অবহেলিত, বিস্মৃত “জিবরাইলের ডানা” খ্যাত অমর কথাশিল্পী : ভাষা সৈনিক অধ্যাপক শাহেদ আলী
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ০৪ নভেম্বর, ২০১৬, ১১:২৯:০৭ সকাল
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অধ্যাপক শাহেদ আলীকে (জন্ম : ২৬ মে ১৯২৫ এবং মৃত্যু : ৬ নভেম্বর ২০০১) নিয়ে লেখাটি কোত্থেকে শুরু করব ভেবে পাচ্ছি না! তাঁকে জানি সেই নবম-দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন থেকে অমর সৃষ্টি “জীবরাইলের ডানা” নামক অসাধারণ গল্পের মাধ্যমেই। এরপর তাঁকে দেখি যতদূর মনে পড়ে ২০০০ সালে চট্টগ্রামে একুশে ফেব্রুয়ারীর একটি অনুষ্ঠানে। সেখানে তিনি আরেক কথাশিল্পী ও সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরীসহ আলোচক হিসেবে এসেছিলেন। দূর থেকে তাঁকে দেখেছি এবং আলোচনা শুনে আবেগে আপ্লুত হয়েছি। প্রিয় লেখকদের এভাবে সরাসরি দেখব, বক্তব্য শুনব সেটা খুব একটা চিন্তা করিনি। আর লেখকদের জন্য সম্মানের একটা স্থান হৃদয়ের গহীনে চিরকালই পোষণ করে এসেছি। তাঁর জন্ম সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে। তাঁর সহধর্মিণী ছিলেন প্রফেসর চেমন আরা।
শিক্ষা ও কর্মজীবন :
তিনি ১৯৪৩ সালে সুনামগঞ্জের সরকারি জুবিলী হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। এরপর সিলেট এম.সি কলেজ থেকে ১৯৪৫ সালে আই.এ এবং ১৯৪৭ সালে ডিস্টিংশনসহ বি.এ পরীক্ষায় কৃতকার্র্য হন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম.এ পাস করেন। ছাত্রাবস্থাতেই মাসিক “প্রগতি” পত্রিকা (১৯৪৪-৪৬) ও ১৯৪৮-৫০সালে ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র “সৈনিক” সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৫১ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর মিরপুর বাংলা কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ, ঢাকার আবুজর গিফারী কলেজ ও চট্টগ্রাম সিটি কলেজে বিভিন্ন সময়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৫ সালে দৈনিক বুনিয়াদ পত্রিকার সম্পাদক, ইসলামী একাডেমীর শিশু পত্রিকা “মাসিক সবুজ পাতা”র সম্পাদনা (বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন) এবং ১৯৫৬ সালে দৈনিক মিল্লাতের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব¡ পালন করেন। ১৯৬৩-৬৪ সালে বাংলা একাডেমী পত্রিকার সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য এবং পরে একাডেমীর কাউন্সিলর হন। তিনি রাইটার্স গিল্ডেরও নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। সবশেষে ১৯৮২ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ ও সংকলন বিভাগের পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
আন্দোলন ও সংগঠন :
শাহেদ আলী ছিলেন দক্ষ সংগঠক ও সর্বদা আন্দোলনমুখী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনসহ বিভিন্ন ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তাঁর প্রতিবাদী চেতনার কারণে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে সক্রিয় ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের অগ্রণী ভুমিকা পালনকারী সাংস্কৃতিক সংগঠন “তমদ্দুন মজলিশের” সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে খেলাফতে রব্বানী পার্টির টিকিটে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়া তাঁর অসাধারণ রাজনৈতিক বিজ্ঞতার পরিচয় মেলে। ১৯৯৯ সালে “তমদ্দুন মজলিশের” আজীবন সভাপতি দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ইন্তেকালের পর তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু উক্ত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অধ্যাপক শাহেদ আলীকে আমরা বরাবরই কথা সাহিত্যিক হিসেবে জানি কিন্তু তিনি আরো বহুমুখী গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। একজন মননশীল লেখক, সম্পাদক, অনুবাদক, আদর্শ শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সংগঠক, সমাজ-হিতৈষী এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তিনি গুণান্বিত ছিলেন।
সাহিত্য-কর্ম :
শাহেদ আলী অসাধারণ সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্য তথা আমাদেরকে ঋদ্ধ করেছে। তাঁর লেখার মাঝে, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মাটি ও মানুষের চিত্র গাঁথা, জীবন সংগ্রামের নিখুঁত চিত্র, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, আশা-নিরাশার দোলাচল, সামাজিক মূল্যবোধ, আদর্শের ব্যাপক বলিষ্ঠতা তিনি সাহসের সাথে উচ্চারণ করেছেন। এতে তিনি কোন রাখ-ঢাক রাখেন নি। জীবন ঘনিষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টিতে রয়েছে তাঁর অসামান্য অবদান। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর বিচরণ চোখে পড়ার মত। তাঁর মননশীল ও গবেষণাধর্মী গদ্য লিখনীর মধ্যে রয়েছে : পাকিস্তান রূপায়নে তরুণ মুসলিমের ভূমিকা (১৯৪৬), একমাত্র পথ (১৯৪৮), ফিলিস্তিনে রুশ ভূমিকা (১৯৪৮), সাম্রাজ্যবাদ ও রাশিয়া (১৯৫২), তরুণের সমস্যা (১৯৬২), তৌহিদ, (১৯৬২), বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান (১৯৬৪), জীবন নিরবচ্ছিন্ন (১৯৬৮), মুক্তির পথ (১৯৬৯), সাম্প্রদায়িকতা (১৯৭০), বুদ্ধির ফসল, আত্মার আশীষ (১৯৭০) ইত্যাদি। গল্প সমূহ : জিবরাইলের ডানা (১৯৫৩), একই সমতলে (১৯৬৩), শা’নযর (১৯৮৬), অতীত রাতের কাহিনী (১৯৮৬), অমর কাহিনী (১৯৮৭), নতুন জমিদার (১৯৯২), স্বনির্বাচিত গল্প (১৯৯৬), শাহেদ আলীর শ্রেষ্ঠ গল্প ইত্যাদি। তাঁর একমাত্র উপন্যাস হলো : হৃদয় নদী (১৯৮৫), নাটিকা : বিচার (১৯৮৫), অনুবাদ গ্রন্থগুলো হচ্ছে : এ যুগের বিজ্ঞান ও মানুষ (১৯৬০), ইসলামে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার মূলনীতি (১৯৬৬), মক্কার পথ-লেখক : মুহাম্মদ আসাদ (১৯৮৬), ইতিবৃত্ত (হিরোডাটাস), দ্য হিষ্ট্রি ও অফ পলিটিক্যাল সাইয়েন্স, দ্য ইকোনমিক অর্ডার ইন ইসলাম (১৯৮১), ইসলাম ইন বাংলাদেশ টুডে ইত্যাদি। শিশুতোষ গ্রন্থগুলো হলো : সোনার গাঁয়ের সোনার মানুষ (১৯৭১), ছোটদের ইমাম আবু হানিফা (১৯৮০), রুহীর প্রথম পাঠ (১৯৮১) ইত্যাদি।
অগ্রন্থিত লেখাসমূহ :
অধ্যাপক শাহেদ আলী তাঁর সাহিত্য জীবনে অসংখ্য লিখা লিখেছেন। ফলে অগ্রন্থিত লেখার সংখ্যাও অনেক রয়ে গেছে। ‘‘অশ্রু’’ গল্পটি মাসিক সওগাতে ১৯৪০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং তিনি ছিলেন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। এছাড়া রিসার্চ স্কলার, ক্রমশ, এই আকাশের হাওয়া, মানহানি, ছিন্নপত্র, পরিচয়, হাসি-কান্না, সোনার চেয়েও দামী, তুচ্ছ, আপন বিদায়, পিটিশন, ময়না তদন্ত প্রভৃতি গল্পও রয়েছে। লেখাগুলো বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় স্থান পেলেও এখনো অগ্রন্থাবদ্ধ রয়েছে। সাহিত্য সমালোচক অধ্যাপক মতিউর রহমান শাহেদ আলীর লেখার মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, “তাঁর লেখায় জীবনধর্মিতার সাথে তাঁর বিশ্বাসের এক আশ্চর্য শিল্প সুন্দর সুসমন্বয় ঘটেছে। শাহেদ আলীর কথাসাহিত্যে বাংলাদেশের নৈসর্গিক মনোরম দৃশ্যপট, সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-আকাঙ্খা, প্রেম-প্রণয়, স্বপ্ন-প্রত্যাশাপূর্ণ জীবনের চিত্র, বর্ণাঢ্য ঐতিহ্য, সামাজিক মূল্যবোধের সাথে আধুনিক জীবন-জিজ্ঞাসার দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ বৈচিত্র্যময় জীবন চিত্র মনোরম বৈভবে অভিনব হয়ে উঠেছে।” (বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য : পৃষ্টা-১৬৫)
জিবরাইলের ডানার কথা :
“জিবরাইলের ডানা” গল্পগ্রন্থে মোট সাতটি গল্প সঙ্কলিত হয়। গল্পগুলো হলো : ঐ যে নীল আকাশ, ফসল তোলার কাহিনী, নানীর ইন্তেকাল, এলোমেলো, পোড়ামাটির গন্ধ, আতসী এবং জিবরাইলের ডানা। বলা যায় “জিররাইলের ডানা” লেখকের সর্বশ্রেষ্ঠ গল্প। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র ‘সৈনিক' পত্রিকায়। প্রকাশের সাথে সাথেই আলোড়ন সৃষ্টি করে বোদ্ধা মহলে। তিনি যখন এমএ পরীক্ষা শেষ করেছেন, তখন এটি আইএ ক্লাশে পাঠ্য ছিল। জিবরাইলের ডানা হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি ও রাশিয়ান ভাষায় অনুদিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরিব্যাপ্ত এই গল্পটি নিয়ে ভারতের কয়েকজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার ছবি নির্মাণের আগ্রহ জানিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, জ্যোতির্ময় রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃনাল সেন এবং নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু একশ্রেণীর লোকের চক্রান্তে তাঁদের পরিকল্পনা সফল হয়নি। বাংলাদেশের স্বনামধন্য চিত্র পরিচালক ইবনে মিজানও “জিবরাইলের ডানা” নিয়ে ছবি তৈরি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অদৃশ্য কারণে তিনিও সটকে পড়েন। অবশ্য এতে শাহেদ আলীর কোন ক্ষতি হয়নি। বঞ্চিত হয়েছি আমরা, বাংলাদেশের কোটি কোটি চলচ্চিত্র পিপাসু জনতা। অধ্যাপক মতিউর রহমান বলেন, “তবে এর দ্বারা ‘জিবরাইলের ডানা’র অসাধারণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমরা অবগত হতে পারি। মোটকথা, দেশে-বিদেশে উচ্চ প্রশংসিত “জিবরাইলের ডানা” শাহেদ আলীর রচিত সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ও ছোটগল্প। এটাকে তার মাস্টার পিস বললে অত্যুক্তি হয় না। সমগ্র বাংলা ছোটগল্প সাহিত্যেও এটা একটি অনবদ্য রচনা হিসাবে স্বীকৃত।”
বিদেশ ভ্রমণ :
তিনি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীর বহুদেশ সফর করেন। এসব দেশ হলো-সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সুইডেন, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, ডেনমার্কসহ পৃথিবীর অনেক দেশ।
পুরস্কার ও সম্মাণনা :
অধ্যাপক শাহেদ আলী তাঁর সাহিত্য-কর্ম, ভাষা আন্দোলন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। এগুলো হলো : বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৪), তমঘায়ে ইমতিয়াজ (১৯৭০), রাষ্ট্রপতির ভাষা আন্দোলন পদক (১৯৮১), নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮৫), সিলেট লায়ন ক্লাব পদক (১৯৮৫), ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৬), জালালাবাদ লায়ন্স ক্লাব পদক (১৯৮৮), একুশে পদক (১৯৮৯), সিলেট যুব ফোরাম পদক (১৯৯০), বাংলাদেশ ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাওয়ার্ড, ইংল্যান্ড (১৯৯১), বাংলাদেশ ইসলামিক ইংলিশ স্কুল দুবাই সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯২), চট্টগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রদত্ত ‘কবি ফররুখ পুরস্কার (১৯৯৭), জাসাস স্বর্ণপদক (২০০০), আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পদক (২০০০) ও কিশোর কণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (মরণোত্তর-২০০৩) প্রভৃতি।
পরপারে যাত্রা :
তাঁর ছিল দীর্ঘ ষাট বছরের সাহিত্য সাধনার ইতিহাস। ২০০১ সালের ৬ নভেম্বর এই মায়াময় পৃথিবী ছেড়ে শক্তিমান ও মননশীল লেখক, সাহিত্যবান্ধব, অনন্য প্রতিভাধর “জিবরাইলের ডানা” খ্যাত অমর কথাশিল্পী ও ভাষা সৈনিক অধ্যাপক শাহেদ আলী নামের এক বর্ণিল ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান ঘটে।
******
বিষয়: সাহিত্য
১৭৯৬ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লিখাটি খুব ভালো লাগলো।
জাযাকাল্লাহু খাইরান।
উনার লেখা কি স্কুল কলেজের সিলেবাসে এখনো আছে? নাকি সেখানে 'খেলারাম' লেখকদের জায়গা দিতে উনাকে বিদায় করা হয়েছে?
আল্লাহ উনাকে বেহেস্ত নসিব করুনl
ধন্যবাদ আপনাকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন