তাফসির আল কুরআন।
লিখেছেন লিখেছেন আবদুল্লা আল মামুন ১৩ মে, ২০১৬, ১২:৫৫:০২ দুপুর
সূরা আল-ফিল
সূরা ফিল হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষী। পবিত্র কুরআনুল কারীমের ১০৫ নং সূরা। এতে আল্লাহ তায়ালা চক্রান্তকারীদের চক্রান্ত কিভাবে ধ্বংস করে দিলেন তা উল্লেখ্য করলেন। They planned & Allah planned, Allah is the best planner.
অর্থ:
পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)
(১) তুমি কি শোনো নি, তোমার প্রভু হস্তীওয়ালাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন?
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ
(২) তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেননি?
أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ
(৩) তিনি তাদের উপরে প্রেরণ করেছিলেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি
وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ
(৪) যারা তাদের উপরে নিক্ষেপ করেছিল মেটেল পাথরের কংকর
تَرْمِيهِمْ بِحِجَارَةٍ مِنْ سِجِّيلٍ
(৫) অতঃপর তিনি তাদের করে দেন ভক্ষিত তৃণসদৃশ।
فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَأْكُولٍ
তাফসীর :
(১) أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيْلِ ‘তুমি কি শোনো নি তোমার প্রভু হস্তীওয়ালাদের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন’?
أَلَمْ تَرَ অর্থ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, أَلَمْ تَسْمَعْ ‘তুমি কি শোননি?’ ফার্রা বলেছেন ألم تُخْبَر ‘তুমি কি খবর পাওনি?’ মুজাহিদ বলেছেন أَلَمْ تَعْلَمْ ‘তুমি কি জানো না?’ কোন নিশ্চিত বিষয় জানানোর জন্য এরূপ বাকরীতি প্রয়োগ করা হয়। শব্দটি প্রশ্নবোধক হ’লেও বক্তব্যটি নিশ্চয়তাবোধক। আবরাহার কা‘বা অভিযান ও আল্লাহর গযবে তার ধ্বংসের কাহিনীটি আরবদের মুখে মুখে প্রচারিত ছিল। যদিও রাসূল (সা.) সে ঘটনা দেখেননি, তবুও তা ছিল প্রশ্নাতীত একটি নিশ্চিত ঘটনা। أَصْحَابُ الْفِيْلِ বলতে আবরাহা বাহিনীকে বুঝানো হয়েছে। অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর শক্তি-মাহাত্ম্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বান্দাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, এত বড় নিদর্শন দেখার পরেও فَمَا لَكُمْ لاَ تُؤْمِنُوْنَ؟ ‘তোমাদের কি হয়েছে যে তোমরা ঈমান আনো না?’ (কুরতুবী)।
(২) أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِيْ تَضْلِيْلٍ ‘তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেননি?’
ইয়ামনী খ্রিষ্টান শাসকদের চক্রান্ত ছিল কা‘বাগৃহকে নিশ্চিহ্ন করা এবং কুরায়েশদের ধ্বংস করা। কিন্তু তারা কোনটাই করতে পারেনি। বরং তারাই ধ্বংস হয়েছে। কা‘বাগৃহ অক্ষত রয়ে গেছে এবং তাদের ফেলে যাওয়া বিপুল গণীমত পেয়ে কুরায়েশরা আরও সচ্ছল হয়েছে। কুরায়েশদের সম্মান সর্বত্র আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
فِي تَضْلِيْلٍ অর্থ فى إبطال وتضييع ‘বাতিল ও ধ্বংস’ (কুরতুবী)।
(৩) وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْراً أَبَابِيْلَ ‘তিনি তাদের উপরে প্রেরণ করেছিলেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি’।
এখানে طَيْرًا একবচন এলেও তার অর্থ বহুবচন এবং জাতিবোধক।
ইবনু হিশাম বলেন, أَباَبِيلَ অর্থ جَمَاعَاتٍ ‘দলে দলে’। আরবরা এটি একবচনে বলে না (ইবনু কাছীর)। ফার্রা ও আখফাশ বলেন, ‘আবাবীল’ আধিক্যবোধক শব্দ। এর কোন একবচন নেই। যেমন বলা হয় جَاءَتْ اِبْلُكَ أَبَابِيْلَ اَىْ فِرَقًا ‘তোমার উট এসেছে দলে দলে’। অনুরূপভাবে এখানে طَيْراً أَبَابِيْلَ অর্থ ‘পাখি এসেছে ঝাঁকে ঝাঁকে’। অর্থাৎ فى جماعات عظام ‘বিরাট বিরাট দলে’। অনেকে একবচন إبَّالة বা إِبَالَةٌ বা إِبِيْل বলেছেন। কিন্তু
তা অপ্রচলিত (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
ইবনু আববাস ও মুজাহিদ বলেন, مةةابعة مجةمعة ‘একের পিছে এক ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি’। ওবায়েদ বিন ওমায়ের বলেন, هى طير سود بحرية فى منقارها وأظافيرها الحجارة ‘সেগুলি ছিল সামুদ্রিক কালো পাখি, যার ঠোঁটে ও পায়ে কংকর ছিল’। ইবনু মাসঊদ, ইবনু যায়েদ ও আখফাশ বলেন, ‘চারিদিক থেকে তারা এসেছিল’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। ইকরিমা বলেন, ‘সবুজ পাখি যা সমুদ্রের দিক থেকে এসেছিল’। ওয়াক্বেদী তার সূত্রে উল্লেখ করেন যে, পাখিগুলি ছিল হলুদ যা কবুতরের চেয়ে ছোট এবং পাগুলি ছিল লাল রংয়ের। প্রত্যেকের সাথে ছিল তিনটি করে কংকর। সেগুলি তারা নিক্ষেপ করে। অতঃপর তারা সব ধ্বংস হয়ে যায়’ (ইবনু কাছীর)। সাঈদ বিন জুবায়ের বলেন, সবুজ পাখি। যার ঠোঁট ছিল হলুদ। তিনি বলেন, كانت طيرا من السماء لم يُرَ قبلها ولا بعدها ‘এগুলি ছিল আসমানী পাখি। যার ন্যায় পাখি তার পূর্বে বা পরে আর কখনো দেখা যায়নি’ (কুরতুবী)। এটাই হ’ল সঠিক কথা। কেননা গযবের উদ্দেশ্যে প্রেরিত কোন প্রাণী পৃথিবীতে বেঁচে থাকে না। যেমন ইতিপূর্বে দাঊদ (আঃ)-এর সময়ে কিছু লোককে শূকর ও বানরে পরিণত করা হয়েছিল (বাকারাহ ২/৬৫)। কিন্তু তাদের কোন বংশ পৃথিবীতে ছিল না।
(৪) تَرْمِيْهِم بِحِجَارَةٍ مِّنْ سِجِّيْلٍ ‘যারা তাদের উপরে নিক্ষেপ করেছিল মেটেল পাথরের কংকর’।
تَرْمِيْهِمْ স্ত্রীলিঙ্গ হয়েছে উহ্য কর্তা جماعات الطير হ’তে। অর্থাৎ পাখির দলসমূহ নিক্ষেপ করেছিল।
سِجِّيْل আরবদের নিকটে কঠিন ও শক্ত বস্ত্তকে বলা হয়। কোন কোন মুফাসসির উল্লেখ করেছেন যে, এটি ফারসী যৌগিক শব্দ, যা দু’টি শব্দের সমষ্টি। আসলে ছিল ‘সাঙ্গগিল’ (سَنْك وكِلْ)। সেখান থেকে আরবীতে ‘সিজ্জীল’ (سجيل)। ‘সাঙ্গ’ অর্থ পাথর এবং ‘গিল’ অর্থ মাটি। মাটি ও পাথরের মিলিত কংকর (ইবনু কাছীর) । এক কথায় ‘মেটেল পাথরের কংকর’। যেমন হযরত লূত (আঃ)-এর সমকামী কওমকে ধ্বংস করার জন্য তাদের উপরে গযবের যে প্রস্তর বর্ষিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন, حِجَارَةٍ مِّن طِيْنٍ ‘মাটির পাথর’ (যারিয়াত ৫১/৩৩)। সম্ভবতঃ উক্ত আয়াত দৃষ্টে ‘ছেহাহ’ (الصحاح) নামক বিখ্যাত অভিধান গ্রন্থে حِجَارَةٍ مِّنْ سِجِّيْلٍ -এর অর্থ حجارة من طين করা হয়েছে (কুরতুবী)।[ছেহাহ ফিল লুগাহ ১/৩০৪] অর্থাৎ ‘মেটেল পাথর’।
ইবনু আববাস (রাঃ) ও ইকরিমা বলেন, ‘ঐ কংকর যার গায়ে লেগেছে, তার গায়ের চামড়া ফেটে বসন্তের গুটি বেরিয়েছে এবং সেবারই প্রথম বসন্ত রোগ দেখা দেয়’। ইবনু ইসহাক বলেন, সে বছরই প্রথম আরবদেশে হাম ও বসন্ত রোগের আবির্ভাব ঘটে (ইবনু কাছীর)।
(৫) فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُوْلٍ ‘অতঃপর তিনি তাদের করে দেন ভক্ষিত তৃণদৃশ’।
الْعَصْفُ বহুবচন। একবচনে عَصيفة، عَصفة، عُصافة অর্থ ভক্ষিত তৃণ। ঘাস-বিচালি চিবিয়ে খেয়ে গবাদিপশু যা ফেলে দেয়। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, كقشر البر ‘গমের ভূষির ন্যায়’। আবরাহা বাহিনীর উপরে নিক্ষিপ্ত গযবের কংকর যার দেহে আঘাত করেছে, তার দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। একথাটিই বুঝানো হয়েছে চিবানো ঘাস-বিচালির উচ্ছিষ্টের সাথে তুলনা করার মাধ্যমে, যা গবাদিপশু গোবর আকারে বা অন্যভাবে ফেলে দেয় (কুরতুবী)।
ইবনু কাছীর বলেন, এর অর্থ হ’ল এই যে, আল্লাহ তাদের ধ্বংস ও নির্মূল করে দেন। তাদের সমস্ত চক্রান্ত ভন্ডুল করে দেন। তাদের প্রায় সকলেই ধ্বংস হয়। যারা ফিরেছিল, তারাও আহত অবস্থায় ফিরেছিল। যেমন তাদের নেতা আবরাহা কিছু সাথীসহ রাজধানী ছান‘আতে পৌঁছেন। কিন্তু তখন তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে পড়ছিল। অবশেষে তার বুক ফেটে কলিজা বেরিয়ে যায় এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে তার আগে তিনি লোকদের কাছে আল্লাহর গযবের কাহিনী বর্ণনা করে যান (ইবনু কাছীর)।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আবরাহার মৃত্যুর পর তার পুত্র ইয়াকসূম (يكسوم) শাসক হন। তার পরে তার ভাই মাসরূক (مسروق) ক্ষমতাসীন হন। এ সময় সাবেক হিমইয়ারী শাসক সম্প্রদায়ের সায়েফ বিন যী-ইয়াযান (سيف بن ذى يَزَن) বিদ্রোহ করেন এবং পারস্য সম্রাট কিসরার সাহায্য প্রার্থনা করেন। ফলে কিসরার সৈন্যদের সহায়তায় তিনি হাবশী শাসকদের পরাজিত করে ৭২ বছর পর নিজ বংশের হৃত শাসন ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন।[সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৬৮]
কুরতুবী বলেন, আমাদের বিদ্বানগণ বলেছেন যে, হস্তীওয়ালাদের এই কাহিনী আমাদের নবীর জন্য অন্যতম মু‘জেযা স্বরূপ ছিল। কেননা তিনি স্বচক্ষে ঘটনা দেখেননি। অথচ যখন তিনি এই সূরা পাঠ করে শুনান, তখন মক্কায় এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বহুলোক বেঁচেছিলেন। তারা সবাই এ সূরার বক্তব্যের সাথে ঐক্যমত পোষণ করেন। এমনকি হযরত আয়েশা (রাঃ) ঐ সময় বাল্য বয়সের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তিনি বর্ণনা করেন যে, لَقَدْ رَأَيْتُ قَائِدَ الْفِيْلِ وَسَائِقَهُ أَعْمَيَيْنِ يَسْتَطْعِمَانِ النَّاسَ– ‘আমি হাতির চালক ও সহিসকে অন্ধ অবস্থায় মানুষের কাছে খাদ্য চাইতে দেখেছি’। [সীরাতে ইবনে হিশাম ১/৫৭] একই বর্ণনা তাঁর বোন হযরত আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ) থেকেও এসেছে (ইবনু কাছীর)।
উল্লেখ্য যে, মক্কা বিজয়ের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (সা.) হস্তীবাহিনী ধ্বংসের কথা উল্লেখ করে বলেন, إِنَّ اللهَ حَبَسَ عَنْ مَكَّةَ الْفِيلَ وَسَلَّطَ عَلَيْهَا رَسُولَهُ وَالْمُؤْمِنِيْنَ قَدْ عَادَتْ حُرْمَتُهَا الْيَوْمَ كَحُرْمَتِهَا بِالأَمْسِ وَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মক্কা থেকে হস্তীবাহিনীকে প্রতিরোধ করেছেন এবং তার উপর তাঁর রাসূল ও মুমিনগণকে বিজয়ী করেছেন। আর এর পবিত্রতা পুনরায় আজ ফিরে এসেছে, যেমন পবিত্র ছিল গতকাল। অতএব হে জনগণ! উপস্থিতগণ অনুপস্থিতগণের নিকট পৌঁছে দাও’।[বুখারী হা/৬৮৮০, মুসলিম হা/১৩৫৫]।
বিষয়: বিবিধ
১৩৫২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন