রমজানুল মোবারকের রোজার উদ্দেশ্য

লিখেছেন লিখেছেন রায়হান আজাদ ২৫ জুন, ২০১৫, ০৯:১৩:২২ রাত

রোজা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়। বান্দা সুবহি সাদিক থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় খাবার, পানাহার ও সংগম থেকে বিরত থাকে কেবল মাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য। মানুষ শত ত্যাগ-তিতিক্ষা, কষ্ট-যন্ত্রনা ভোগ করে রোজার আনুষ্ঠানিকতা পালন করে। রোজা পালনের মধ্যে রয়েছে প্রকৃত খোদাভীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। রোজার উদ্দেশ্য আল্লাহকে রাজী করা, কিন্তু সামাজিকভাবে আমাদের এ উদ্দেশ্য কতদূর ফলপ্রসূ হচ্ছে তা ভেবে দেখা দরকার। রোজার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রোজাদারের ইবাদতী মন থাকা প্রয়োজন। আর ইবাদত অর্থ দাসত্ব করা, গোলামী করা। ইসলামী চিন্তাবিদদের পরিভাষায় ইবাদত হল, আল্লাহর ভয়ে আল্লাহর আইন ভঙ্গের অপরাধ না করা এবং যে কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায় আর যতদূর সম্ভব নিজের আমিত্বকে নষ্ট করা যায়, আল্লাহকে ভালবেসে সে সব কাজ ঐকান্তিক আগ্রহের সাথে পালন করা। দিনভর খাবার ও পানীয় বর্জন রোজার বাহ্যিক দিক। যদি অবিচল বিশ্বাস ও খোদাভীরুতা না থাকে তাহলে রোজার আভ্যন্তরীণ দিক পূর্ণতা পাবে না। প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলবে রোজা। আর তাই রাসুলে খোদা (সাঃ) এরশাদ করেছেন- “মান ছা‘মা রমাদানা ঈমানান ওয়া ইহতেসাবান গুফিরা লাহু মা ত্বাকাদ্দমা মিন জনবিহি”। অর্থাৎ ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে যে ব্যক্তি রোজা রাখবে তার অতীতের গুনাহ-অপরাধ মাফ করে দেয়া হবে।

এ হাদীসে ঈমান ও ইহতেসাবের সাথে রোজা রাখার কথা বলা হয়েছে এবং সেই মানের রোজার ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে ঈমান অর্থ আল্লাহ সম্পর্কে একজন মুমিনের যে ধারনা ও আকীদা হওয়া উচিত তা স্মরণ থাকা চাই আর ইহতেসাব অর্থ এই যে, মুসলমান সব সময়েই নিজেও চিন্তা- কল্পনা করবে, নিজের কাজকর্মের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে ও ভেবে দেখবে যে, আল্লাহর মর্জির বিপরীতে চলছে না তো ।

হযরত নবীয়ে দো জাহান মৃহাম্মদ (সHappy নানাভাবে রোজার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এবং বুঝিয়েছেন যে, উদ্দেশ্য না জেনে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত সময় কাটানোর কোন সার্থকতা নেই। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করবে না তার শুুধু খানাপিনা পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনই প্রয়োজন নেই। অন্য হাদীসে মহানবী (সঃ) এরশাদ করেছেন, “অনেক রোজাদার এমন আছে কেবল ক্ষুধা আর পিপাসা ছাড়া যার ভাগ্যে কিছূই জুটে না। তেমনি রাত্রিতে ইবাদতকারী এমন মানুষও আছে যারা রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছূই লাভ করতে পারে না । উল্লেখিত হাদীস দুটি দ্বারা এটা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, শুধু ক্ষুধা ও পিপাসা নিবারণে রোজা হয় না। এটা রোজার অবলম্বন মাত্র। রোজা ত্যাগ, নিষ্ঠা, সংযম, সহানুভূতি ও তাকওয়ার যে শিক্ষা দেয় তা অর্জন ও বাস্তবায়ন করতে না পারলে সে রোজা অন্তঃসার শূণ্য থেকে যাবে। তা বাহ্যিক রোজা পালন হলেও আল্লাহর কাছে কবুল হবে না।

রমজান মাস প্রশিক্ষণের মাস। আত্মশুদ্ধি ও আত্ম গঠনের মাস। এ মাসে মুমিন নৈতিক ও ঈমানী চরিত্র অর্জন করে বাকী এগারো মাসে তা অনুসারে জীবন যাপন করবে। রমজানে মুমিন দিবা বেলায় সিয়াম ও রাতের বেলায় ক্বিয়ামে নিরলস ও বলিষ্ট চেতনা শিক্ষা লাভ করে । ক্ষুধা -তৃষ্ণায় দরিদ্রের কষ্ট বুঝার সুযোগ পায়। ইফতার ও তারাবীহ হতে মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের চিত্র পরিস্ফুটিত হয়। নির্জনে নিদারুণ তৃষ্ণার পরও এক ফোঁটা পানি পান না করাতে তাকওয়ার চরিত্র অর্জিত হয়। ঝগড়া, ফ্যাসাদ, মারামারি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা রমজানে কমে যায়। মুমিন নিজেকে রোজাদার ভেবে এ সব কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকে । এতদ সম্পর্কে রাসুলে পাক (সাঃ) বলেছেন, ‘রোজা একটি ঢালের ন্যায়। ঢাল যেমন দুশমনের আক্রমন থেকে রক্ষা করে, তেমনি রোজাও শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচার জন্য ঢাল স্বরূপ। সুতরাং যে ব্যক্তি রোজা রাখবে, তার এ ঢাল ব্যবহার করা বাঞ্চনীয়। দাঙ্গা-ফাসাদ থেকে ফিরে থাকা উচিত। কেউ তাকে গালি দিলেও কিংবা তার সাথে লড়াই-ঝগড়া করলেও পরিস্কার ভাবে বলা উচিত যে, ভাই, আমি তো রোজা রেখেছি, তোমার সাথে এ অন্যায় কাজে যোগ দেব আমি এমন আশা করতে পারি না। অতএব রোজাদার মাসব্যাপী কঠোর ও কৃচ্ছতা সাধনের মাধ্যমে যে গুণাবলী অর্জন করবে তা বাকী মাসগুলোতে মেনে চলবে। অন্যথা রোজার কোন স্বার্থকতা নেই। মানুষের কু প্রবৃত্তি দমন করা রোজার অন্যতম উদ্দেশ্য। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য- এ ষড়রিপুকে বশীভূত করে রোজা।

দেখা যায়, আমাদের সমাজে গোটা রমজান মাস ভরে ৩৬০ ঘন্টাকাল সিয়াম ও কিয়ামের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করার পরে যখন মুসলমানগণ অবসর গ্রহণ করে তখন ঈদুল ফিতরের দিনেই এ বিরাট ইবাদতের সকল প্রভাব একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়। হিন্দু জাতি তাদের মেলা উৎসবে যা কিছূ করে মুসলমানগণ অনেকক্ষেত্রে ঈদের উৎসবে ঠিক তাই করে। শহর-উপশহর অঞ্চলে ঈদের দিন ও এর পরে অশ্লীল নাটক, সিনেমা প্রদর্শন, ছেলে মেয়ে এক সাথে হৈ হুল্লা করা, কোন কোন জায়গায় নাচগান, আড্ডা ও বেহাইয়াপনার আসর বসানো হয়। শূণ্য হয়ে পড়ে মসজিদ। বিদায় নেয় ইসলামী পরিবেশ। আল্লাহর বিশেষ মেহেরবান, গ্রামের সাধারণ মুসলমান এতটা পথভ্রষ্ট এখনও হয় নি। কিন্তু জিজ্ঞাস্য এই যে, রমজান খতম হওয়ার পরেই তাকওয়া-পরহেযগারির প্রভাব কয়জন লোকের উপর জারী থাকে? আল্লাহর আইন লংঘন করতে কতজন লোক ভয় পায়? নেক কাজে কতজন লোক শরীক হয়? স্বার্থপরতা কতজনের দূর হয়ে যায়?

মূল কথা হচ্ছে, রোজা কোন যাদু নয়, এর আনুষ্ঠানিকতা পালন করলেই বড় কোন উদ্দেশ্য লাভ হয় না। ভাত হতে ততক্ষণ পর্যন্ত শারীরিক শক্তি লাভ করা যায় না যে পর্যন্ত না তা পাকস্থলীতে গিয়ে হজম হবে এবং রক্ত হয়ে শরীরের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হবে। ঠিক তেমনি রোজা দ্বারাও কোন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করা যায় না- যতক্ষণ পর্যন্ত রোজাদার রোজার আসল উদ্দেশ্য ভাল ভাবে বুঝতে না পারবে এবং তার মন ও মস্তিষ্কের মধ্যে তা অংকিত না হবে এবং চিন্তা-কল্পনা, ইচ্ছা ও কর্ম সব কিছূর উপর তা একেবারে প্রভাব বিস্তারকারী হয়ে না যাবে।

যে আয়াতে ক্বারীমা দ্বারা রোজা ফরজ করা হয়েছে সে আয়াতে ক্বারীমায় রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘লা-আল্লাকুম তাত্তাকুন’- রোজা এজন্য ফরজ করা হয়েছে যে, ‘যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো’ । তাকওয়া অর্থ-আত্মরক্ষা করা, বিরত থাকা। পরিভাষায়, শরীয়তের আদেশগুলো পালন করা এবং নিষেধ সমূহ থেকে বিরত থাকার নামই তাকওয়া।

পরিশেষে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্যে আমাদের সিয়াম সাধনা করা উচিত । আর এ তাকওয়া অর্জন করে বাকী ১১ মাস চলতে না পারলে সে রোজার কোন মূল্যায়ন হবে না। তাকওয়ার উদ্দেশ্যমন্ডিত রোজার জন্যই সকল ফজিলত ও মারতাবা। রোজা সঠিকভাবে না হলে তার জন্য সাওয়াব তো দূরের কথা ফরজ তরকের গুনাহ রয়েছে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে রোজার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া ভিত্তিক জীবন যাপন করার তৌফিক দান করুন।

বিষয়: বিবিধ

১৩৫৪ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

327477
২৫ জুন ২০১৫ রাত ১০:১২
চাটিগাঁ থেকে বাহার লিখেছেন : ভাল লেগেছে আপনার লেখাটি, আশা করি আরো লিখবেন । ধন্যবাদ আপনাকে
327484
২৫ জুন ২০১৫ রাত ১১:১১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : আমিন।
রোজার উদ্দেশ্য নিজেকে প্রশিক্ষন দেওয়া বাকি ১১ মাস এর জন্য।
327491
২৫ জুন ২০১৫ রাত ১১:২৮
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : ভাই টিভিতে দেখলাম ভেজাল বিরোধী অভিযান চলছে, পুরো বাংলাদেশ সয়লাব ভেজালে। রমজানে দ্রব্যমুল্য বাড়ে বছরের যে কোন সময়ের তুলনায়। এই রোজার উদ্দেশ্য তাকওয়া হাসিল, তা কতটুকু অর্জিত হচ্ছে? মুসলমানরা ১১মাস প্রশিক্ষণ নেয় কিভাবে রমজান এলে রোজাদারদেরকে ঠকাবে? তাহলে রোজা উদ্দেশ্য তাকওয়া-আমাদের কি কাজে আসছে? ধন্যবাদ আপনাকে..

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File