রোহিঙ্গা সমস্যা ও নাগরিক ভাবনা...
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ০৪ জানুয়ারি, ২০১৭, ০৮:০৭:১১ রাত
রোহিঙ্গা সমস্যা বর্তমান বিশ্বের সমস্যাগুলো মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত ও জ্বলন্ত সমস্যা। এ সমস্যা অনেক পুরনো। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর একচোখা নীতি, জাতিসংঘের কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নেয়া, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নীরবতা এহেন সমস্যা জিইয়ে রয়েছে বছরের পর বছর। গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে যে দেশ নোবেল পুরষ্কার লাভ করেছে। সেই দেশে এমন নৃশংস শতাব্দীর নৃশংসতম জাতিগত নির্মূল অভিযান চলতে পারে ভাবাই যায় না। নোবেল লরিয়েট অং সান সুকীদের ভুমিকা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঝড় বয়ে গেছে অং সান সুকীর নোবেল প্রত্যাহারের জন্য। বৌদ্ধদের অহিংস নীতি আজ কাগুজে বলে প্রমাণিত। আমরা জানি রোহিঙ্গা মুসলিমরা বার্মায় কোন উড়ে এসে জুড়ে বসা জাতি নয়। হাজার বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ এ জাতি। শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর শেষ শয্যা মায়ানমারে। এ সমস্যার সমাধানে প্রতিবেশি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূমিকা আরো জোরালো করার দাবী রাখে। ভ্রাতৃত্ববোধের নজির হিসেবেও এগিয়ে আসা দরকার আমাদের। কিন্তু কোন অদৃশ্য কারণে আমরা তা হতে দিচ্ছি না বোধগম্য নয়, অবশ্যই এর আগের অনেকগুলো হৃদয়বিদারক ঘটনার কারণে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা আশ্রয়ে আছে এদেশে। তবুও মানবতার খাতিরে একটুখানি আশ্রয় দেয়া দরকার। একদিকে বর্মী নাসাকা বাহিনী, অপরদিকে বাংলাদেশের বিজিবি। কোথায় যাবে তারা? মাঝখানে সাগর, ভাসছে নৌকা ভর্তি বনি আদম, কাতর, উদ্বেগাকুল চাহনি! কত জনের সলিল সমাধি হয়েছে স্রষ্টা ছাড়া আর কেউ জানে না!
গণহত্যা থেকে প্রাণ বাঁচাতে পানির মত আসছে রোহিঙ্গা মুসলমানরা। আমরা আশ্রয় দিচ্ছি না, হীনমন্যতার জন্য। অথচ আমরা অতীত ঘাটলেই অত্যাচার থেকে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় পেয়েছি এমন দৃষ্টান্ত আছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিবেশি দেশ ভারত আমাদের এ সাহায্য করেছিল। ফলে পাকিস্তানী বাহিনীর হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে পেছে লক্ষ-কোটি মানুষ। ইতিহাসে পাতায় আরাকান একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল, বর্মীদের আধিপত্যবাদের কারণে তা আজ মিয়ানমারের একটি প্রদেশ। যা বর্তমানে “রাখাইন” নামে পরিচিত। রোহিঙ্গা সমস্যার সূত্রপাত সম্পর্কে বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ বলেন, “রোহিঙ্গারাও এক সময় স্বাধীন আরাকানের অমাত্যসভা থেকে শুরু করে রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখলেও বর্তমানে তারা আরাকানের সবচেয়ে নিগৃহীত জাতিগোষ্ঠী। ১৭৮৪ সালে বর্মীরাজ বোধপায়া কর্তৃক আরাকান দখলের মধ্য দিয়েই মূলত রোহিঙ্গাদের নিগৃহীত জীবনের সূচনা হয়। অতঃপর ব্রিটিশ শাসনের সমাপ্তিলগ্নে ব্রিটিশ কূটকৌশলের ফলে তাদের জীবনে দ্বিতীয়বারের মত অনিশ্চয়তা নেমে আসে। স্বাধীনতা-উত্তর বার্মায় ১৯৬২ সালে সামরিক জান্তা নে উইন কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পর হতে রোহিঙ্গারা ক্রমশ নাগরিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হতে থাকে। অবশেষে ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনের নামে তাদেরকে বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করে কল্লা বা বিদেশী আখ্যা দিয়ে দেশ থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে।” (সূত্র : আরাকানের মুসলমানদের ইতিহাস)
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দাবীতে অবশেষে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যার ব্যাপারে তদন্ত করবেন বলে খবর পাওয়া গেছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পুলিশি নির্যাতনের ভিডিওটি গত নবেম্বরের। মংডোতে পুলিশের অভিযান চলার সময় ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছিল। এক পুলিশ কর্মকর্তাই ভিডিওটি ধারণ করেছিলেন। ভিডিওতে দেখা গেছে একটা বিশাল সংখ্যক গ্রামবাসী পুলিশ কর্মকর্তাদের সামনে সারিবদ্ধভাবে বসে আছেন। আরও দেখা গেছে এক পুলিশ কর্মকর্তা এক ব্যক্তিকে মারধর করছেন, আর আরেকজন তার মুখে লাথি দিচ্ছেন। এরপর অন্য লোকদেরও লাথি দিতে থাকেন তারা। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, যেসব কর্মকর্তা পুলিশ বাহিনীর আইন লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে সাংবাদিক ও তদন্তকারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়ায় স্বাধীনভাবে নিপীড়নের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা যাবে কিনা, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ প্রকাশ করছেন সবাই। আসলে নির্যাতন, হত্যার খবর যা প্রকাশ পাচ্ছে তা নিতান্তই স্বল্প, বাস্তবে তার চেয়েও অবস্থা ভয়াবহ। একবিংশ শতাব্দীতে এহেন জঘন্য কুকর্ম অকল্পনীয়।
যা-ই হোক আরাকানের মুসলমানদের নিয়ে নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। তাদের বিপদে আমাদেরকে আশ্রয় দিতে হবে এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। একজন নাগরিক হিসেবে, ভ্রাতৃত্ববোধের তাগিদও তাই। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে উপায় বের করা সময়ের দাবী। তবে এক্ষেত্রে জাতিসংঘকে বেশি ভুমিকা পালন করতে হবে, এরপর আসে ওআইসি এবং প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলোকে। সৌদি আরব, পাকিস্তান, মিশর, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াকে অগ্রণী ভুুমিকা পালন করতে হবে। বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থী রয়েছে তাদের দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা মাধ্যমে ফিরিয়ে নিতে প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এটা বাংলাদেশের জন্য বাড়তি এক বোঝা। তাই প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশেরই ব্যাপক ভুমিকা থাকা অনিবার্য। প্রয়োজনে বার্মার সাথে বাণিজ্য যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, বার্মার অনেকগুলো পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সকল দমন-নিপীড়ন, হত্যা বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। দেশে দেশে যে সকল রোহিঙ্গা নাগরিক রয়েছে তাদের ফিরিয়ে এনের সকল নাগরিক স্বীকৃতিসহ সকল সুবিধা প্রদানে ব্যবস্থা করতে হবে। মায়ানমারের শাসকদের মনে রাখতে হবে বন্দুক দিয়ে সবকিছু অর্জন করা যায় না। প্রত্যেক মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে, স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। প্রয়োজনে রাখাইন স্টেটের মুসলমানদের জন্য আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করতে হবে বিশ্ব সম্প্রদায়কেই।
=====
বিষয়: বিবিধ
১০১১ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমার পোস্ট টি স্বপন ২ ও মনসুর আহমেদ গংয়েরা তাদের কমন ডায়লগ ও লিংক মেরে ছ্যাতা ব্যাতা করে দিছে রে ভাই !
http://www.bdnatun.net/blog/blogdetail/detail/3323/HOTOVAGA/80228
তবে মতামতটির জন্য অবশ্যই আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ইতিহাসের আলোকে পর্যালোচনাপূর্বক আপনার জ্ঞানগর্ভ মূল্যবান লিখাটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে যে দেশ নোবেল পুরষ্কার লাভ করেছে। সেই দেশে এমন নৃশংস শতাব্দীর নৃশংসতম জাতিগত নির্মূল অভিযান চলতে পারে ভাবাই যায় না। নোবেল লরিয়েট অং সান সুকীদের ভুমিকা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঝড় বয়ে গেছে অং সান সুকীর নোবেল প্রত্যাহারের জন্য। বৌদ্ধদের অহিংস নীতি আজ কাগুজে বলে প্রমাণিত। আমরা জানি রোহিঙ্গা মুসলিমরা বার্মায় কোন উড়ে এসে জুড়ে বসা জাতি নয়। হাজার বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ এ জাতি। শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর শেষ শয্যা মায়ানমারে। এ সমস্যার সমাধানে প্রতিবেশি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূমিকা আরো জোরালো করার দাবী রাখে।
সহমত।
আসলে আমাদের কাছ মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা দিন দিন লোপ পাচ্ছে। আমাদের অবস্থাও রোহিঙ্গাদের মত হতে কতক্ষণ! আমরা তাদের জন্য কাঙ্খিত ভুমিকা রাখতে পারছি না, ঈমানের দৈন্য দশার কারণে!
ধন্যবাদ আপনার প্রেরণামূলত মতামতটির জন্য।
কক্সবাজার যাবার পথে অনেকবার গাড়ি চেক করা হয়েছে, শুধু রোহিঙ্গাদের খোজে।
ধন্যবাদ আপনাকে
মন্তব্য করতে লগইন করুন