হিমু এখন সৈকত নগরী কক্সবাজারে.....!!!!!
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ২১ জানুয়ারি, ২০১৮, ০১:২৪:৫৫ দুপুর
মাজেদা খালা, রেশমা খালা এবং সুরমা খালা তিনজনই হিমুর খোঁজে হয়রান! প্রায় তিন মাস হিমুর দেখা নেই। রূপা, বাদল, বদরুল সাহেব, মেস ম্যানেজার কাউকে সে বলে যায়নি কোথায় গেছে। অবশ্য কখনো বলে গেছে এমন কথাও না। হিমুর যা স্বভাব তাতে কোন হিসাব মিলছে না। রূপা সিমসহ একটা স্যামসং মোবাইল সেট গিফট করেছিল যাতে যোগাযোগটা থাকে। কিন্তু সে বন্ধ রাখে সবসময়। কদাচিৎ ইচ্ছে হলে সেটটি উল্টে পাল্টে দেখে, ওপেন করে। আবার অফ করে দেয়। মহাপুরুষ হতে হলে জনবিচ্ছিন্ন হতে হয়। এমন ধারণা তার।তার বাবার স্বপ্ন ‘‘মহাপুরুষ প্রকল্প’’ যদি ভেস্তে যায়! মাঝখানে পুলিশের জঙ্গি বিরোধি অভিযানে গ্রেফতার হয়ে দু’মাস জেলও খাটে। ফলে সে আরো জনঅসম্পৃক্ত হয়ে যায়। খালুর জোর প্রচেষ্টায় জেল থেকে মুক্তি পায়। জেল থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে মনস্থির করতে পারে না। কক্সবাজার-টেকনাফে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের ঢল নেমেছে বর্মী মগদের অত্যাচারে। মনটা রোহিঙ্গাদের সাথে কাটাতে চায় ক’দিন। ভিটে বাড়ি ছাড়া, স্বজনহারা, নিঃস্বপ্রায় রোহিঙ্গারা কিভাবে জীবন-যাপন করছে তা কাছে থেকে দেখতে চায়। মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। মানবতার কী কোন মূল্য নেই! যেন ইয়াবার দামও রোহিঙ্গাদের চেয়ে বেশি?
ইরা হানিমুনে গেছে কক্সবাজার। স্বামী হাসান। ফাইভ স্টার হোটেলে উঠেছে। সাথে আছে ছোট বোন লিরাও। কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। সকাল ১১টা। ইরা ও হাসান হাত ধরাধরি করে হাঁটছে সী বিচে। গত দু’দিন একটি অখ্যাত হোটেলে ঘুমিয়েছে। রেস্ট হাউসের মতো বলা যায়। কারণ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়ার আগে বিশ্রাম নেয়া দরকার। জার্ণিতে তার যথেষ্ট দখল গেছে। আর মনটাও ফ্রেশ করার জন্য বীচের দিকে পা বাড়িয়েছে। হিমু লক্ষ্য করল হাত ধরাধরি করে হাঁটা মেয়েটি তাকে দেখছে। পেছনে আর কতদূর পেছনে আরো একটি মেয়ে। কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। চেনা চেনা লাগছে। বাদলদের বাসায় দেখেছিল। নামটা ইরা-মীরা এ জাতীয়। হ্যাঁ মনে পড়েছে। ইরা ফিজিক্সে পড়ত। ভাল ছাত্রী ছিল। রেকর্ড মার্ক নিয়ে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার কথা ছিল। জিজ্ঞেস করবে নাকি? কিন্তু যেদিন রাস্তায় থাকে ভড়কে দিয়েছিল গাড়ি দিয়ে, সেদিন তো প্রেমিকের নাম মুহিব বলেছিল। ছেলেটার নাম মুহিব বলেছিল ইরা। আমি তাকে ‘ক্যাবলা মুহিব’ বলে ইরাকে রাগিয়ে দিয়েছিলাম। এখন সময়ের সাথে সাথে প্রেমিকও পাল্টে গেল নাকি? কেমন আজব চিজ রে মেয়ে! প্রেম করেছ একজনের সাথে বিয়ে করেছ আরেকজনকে। বেশ বেশ! খেলারাম খেলে যা!
এই যা আমি কী ভাবছি! ওরা একদম কাছাকাছি।
-হিমু ভাইয়া না?
-হুম! আমি আবার ভাইয়া হলাম কখন?
-কেমন আছেন ভাইয়া?
-এই তো বেশ! উনি কে?
-উনি হাসান। আমার স্বামী এই গত সপ্তাহে আমাদের বিয়ে হয়েছে। তিন দিন হল এখানে এসেছি।
-ভাল।
হাসান সাহেব বেশ বিব্রতবোধ করছেন। হিমু না টিমু। বাসর রাতেও হিমুর কথা বলে মনমেজাজ খারাপ করে দিয়েছিলো ইরা। আজগুবি সবকথা। এইসব লাফাঙ্গাদের কথা না বললেই কি হতো না। এখন আবার কোত্থেকে এসে জুটেছে উঠকো ঝামেলা। নাকি অন্য কোন.. ..ভাবতে থাকে।
এরই মধ্যে লিরা পেছন থেকে সামনে এসে হাজির।
-আরে হিমু ভাইয়া কেমন আছেন? লিরা বলল।
-এই তো চলছে।
-আপনাকে আমি সে-ই কবে থেকে খুঁজছি। ইরা আপাকে আপনি যখন থেকে এক রাতের জন্য মহিলা হিমু বানিয়ে দিয়েছিলেন। আমার ইচ্ছে একদিনের জন্য হিমু হবো। মেডিক্যাল হোস্টেলের তো মেয়েরাও হিমু হওয়ার জন্য পাগল! সবাই একদিনের জন্য হলেও মহিলা হিমু হতে চায়। হিমু হিমু লাইফ কেমন লাগে তাই?
-আমি হিমু বানানোর প্রজেক্ট নিয়েছি নাকি? আমি একটা মিশনে এসেছি।
-কী মিশন?
-মানুষকে সচেতন করানোর মিশন। আরাকানের নির্যাতিত মুসলমানদের সহায়তা করার জন্য। ওদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে বার্মিজ পণ্য-সামগ্রী বয়কট করার প্রচারে নেমেছি।
-খুব ভাল। কিন্তু বার্মিজ আচার আমার যে খুব প্রিয়!
-হোক। এখন থেকে বাদ।
-আপনি যখন বলছেন বাদ!
ইরা-হাসান অনেক সামনে চলে গেছে। লিরা আবদার করে একদিন হোস্টেলের ক্যান্টিনে আসার জন্য। মেয়েরা সবাই উদগ্রীব। হিমু কক্সবাজারে আছে জানলে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। সটকে পড়তে হবে। সন্ধ্যার নাগাদ কাছাকাছি একটা ক্যাম্পে যেতে হবে।
ঝাউতলায় গেছে এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা করতে। তারও যাওয়ার কথা। পথঘাট তার বেশ জানা। থাকলে সুবিধা। পথিমধ্যে একটি জঠলা দেখে দাঁড়ায়। কৌতুহলিভাবে এগোয়। পরিস্থিতি ভাল না, উত্তেজনাপূর্ণ এবং বেশ গ্যাদারিং। অকুস্থল একটি জুয়েলারি দোকান। এক কাস্টমার ৩ ভরি স্বর্ন বন্ধক দিয়েছে। ফেরত নেয়ার সময় দেখা গেছে সুদে-আসলে সব স্বর্ন জুয়েলারির দখলে গেছে। টাকা দিতে দেরি করেছে। এক আত্মীয় এনে দোকানদারের উপর চড়াও হয়েছে। ঘটনা কতদূর যায় বলা যায় না। মালিক হিন্দু হওয়াতে কেউ আবার না বলে বসে সংখ্যা লঘু নির্যাতন, অথচ গরীব কাস্টমারই সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশে অনেকগুলো জুয়েলারি দোকান আছে সুদের ফাঁদ পেতে বসে আছে। মহাজনদের কবল থেকে এখনো ভুক্তভোগিরা রেহাই পাচ্ছে না। হিমু ওদিকে আর তাকায়নি। প্যাঁচালের সময় এখন নয়। মহাজনদের সুদের নিবিড় চাষ কিভাবে বন্ধ করা যায় তা নিয়েও ভাবতে হবে অন্যসময়।
শরণার্থীদের একটা ক্যাম্প। শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সব মিলে তিন-চারশ হবে। গাদাগাদি অবস্থায় বসবাস। সেনাবাহিনী শৃংখলার সাথে ত্রাণ বিতরন করছে। পুরুষরা দাঁড়িয়ে আছে লাইন ধরে। পুলিশের একটা গ্রুপও অনতিদূরে দায়িত্বরত। এস.আই মাহমুদ বদলি হয়ে এসেছেন কয়েকমাস পূর্বে টেকনাফে। হিমুর হলুদ পাঞ্জাবি দেখে কেউ কেউ তাচ্ছিল্য করছে। সে কিছু বলছে না। এরকম বেশের লোক তো এখানে আসেনি। কয়েকদিন আগে ওয়েস্টার্নের এক মহিলাকে মায়ানমারের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করার সময় ধরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনি। হিমুও কোন চর কিনা সবাই ভাবছে। এস.আই মাহমুদ এগিয়ে এলেন। সবাইকে সরে দাঁড়াতে বললেন। দেখি কী হচ্ছে। হিমুর সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়।
-স্যার ! আপনি?
-হ্যাঁ। আপনি এখানে কখন থেকে।
-বদলি হয়ে এসেছি স্যার। পুলিশের চাকরি তো? কখন কোথায়?
-ওহ, তাই।
-স্যার কোন অসুবিধা?
-না, না। কোন অসুবিধা নেই।
পুলিশ ঐ লোকটাকে স্যার বলায় লোকজন সরে পড়তে থাকে। মাহমুদ সাহেবকে বলে, আমি একটু ঘুরে ঘুরে দেখব ক্যাম্পটি। স্যার আপনি দেখেন, আর কোন অসুবিধা হলে জানাবেন। লোকজন প্রথমে সরে গেলেও এখন অনেক লোক হিমুর পেছন পেছন লেগে থাকে। একটা মিছিলের মত হয়ে যায়। ত্রাণ সহায়তা দানকারি ছাত্র-যুবকরা কেউ কেউ হিমুকে চিনতে পারে। হঠাৎ দু’একটা ছেলে শ্লোগান ধরে। হিমু ভাইয়ের আগমন! শুভেচ্ছা স্বাগতম! হিমু যতই নিষেধ করে ততই আরো শ্লোগান জোরালো হয়। আমার ভাই, তোমার ভাই! হিমু ভাই হিমু ভাই! আস্তে আস্তে কয়েকজন সাংবাদিকও চলে আসে।
হোটেলে ইরা-লিরা। সকালবেলা “দৈনিক কক্সবাজার” পত্রিকা হাতে। আপু দেখ, দেখ! হিমু ভাইয়ের কাণ্ড! লিরা বলল। হিমুকে নিয়ে লিড নিউজ, “হিমু এখন সৈকত নগরী কক্সবাজারে।” বাদ দে, এসব পাগল-ছাগলের কাণ্ড! ইরা বলে। গোটা কক্সবাজার নয়, পুরো বাংলাদেশে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুক দুনিয়ায়ও এ নিউজ ভাইরাল হয়। মাজেদা খালারা এ খবর জানতে পারে। কিন্তু মোবাইল যে বন্ধ। মোবাইল টিপতে টিপতে ব্যথা হয়ে যায়? কী করা যায় মাজেদা খালা ভাবতে থাকে? মাজেদা খালা ফেসবুকে পোস্ট দেয়। তোর খালু এখন মরনাপন্ন! তোকে দেখতে চায়। হিমু তো ফেসবুক চালাতে জানে না। এ পোস্ট চোখে পড়বে না। রূপা যে একাউন্ট একটা খুলে দিয়েছিল, সেটার পাসওয়ার্ডও ভুলে গেছে।
হিমু যেদিকে যায়। লোকের লোকারণ্য হয়ে যায়। ভাবে ঢাকা শহরে হাঁটলে কেউ ফিরেও তাকায় না। এখানে মিছিল হয়ে যায়। আর থাকা যাবে না। সৈকত নগরী থেকে আবারও রাজধানী চলে যেতে হবে। শরনার্থী ক্যাম্পেও আর যাওয়া যাবে না।
(কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমদের বিখ্যাত চরিত্র হিমু অবলম্বনে। বাস্তবে কারো সাথে এর মিল নেই)
Photocredit : google dada
বিষয়: সাহিত্য
১২৬৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন