প্রবাসে সাহিত্যচর্চা : দেশপ্রেমের মহাউপাখ্যান-১

লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ৩০ অক্টোবর, ২০১৮, ০১:৩১:১৪ দুপুর



বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও মধ্যযুগের সর্বশেষ কবি ভারতচন্দ্র বলেছেন,

“নারী ছাড়ি ধন আশে যেই থাকে পরবাসে

তার বড় কেবা আছে দু:খী।”


প্রবাস নিয়ে কবি ভারতচন্দ্রের এ চরণ দু’টির সাথে দ্বিমত করবেন এমন কেউ নেই। চরম সত্যটাই প্রকাশ পেয়েছে কবির চরণে। প্রবাস মানে চরম অনিশ্চয়তা, হতাশা, আশা-নিরাশার দোলাচল এবং প্রতিটি মুহুর্ত বিপদের ঘনঘটা। প্রতিক্ষণই চলে টিকে থাকার লড়াই। একদিকে কফিল নামক অভাজনের সাথে সবসময় বোঝাপড়া করে চলা, অন্যদিকে প্রিয় জন্মভুমি, চিরচেনা পথঘাট, মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান, বন্ধু-বান্ধব এবং মায়ার সংসার ফেলে নিয়ত চোখের পানি বিসর্জন। আছে এক প্রবাসীর সাথে আরেক প্রবাসীর অর্থনৈতিক লেনেদেনে অস্বচ্ছতা, স্পন্সর কর্তৃক ভিসার টাকা ফেরত না দেয়া, যথাসময়ে আকামা বা রোডপাস না দেয়া এবং যখন ইচ্ছে তখন ধরপাকড় করে জেলেবন্দী বা দেশে ফেরত ইত্যাদি। লক্ষ লক্ষ টাকার খরচ করে, সহায় সম্বল যা আছে, ভিটে মাটি বিক্রি করে বিদেশ গিয়ে যদি ধরা পড়ে! এক বিরাট টেনশন সবসময়! আসলেই অনেক চ্যালেঞ্জের নাম প্রবাস। তাই তো কবি ভারতচন্দ্রের কথায় তার চেয়ে আর কেউ দু:খী নেই বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি প্রবাসে ছিলেন কি না জানি না। হয়ত প্রবাসীদের দু:খ-কষ্ট সম্পর্কে অবগত ছিলেন ভালভাবে। এরকম প্রবাসে থেকে সমস্ত দু:খ-কষ্ট এবং গ্লানিকে একপাশে রেখে সাহিত্যচর্চা করছেন এমন লেখকের সংখ্যা আজ অনেক প্রবাসী। তারা সমস্তÍ দু:খ-কষ্টকে পায়ে দলে সাহিত্যচর্চাকে আপন করে নিয়েছেন। জ্ঞানার্জনকে প্রাধান্য দিয়ে নিয়মিত আহরণ করে চলেছেন। দেশের প্রতি অগাধ ভালবাসা ও গভীর মমতায় কলম চালিয়ে যাচ্ছেন নিবিড়ভাবে। তারা কখনো সাহিত্যিক হবেন, কবি বা লেখক বলে সবাই ডাকবেন এমন চিন্তা-চেতনা থেকে নয়। লিখেছেন নিজস্ব দায়বদ্ধতা থেকে, দেশের প্রতি ভালবাসার টানে। ছিলেন মজলুম রেমিট্যান্সযোদ্ধা, এখন হয়েছেন নির্ভীক কলমযোদ্ধা। একদিকে পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষনের মহান দায়িত্ব অন্যদিকে দেশপ্রেম । সত্যিই যা অতুলনীয়!

প্রবাসীদের নিয়ে “প্রবাসের কাব্য” নামক কাব্যগ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন কবি ও সম্পাদক স্বপন মিয়া। এতে বাংলা ভাষাভাষি বিশ্বের অনেক স্বনামধন্য লেখকবন্ধুরা অংশগ্রহণ করেছেন। কাব্যগ্রন্থের পরতে পরতে বিধৃত হয়েছে প্রবাস নামক কারাগারে বন্দী একদল কলম যোদ্ধাদের অজানা জীবন ইতিহাস। প্রবাস নিয়ে যারা নাক সিটকান, কামলা বলে গালি দেন, পদে পদে হয়রানি করেন, অনেক সময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন প্রবাসী শুনলেই যেসব মেয়ে বা তাদের বাবারা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন-তাদের কাজ-কর্ম, অবদান, দেশের প্রতি গভীর টান সম্পর্কে জানা থাকলে। কখনো এরূপ করতেন বলে মনে হয় না। রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক গতিশীল। ফ্রান্স প্রবাসী কবি আলম মুহাম্মদ ''কামলা-১” কবিতায় লিখেন-

“অর্ধ শতাধিক তাপমাত্রায়, উত্তপ্ত বালুভুমিতে আমি কাজ করি।

মাইনাস আট-দশ ডিগ্রী তাপমাত্রায় বরফ আচ্ছাদিত পথে কাজের সন্ধানে আমি হেঁটে চলি।

কায়িক শ্রম, অবিশ্রান্ত গতর খাটুনির পর মাস শেষে মাইনেটা আসার পর

তখন কী করি জানেন?

আমি ছুটে চলি কোন এক মানি একচেঞ্জে।

বাবা কিংবা ভাইয়ের নামে টাকাটা অর্ডার করি।

আমার মুখে হাসির গোলাপ প্রস্ফুটিত হয়,

আমার অন্তরে পরম প্রশান্তি অনুভব করি।”


প্রবাসের একাকীত্ব, একরাশ হতাশা, পরিবার বিহীন দিনলিপির কথা উঠে আসে কবি ও সম্পাদক শাহাদাত হুসাইনের কলম থেকে। “আবার কবিতা লেখা হবে” কবিতায় তিনি লিখেন-

“এখন আমি হয়ে গেছি অন্যরকম

কাক ডাকা ভোর, শিশির ভেজা সকালবেলা হয় না দেখা

ভালোবাসা পাই না কারো

আছি আমি একলা একা

তাইতো কবিতাগুলো আগের মতো হয়না লেখা।”


কাতার প্রবাসী কবি আবু তাহের মিয়াজী কবিতায় দেশপ্রেমের পরিচয় ফুটে উঠেছে। তার ”দীর্ঘশ্বাস” কবিতায় বলেন,

“প্রবাস থেকেও সদা আমি দেশের কথা ভাবি

স্বদেশ আমার জীবন-মরণ, স্বদেশ আমার রবি

ডায়েরীর পাতায় লিখি যখন প্রবাস ইতিহাস

তখন থেকেই ফেলছি শুধু ব্যথার দীর্ঘশ্বাস।”


সৌদি প্রবাসী কবি রবিউল খন্দকারের লেখা থেকে জানা যায় দেশের বিমানবন্দরগুলোর অনিয়ম এবং নানা হয়রানির কথা। একজন কর্মকর্তা কিছুদিন আগে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের কামলা বলে হালি দেন।''মহান দেশপ্রেমিক” কবিতা লিখেন-দেশের বিমান বন্দরগুলোর একশ্রেণির কর্ম-কর্তাগণের আচরণ-ব্যবহার কত যে নিম্ন মানের বলার অপেক্ষা রাখে না।

“বিদেশ থেকে দেশে ফেরার পর বিমানবন্দর থেকে শুরু হয়

তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ।

কর্মকর্তাদের গালাগালি শোনা তাদের ভাগ্যের লিখন,

লাগেজ নিয়ে টানাহেঁচড়া তো সাধারণ ব্যাপার

বাড়ি পর্যন্ত নিরাপদের যাওয়ার কোন আশাও নেই।”

প্রবাস কী তা অতি সুন্দরভাবে তুলে ধরেন কবি শাহাদাত আল মাহদী ।“একদিন সব চলে যাবে” কবিতায় তিনি বলেন,

“থেমে যাবে স্রোতের সীমানা পেরিয়ে

ঝাউবনের পাতার মতো মন

গোরস্থানের সাড়ে তিন হাতঘর হবে আপন নিবাস

থাকবো সেখানেই এখানে ক’দিন আছি, এটাই প্রবাস।


আরেক ইউএই প্রবাসী কবি এনামুল হক “মনে পড়ে” কবিতায় বলেন-

“মরুর বুকে নাইরে সুখে ছেড়ে আপন দেশ

জানি না তো কখন হবে প্রবাস জীবন শেষ

ইট পাথরে গড়া শহর মানুষগুলো পর

বুকের ভেতর বইছে সদা মরুভুমির ঝড়।”


এভাবে উদ্ধৃতি দিতে গেলে লেখার কলেবর বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এ মহাউপাখ্যানের যবনিকাপাত হবে না! ”প্রবাসের কাব্যে” গ্রন্থের সব কবিরাই হৃদয় দিয়ে লিখেছেন অনবদ্য সব কথামালা। আশাকরি আগামিতে কাব্যগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সমর্থ হবে।

অল্প-বিস্তর লেখালেখি, প্রবাসকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে সারা বিশ্বজুড়ে অনেক, খ্যাতনামা, নবীন-প্রবীন লিখিয়ে, প্রকাশক ও সম্পাদক অনেকের সাথে পরিচয় আছে। তাও আবার ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ভালোবাসার নিবিড় বন্ধনের কারণে। কয়জনের কথা বলব? মধ্যপ্রাচ্য, দুরপ্রাচ্য, লন্ডন-আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া সবখানেরই লেখককন্ধুবর্গ আছেন। তাদের মধ্য থেকেই কয়েকজনের সম্যক পরিচয়, লেখালেখির সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়াসে এই নিবন্ধের অবতারনা।
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় দেশ সৌদি আরব। যারা লেখালেখির সাথে যুক্ত আছেন : শাহাদাত হোসাইন (সম্পাদক-প্রবাসের গল্প, শামীম খান যুবরাজ, কামরুল হাসান ফরাজী, মো: আলী জিন্নাহ, নজরুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন মজুমদার, মো.আলী রাশেদ (এনটিভি, মদিনা প্রতিনিধি), রবিউল খন্দকার, মাহবুবা লায়লা সুলতানা, ফইম ফরহাদ, শাহজাহান চঞ্চল, হামিদুর রহমান পলাশ, আবু জারীর, আনোয়ারুল ইসলাম নান্নু, শাহাদাত আল মাহদী, মো: নজরুল ইসলাম, লোকমান বিন নুর হাশেম, যাকারিয়্যা মাহমুদ, আবদুল গাফফার, ফরিদ মাহবুব, ফখরুল ইসলাম, ফজলে এলাহি মাহমুদ, সাইয়্যেদ রফিকুল ইসলাম মাদানী, মো: হাসান মুরাদ, মাসুম বিল্লাহ ফিরোজী, মাওলানা ওসমান গনি রাসেল, মোবারক হোসেন ভুঁইয়া, দেলওয়ার হোসেন সুমন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাস করে লেখালেখির সাথে যুক্ত আছেন : মো: এনামুল হক, মো: ইসমাইল, জামাল উদ্দিন, আহসানুল আজিম শাহ, কামরুল হাসান জনি, মাসুদ আল মাহদী, আমিনুল হক, মনজুর হোসেন, মো. গিয়াস উদ্দিন সিকদার (এনটিভি ও এশিয়ান টিভি, ইউএই প্রতিনিধি), আবদুল্লাহ আল শাহীন, মো: লোকমান, বশিরুজ্জামান, ওবাইদুল হক, আবু তাহের খাঁন, মো: হারুন অর রশীদ, আবদুর রহিম, দিল মোহাম্মদ মামুন। অন্যান্য দেশের লেখকবৃন্দ হলেন: আবু বকর সিদ্দিক (বাহরাইন), কুতুব উদ্দিন (কুয়েত), আবু তাহের মিয়াজী, মাহমুদুল হাসান চৌধুরী, তামীম রায়হান, আমিনুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম (কাতার), আলম মুহাম্মদ, মন্জুরুল আলম, খান মুফতি মাহমুদ (ফ্রান্স), আনিসুর রহমান, মুন্সী কাউসার মাহমুদ (মালয়েশিয়া), মাওলানা দেলওয়ার হোসাইন, আসলাম খান, রাফিয়া খান নিশি (যুক্তরাষ্ট্র), আবদুদ্দাইয়ান মো: ইউনুস, হাজেরা বেগম পপি, মাহফুয আহমদ, আবদুল্লাহ আল মামুন (যুক্তরাজ্য), মো: জুমান হোসেন (অষ্ট্রেলিয়া), মো: আবদুল্লাহ মো: ওবায়দুল্লাহ (মালদ্বীপ), রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ (সিঙ্গাপুর)।


তারা প্রতিনিয়ত রচনা করছেন আগামি দিনের কথামালা, প্রবাস নিয়ে নানা কাব্য গাঁথা। নানা সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা। যার সাথে জড়িয়ে আছে সারা বিশ্বে অবস্থানরত প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশী প্রবাসী। এত প্রতিকুল পরিবেশে বসবাস করে লেখালেখি চাট্টিখানি কথা নয়। উল্লেখিত কলম সৈনিকদের অনেকেরই বিভিন্ন সময়ে বই প্রকাশিত হয়েছে। অনেকের বই আলোর মুখ দেখার অপেক্ষায়। বলা বাহুল্য, নিবন্ধে উল্লেখিত লেখকদের বাইরেও অনেক স্বানমধন্য শত-হাজার লেখক রয়েছেন। প্রতি বছর প্রাণের মেলা বইমেলা আসে, বইমেলা যায়। সুযোগ পেলে প্রবাসী লেখকরাও প্রাণের মেলায় আসে, বইমেলায় অংশগ্রহণ করে। নিজের সৃষ্টিশীলতায় মুগ্ধ হয়! একের সাথে অপরের পরিচয়ে আনন্দিত হয়। সন্তান প্রসবের পর যেমন মা ভুলে যায় তীব্র প্রসববেদনার কথা। প্রবাসী লেখকরাও ভুলে যান অতীত দিনের হতাশা ও গ্লানিময় জীবনের সকল যাতনা! গত কয়েক বছর ধরে প্রবাসী লেখকদের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে একুশে বইমেলায় সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য প্রবাসী লেখক পুরস্কার প্রবর্তন করেছে বাংলা একাডেমী। এ ধারা অব্যাহত আছে এখনো। প্রবাসীদের অবদান, ত্যাগ ও কষ্টের জীবন নিয়ে আমরা ক’জন ভাবি। তারাও যে সাহিত্যজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ সেটা আমরা ভুলে যাই। এমনটি যেন কখনো না হয়। প্রবাস নামক নিষ্ঠুর কারাগারেও থেকে যারা নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করেন তাদের হৃদয় নিংড়ানো মোবারকবাদ জানাই। আমি বিশ্বাস করি উনারা লেখক হিসেবে দেশে-সমাজে অভিহিত হওয়ার জন্য লিখেন না। তারা লিখেন বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে, সত্য ও সুন্দরের চর্চার প্রয়োজনে সর্বোপরি নিখাদ দেশপ্রেম থেকে।

(পরবর্তী পর্বে থাকছে শাহাদাত হুসাইন সম্পাদিত প্রবাসের গল্প :১-৩ এর পর্যালোচনা। অপেক্ষায় থাকুন)

বিষয়: সাহিত্য

১০০৫ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

386083
৩০ অক্টোবর ২০১৮ সন্ধ্যা ০৭:২৩
শেখের পোলা লিখেছেন : শুভেচ্ছা রইল,শুভ কামনাও।
৩১ অক্টোবর ২০১৮ বিকাল ০৪:০৫
318052
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : ধন্যবাদ প্রিয়জন..ভালো থাকবেন..

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File