রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কোন্ পথে?
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ০৯ নভেম্বর, ২০১৭, ১১:৪৯:৪৮ সকাল
ভাগ্যাহত এক জাতি রোহিঙ্গা। বিশ্বের বুকে পরিচয় মুসলিম হিসেবে। কয়েক দশক ধরে চলছে বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের তান্ডব আরাকানে। নতুন করে আবারও শুরু আগষ্টের শেষে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন্ পথে? প্রশ্নটি মাত্র কয়েক শব্দের হলেও সমাধান কিন্তু বেশ দুরূহ এবং জটিলতার আবর্তে। এই মুহুর্তে কেবল আশ্বাস বাণীই পেয়েছে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে। যদিও আশ্বাস আসলে লোক দেখানোই সার বলে বিজ্ঞমহলের ধারণা। এটা একটা সময়ক্ষেপন করার অপকৌশল মাত্র। আমরা দেখে আসছি বছরের পর বছর ঝুলে আছে রোহিঙ্গা সমস্যা। সমাধানে কোন আলোর দেখা নেই। প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এবং নিরাপদে বাংলাদেশে আসতে না পারার সংখ্যাও লক্ষ লক্ষ। তাদের ভবিষ্যত ঘোরতর অন্ধকারে নিবদ্ধ। বাংলাদেশের মত একটি দেশে তাদের ভরণ পোষণ বা দেখভাল করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার বটে। মানবতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে তাদের আ¤্রয় দিয়ে ইতিমধ্যে সবার প্রশংসা কুড়ালেও তা দেশের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা। আগে থেকে কয়েক লক্ষের পর নতুন কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা যোগ দিয়ে নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগলিক অনেক রকমের সমস্যা। তাদের পুর্নবাসন প্রকৃয়াও বেশ জটিল। ভাসানচর বা অন্য কোথাও পুনর্বাসন মানে সমস্যা সমাধানে আরো বিলম্ব হওয়া এবং তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা। এজন্য কোন চর বা অন্যস্থান না হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেল করা হলে ভাল হতে পারে। কারণ পার্বত্য চ্ট্টগ্রামে জনসংখ্যার ঘনত্ব কম হওয়াতে সৃষ্ট সমস্যা সমাধান বিলম্ব হলেও অন্যান্য স্থানের চেয়ে ভাল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রস্তাবটি ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে চীন। এরা বাংলাদেশ যাতে আন্তর্জাতিক ফোরামে জোরালো ভাবে তুলে ধরতে না পারে সেজন্য ইতিমধ্যে জানিয়েছে। এরা আরো বলে, এটা দ্বি-পাক্ষিক সমস্যা। মোটেও তা না। গ্রাম্য একটা প্রবাদ আছে-ছাগল নাচে খুঁটির জোরে। বার্মার খুঁটির জোর কোথা সবাই তা জানে। বারবার বাংলাদেশের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করলেও চরম ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। বার্মা সরকার সমস্যাকে জ্ইিয়ে রেখে অন্য দিকে মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার সমূহ প্রচেষ্টা বাংলাদেশ তাদের পাতা ফাঁদে পা দেয় নি। তবে সমাধান কীভাবে? জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্ব কমিশনের ৮৮ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হতে পারে অনেকের বিশ্বাস। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও “আনান কমিশন”এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। প্রয়োজনে সব ধরনের সাপোর্ট তিনি দেয়া কথা নির্দ্বিধায় বলেছেন। অং সান সূচিও চায় আনান কমিশনের মাধ্যমে আরাকানে শান্তি প্রতিষ্ঠা। কিন্তু তার অবস্থান কৌশলী। তিনি মন থেকেই এ কথা বলছেন না যে তা পরিষ্কার। তার শান্তিতে পাওয়া নোবেল পুরষ্কার আজ প্রশ্নবিদ্ধ। শান্তিকামী হয়ে কেন এমন নিমর্ম গণহত্যায় সেনাবাহিনীকে সমর্থন করছেন তা রহস্যজনক। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা নাকি মায়ানমারে ফিরতে চান না। এটা কেমন কথা? নিজের জন্মস্থান ছেড়ে পরদেশে বসবাস করতে পারে না কেউ। এটাও এক ধরনের অপপ্রচার। এদিকে বাংলাদেশের অবস্থানরত রোহিঙ্গারাও বেশ কিছু দাবী তুলেছেন সেদেশে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে। দাবীগুলো যৌক্তিক হলেও বাংলাদেশে থেকে এধরনের দাবী করা আদৌ সিদ্ধ কিনা প্রশ্ন সাপেক্ষ। মানবেতর জীবন যাপনকারী রোহিঙ্গা মুসলিমরা আজ প্রকৃত অর্থে অসহায়। একটি দেশের জন্মগত অধিকার নাগরিকত্বকে কলমের খোঁচায় বাতিল করে অবৈধ ঘোষণা করা যায় না। এভাবে চলতে পারে না। বিশ্ববাসী সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করা স্বাধীন কোন জনগোষ্ঠীর জন্য দুরূহ হয়ে পড়বে। সবুজ-শ্যামল পৃথিবীটা কেন আজ ধ্বংসের কিনারায়? কতগুলো দানব আজ কেন লোলুপ রক্তপান করে মানবতাকে হত্যা করতে চায় তা ভাবতে হবে। জাতিসংঘ নামক টুঠো জগন্নাথের কী প্রয়োজন যদি বাস্তুহারা বিপন্ন মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে না পারে ?
আরেক পরাশক্তি রাশিয়াও কোন রাখঢাক না করেই বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ভারতের অবস্থানও কপটতাপূর্ণ। ভারতীয় সাংবাদিক গৌতম দাস একটি জাতীয় পত্রিকায় লিখেছেন, “ভারতের অবস্থান বার্মার রোহিঙ্গা নির্মূলের নীতি ও বর্বরোচিত তৎপরতার পক্ষে এবং এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার।.....ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ৬ সেপ্টেম্বর বার্মা সফরে গিয়ে সামরিক বাহিনীর রোহিঙ্গা নির্মূলকে ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা’র কাজ বলে বাহবা দিয়ে এসেছিলেন। বার্মার এই কথিত সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের কাজে মোদি গভীর উদ্বেগ দেখিয়ে এসেছিলেন। এটাই হল রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের প্রকৃত অবস্থান।” (নয়াদিগন্ত-২৬ অক্টোবর, ২০১৭)
আমরা এই বৃহৎ প্রতিবেশী এবং দুই পরাশক্তির হাতে পণবন্দী। রোহিঙ্গাদের ভাগ্য যেন ওদের হাতে। শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা সবই তাদের মুষ্ঠিবদ্ধ। মানবতার আজ অসহায়। বাংলাদেশের জনগণ দলমত নির্বিশেষে রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষে। ঐতিহাসিকভাবে আরাকানের সাথে আমাদের সম্পর্ক বিরাজমান। প্রতিবেশি হিসেবেও তাদের অধিকার অগ্রগণ্য। দেশের অকুন্ঠ চিত্তে তাদের গ্রহণ করেছে। অন্যান্য মুসলিম দেশ কিন্তু প্রত্যাশিত ভুমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রকৃত অর্থে যা সাহায্য পাওয়ার অধিকার তা পাচ্ছে না। ত্রাণের চেয়ে তাদের প্রাণ রক্ষা এবং নিরাপত্তা জরুরী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, রাজপথের বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভুমিকা দৃশ্যমান। বেগম খালেদা পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখার জন্য যাওয়ার বিপত্তিটা নিন্দনীয়। নিজ জেলা ফেনীতে ঘটিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় তদন্তপূর্বক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান আবশ্যক। এ ঘটনা ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে অভিজ্ঞজনের ধারণা।
আরাকান জ্বলছে তো জ্বলছেই। লাশের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিনিয়ত মানুষ সীমানা পার হচ্ছে। পার হতে গিয়ে ইতি মধ্যে নাফ নদীতে সলিল সমাধি হয়েছে কত বনি আদমের। আরো কত শত লাশ পানির অতলে হারিয়ে গেছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ সহ বিশ্বনেতারা কেন থামাতে পারছে না এই নিধনযজ্ঞ। আসলে রোহিঙ্গারা মুসলিম বলেই আজ আন্তর্জাতিক কিলিং মিশনের শিকার। বৃটিশের প্রসবিত ও যুক্তরাষ্ট্র লালিত ইসরাইলের মানবতা বিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে কোন প্রস্তাব জাতিসংঘ নিলে ভেটো দিয়ে তা যুক্তরাষ্ট্র প্রতিহত করে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির দাবানল জ্বলছেই। তারই সূত্র ধরে চীনের ভেটো শক্তির আসকারা পেয়ে বৌদ্ধ দানবরাও গণহত্যা চালাচ্ছে আরাকানে। তারা আরাকানীদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে, এমন কি নাম পরিবর্তন করে রাখাইন স্টেট ঘোষণাও করেছে। বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা যা করছে তা সর্বকালের গণহত্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। আসলে জাতিসংঘের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ‘ভেটো নামক’ বুলেট দিয়ে যে যার মত খেলছে। তার নির্মম শিকার বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমানরা। জাতিসংঘকে পুর্নগঠন করে প্রভাশালী মুসলিম যেকোন একটি দেশকে ভেটো পাওয়ার দিয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা সময়ের দাবী। আপাতত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের কোন লক্ষণ প্রতিভাত হচ্ছে না। কারণ সংকট সমাধানের চাবি যে চীনের হাতেই। বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সমস্যাকে আন্তর্জাতিক ফোরামে বলিষ্ঠতার সাথে তুলে ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি মায়ানমার সরকারের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। তারা বলছে বাংলাদেশ সরকারের কারণেই নাকি রোহিঙ্গা সমস্যার জিইয়ে রয়েছে। অং সান সুকীর মুখপাত্র জও হতাই মাত্র দু’দিন আগে রাজধানী ঢাকাতে বসে বলেন, ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে বার্মা সরকার প্রস্তুত। কিন্তু অন্যপক্ষ (মানে বাংলাদেশ) তা গ্রহণ করছে না। তার দাবী হাস্যকর বৈকি। অপপ্রচারের মাধ্যমে কালক্ষেপন করে রোহিঙ্গা সমস্যা পাশ কাটাতে চায়। এভাবে বিশ্বে প্রতিনিয়ত আরেকটি জ্বলন্ত ইস্যু তৈরি হলে রোহিঙ্গা সমস্যা চাপা পড়ে যাবে-তার জন্য এই কালক্ষেপন মায়ানমার সরকারের। কেবল রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস বাণীর রেকর্ডই বারবার শুনিয়ে যাবে। কাজের কাজ কিছু করবে বলে মনে হয় না।
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১০৯৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন