নীলাক্কাস

লিখেছেন লিখেছেন নিল রুদ্র ০২ জুলাই, ২০১৫, ০৪:৫১:০৬ বিকাল

নীলাক্কাস *** ডায়েরিটার উপরে এখনও রক্তের দাগ পড়ে আছে । ভিতরের অনেকগুলো পৃষ্ঠা ই রক্তের লাল রঙে রাঙানো । আলতো করে ডায়েরিটার পাতাগুলো উল্টাতে থাকে নীলাক্কাস । চোখের কোণায় কিছু রহস্য চিকচিক করে উঠে । . *** - হ্যালো, আক্কাস । - হ্যালো তিতা । - অই, আমারে তিতা বললি কেন? - তুই আমারে আক্কাস বললি কেন? - আমি তো মজা করে বলছি । - আমিও তো আদর করে বলছি । - রাখ তোর আদর । কী করছ তুই? - বাথরুমে, গান গাইতাছি । - ওয়াক, ছিঃ!! তুই বাথরুম সিঙ্গার? - এতে ঘেন্নার কি হইল? মনে রাখ বত্স, পৃথিবীর মহান গায়করা বাথরুম থেকেই গান গাওয়া শুরু করছে । - হ, তুই বললি আমি মনে রাখলাম । যেই না সুন্দর গলা ! এর চেয়ে কাউয়ার গানও উত্তম । - উত্তম হইলে উত্তম । তুই তাইলে কাউয়ার গান শুন । আমারে জ্বালাইছ না, ফোন রাখ । - এই রাখলাম ফোন । - অই wait. - আবার wait কেন? - আজ একটু ভাল করে সাজুগুজু করে পার্কে আসবি । - সাজগোজ করে পার্কে! কেন কেন? - আমি বলছি তাই । - তর মতলব ভাল না । ফোন রাখ । বলেই ফোনটা রেখে দিল তিথি । এতক্ষণ আকাশের সাথে কথা বলছিল । আকাশ তিথির বেস্ট ফ্রেন্ড । হাই স্কুল থেকেই বন্ধুত্ব তাদের । আজও আছে, ঠিক আগের মতই । . কিন্তু কয়দিন যাবতই আকাশ তিথির প্রতি একটা দুর্বলতা অনুভব করতে থাকে । তিথির সব কিছুতেই তার ভাল লাগে । যেমন, তিথির সাথে কথা বলতে, তিথির দিকে এক নাগারে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকতে, তিথির বকবকানি শুনতে, কারণ ছাড়াই তিথির সাথে ঝগড়া করতে এরকম আরও অনেক কিছুই । আকাশ জানে না, এই ভাল লাগাই ভালবাসা কিনা? তবে সে এটা জানে, তিথিকে সে প্রচন্ড রকম ভালবেসে ফেলেছে । তাই আজ ঠিক করল, তিথিকে তার ভালবাসার কথা বলবে । এই জন্যই সাজগোজ করে আসতে বলা । . বিকাল চারটা বাজতেই আকাশ রেডি হয়ে বের হয়ে পড়ল পার্কের উদ্দেশ্যে । আজ একটা নীল পাঞ্জাবি পড়েছে সে । মাথার চুলগুলো অগোছালো করে রেখেছে, যাতে তিথি তার চুলগুলো গুছিয়ে দেয় । . সারে চারটা বাজতেই আকাশ পার্কে উপস্থিত হল । পার্কের কোণার বিড়াট কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় তিথি অপেক্ষা করছে । পড়নে হলুদ শাড়ি, হাতে নীল চূড়ি । আজ বড় মায়াবি লাগছে মেয়েটাকে । আকাশ তো তিথিকে দেখেই একটা টাস্কি খেল । মেয়েটাকে যত বার দেখছে ততই অপূর্ব লাগছে । . - কিরে তোর আসার সময় হল? - কেন? দেরি করে ফেলেছি? - না, দেরি কোথায়? চারটায় আসতে বলে এখন সারে চারটা বাজে । - সরি । - ওরে বাবা! তুই সরি বলছিস? এই আমি দিনের বেলা স্বপ্ন দেখছি না তো? - তুই স্বপ্নই দেখছিস । আমি তরে সরি বলমু? এই আমি? - হতেও পারে । তো, অবেলায় ডাকলি কেন? - ডাকতে কী মানা আছে? - অই, তর মতলবটা কীরে? আজ এত সুন্দর করে কথা বলতাছস? - দেখ, তোকে অনেকদিন যাবতই একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম । তবে বলার সাহস হয় নি । - কী বলবি? - আমি না, একটা মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছি । আমাকে হেল্প করবি দোস্ত? . কথাটা শুনেই তিথি কিছুটা থতমত খেয়ে গেল । কেমন একটা যন্ত্রনা অনুভব করতে থাকল মনের মধ্যে । তবুও আকাশ কষ্ট পাবে ভেবে জিজ্ঞাস করল - মেয়েটা কে? - মেয়েটা কে তুই ভালভাবেই চিনিস । - তুই কাকে ভালবাসিস. তাকে আমি চিনব কীভাবে? - আমি চেনাব, তুই চিনবি । - আচ্ছা! তাহলে মেয়েটা কে? - মেয়েটার নাম নুসাইবা জান্নাত । . তিথি নামটা শুনেই রাগে ফুলতে থাকল । অনেকক্ষণ সৈহ্য করেছে । আর না । আর বেশিক্ষণ থাকলে সে কেঁদেই দিবে । আকাশও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে । তাই আর কাঁদাতে চাচ্ছে না তিথিকে । তিথি উঠে যাবে, এমন সময়ই বলে উঠল - কিরে? মেয়েটাকে চিনছিস? - তুই কার না কার সাথে প্রেম করবি, তাকে আমি চেনার কি দরকার? - দরকার আছে । কারণ মেয়েটার ডাক নাম যে 'তিতা' । তখনই তিথির মনে পড়ে গেল, আরে আমার নাম তো নূসাইবা জান্নাত তিথি । তার মানে . . . - তিতা? মানে আমি? - হুম তুই । - তর সাথে প্রেম করমু আমি? আক্কাস কোন খানের! - তুই আমাকে আক্কাস বললি কেন? - সরি সরি, তুই আক্কাস না । - এই তো লাইনে আসছত । - তুই আক্কাস না । তবে তুই আজ থেকে নীলাক্কাস । নীলাক্কাস, নীলাক্কাস . . . . - নীলাক্কাস? - হুম । দেখ, এমনিতেই তুই আক্কাস, আর আজকে এই প্রথম তরে নীল পাঞ্জাবিতে দেখলাম । তাই আজ থেকে তুই নীলাক্কাস । - আমি নীলাক্কাস হইলে তুই তিতালুদ । - তিতালুদ! যাহ তর সাথে কথা নাই । - অই তিতা, রাগ করছ কেন? যাহ আমাকে যত বার ইচ্ছা নীলাক্কাস বলে ডাক । কিচ্ছু বলব না । - নীলাক্কাস, নীলাক্কাস, হি হি হি . আকাশ অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তিথির দিকে । কি মিষ্টি হাসিটা । তিথিকে নিয়ে কল্পনার রাজ্যে ডুব দেয় সে । . তিথির ডাকে বাস্তবে ফিরে আকাশ । - অই, এমন করে কি দেখস? - কিছু না । - কিছু না? আচ্ছা চল রেল লাইনের দিকে যাই । সন্ধ্যা তো প্রায় হয়ে এল । - রেল লাইনের ধারে যাবি? এখন? আমি পারব না । - তুই না আমাকে ভালবাসিস? এই তোর ভালবাসা? প্রেমিকার ছোট্ট একটা আবদার পূরণে ভয় পায় । ভিতু কোথাকার । - তুই আমার প্রেমিকা, তুই স্বীকার করে নিলি? তার মানে তুইও আমাকে ভালবাসিস । ইয়া হু. . . - ভালবাসি না বাসি এটা পড়ে দেখা যাবে, তুই যাবি কিনা বল? - আচ্ছা চল । . দুজনেই হাঁটতে হাঁটতে রেল লাইনের কাঁছে যেতে থাকে । পথে তিথি একটা দোকানে দাড়ায় । আকাশকে উল্টো ঘুরতে বলে । দোকান থেকে রঙিন কাগজে মোড়ানো বইয়ের মত কিছু একটা নিয়ে আসে তিথি । তারপর আবারও হাঁটতে থাকে । . বিকাল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা । সূর্য্য অস্তাচলে, আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে হলুদের আভা । আর অপর দিকে রেল লাইনের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নীল হলুদের এক জোড়া প্রাণি । বড্ড মানিয়েছে দুজনকে । হটাত্ই আকাশের মোবাইলে একটা ফোন এল । আকাশের বাবা ফোন করেছে । অনেকক্ষণ হয়, ছেলে ঘরের বাইরে । চিন্তা তো হবেই । আকাশ রেল লাইন থেকে নেমে নিচে তার বাবার সাথে কথা বলতে থাকে । একটার পর একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যায়, কখনও বা অজুহাত । . এদিকে তিথি হটাত্ই আকাশকে চিত্কার করে ডাকতে থাকে । আকাশ পিছন ফিরে ঘুরতেই দেখতে পায় তিথির একটা পা রেল লাইনের ফাঁকে আটকে গেছে । চেষ্টা করেও বের করতে পারছে না । এদিকে একটা ট্রেনও ছুটে আসছে । আকাশ দ্রুত ছুটে যায় তিথির কাছে ।. চেষ্টা করতে থাকে তিথির পা টা রেল লাইন থেকে ছাড়ানোর । কিন্তু আকাশ অনেক চেষ্টা করেও তিথির পা রেল লাইন থেকে ছাড়াতে পারে না । প্রতিটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে মৃত্যু ঘনিয়ে আসে । তিথি আকাশকে জড়িয়ে ধরে । তারপর কানে কানে বলে, . - আমি তোকে খুব ভালবাসিরে । অনেক আগে থেকেই তোকে ভালবাসতে থাকি । কিন্তু বলার সাহস হয় নি । আজ যখন তুই আমায় ভালবাসিস বললি, আমি খুব আনন্দ পেয়েছি । আমি জানি তুই লেখক হতে চাস । তর ব্যাগে থাকা ডায়েরি সবটাই আমি পড়েছি । এই ছোট্ট উপহারটা রাখ । আর নিচে নেমে যা । আমার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে । - আমি তোকে ছাড়া যাব না । বাঁচলে একসাথে বাঁচব, মরলেও একসাথে । - ধুর বোকা । তা কি করে হয় । তোকে বড় লেখক হতে হবে । গায়ক হতে হবে । ভাল মানুষ হতে হবে । তোকে সব কিছু হতে হবে । প্লীজ তুই নিচে নেমে যা । - না । তোকে ছাড়া আমি যাব না । - তুই আসলেই একটা নীলাক্কাস । যাহ. . . . বলেই তিথি আকাশকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয় । আর এদিকে দ্রুত গতিতে চলন্ত ট্রেন তিথিকে রেল লাইনের পিপাসার্ত পাত গুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়ে যায় । তিথির দেওয়া উপহারটার উপর রক্ত এসে পড়ে, সবটাকে রাঙিয়ে দেয় । আকাশের চোখের সামনেই তিথি মিলিয়ে যায় । . আকাশ শুনতে পায়, কেউ একজন চিত্কার করে হাসতে হাসতে বলছে, 'তুই যাদেরকে প্রচন্ড ভালবাসবি, তাদের সবাইকেই হারাবি নীলাক্কাস । তোর জীবনে ভালবাসা নেই । তোর ভালবাসা বিষাক্ত ।' . আকাশের কানে একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হয়, 'তুই একটা নীলাক্কাস । হা হা হা. . .' *** . বিভত্স্য দিনটার কথা মনে করে আজও আতকে উঠে নীলাক্কাস । ভয়, আতংক, বেদনা সব কিছু তাকে আকড়ে ধরে । সেদিনের পর থেকে সে যা কিছুকে ভালবেসেছে, সব কিছুই হারিয়েছে । এসব চিন্তা করতে করতে হটাত্ই মোবাইলে একটা ফোন এল । . নীলা ফোন করেছে । নীলাক্কাসের মনে নতুন আতংক জেগে উঠল । নীলারও বোঝি সময় ফুরিয়ে এসেছে ।

বিষয়: সাহিত্য

১৫৯৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File