ইরান তোমাকে স্যালুট। পৃথিবীকে উপহার দিয়েছো, সুস্থ চলচিত্র।

লিখেছেন লিখেছেন শাহমুন নাকীব ফারাবী ১১ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০৩:৪১ দুপুর

আমার জন্মহয় একটি ইসলামী রক্ষণশীল পরিবারে। যেখানে টিভি দেখা কিংবা ক্যাসেটে বাজিয়ে গানশোনাটা খুব খারাপ কাজ বলে গণ্য হয়ে থাকে। আমরা ভাই বোনেরা বড় হবার সাথে সাথে টিভির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকি। আশে পাশের যেসব বাসায় টিভি ছিল আমরা সেখানে দেখতে যেতাম। এদিকে আব্বার সামর্থ থাকা স্বত্বেও তিনি টিভি কিনতে পারছিলেন না। কারণ, আমার দাদী এতে ভীষণ রাগ করবেন এবং কষ্ট পাবেন। আবার ওদিকে আব্বার ছেলে মেয়েরা বাহিরে বেশি ঘুরাঘুরির অভ্যাস করে ফেলছে। এসব কিছু ভেবে আব্বা দাদীকে বুঝিয়ে টিভি কেনার ব্যবস্থা করে ফেললেন। ২০০১ সালে আমাদের বাসায় প্রথম টিভির প্রবেশদ্বার উন্মোচিত হয়। টিভি কেনা হলেও আমরা পরিবারের সবাই এক সঙ্গে বসে কোনদিন টিভি দেখিনি। সম্ভবত ২০০৩ সালের এক রাতে আমরা সবাই খেতে বসেছি। আব্বা বললেন, রাত ১০ টার ইংরেজি সংবাদের পর বিটিভিতে একটি সিনেমা দেখানো হবে। আমি তোমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সেই সিনেমাটা দেখব। আমরা তো অবাক। যে আব্বা রাত ১০ টার পর টিভি চালানো হারাম করে দিয়েছেন তিনি কিনা আজ আমাদের সঙ্গে টিভি দেখবেন।

আমরা সবাই আব্বা আম্মাকে ঘিরে গোল হয়ে টিভির সামনে বসে পড়লাম। ইংরেজি সংবাদের পর শুরু হল সিনেমা। সিনেমাটির নাম,চিলড্রেন অব হেভেন।



ইরানী ছায়াছবি। ছবিটির কাহিনী আবর্তিত হয় আলী এবং জারা নামের দুই ভাই বোনকে ঘিরে। তারা ইরানের একটি অখ্যাত গ্রামে বাস করে। একদিন আলী তার ছোটবোন জারার জুতা পরে স্কুলে যায়। কিন্তু পথিমধ্যে সে জুতা খুলে আলুর দোকানে আলু কিনতে যায়। আর সেখানেই ঘটে বিপত্তি। সেই দোকান থেকে এক অন্ধ ফকির বের হবার সময় ভুল করে আলীর জুতা গুলো নিয়ে যায়। এই জুতো কে ঘিরেই শুরু হয় কাহিনী!

আলীদের সংসারে টানাপড়ন সব সময় লেগেই আছে। তাদের বাবা খুব স্বল্প আয়ের একটি কাজ করে। সেটা দিয়ে সংসারের কিছুই হয় না। পাঁচ মাসের ঘরভাড়া বাকি রয়েছে সেইসাথে ‍মুদীর দোকানেও অনেক টাকা বাকি পড়েছে। অন্যদিকে আলীদের মা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। জুতা হারানোর ঘটনা আলী জারাকে খুবই অনুনয় বিনয়েল সাথে বলে এবং জারাকে অনুরোধ করে যাতে জারা তার মা-বাবাকে না বলে দেয় । জারা কথা দেয় যে সে জুতা হারানোর কথা কাউকে বলবে না । অভাবের সংসারে কেটে যায় আলী ও জারার পড়াশোনা । কিন্তু আলী ভাবে জারা কিভাবে স্কুলে যাবে কারন আলীর বিশাল সাইজের ছেড়া একজোড়া সাদা জুতো আছে যা জারা পায়ে কোন ভাবেই ফিট হবে না । অন্যকোন উপায় না পেয়ে জারা সেই জুতাটি পড়তে রাজি হয় কারন সে আলীকে কথা দিয়েছে কাউকে কিছু বলবে না এবং কয়েকদিন পড়েই জারা একটি গোলাপী রংয়ের নতুন জুতা পেতে যাচ্ছে এই আশায় ।



শুরু হয় একই জুতা পড়ে দুই ভাই-বোনের স্কুলে যাওয়া এবং আসার যুদ্ধ । প্রতিদিন সকালে জারা সেই জুতো পড়ে স্কুলে যায় এবং স্কুল ছুটির পর জারার বন্ধুরা যখন স্কুলের মাঠে খেলাধুলায় মেতে উঠে জারা তখন তার ভাই আলীর কথা ভেবে এক দৌড়ে ছুটে আসে বাড়ি কারন আলী তার অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে । জারা তার পা থেকে সেই ছেড়া বিশাল সাইজের নোংরা জুতোটি যখন খুলে আলীকে দেয় আলী সেটি পড়ে দেয় এক দৌড় কারন আলীর ক্লাস শুরু হয়ে গেছে । স্কুলে আসা যাওয়ার এই দৌড়াদৌড়িতে আলী প্রায় প্রতিদিনই দেরি করে স্কুলে প্রবেশ করে কারন জারা আসলেই আলী একই জুতো পড়ে স্কুলে আসার সুযোগ পায় । স্কুলের মাস্টার বিষয়টি অনুধাবন করতে পারে এবং আলীকে বিষয়টি সম্পর্কে কঠোর দিকনির্দেশনা দেয় । আলী বুঝে উঠতে পারে না কিভাবে সে এ ব্যাপারটি সামাল দেবে । অন্যদিকে জারা আলীর উপড় বিরক্ত হয়ে তার বাবাকে বলে দিতে চায় কিন্তু জারা বলতে পারে না কারন আলী জারাকে নতুন একটি গোলাপী রংয়ের জুতা দেওয়ার আশ্বাস দেয় ।

একদিন আলীর হাতে একজোড়া জুতো জিতে নেওয়ার একটি সুযোগ আসে । আলী স্কুলে দৌড় প্রতিযোগীতায় নাম লেখায় । এই দৌড় প্রতিযোগীতায় জিততে পারলে আলী পাবে ৩য় পুরুস্কার হিসেবে এক জোড়া জুতো । সুতরাং আলীর টার্গেট ৩য় স্থান দখল করা । কারন জারাকে সে কথা দিয়েছে এক জোড়া জুতে কিনে দেবে । এই প্রতিযোগীতায় জেতার জন্য আলী জীবন বাজি রেখে এক দৌড় দেয়। দৌড়ে জেতার জন্য আলীর টার্গেট ছিল ৩য় স্থান কিন্তু আলী প্রথম হয়ে যায় । ছবির শেষ দিকে দেখা যায় আলীর বাবার একটি নতুন সাইকেল, দুজোড়া নতুন জুতো।



এই অসাধারণ ছবিটি আমার জীবনে দেখা বেষ্ট ছবি। কারণ, খুব সাধারণ একটি ঘটনাকে এতোটা নিখুঁত এবং ড্রামাটিকভাবে উপস্থাপন করাটা সহজ কাজ নয়। আর এরকম হাজারো আলী এবং জারা আমাদের বাংলাদেশে রয়েছে। কিন্তু সেসব কখনোই আমাদের বাংলা সিনেমায় উঠে আসে না। বাস্তবতার সাথে সামঞ্জতা থাকলে ছবিযে ব্যবসা সফল হতে বাধ্য তা দেখিয়ে দিয়েছেন মনপুরা সিনেমাটির মাধ্যমে। অর্ধনগ্ন না হয়ে কোমর না দুলিয়ে ছবি কে কান পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করা যায় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ইরানের চলচিত্র নির্মাতারা। জয় হোক,সুস্থ চলচিত্রের। জয় হোক, শালীন সংস্কৃতির।

বিষয়: বিবিধ

১৩৮০ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

365315
১১ এপ্রিল ২০১৬ দুপুর ১২:৫২
শফিউর রহমান লিখেছেন : কাহিনী হিন্দী মুভির কপি নয়তো?
রক্ষণশীল মুসলমান কি? মুসলমানতো মুসলমানই। যে ইসলামের যত শতাংশ মানে সে তত শতাংশ মুসলিম আর যত শতাংশ মানে না তত শতাংশ মুসলিম নয়।
365354
১১ এপ্রিল ২০১৬ বিকাল ০৪:১৬
কুয়েত থেকে লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ আপনাকে সুস্থ সাংস্কৃীতির ধারা বজায় রেখে সিনামা তৈরী করলে যেমন উপকৃত হবে জাতি তেমনি্উপকুত হবে ইসলাম কিন্তু কে করবেন
365366
১১ এপ্রিল ২০১৬ বিকাল ০৪:৫৭
বিবর্ন সন্ধা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম

এমন বাবা মা ই তো প্রতিটি পরিবারে থাকা উচিত।
365409
১১ এপ্রিল ২০১৬ রাত ০৯:০১
শেখের পোলা লিখেছেন : অনেকের ধারণা টিভি মানেই খারাপ কিছু৷ তাদের এ গোঁড়ামো দূর হোক৷ ধন্যবাদ৷
365512
১২ এপ্রিল ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:৫৩
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন : এই ছবিটা অনেকবার দেখেছি। চমৎকার একটা মুভি। আমার বাড়িতে পিচ্ছিরা এটা দেখার জন্য পাগল। অন্য কিছু দেখার চাইতে এটা দেখতে চায় বেশি। আলহামদুলিল্লাহ্।
জাযাকাল্লাহু খাইর

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File