বই আলোচনা: কবি ও শিক্ষাবিদ ড. আহসান সাইয়্যেদ ও তাঁর “কবিতার বিষদাঁত”

লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ২৮ অক্টোবর, ২০১৮, ০৪:১৭:৩৮ বিকাল



“ব্যবসায়ী খুব অবাক হয়ে ফের শুধায়-

তাহলে আপনার কী আছে?

কবি বললেন-আছে কয়েকখানা কবিতার বই

ও গুলোই আমার সম্পদ।”


(কবিতার পান্ডুলিপি, কবিতার বিষদাঁত)

এই হল একজন কবির প্রকৃত স্বরূপ। যার শক্তি, সাহস, সম্পদ ও অহংবোধের স্থান হচ্ছে কলম। কবিরা হচ্ছেন কালের প্রবক্তা। লেখনির মাধ্যমেই একজন কবি জাগতিক সকল প্রশ্নের, পাঠক মনের দোলাচলে জেগে উঠা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব অবসান ঘটানোর সফল উদ্গাতা। কবি ড. আহসান সাইয়্যেদ। একজন খ্যাতনামা শিক্ষক। বর্তমানে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়’ঢাকার উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে চলা আহসান সাইয়্যেদের পরিচয় আরো ব্যাপক। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, আদর্শিক চিন্তাবিদ, গবেষক, গল্পকার, নাট্যকার, লেখক, অনুবাদক, সংগঠক, সংস্কৃতিকর্মী, উপন্যাসিক ও উপস্থাপক। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী তিনি। বায়তুশ শরফের আনজুমানে ইত্তেহাদ আয়োজিত ”ঈদে মিলাদুন্নবী (সা)”এর সুন্দর ও সাবলীল উপস্থাপনাসহ আরো অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার উপস্থাপনায় শ্রোতামনে মুগ্ধতা বিরাজ করে! আলোচ্য প্রবন্ধের শিরোনামে দু’টি অংশ রয়েছে। সত্যি বলতে কী, তার সম্পর্কে যা জানি এর চাইতেও বেশি রয়েছে অজানা। যা-ই হোক, কবির কর্মময় জীবনের বাকি কথা শেষের অংশে আলোচনার সংক্ষিপ্ত প্রয়াস পাব।

কাব্যগ্রন্থটি পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে, “কবিতার বিষদাঁত” এটি কেবল কাব্যগ্রন্থ মাত্র নয়, যেন প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে সার্বিক মুক্তির দিক-নির্দেশনা। তাবৎ দুনিয়ার মানুষ মুক্তির দিশা পেতে তন্ত্র-মন্ত্রের কাছে যাচ্ছে কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসছে। কারণ মানবতার মুক্তি মানুষ রচিত কোন মতবাদ হতে পারে না। বিধান দিতে পারেন কেবল যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনি। সেই পরকালীন মুক্তির বিধান আছে কুরআন ও রাসুল (সা)এর প্রদর্শিত জীবন-ধারায়। রাসূল (সা) বিদায় হজ্জের ভাষণে যেমন বলিষ্ঠভাবে ডিক্লেয়ার করেছেন। কবিও তেমনি কোন রাখ ডাক না রেখে, কথার কোন মার প্যাঁচে না গিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন।

“আমি ধরেছি আঁকড়ে শুধু দু’টি জিনিস

নবীর হাদীসে যা পেয়েছি-

আমি রেখে যাচ্ছি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস

আল্লাহর কিতাব আর আমার হাদীস

এ দু’টি জিনিস যে আঁকড়ে ধরবে, পথভ্রষ্ট হবে না সে কভু।”

(দু’টি জিনিস)


মুক্তির অন্বেষায় মানুষ কুরআনে ঘোষিত কয়েকটি রাতকে মুসলিম সমাজ বিশেষভাবে গুরুত্ব দেন। সেই হাজার মাসের চেয়েও উত্তম মহিমান্বিত রাত লাইলাতুল কদর। তিনি সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন তার কলমের তুলিতে-

“ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হৃদয় আরশিতে

জমেছে ময়লা বেশ

আজ না হয় জেগেই থাকো।

কতজনের জন্য কতকিছু উৎসর্গ করেছ।

আজ না হয় উৎসর্গ করো একটি রাত

মহান স্রষ্টার তরে।”

(একটি রাত)


আধুনিক কবি ও কবিতা মানে নারীর দেহ সর্বস্ব এবং রগরগে বর্ণনা। কাব্যশিল্পকে একশ্রেণির কবি তাদের নিজস্বতা মনে করে। নিজেদের ছাড়া আর কাউকে কবি হিসেবে মানতে নারাজ। তিনি দেহ সর্বস্ব কাব্যকলার বিরুদ্ধে ইস্পাত দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। স্বগতোক্তি করে তীব্র বাণ নিক্ষেপ করেছেন। তাদের কর্মকা- থামানোর জন্য আকুতি করেছেন। এক চোখা প্রেম, মিলনের প্রেম, ট্র্যাজেডির প্রেম, স্ত্রীর প্রেম, বালিকার প্রেম, চাকরানির প্রেম, পরকীয়া প্রেম সম্পর্কে তিনি বলেন, “প্লীজ যথেষ্ট হয়েছে কাব্যের ছন্দে নারীর শরীর নিয়ে যথেষ্ট মাপঝোঁক হয়েছে আর নয়। দয়া করে অন্য কিছু লিখুন অন্তত কবিতা নয়।” তাই ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য পথও বাতলে দিয়েছেন। সংজ্ঞায়িতও করেছেন শাশ্বত কবিতার নতুন কাব্যিক রূপরেখাও সুনিপুণভাবে। “শরীর ও আত্মার সমন্বয়ে নির্মিত হয় কবিতা। আত্মা হল কবিতার ভেতরের ভাব-রস তথা নান্দনিক সৌন্দর্য। সুতরাং এবার আমার দরকার কবিতার নান্দনিক রূপ আয়ত্ব করা। কবিতার পেটের ভেতরের ভাব-রস অন্বেষণ করা।” উপমা ও উৎপ্রেক্ষা সমন্বয়ে তিনি অতি চমৎকারভাবে বিবৃত করেছেন।

”কবিতাকে যারা আজ

মহিলার চুলের খোঁপায় গুঁজা ফুল

মনে করে তারা কি পড়েছে

রাসুল (স.) কেন্দ্রিক কবিদের কবিতা

হাস্সান সাবিত কিংবা

কা’আব ইবন যুহাইরের কবিতা।”*

(প্রার্থনা
)

মানুষের মনের চিরন্তন আকুতি খালেছভাবে তাওবা করে পাপকার্য থেকে নিবৃত হয়ে জীবনের বাকী সময় অতিবাহিত করা। বা যখনই পাপ সংঘটিত হবে-তখনই করুণাময়ের দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়া। পাপ থেকে নিবৃত হয়ে ফিরে আসার নামই তওবা। কবিমন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করে বারে বারে জ্ঞাত-অজ্ঞাত পাপের জন্য ¯্রষ্টার নিকট ক্ষমা চাওয়ার। তাওবা করে পরিশুদ্ধ হওয়া মৃত্যুর প্রস্তুতি হিসেবে পরিশুদ্ধ হওয়া চাই। কবিতার নামে যারা যাচ্ছেতাই লিখে কাব্য সমাজকে পাপাসক্ত করে ফায়দা লুটছেন তাদের বিরুদ্ধে বলে যেতে।

“পায়ের জুতো থেকে মাথা অবধি সবকিছু বদলে

নতুন পোষাকে নিজেকে সাজাবে

পুরনো গন্ধময় পোষাক খুলে ফেলা চাই।

অপবিত্র দেহে বন্দেগী হবে না, তাই বৃষ্টি নামলেই ভিজবে

এরূপ চিন্তা তার দীর্ঘদিনের।

...

ইচ্ছেমত ভিজে চুপসে শরীরের সব কালিমা ধুয়ে ফেলা চাই

অপবিত্র পোষাক ছুঁড়ে ফেলে

নতুন পোষাক পরা চাই। তারপর জায়
নামাযে বসা চাই।”

(কালস্রোত)

কবি আহসান সাইয়্যেদের জন্ম ডলু খালের তীর সাতকানিয়া থানায়। তিনি ইসলামী আরবেী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়ার পূর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন। তার একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ “কবিতার বিষদাঁত” প্রকাশ করেই কবি হিসেবে তিনি তার শক্তিমত্তা জাহির করেছেন। তিনি কবিতা লেখার পাশাপাশি একজন সব্যসাচী লেখক ও গবেষক বটে। শুধু তাই নয়, একজন সুপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী চিন্তানায়ক হিসেবে হাদীস শাস্ত্রেও উপর তার গবেষণাগ্রন্থ “হাদীস সংকলনের ইতিবৃত্ত” এবং “বাংলাদেশে হাদীস চর্চা-উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ” প্রকাশিত হয়েছে। আরো যেসব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তন্মধ্যে-নাট্যগ্রন্থ : রক্তলাল স্বাধীনতা, পাকা চোর, জীবিত জীবন; শিশুতোষ উপন্যাস : তিতাসের অট্টহাসি; গল্পগ্রন্থ : মাঝরাতে বৃষ্টি, আপোফিসের স্বপ্ন, হাইজ্যাকারের পাল্লায়; রম্য রচনা: গৃহবধু পিঞ্জরের পাখি এবং অনুবাদগ্রন্থ : নোবেল বিজয়ী নাগিব মাহফুজের ছোটগল্প এবং তাওফিক আল হাকীমের আরবী নাটক। নিরন্তর লিখে চলা ড.আহসান সাইয়্যেদ ব্যক্তিগত জীবনে একজন সদালাপী ও দারুণ স্মার্ট ব্যক্তিত্ব। সামাজিক-সাংস্কৃতিক সকল প্ল্যাটফরমে তার সাবলীল পদচারণা ও সুখ্যাতি রয়েছে। মজার ব্যাপার তিনি যে একজন কন্ঠশিল্পী তাও হয়তো অনেকেই জানেন না। চলার পথে বিভিন্ন প্রোগ্রামে তার সাথে কদাচিৎ সাক্ষাত হলেও মনে হয়েছে যেন দীর্ঘদিনের পরিচিত একজন আপন মানুষ! ক্ষণিকের আলাপের মানুষের হৃদয় জয় করা অভিব্যক্তি, সন্মোহনী শক্তি বিদ্যমান। পরামর্শ সভায় দেখেছি দ্বিধাহীন, গঠনমূলক মতামত এবং অনড় মনোভাব। পরিশেষে মহান মনিবের দরবারে তারই প্রার্থনা অনুযায়ী দীর্ঘ জীবন কামনা করছি।

“হে আল্লাহ!

এসব কথা লিখতে আমাকে দীর্ঘ সময় দাও

খ্যাতির মোহে বিপথগামী কবিদের

কবিতায় কত পাপ জমা হল তার একটি

হিসেব তুলে ধরা চাই।”

(প্রার্থনা)


*[পাদটিকা: কবি হাসসান সাবিত এবং কা’ব ইবনে জুহাইর রাসূল সা.এর বিখ্যাত সাহাবী ছিলেন। হাসসান ইবনে সাবিতের জন্য রাসূল সা. এর মসজিদে একটি মিম্বর বা মঞ্চও প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইসলাম বিরোধীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়ার জন্য হাসসান ইবনে সাবিতকে আল্লাহর রাসুল দোয়া করতেন। “হে আল্লাহ! রুহুল কুদ্দুসকে দিয়ে তুমি তাকে সাহায্য করো।” রাসূল সা. আরো বলতেন, “তার কবিতা বিরোধীদের জন্য তীরের আঘাতের চেয়েও সাংঘাতিক।” কা’ব ইবনে জুহাইর ইসলাম বিরোধী কবিতা লেখার অপরাধে রাসূল সা.কর্তৃক প্রাণদন্ড প্রাপ্ত ছিলেন। তার অন্তর্দৃষ্টি এত প্রখর ছিল যে, তিনি ভুল বুঝতে পেরে রাসূল সা.এর প্রতি ঈমান আনলেন। ঈমান আনয়নের পর তার ভুমিকা কবিদের জন্য ইসলামের ইতিহাসে সমুজ্জল ছিল। (নির্বাচিত প্রবন্ধ-মতিউর রহমান মল্লিক, পৃ-১৫-১৬)]



বিষয়: সাহিত্য

১০০২ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

386074
২৮ অক্টোবর ২০১৮ রাত ০৮:৩৬
শেখের পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো। অনেক ধন্যবাদ।
৩০ অক্টোবর ২০১৮ সকাল ১১:৩৯
318049
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : ধন্যবাদ মাননীয় । ভালো থাকুন...
386079
২৯ অক্টোবর ২০১৮ সন্ধ্যা ০৭:১৩
আমি আল বদর বলছি লিখেছেন : কবিতা গুলি অনেক ভাল লাগলো

ভাল লাগা রেখে গেলাম
৩০ অক্টোবর ২০১৮ সকাল ১১:৩৮
318048
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : ধন্যবাদ প্রিয়বরেষু!ভালো থাকবেন নিয়ত..

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File