ফাঁসির পূর্ব মুহূর্তে জগতের কতক বীরের অভিব্যক্তি এবং শেষ কথা.........

লিখেছেন লিখেছেন শাহমুন নাকীব ফারাবী ২৪ নভেম্বর, ২০১৫, ১২:৩৬:৩২ দুপুর

প্রতিটি ফাঁসির ঘটনাই মিডিয়াতে সবচেয়ে হট টপিক হিসেবে বিবেচিত হয়। আর এই আলোড়ন এর ছোঁয়া সাধারণ মানুষের মাঝেও পৌঁছে যায়। তাদের আগ্রহের কেন্দ্রস্থলে থাকে ফাঁসির পূর্ব মুহূর্তে দন্ডিত ব্যক্তিরা কি করে কিংবা কি বলে! আর সেই ফাঁসি যদি হয় কো আদর্শবাদী দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতার কিংবা ব্যক্তিদের তাহলে মানুষের আগ্রহটা আরও কয়েকগুন বৃদ্ধি পেয়ে যায়। মানুষ জানতে চায়, এই আদর্শবাদী নেতারা ফাঁসির পূর্ব মুহূর্তে কি হাউমাউ করে কঁদেছিলেন নাকি বীর দর্পে ফাঁসির রসি গলায় পরেছেন! জীবনের শেষ বেলায় এসে এই ব্যক্তিরা কি বলেছিল?

সেরকমই কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি যাদেরকে শুধুমাত্র আদর্শিক কারণে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে, তাদের জীবনের পূর্ব মুহূর্তের অভিব্যক্তিগুলো লেখার চেষ্ঠা করছি।

মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমুন দলের নেতা সাইয়্যেদ কুতুব (রহঃ) কে ১৯৬৬ সালে মিশরের স্বৈরাচারি সরকার জামাল আবদেল নাসের এর সময়ে ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২৫ আগষ্ট সাইয়্যেদ কুতুব (রহঃ) কে ফাঁসি দেয়া হয়। ফাঁসির পূর্ব মুহূর্তে তিনি বলেছিলেন, “ আমি এই মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছি। আমি যেভাবে বেঁচে আছি তেমন ভাবে আগে কখনো বাঁচিনি।ঈমানের মানে আমি বুঝতে পারছি। আমি শাহাদাতের জন্য অপেক্ষা করছি। এর চাইতে ভালোভাবে আর কখনো বাঁচিনি ”।

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী। কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে একটি বই লেখার কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত করে। যদিও পরবর্তিতে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ফলে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করতে পারেনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। ফাঁসির রায় শুনেও যিনি ছিলেন পাহাড়ের মত অটল। ফাঁসির পোশাক পরিধান করার পর যাকে সরকারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি বলেছিলেন, “হায়াত আওর মওত কা ফয়সালা আসমান পর হোতা হ্যায়, জমিন পর নাহী। ইস্ বাতিল হুকুমতকে সামনে মাফী মাঙ্গনে কা মতলব হীয়ে হ্যায় কেহ, আল্লাহর মুঝে শাহাদত জেসী উচ্চ মরতবা দেনা চাহ্তো হেঁ, আওর মাই উস্ছে রুগর দানী কারবাহা হোঁ”। অর্থাৎ জীবন ও মৃত্যুর ফয়সালা আসমানে থেকে হয়; জমিন থেকে নয়। এই জালিম সরকারের কাছে ক্ষমা চাওয়ার অর্থ হলো আল্লাহ আমাকে শহীদের মর্যাদা দিতে চান আর আমি তা প্রত্যাখ্যান করতে চাচ্ছি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমন করার পর প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন দির্ঘদিন পলাতক ছিলেন। এরপর ২০০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিনি আমেরিকান সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন। এরপর মার্কিনিদের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি নামকওয়াস্তে বিচারিক আদালতে সাদ্দাম হোসেনকে ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত করা হয়। ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৬টা ৬ মিনিটে সাদ্দাম হোসেনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ইরাকে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ফাঁসির পূর্ব মুহূর্তে বলেছিলেন, “ প্রিয় বিশ্বাসী জনগণ! আমি তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কিন্তু আমি থাকব পরম করুনাময় আল্লাহর সঙ্গে। তাঁর কাছে যারা আশ্রয় চান তিনি তাদের সাহায্য করেন এবং কখনোই কোন বিশ্বাসীকে নিরাশ করেন না। আল্লাহ মহান..........আল্লাহ মহান। আমাদের জাতি দির্ঘজীবি হোক। আমাদের সংগ্রামী জনগণ দির্ঘজীবি হোক। ইরাক দির্ঘজীবি হোক। প্যালেষ্টাইন দির্ঘজীবি হোক। জিহাদ এবং মুজাহেদিন দির্ঘজীবি হোক”।

২০০১ সালে ভারতের পার্লামেন্টে সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগে আফজাল গুরুকে গ্রেফতার করা হয়। আফজাল গুরু ছিলেন ভারতের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের নেতা। কিন্তু শুধুমাত্র মুসলিম এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার কারণে তাঁকে সেই হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয়। ২০১৩ সালের ফেব্রয়ারীতে তিহার কারাগারে আফজাল গুরুকে ফাঁসি দেয়া হয়। ফাঁসির পূর্ব মুহূর্তে তিনি বলেন,“ আমাকে এই অবস্থানে উঠানোর জন্য আল্লাহপাককে শতকোটি শুকরিয়া জানাই। সকল বিশ্বাসীকেও আমার অভিনন্দন জানাই। কারণ, আমরা সবাই একসঙ্গে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছি এবং আমাদের শেষটাও হতে হবে সত্য ও ন্যায়ের পথে। আমার পরিবারে প্রতি অনুরোধ, আমার মৃত্যুতে শোকার্ত না হয়ে, তাদের উচিত হবে আমি যে অবস্থান অর্জন করেছি তাকে শ্রদ্ধা করা। আল্লাহ তোমাদের সবচেয়ে বড় রক্ষাকর্তা ও সাহায্যদাতা। আল্লাহ হাফেজ”।

আব্দুল কাদের মোল্লা। যাকে যুদ্ধাপরাধী অভিযোগে ২০১০ সালে গ্রেফতার করা হয়। এরপর একটি ত্রুটপূর্ন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তাঁকে ফাঁসি দেয়া হয়। ফাঁসির পূর্ব মুহূর্তে তিনি পরিবারের উদ্দেশ্যে বলেন,“ সত্যপথে মৃত্যুবরণকারীদের আল্লাহর কাছে অতি উচ্চ মর্যাদার কথা আল্লাহ স্বয়ং উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ নিজেই যদি আমাকে জান্নাতের আসনে বসাতে চান তাহলে আমার এমন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। কারণ জালেমরে হাতে অন্যায়ভাবে মুত্যুতো জান্নাতের কনফার্মড টিকেট। যদি সম্ভব হয় তাহলে মহল্লার মসজিদে এবং বাড়িতে জানআযার ব্যবস্থা করবে। পদ্মার ওপারের জেলাগুলোর লোকেরা যদি জানাযায় শরিক হতে চায় তাহলে আমাদের বাড়ির এলাকায় যেন আসে। তাদের অবশ্যই খবর দেয়া দরকার। কবরের ব্যপারে তো আগেই বলেছি আমার মায়ের পায়ের কাছে। কোন জৌলশপূর্ন অনুষ্ঠান এবং কবর বাধাইয়ের মত বেদআত যেন না করা হয়। সাধ্য অনুযায়ী এতিমখানায় কিছু দান খয়রাত করবে। ইসলামি আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার বর্গকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। বিশেষ কারে আমার গ্রেফতার এবং রায়ের কারণে যারা শহীদ হয়েছে। অভাব গ্রস্থ হলে সেই সকল পরিবার বর্গকে অগ্রাীধিকার ভিত্তিতে সাহায্য সহযোগিতা করবে”।

সবশেষে তিনি স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, “ পেয়ারী! হে পেয়ারী! তোমার এবং ছেলেমেয়েদের অনেক হকই আদায় করতে পারিনি। আল্লাহর কাছে পুরষ্কারের আশায় আমাকে মাফ করে দিও। তোমাদের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করছি। ইনশা আল্লাহ জান্নাতের সিঁড়িতে দেখা হবে”।

মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান। যাকে যুদ্ধাপরাধী অভিযোগে ২০১০ সালে গ্রেফতার করা হয়। এরপর একটি ত্রুটপূর্ন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে ২০১৫ সালের এপ্রিলে তাঁকে ফাঁসি দেয়া হয়। ফাঁসির পূর্ব মুহূর্তে মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান পরিবারের উদ্দেশ্যে একটি ছোট্ট চিঠি পাঠান।মুহাম্মদ কামারুজ্জামান যা লিখেছেন,

“১. ইসলামের বিধান মেনে চলবে।

২. পাঁচ ভাই এক থাকবে।

৩. মায়ের সেবা ও অাদেশ মানবে।

৪. পরামর্শ করে কাজ করবে।

৫. ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীল ও আমার বন্ধুদের সম্মান করবে।

৬.কোন অবস্থাতেই হারাম পথে উপার্জন করবে না ।

৭. রক্তের সম্পর্কের আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করবে।

৮. গরীব আত্নীয়দের সাহায্য করবে”।

আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদ। যাকে ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এরপর একটি ত্রুটিপূর্ন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে ২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর ফাঁসি দেয়া হয়। ফাঁসির পূর্ব মুহূর্তে তিনি বলেন,“ এ জালিম সরকারের কাছে আমার প্রাণভিক্ষা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই সরকার গত ৫ বছর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে মিথ্যা মামলা দিয়ে মিথ্যাচার করেছে। আজ এই শেষ মুহূর্তে এসেও তারা মিথ্যাচার অব্যাহত রেখেছে। মূলত আমাকে আমার দলের কাছে, আমার পরিবারের কাছে, দেশের মানুষের কাছে হেয় করার জন্য, কাপুরুষ বানানোর জন্য তারা এ মিথ্যা অপপ্রচারের নাটক করেছে”।

বিখ্যাত ব্যক্তি ভগবৎ সিং বলেছেন,“ ব্যক্তিকে সহজেই হত্যা করা যায়, কিন্তু আদর্শকে গত্যা করা যায় না। বড় বড় সম্রাজ্য ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে-কিন্তু আদর্শ টিকে থেকেছে”।

বিষয়: বিবিধ

২০৪০ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

351185
২৪ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:৪১
হতভাগা লিখেছেন : আহ্‌ ! এরকম সেন্স যদি ৭১ এ কাজ করতো !
২৪ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ১২:৪৮
291511
শাহমুন নাকীব ফারাবী লিখেছেন : সে সেন্স ছিল বলেই না আজ তাঁরা ফাঁসির মঞ্চে!
২৪ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০২:০৭
291535
হতভাগা লিখেছেন : সে সময়ে তাদের সেন্স কাজ করছিল নিরীহ বাংলাদেশী মুসলমানদের হত্যা করার । শেখ সাহেব ক্ষমা করে দেওয়ায় , জিয়া সুযোগ দেওয়ায় এবং খালেদা সাথে নেওয়ায় মনে করেছিল যে পার পেয়ে গেছে ।

পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না ।

হাসু বু জামায়াতীদের বুকে কাঁপনই ধরিয়ে দিয়েছেন ।
২৬ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০৯:৪৮
291933
শাহমুন নাকীব ফারাবী লিখেছেন : পাপটা প্রমাণিত করার পরই এমন কথা বলা সমুচিন নয় কি??
351193
২৪ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০১:১৫
অপি বাইদান লিখেছেন : প্রানভিক্ষা চেয়ে কুল পায় না............!!
২৪ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০৩:৫৯
291554
শাহমুন নাকীব ফারাবী লিখেছেন : সে কারণেই না প্রাণভিক্ষার আবেদন পত্র দেখাতে পারে না!
351220
২৪ নভেম্বর ২০১৫ দুপুর ০৩:৪৫
আফরা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ ।
২৬ নভেম্বর ২০১৫ রাত ০৯:৪৮
291934
শাহমুন নাকীব ফারাবী লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File