মাওলানা মওদূদীর নামে আনিত অভিযোগ এবং কিছু কথা.......
লিখেছেন লিখেছেন শাহমুন নাকীব ফারাবী ৩১ মার্চ, ২০১৬, ০১:০৯:১১ রাত
সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী উপমহাদেশের অন্যতম আলোচিত এবং সমালোচিত নাম। এক শ্রেণীর মানুষের কাছে তিনি একটি আলোকিত প্রদীপ। আবার এক শ্রেণীর মানুষের কাছে তিনি বিতর্কিত ব্যক্তি। এই আলোচিত ব্যক্তি মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে ভারতের হায়দরাবাদ দাক্ষিণাত্যের শহর আওরঙ্গাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। যে কারো জীবনী পড়লে প্রথমেই দেখতে পাই, "তিনি একটি সম্বান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন" এমন বাণী জুড়ে দেয়ার রেওয়াজ। তাই সম্বান্ত মুসলিম পরিবার শব্দগুলো একটা হাস্যকর উপমায় পরিণত হয়েছে। তারপরও লিখতেই হচ্ছে সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী (রহঃ) একটি অত্যন্ত সম্বান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার ভারতের দক্ষিণাত্যের (বর্তমান মহারাষ্ট্র) আওরঙ্গাবাদে সাইয়েদ আহমদ হাসানের (১৮৫৫-১৯২০) ঐরসে এবং রোকেয়া বেগমের গর্ভে জন্মলাভ করেন।
তের-চৌদ্দশত বছর ধরে ইসলামী দাওয়াত, দ্বীনি শিক্ষা দীক্ষার কাজে অব্যাহতভাবে শ্রম দিয়েছে আহলে বাইতের এমন একটি সুপ্রসিদ্ধ ও সম্বান্ত শাখায় তার জন্ম। ভারতীয় চিশতীয়া তরিকতের সবচেয়ে বুযুর্গানে দ্বীন, প্রধান বা বড় পীর হিসেবে পরিচিত খাজা কুতুবুদ্দিন মওদূদ চিশতী (রহঃ) (১০৩৯-১১৩৩ হিজরী) এবং নামকরা বুজুর্গ মাওলানা আবু আহমদ আবদাল চিশতী (রহঃ) (মৃতু্য:৯৬৫ ইসায়ী) এ খান্দানেরই সন্তান। যুগ যুগ ধরে এ খান্দান ধর্মীয় অনুশাসন পালনরে পাশাপাশি ধর্মীয় নেতৃত্ব দিয়ে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করে।
আদর্শ বাবার সংস্পর্শে শৈশবেই মওদূদী (রহঃ) দ্বীনি এলেমসহ ইসলামী আদব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তার বাবা একজন উকিল হলেও মিথ্যা ও অন্যায়ের পক্ষে কেস গ্রহণ না করায় এবং ইবাদত ও কৃচ্ছতা সাধনের সহজ সরল সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত হওয়ায় ওকালতিতে সময়দানের চেয়ে আলেম-ওলামাদের বৈঠকে সময় দেয়াটাকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন। আলেম-ওলামাদের এসব বৈঠকে তিনি নিয়মিত একান্ত প্রিয় সন্তান মওদূদীকে (রহঃ) নিতেন তালিম দেয়ার জন্য।
পিতার সাহচর্যে তিনি কুরআনের ছোট ছোট সূরাগুলো মুখস্ত করেন, শিখে ফেলেন আরবী ও উচ্চাঙ্গের উর্দু ভাষা। তার শিক্ষার প্রথম দিন থেকেই উর্দু, ফারসী, আরবী, ফিকাহ ও হাদীসের শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করেন তার বাবা। সন্ধ্যাগুলো তার কাটতো বাবার মুখে নবী-রাসুলদের (আ) কাহিনী শুনে, দ্বীনের মহা-মনীষীদের জীবন গাঁথা শুনে। ফলে অল্প বয়সেই দ্বীনি আকায়েদ, আদাবে জীন্দেগী, শিক্ষা প্রভৃতি তার কোমল হৃদয়ে গেঁথে ফেলেন।
মূলত শিশু মওদূদীর (রহঃ) শিক্ষাগুরু ছিলেন তার বাবা। তার চাল-চলনে কোন ত্রুটি দেখলেই তৎক্ষনাৎ তিনি তা সংশোধনের চেষ্টা চালাতেন, এমনকি সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত তিনি এ কাজে লেগেই থাকতেন। ফলে শৈশবেই তিনি চমৎকার চারিত্রিক মাধুর্য অর্জন করেন।
শৈশবে মওদূদী (রহঃ) গৃহপরিচারিকার ছেলেকে মেরেছিলেন একবার। সাথে সাথে বিষয়টি তার বাবার নজড়ে পড়ে যায়। অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হলেন তিনি। কিছুতেই সন্তানের এহেন আচরণ মেনে নিতে পারলেন না। তিনি তৎনাৎ গৃহপরিচারিকার ছেলেকে ডেকে পাঠান। ছেলেটিকে তিনি নির্দেশ নিলেন একইরূপ মার দিতে মওদূদীকে (রহঃ) যেমন মার তিনি দিয়েছিলেন গৃহপরিচারিকার সন্তানকে। এ শিক্ষা মওদূদীর (রহঃ) জীবনে এমন প্রভাব ফেলে যে আমৃতু্য তিনি আর কখনো তার অধিনস্ত কোন ভৃত্য কিংবা কর্মচারীর গায়ে হাত তোলেন নি।
মাওলানা মওদুদী, বা শাইখ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন মুসলিম গবেষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা ও বিংশ শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। তিনি তার নিজ দেশ পাকিস্তানের একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তিনি জামায়াতে ইসলামী নামক একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলেরও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন ২০ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম স্কলারদের মধ্যে একজন। তিনি ইতিহাসের দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ ব্যক্তি যাহার গায়েবানা জানাজার নামাজ পবিত্র কাবাতে পড়া হয়।
এই আলোচিত ব্যক্তির নামে একটি গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে তিনি সাহাবায়ে (রাঃ) কেরামদের নামে কুলষতা দিয়েছেন। যা অনেক দরবারি আলেমরা বলে থাকেন। কিন্তু এই বিষয়ে সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী সাহেব কি বলেছেন তা ইতিহাসের পাতায় তেমন একটা পাওয়া যায় না কিংবা খোঁজও করা হয় না।
১৯৬৮ সালের ১১ মে রাওয়ালপিন্ডিতে এক ছাত্র সমাবেশে , এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। তখন মাওলানা মওদূদী সাহেব জবাবে বলেছিলেন, যেহেতু প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছে তাই এই ব্যাপারে আমি কয়েকটা কথা বলে দিচ্ছি। প্রকৃতপক্ষে , আমি এইসব প্রশ্নের উত্তর দেই না। কারণ আমি জানি যে, এগুলো আমার ব্যাপারে অসুন্তুষ্টির মূল কারণ নয়। বরং অসুন্তুষ্টির মূল কারণ অন্য কিছু। এদিক সেদিস থেকে এই অভিযোগ গুলো উত্থাপিত হয়েছে যেন বিশ্ববাসী মনে বিশ্বাস জন্মে যে, আমরা ব্যক্তিগত কারণে এই লোকটির বিরোধীতা করছি না। বরঞ্চ মৌলিক বিষয়ের সাথে সাংঘর্ষিক বলেই বিরোধীতা করছি। এ ব্যাপারে প্রথমেই বুঝতে চেষ্ঠা করুন যে, এক ভ্যক্তি তার শত শত বাক্য দ্বারা নিজের চিন্তা এবং দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। এখন সেখান থেকে একটি বাক্য বা একটি বাক্যাংশ কে সামনে এনে তার দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্ঠাকে হঠকারী কাজ ছাড়া আর কিছু বলা চলে না।
আপনারা দেখবেন যে, আমার রচিত তাফহীমুল কুরআন বর্তমান আছে। তাতে আমি যেখানে ফেকহার মাসয়ালা বা দ্বিনী মাসয়ালা সংক্রান্ত আলোচনা করেছি সেখানেই দেখবেন সাহাবায়ে কেরামদের বক্তব্যকে আমি দলীল হিসাবে উপস্থাপন করেছি। যেখানে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) দের আলোচনা এসেছে সেখানেই আমি বলেছি, “এই ধরা পৃষ্ঠে রাসূল (সাঃ) এর সাহাবায়ে কেরামদের মত মানুষ কখনও জন্মেনি। সমগ্র মানব জাতির মধ্যে উৎকৃষ্টতম দল হিসেবে একমাত্র সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) কেই চিন্হিত করা যেতে পারে। আপনারা তাফহীমুল কুরআনে দেখে থাকবেন আমি বিভিন্ন মাসয়ালার সূত্র হিসেবে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এর বক্তব্য বর্ণনা করেছি। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) সম্পর্কে নেতিবাচক বা বিষাদগার করা ব্যক্তির পক্ষে কি উল্লেখিত কাজ গুলো করা সম্ভব?
যেসব ঘটনা ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত, সেই সব্ ঘটনা বর্ণনা করা যদি গুনাহ এর কাজ হয়ে থাকে, তাহলে অনেক মুহাদ্দিস মুফাচ্ছির (রহঃ) এই গুনাহের কাজ করেছেন। স্বয়ং পবিত্র কুরআনে সাহাবী (রাঃ) দের কিছু কিছু ভুলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সূরা জুময়াতে বলা হয়েছে, “ রাসূল (সঃ) খুৎবা দিচ্ছিলেন, এমন সময় একদল ব্যবসায়ী সেখানে উপস্থিত হলো,মাত্র ১২ জন সাহাবী ছাড়া বাকিরা সবাই খুৎবার স্থল থেকে উঠে ব্যবসায়ীদের নিকট চলে গেল”। এই ঘটনা বর্ণনার জন্য আপনি কি আল্লাহকে দোষ দিবেন? ( নাউযুবিল্লাহ)
ওহুদ যুদ্ধে ৫০ জন সাহাবী (রাঃ) এর আদেশ অমান্য করার ইতিহাসতো সব তাফসিরকারক প্রকাশ করেছেন। তাহলে তারা কি দোষি হবেন? আল্লাহপাক সাহাবীদের এইসব ভুলগুলো উল্লেখ করে মানুষকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, সাহাবী (রাঃ) রাও রক্তে মাংসে গড়া সাধারণ মানুষ ছিলেন। [ সূত্রঃ ছাত্র ও যুব সমাজের মুখোমুখি মাওঃ মওদূদী, পৃঃ১০৫-১০৬]
মাওলানা মওদূদী বলেছেন, যারা বিরোধীতার খাতিরে আমার বিরোধীতা করে থাকে তাদের জন্য আমার কিচ্ছু বলার নেই। আমি শুধু বলব, তাদের নামে আমি আল্লাহপাকের দরবারে মামলা দায়ের করলাম। তিনিই উ্ত্তম ফয়সালাকারী।
আমার নিজের আর একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি, কিছুদিন আগে বড় ভাই এর নেতৃত্বে, এক আলেমের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গেলাম। তিনি আবার মওদূদী সাহেবের নামই শুনতে পারেন না। তিনি মওদূদী সাহেবের নামে অভিযোগের ফিরিস্তি পেশ করলেন। বড় ভাই সেই আলেমকে মওদূদী সাহেবের “খেলাফত ও রাজতন্ত্র” পড়তে দিলেন। বইটি দেবার আগে লেখকের নামটা ছিড়ে ফেললেন। সপ্তাহ খানেক পর সেই আলেমকে জিজ্ঞেস করা হল, বইটা কেমন লেগেছে? মুহতারাম আলেম বললেন, এক কথায় অসাধারন একটা বই। এরকম নিঁখুত বিশ্লেষন খুব কম বইতেই পাওয়া যায়। এই বইটা তো আমার আরও আগে পড়া উচিত ছিল। তখন বড় ভাই বললেন, প্রিয় ভাই! বইটার লেখক মাওঃ মওদূদী সাহেব। বইটা দেবার আগে লেখকের নাম বলতাম, তাহলে আপনি বইটা পড়েও দেখতেন না। আর পড়লেও ভুল ধরবার মানষিকতা নিয়ে পড়তেন।
মাওলানা মওদূদী সাহেবের সমালোচনায় মুখর অনেক বই বাজারে পাওয়া যায়। অনেকে সেসব বই পড়েই মাওলানা মওদূদী সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌছে যান। কিন্তু প্রিয় ভাই! তার বিরোধীতা মুখর বইগুলো যখন কষ্ট করে পড়তে পেরেছেন এবার আরও একটু কষ্ট করে মাওলানা মওদূদী সাহেবের বইগুলো পড়ুন,ভুল বের করুন তারপর সরাসরি বিরোধীতা করুন। এতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে সরাসরি দৌড় না দিয়ে নিজে একবার নিজের কানটাকে পরখ করে নিন।
বিষয়: বিবিধ
২০২৬ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যারা বিরুধিতা করেন তারা যদি চিন্তায় সৎ ও তাকওয়াদারি (আল্লাহ কে ভয়কারি) হতেন তাহলে মওদূদী সাহেবের এই কথায় তাদের বুক কেঁপে উটতো "যারা বিরোধীতার খাতিরে আমার বিরোধীতা করে থাকে তাদের জন্য আমার কিচ্ছু বলার নেই। আমি শুধু বলব, তাদের নামে আমি আল্লাহপাকের দরবারে মামলা দায়ের করলাম। তিনিই উ্ত্তম ফয়সালাকারী।"
জাযাকাল্লাহ খায়ের
জামায়াতের বিরোধিতা কত প্রাচীন এবং বিরোধীরা কতটা বিদ্বেষ পোষণ করেন তার একটা নমুনা এখানে দেখুন-
‘জামা’তে ইসলামী’তে আমার যোগদান অসম্ভব কেন?
মন্তব্য করতে লগইন করুন