বিপর্যস্ত সিরিয়া : মানবতার আর্তনাদ
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ০৪ মে, ২০১৭, ০৭:৩২:২২ সন্ধ্যা
সিরিয়া সংকট নিয়ে এই নিবন্ধ যখন লিখা শুরু করেছি তখন নতুন খবর প্রচারিত হচ্ছে, সিরিয়া বিদ্রোহীদের দখলে থাকা দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ইদলিব প্রদেশে রাসায়নিক অস্ত্র হামলা চালিয়েছে। হামলায় ১১ শিশুসহ অন্তত ৫৮ জন নিহত হয়েছে। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের খবর অনুযায়ী রাসায়নিক হামলায় আরো কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়েছে। ইদলিবের কেন্দ্রের খান শেখন শহরে ওই বিষাক্ত গ্যাস হামলা হয়েছে। ইদলিবের স্বাস্থ্য অধিদফতরের মতে, গ্যাস হামলায় নিহতের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে যেতে পারে। এছাড়া আহত হতে পারে আরো ৪০০ মানুষ। মূলতঃ গ্যাসের প্রভাব ও দম বন্ধ হয়ে এ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র যেখান থেকে রাসায়নিক হামলা চালিয়েছিল সেখানে ৫০টির অধিক ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। কংগ্রেসের অনুমতি না নিয়ে ট্রাম্প এ হামলা চালায়। বেশ হতাহতও হয়। সিরিয়া ও রাশিয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন-এটা সুস্পষ্ট আগ্রাসন। রাশিয়াও এখন বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাচ্ছে বলে ঘোষণা দেয়। সিরিয়ার যুদ্ধ বা সংঘাত ছয় বছর পার করলো। যুক্তরাষ্ট্র এইপ্রথম সরাসরি হস্তক্ষেপ করায় যুদ্ধের মোড় এখন কোনদিকে টার্ন করে বলা মুশকিল! পারস্পরিক স্বার্থ, আদর্শগত পার্থক্য, ক্ষমতার দাপট, নীতিহীন বিশ্ব রাজনীতি এবং পরাশক্তিগুলোর যুদ্ধক্ষেত্র এখন সিরিয়া। আসলেই সেখানকার পরিস্থিতি অনেক জটিল আকার ধারণ করেছে। পরাশক্তিগুলো যে যার মতে খেলছে। একদিকে আছে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, তুরস্ক এবং সিরিয়া বিদ্রোহীরা। অন্যদিকে রাশিয়া, ইরান এবং আসাদ সরকার। আবার মাঝখানে আইএস সন্ত্রাসীরা। আবার তুরস্কও এখন রাশিয়ার সাথে মিত্রতা স্থাপন করেছে। তুরস্কের অবস্থান তাই পরিষ্কার নয়। এখানে সবচাইতে বেশি সিরিয়াস হচ্ছে রাশিয়া এবং ইরান। যেকোন কিছুর বিনিময়ে আসাদ সরকারকে রক্ষা করতে তারা বদ্ধপরিকর। আইএস এবং বিদ্রোহীরাও এখন কোণঠাসা। এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বেশ দুর্বল ছিল। সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার সরকারের নীতি এখানে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই আসাদ সরকার সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পরাশক্তির রাশিয়ার উত্থানও হচ্ছে। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রই ছিল একক পরাশক্তি। এখন আগের চেয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়ার বেশ নাক গলাচ্ছে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের কঠিন ভুমিকায় যুদ্ধ আরো ব্যাপক আকার ধারণ করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
কিছুদিন পূর্বেও দ্বিতীয় দফা শান্তি আলোচনাও কাখাস্তানের রাজধানীতে কোন অগ্রগতি ছাড়া শেষ হয়। কেন জানি যুদ্ধটা আরো দীর্ঘস্থায়ী হতে যাচ্ছে। যেন কোনপক্ষই সমস্যা সমাধানে আন্তরিক নয়। জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিত ব্রিফিং দিয়ে দায় সারছে। নিন্দা, হুমকি-ধমকি দিয়ে কি সমস্যার সমাধান অবান্তর। জাতিসংঘ বলছে, সিরিয়ার জনগণ প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না এবং তিনি নির্বাচনে দাঁড়ালেও জনগণ তা মেনে নেবে না। এক ব্রিফিং-এ আসাদকে যুদ্ধাপরাধী বলেও অভিযুক্ত করেন। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে বড়ো বাধা। এছাড়া সিরিয়ার জনগণের জন্য তার শাসন অগ্রহণযোগ্য। মার্কিন দূত টিলারসন আঙ্কারায় বলেন, প্রেসিডেন্ট আসাদের ভবিষ্যতের ব্যাপারে সিরিয়ার জনগণকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার চলে যাওয়ার বিষয়ে আর জোর করবে না। আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে রাশিয়ার যেখানে জড়িত সেখানে সহসা শান্তি আসবে না। ফলে সিরিয়ার দীর্ঘ ছয় বছরের সংঘাত অবসানের ক্ষেত্রে আসাদের ভবিষ্যতের বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বারবার হোঁচট খেতে হচ্ছে।
সিরিয়ার অনেক নগরী সমূলে ধ্বংস প্রায়। দামেস্ক, আলেপ্পো, ইদলিব, লাতাকিয়া, রাক্কা, পালমেইরা এবং হোমস্ শহরগুলি এখন মৃত্যুপুরী। নাগরিক জীবন বিপর্যস্ত। সব অবকাঠামো ধ্বংসপ্রায়, কবে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে কেউ জানে না। এই ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধে নিহত হয়েছে ৫ লক্ষাধিক মানুষ। এর মধ্যে ৬০ হাজারের ও অধিক শিশু। ৫০ লক্ষাধিক মানুষ দেশ ছেড়ে অভিবাসী হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদ, তার প্রধান মিত্র রাশিয়া ও ইরানের হঠকারী নৃশংসতার কারণে এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী বলে কোন কোন মহলের অভিমত। বারবার যুদ্ধ বিরতি লঙ্ঘন করে প্রতিপক্ষ হামলা সংঘটিত করছে। আসাদের সাথে রাশিয়া এবং ইরান না থাকলে এতদিনে সাদ্দামের পরিণতি বরণ করতে হতো। কথা হচ্ছে, সাদ্দামের পরিণতি হলে কি শান্তি আসত সিরিয়ায়? মোটেও না তা। যারাই যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করেছে তারাই মূল কুশীলব। তারা যতদিন চাইবে লড়াই ততদিন চলবে! দুই প্রতাপশালী প্রতিপক্ষ লড়াই শেষ করলেও আইএসের কারণেই যুদ্ধ আরো দীর্ঘস্থায়ী হবে, যেটা ইরাকে ঘটছে। মজার ব্যাপার আইএস নিমূর্লের কথা বলে রাশিয়া এবং আমেরিকা যুদ্ধে জড়ায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না উদ্দেশ্য ভিন্ন। কাতারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হামাদ বিন জাসেম বলেছেন, “সিরিয়ায় যা ঘটছে তা গণবিপ্লব নয়, বরং মার্কিন, সৌদি ও দোহা সরকারই সিরিয়ার ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, আর আমার শাসনামলেই তা শুরু হয়েছে।” তিনি আরো বলেন, “২০১২ সালে যখন সিরিয়ার বিষয়ে কাজ শুরু করি তখন নিশ্চিত ছিলাম যে খুব শীঘ্রই কাতার সিরিয়ার পরিস্থিতির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। কারণ, সৌদি সরকার তখনও সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু পরে সৌদি আরব সরকার নীতি পরিবর্তন করে এবং সিরিয়ায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইস্যুটি রিয়াদ ও দোহার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে পরিণত হয়।” জাসেম সিরিয়া-সংকটকে একটি আন্তর্জাতিক গেইম হিসেবে অভিহিত করে বলেন, মার্কিন, সৌদি ও কাতারের সরকার এই খেলার শরিক এবং রিয়াদই এখানে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। তিনি এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোলান দুমা’র একটি বক্তব্য তুলে ধরেন যেখানে দুমা বলেছিলেন “আরব-বসন্ত” শুরুর দুই বছর আগেই বৃটেন সিরিয়ায় হামলার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল এবং সিরিয়ার সংকটটি আসলে একটি ষড়যন্ত্রেরই ফসল। জাসেমের বক্তব্য একপেশেই মনে হয়েছে। অবশ্য আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তো ছিলোই সেটা এড়ানোর সুযোগ নেই।
যুক্তরাষ্ট্র যখন নির্বাচনী ডামাডোলে ব্যস্ত ঠিক সে সময়ে পুতিন কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দিয়ে সিরিয়ায় নিজের অবস্থান দৃঢ় করেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হওয়ায় এখন চলবে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। রাশিয়া ক্রমশ নিজেদের অংশগ্রহণ বাড়ালে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার এই গৃহযুদ্ধ থেকে তাদের সামরিক শক্তি গুটিয়ে নেয়। ওবামার কিছু উদারতার কারণে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি খর্ব হয়েছে। তাই পুতিন সুকৌশলে সিরিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারে সফলতা অর্জন করেছেন। আমাদের মনে আছে, স্নায়ুযুদ্ধের সময় এই সিরিয়া ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমানে রাশিয়ার) মিত্র দেশ। এদিকে পেন্টাগনের প্রাথমিক পরিকল্পনার আওতায় সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে আরো এক হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হবে ঘোষণা দেন। অবশ্য পরিকল্পনাটি কার্যকর করতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিসের অনুমোদন লাগবে। মধ্যপ্রাচ্যে নিযুক্ত মার্কিন বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জোসেফ ভোটেল কিছুদিন পূর্বে বলেছিলেন, সিরিয়ায় আইএস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরো বেশি মার্কিন সেনা প্রয়োজন হতে পারে। ওবামার আমলে তিনি হুংকার দিয়েছিলেন আসাদের বিরুদ্ধে, “রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করলে বাশার বিপদসীমা অতিক্রম করবেন।” কিন্তু বাশার রাসায়নিক অস্ত্র বারবার ব্যবহার করেছেন। ওবামা তখনও কোনো পদক্ষেপ নেননি। জাতিসংঘও অবরোধ প্রস্তাব করলে চীন ও রাশিয়া ভেটো দিয়ে ব্যর্থ করে দিতেন। ট্রাম্পের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা মধ্য দিয়ে আসল যুদ্ধ কি শুরু হয়ে গেল?
মূলত সিরিয়া সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা ও ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতির কারণে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে চটাতে চাচ্ছে না। এভাবে চলতে থাকলে রাশিয়ার ফ্রন্ট আরো বিস্তৃত হতে পারে। শোনা যাচ্ছে আফগানিস্তানেও এখন নজর নিবদ্ধ করেছে বলে বিভিন্ন কর্মকা-ে প্রতীয়মান হচ্ছে। আমরা জানি যেকোন খেলায় মধ্যমাঠ যারা দখলে রাখবে তারাই বিজয়ী হবে। বিশ্বের মধ্যমাঠ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, ইয়েমেন, মিশর, ফিলিস্তিন, রাশিয়া কিছু অংশসহ। তাই বিশ্বের দুই পরাশক্তির মধ্যমাঠ দখলের লড়াইয়ে মুসলিম বিশ্ব। রক্তপাত, হানাহানি, সংঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ আমার মনে হয় পৃথিবী ধ্বংসের পূর্বপর্যন্ত চলতেই থাকবে! কোথাও সাময়িক রক্তপাত বন্ধ হলেও অনেক স্থানে দীর্ঘস্থায়ীভাবে চলতেই থাকবে। সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন-এভাবে যুদ্ধের ফ্রন্ট কেবল বাড়তেই থাকবে। শান্তি সে তো সূদুর পরাহত! আমরা শান্তিকামী মানুষ, শান্তির প্রতি চাতকের মতো কেবল চেয়েই থাকব! যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ অভিবাসীরা যাতে সেখানে অনুপ্রবেশ করতে না পারে নিত্য নতুন কলাকৌশল প্রয়োগে করে বাধা দিচ্ছে। তবুও বিপন্ন মানব¯্রােত ঠেকাতে পারছে না। মানবতার আহাজারি বন্ধের উদ্যোগ না নিয়ে যতই ঠেকানোর অপচেষ্টা চালান না কেন কোন স্থায়ী সমাধান হবে না? কারণ আইলানদের মিছিল যে শেষ হবার নয়!
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১০২৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন