিশ্বের সম্পদ। গোটা মুসলিম উম্মাহর সম্পদ। উস্তাদ মওদূদী রহঃ সম্পর্কে বলতে গিয়ে শহীদ হাসানুল বান্না বলেছিলেন, “শায়খ আমাদের ওস্তাদ! তিনি আমারও ওস্তাদ”।
একটা ছোট্ট ঘটনা বলি! পাশের এক কওমী মাদ্রাসার উস্তাদ যার সঙ্গে আমার দেখা এবং কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তার কথায় স্পষ্ট প্রকাশ পেল তিনি উস্তাদ মওদূদী রহঃ এর বই পড়েন না এবং কাউকে পড়তেও দিবেন না। যুক্তি হিসেবে বলেন, ফেতনা ছড়িয়ে পড়বে তাই! আমি অবাক হলাম! তিনি না পড়েই সিদ্ধান্তে পৌছে গেছেন যে, তার বই পড়লেই ফিতনা ছড়িয়ে পড়বে! তখন বুদ্ধি করে তার হাতে উস্তাদ মওদূদী রহঃ ‘খেলাফত ও রাজতন্ত্র’ বইটা পড়তে দিলাম। আর ব্লইটি দেবার আগে লেখকের নাম লেখা অংশটি ছিড়ে ফেললাম। কয়েকদিন পর সেই উস্তাদ বললেন, ভাই! আপনি এই বই কোথায় পেয়েছেন? আমি আগে কেন এই বই পড়িনি? এটা তো আমাদের সবারই পড়া উচিত! সবার হাতে হাতে পৌছানো উচিত। আমি তাকে বললাম, বইটির লেখক কে জানতে চাইবেন না? উনি আগ্রহ নিয়ে বললেন, কে লেখক? বললাম, উস্তাদ সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী রহঃ। তাকে আরও বললাম, বইটিতে যদি লেখকের নাম থাকতো তাহলে আপনি ভুল ধরার প্রবনতা নিয়ে বইটি পড়তেন! যার কারণে বইটির মূল আলোচনাটি আপনার মাথায় জায়গা পেত না!
উস্তাদ মওদূদী রহঃ সম্পর্কে যাদের চুলকানী আছে, আমার মনে হয় তাদের অধিকাংশরই উপরের বর্ণিত উস্তাদের মত অবস্থা! বিভক্তি নয় ঐক্য চাই। গালাগালি নয়, ভালোবাসা চাই। কাফের ফতোয়া নয়, দ্বীনা ভাইয়ের মোয়ামেলাত কামনা করি।
বিষয়: বিবিধ
১৭৭৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আচ্ছা ভাই এই কাফের ফতোয়ার কোন দালিলিক প্রমাণ কি আপনার নিকট আছে?
নাকি আপনি শুনে শুনেই ওলামায়ে দেওবন্দের বিরোধীতায় লিপ্ত?
আমি জানি আলেমদের অনেক মতানৈক্য রয়েছে, থাকবে, কিন্তু মতানৈক্যের কারণে কাফের বলা এই প্রথম শুনলাম।
ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন