মহানবী (সা)এর আগমন ও রবিউল আউয়ালের আসল চেতনা..
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৮:০৫:৫৮ রাত
সাইয়্যেদুল মোরসালীন, রাহমাতুল্লিল আলামীন, বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা) ৫৭০ (মতান্তরে ৫৭১ খৃ.) খৃ. ৯/১২ই রবিউল আউয়াল মাসে মুক্তির র্বাতা নিয়ে ধূলির ধরায় শুভাগমন করেন। তাঁর এই শুভাগমন মানবতার মুক্তির অনন্য দিশা। তখনকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা ছিল এরকম : গোত্রে গোত্রে কলহ-বিবাদপূর্ণ, সংঘর্ষ, খুন, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি, জেনা-ব্যাভিচার, লুটতরাজ, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারের স্টীম রোলার, মেয়ে শিশুর জীবন্ত কবর দেয়া, সুদের অক্টোপাশে বন্দী মানবতা, রাজনৈতিক নিপীড়ন, পর সম্পদ হরণ, এতিমের প্রতি সীমাহীন রূঢ়তা ইত্যাদিতে ভরপুর। ইতিহাসে এ সময়কে “আইয়ামে জাহিলিয়াত” বা অন্ধকার যুগ বা অজ্ঞতার যুগ বলা হয়। ঠিক এমনি সময় মানবতা মুক্তির প্রহর গুণছিল। এহেন দূর্দিনে নবীজী (সা) এলেন বিশ্ব মানবতার জন্য অশেষ অনুগ্রহ ও নিয়ামত হিসাবে। আল্ কোরআনে এরশাদ হয়েছে,
“ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতুল্লিল আলামীন ”অর্থাৎ আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।” (সূরা আম্বিয়া-১০৭)
বিশ্বনবী (সা)এর সমগ্র জিন্দেগী আমাদের জন্য একমাত্র অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ। আল্ কোরআনের ভাষায়,
“লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসূলুল্লাহি উস্ওয়াতুন হাসানা” অর্থাৎ তোমাদের জন্য রাসূলের জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। (সূরা আহযাব-২১)
এ আদর্শকে হৃদয়ে বদ্ধমূল করে জীবন পরিচালনা করলেই মানব জীবন সফল হবে। বিদায় হজ্বের ভাষণেও তিনি এ কথার প্রতিধ্বনি করেন। বলেছেন,
“তোমরা কখনো গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট হবে না, এ দু’টি জিনিস দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরলে : তা হল এই, কালামুল্লাহ শরীফ এবং আমার সুন্নাহ। বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিগৃহীত, শোষিত, বঞ্চিত, পথহারা, দিকভ্রান্ত, সীমাহীন দুঃখ-দূর্দশায় আপতিত, হতাশাগ্রস্ত, পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত, ক্ষেত্রবিশেষে বাস্তুহারা ও লাঞ্ছিত মুসলমানদের শান্তি ও মুক্তির মুলসূত্র এটিই।
মূলতঃ রাসূল (সা) এর আগমন হয়েছিল মানবতার মুক্তির জন্য। বিপদগ্রস্ত, দিশেহারা মানবকুলকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়ে চিরসুখের নিবাস জান্নাতে নিয়ে যাবার জন্যে। দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার জন্যে। কোরআন বলছে,
“হুয়াল্লাজি আর সালা রাসূলাহু বিলহুদা ওয়াদ্বীনিল হাক্কি লিইউযহিরাহু আলা দ্বীনি কুল্লিহি ওয়ালাউ কারিহাল মুশরিকুন“ অর্থাৎ তিনি তাঁর রাসূলকে সত্যদ্বীন এবং নির্ভুল বিধি-ব্যবস্থা দিয়ে এজন্যই প্রেরণ করেছেন যে, তিনি যেন আল্লাহর দ্বীনকে অন্য দ্বীনের উপর বিজয়ী করেন, তা মুশরিকরা যতই অপছন্দ করুক না কেন? (সূরা ছফ:৯)
কোরআনের আরো দু’টি সূরা, ফাতহ্-২৮ এবং তওবা-৩৩ আয়াতেও একই বাণী উচ্চকিত হয়েছে। এই আয়াত ত্রয়ের কথা একটু চিন্তা করলে এ বিষয়ে সুষ্পষ্ট হয় যে, আমাদের সমগ্র জীবন পরিচালিত করতে হবে দ্বীনকে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে। সমগ্র তৎপরতার কেন্দ্র বিন্দু হবে আল কোরআন ও মোহাম্মদ (সা) জীবনকে অনুসরণ করে। মসজিদ-মাদ্রাসা, খানকা প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য হবে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করা এবং সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, সভা-সমাবেশ, মীলাদ, সীরাত, ওয়াজ-মাহফিলের উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি তথা গোটা রাষ্ট্রীয় ও সমাজের বৃহত্তর প্রশাসনের মূল কর্মকান্ড হবে আল্লাহর দ্বীনের মর্যাদা ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। একটি শোষণ, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই মহানবী (সা)এর এ ধরায় আগমন।
আমরা কালজয়ী জীবনাদর্শ ইসলাম, মহাগ্রন্থ আল্ কোরআন এবং মানবতার বন্ধু মোহাম্মদ (সা)কে নিয়ে সীমাহীন ভুলে নিমজ্জিত। আমাদের ভুল কোথায় এর কারণই বা কি তা অতি সুন্দরভাবে ব্যক্ত করেছেন, বিশ্ববিখ্যাত একজন মনীষী।
তিনি বলেন, “গোড়া থেকেই মুসলমানদের একটি বিশাল অংশ তিনটি ভুলের মধ্যে আক্রান্ত হয়ে আছে। প্রথমতঃ কোরআনকে তারা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের মত মনে করে। দ্বিতীয়তঃ ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের মতই শুধুমাত্র ধর্ম মনে করে। তৃতীয়ত : মোহাম্মদ (সা)কে অন্যান্য ধর্মীয় নেতাদের মতই শুধু একজন ধর্মীয় নেতা মনে করে। অথচ মানব জীবনে যা কিছু প্রয়োজন তার সবটুকুই আল্ কোরআনে লিপিবদ্ধ আছে। ইসলাম গতানুগতিক কোন ধর্ম নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। উদার, গণতান্ত্রিক ও সহনশীল বিধি ব্যবস্থা, যা সকল মানুষের অধিকারের পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধান করে। নবী করিম (সা) বিশ্ব মানবতার শিক্ষক ও বিশ্বস্ত বন্ধু। তাঁর নুবুওয়াত ও নেতৃত্ব কোন যুগ, কাল, গোষ্ঠী বা সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কিয়ামত পর্যন্ত তিনি মানুষের জন্য একমাত্র আদর্শ নেতা।”মহানবী (সা) শুধু ধর্মীয় নেতাই নন, তিনি ছিলেন একাধারে একজন আদর্শ স্বামী, আদর্শ শিক্ষক, ন্যায়পরায়ণ শাসক, একজন সফল সমাজ সংস্কারক, সফল ব্যবসায়ী, সিপাহশালার, আইনবিদ, চিকিৎসাবিদ, সমাজবিদ, রাজনীতিবিদ, পররাষ্ট্রনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, সর্বোপরি একজন আদর্শ মহামানব। এক জীবনে এতগুলি গুণাবলী বিশিষ্ট মানুষ পৃথিবীতে আর ছিল না, নেই এবং ভবিষ্যতেও আর আসবে না। তাঁর কৃতিত্বময় জীবন বিশ্বমানবতার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জল ইতিহাস রচনা করেছে। অনেক অমুসলিম মনীষীগণ তাঁর কৃতিত্বময় জীবনে অকুন্ঠ স্বীকৃতি দিয়েছেন। জোসেফ হেল বলেন, “মোহাম্মদ (সা) এমন একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন, যাঁর আগমন না হলে এই পৃথিবী অসম্পূর্ণ থেকে যেত।” জর্জ বার্নাড’শ বলেন, ''If all the world was united under then Mohammad world have been the best fitted man to lead the people of various creeds dogmas and ideas to peace and happiness'' অর্থাৎ যদি গোটা বিশ্বের বিভিন্ন সম্প্রদায়, আদর্শ ও মতবাদ সম্পন্ন মানব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এক অধিনায়কের শাসনাধীনে আনা হত, তবে একমাত্র মোহাম্মদ (সা)ই সর্বাপেক্ষা সুযোগ্য নেতা হিসাবে তাদেরকে সুখ ও সমৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করতে পারতেন।” তার মানে মোহাম্মদ (সা)এর নেতৃত্ব, আদর্শ, জীবন ও কর্ম অনুসরণ করলেই এ পৃথিবী আবার শান্তিতে ভরপুর হয়ে উঠত।
মহানবী (সা) এর রাষ্ট্র পরিচালনা পদ্ধতি ছিল শোষণ মুক্ত, সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের জন্য সাম্যের এবং কল্যাণমূলক। পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান মদীনা সনদ। ইতিহাস যার স্বাক্ষর এখনও বহন করছে। তাঁর বিদায় হজ্বের ভাষণ পৃথিবীতে মানবাধিকারকে উর্ধ্বে নিয়ে গেছে। আল্লাহ্র মেহেরবানীতে এ পৃথিবীতে এখন ১৫০ কোটিরও বেশী মুসলমান। তাঁর জীবনাদর্শ গ্রহণ করে দেড় হাজার বছর ধরে পৃথিবীর সর্বত্রই ছড়িয়ে গেছে উম্মতে মোহাম্মদী। কিন্তু কোথাও মুসলমানরা শান্তি ও নিরাপত্তায় নেই। এর কারণ যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ এ ধরণীতে রাসূল প্রবর্তিত ও খোলাফায়ে রাশেদার অনুসরণে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের দিকেই আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে আবার এ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ইসলামকে একটি ধর্ম নয়, জীবন ব্যবস্থা হিসাবে মানতে হবে। আল্ কোরআনকে হেদায়েতের সর্বশেষ বিধান হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। এর কিছু অংশ মানব আর কিছু অংশ মানব না, তা হতে পারে না। কোরআনকে খন্ডিত ভাবে দেখার কোন সুযোগ নাই। কোরআনের ভাষায়,
“তবে কি তারা কোরআনের কিছু অংশ বিশ্বাস এবং কিছু অংশ প্রতাখ্যান করে ? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করবে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনহীনতা এবং পরকাল দিবসে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হবে।” (সূরা বাকারা-৮৬)
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে এটা বুঝা যায় যে, রাসূল (সা)এর আগমনের কারণ মানুষকে হেদায়েতের রাস্তা দেখানো, আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির পথ দেখানো। তাঁর আগমন আমাদের বিশ্বসভায় গৌরবান্বিত করেছে, মর্যাদাবান করেছে। মানবতার একজন পরিপূর্ণ শিক্ষক হিসাবে মানুষের মুক্তির পথ কোন্টি তা বাস্তব অনুসরণের মাধ্যমে মানুষকে উন্নততর জীবন পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে গেছেন। একটি আদর্শ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ প্রথা বিলুপ্ত করে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দিয়েছেন। তাই রাসূল (সা)এর জন্মের এই রবিউল আউয়াল মাসে উম্মাহর মধ্যে যত মত বিরোধ আছে তা ভুলে তাঁরই শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। সকল প্রকার ফিৎনা-ফ্যাসাদ, হিংসা-বিদ্বেষ, আত্মপূজা,আত্মপ্রীতি, ধোঁকাবাজি, শঠতা, প্রবঞ্চনা, মিথ্যা, কুধারণা, গীবত, পাপাচার, মুনাফেকী স্বভাব ছেড়ে দিয়ে আমলদার আলেম-উলামা, সর্বস্তরের মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ হওয়া একান্তই জরুরী। অন্যথায় দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়ে ভ্রাতৃঘাতী তৎপরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে এবং নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস সাধন করব। আসুন আমরা নবীজীর প্রেমে ও আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সমস্ত মতবিরোধ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হই। অন্যথায় পরকালে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা থেকে কেউ বাঁচতে পারবো না। আল্ কোরআনে এরশাদ হয়েছে,
“যারা নানা দলে-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, স্পষ্ট হেদায়েত আসার পরও মতভেদ হয়েছে, তোমরা তাদের মত হয়ো না। এমন লোকদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।” আল্লাহ আমাদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে দ্বীনকে বুঝার এবং প্রতিষ্ঠার তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক : কলামিস্ট ও সম্পাদক, ইদানীং লিটল ম্যাগ।
বিষয়: সাহিত্য
১৪৪৯ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
রাসূল (সা)এর আগমনের কারণ মানুষকে হেদায়েতের রাস্তা দেখানো, আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তির পথ দেখানো। তাঁর আগমন আমাদের বিশ্বসভায় গৌরবান্বিত করেছে, মর্যাদাবান করেছে। মানবতার একজন পরিপূর্ণ শিক্ষক হিসাবে মানুষের মুক্তির পথ কোন্টি তা বাস্তব অনুসরণের মাধ্যমে মানুষকে উন্নততর জীবন পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে গেছেন। একটি আদর্শ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ প্রথা বিলুপ্ত করে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দিয়েছেন। তাই রাসূল (সা)এর জন্মের এই রবিউল আউয়াল মাসে উম্মাহর মধ্যে যত মত বিরোধ আছে তা ভুলে তাঁরই শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। সকল প্রকার ফিৎনা-ফ্যাসাদ, হিংসা-বিদ্বেষ, আত্মপূজা,আত্মপ্রীতি, ধোঁকাবাজি, শঠতা, প্রবঞ্চনা, মিথ্যা, কুধারণা, গীবত, পাপাচার, মুনাফেকী স্বভাব ছেড়ে দিয়ে আমলদার আলেম-উলামা, সর্বস্তরের মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ হওয়া একান্তই জরুরী। অন্যথায় দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়ে ভ্রাতৃঘাতী তৎপরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাবে এবং নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস সাধন করব। আসুন আমরা নবীজীর প্রেমে ও আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সমস্ত মতবিরোধ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হই।
অসাধারনভাবে পুরো বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এটাই উদ্দেশ্য
মন্তব্য করতে লগইন করুন