সদরঘাটের কালু পাগলা ও মরা মুরগীর গল্প..
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ২৫ জুন, ২০১৬, ১২:৩৪:৩৪ দুপুর
ইউপি নির্বাচনে হেরে ভাতিজা বিমর্ষ অবস্থায় তার রূমে বসে আছে। তখন রাত ১১টা। ক্লাস টেনের ছাত্র আনাস। চাচার নির্বাচনের জন্য ভাইপো ভোটার না হয়েও নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল। তার চাচা বিজয়ী হবে সেটা একপ্রকার নিশ্চিত ছিল। যদিও তিনি সরকারী দলের বিদ্রোহী প্রার্থী। দু’জন প্রার্থী তার সমর্থনে প্রার্থীতাও প্রত্যাহার করেছিল। পরে শোনা গেছে চাচা টাকা দিয়ে ওদের বসিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দু’জনই সরকারী দলের হওয়াতে ভোট হয়েছিল, নইলে তো হত কিনা সন্দেহ! চাচার পক্ষে জনসমর্থনও অন্যপ্রার্থীর তুলনায় বেশি ছিল। মানুষ ধরেই নিয়েছিল চাচা আবদুল ওহাব চৌধুরী অবশ্যই জিতবেন, এলাকার চেয়ারম্যান হবেন-যদি না কোন হেরফের হয়! কিছুটা শঙ্কিতও ছিল, রাজনীতি বেশি না বুঝলেও দেশের খবরাখবর এবং হালচাল বেশ বুঝে। ক্লাসের ফার্স্ট বয় সে।
মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সান্ত্বনা দেয়, তুই ছোট ছেলে এসব চিন্তা করার দরকার কী? এসবের কোন দাম আছে? দেখ না, আমি তো ভোটও দিতে যাই নি। তোর পাড়াতো দাদীরাও যান নি।
আনাস বলে, "কী বলো মা? চাচার জন্য তোমরা ভোট দিলে না।"
মা বলে, "আরে বোকা! এসব কী ভোট?" তিনি আরো বলেন, তোর চাচা সমর্থকদের নিয়ে থানায় গেছে মামলা করতে।
আনাস ভাবে, মামলা করলে কী আর চাচার জিতবেন, মামলা চলতে চলতেও তো ৫ বছর চলে যাবে। পত্রিকায় পড়েছি এসব মামলা নাকি বেশি দিন টিকে না। তাই কোন লাভ হবে না মনে হয়।
“তোর এত বুঝে কাজ নেই। যা ফ্রেশ হয়ে আস, টেবিলে ভাত দিচ্ছি।” মা বলে।
আনাস মানতে পারছে না, চারদিকে খবর হয়ে গেছে চাচা জয়ের, তারা বিজয় মিছিলও বের করেছে। কিন্তু কিভাবে যে একটা ভোট কেন্দ্র সব ওলট পালট করে দিল পুলিশ এবং নির্বাচনী কর্মকর্তারা মিলে। চাচার দাবী পুণ:ভোট গণনা করতে হবে। ওরা মানতে নারাজ। ব্যালট ভর্তি বাক্সটি ছো মেরে ছিনিয়ে নিয়ে মাইক্রোতে উঠে পুলিশ এবং অন্যরা বিদ্যুত গতিতে চলে গেল। গাড়ীর পেছন পেছন বেকুবের মত তারাও দৌড়ল। থানা থেকে বিজয়ী ঘোষণা করা হল তপন কান্তি পোদ্দারকে! জনতা বিক্ষুদ্ধ হল, দোকান-পাট ভাঙচুর হল। বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থকদের কারো কারো বাড়িতে আগুন দেয়া হল। পুলিশ এসেছে। স্পট থেকে অনেকেই সটকে পড়েছে। উত্তেজনা থর থর কাঁপছে সারা গ্রাম। মুরব্বীরা পুলিশকে বুঝিয়ে চলে যেতে বললেন।
আনাস বিকেলে স্থানীয় বাজারের দিকে যায়।প্রায়ই বিকেলে বাজার হয়ে স্কুলের মাঠে যায়। বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। হকার থেকে পত্রিকা নিয়ে পড়ে। মাঠের এক কোণে আলিফ, শরীফ এবং হায়দার বসে। হাত দেখায় তারা আনাসও গিয়ে বসে। গতকালের নির্বাচনের আলাপ সর্বত্রই চলতে থাকে। পত্রিকারগুলোয় নির্বাচনী অব্যবস্থাপনার ভয়াবহ চিত্র দেখে এরা আঁতকে উঠে। কোথাও রাত ১২টায় ভোট বাক্স ভরছে, কোথাও সকাল ১১টার মধ্যেই নির্বাচন শেষ, কোথাও পুলিশ-ভোটাররা ব্যালট বাক্স নিয়ে টানাটানি করছে, শত শত আহত, কোথাও বিরোধী দলের প্রার্থীরা দুপুরের আগেই নির্বাচন থেকে বিরত থেকেছেন, রাস্তায় ব্যালট পেপারের মুন্ডু দেখা যাচ্ছে। কী অবস্থা! পত্রিকাটি গুটিয়ে বন্ধু শরীফ এক দিকে ছুঁড়ে মারে।
হায়দার বলে, “দশ টাকা দিয়ে পত্রিকা কিনে না পড়েই ফেলে দেব?”
আলিফ বলে, “তোর ইচ্ছে করলে, নিয়ে পড় গে।”
আনাস গিয়ে নিয়ে আসে। এবার পত্রিকার ভেতরে লেখা নিবন্ধগুলোতে চোখ বুলোয়। সাবেক এমপি গোলাম মওলা রনির একটি নিবন্ধে চোখ আটকায়। কলামিস্ট হিসেবে রনির লেখা ভাল লাগত আনাসের।
বন্ধুরা কেউ খেলায় মত্ত ছেলেদের দিকে মনোযোগ দেয়। ছোট ছোট ছেলেরা কেউ কেউ ঘুড়ি উড়ায়। মাঠের অন্য পাশে অনেকগুলো ছেলে ভলিবলও খেলছে। আনাসের মন পত্রিকায়।
“ইতঃপূর্বে জানতাম- গণতন্ত্র মানে জনগণের শাসন, যেখানে শাসন ক্ষমতায় নিয়োজিত অধস্তন কর্মচারী থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপি, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি সবাই জনগণকে ভয় করবে, সমীহ করবে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সমর্থন নিয়েই রাষ্ট্রক্ষমতা প্রয়োগ করবে। গণতন্ত্র সম্পর্কে অতীতের সেই ধারণা এখন আর অবশিষ্ট নেই। এখন নির্বাচন হবে-কিন্তু ভোট হবে না। আবার ভোট হবে তো গণনা হবে না। অথবা ভাগ্যগুণে গণনা হলেও যদি বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয় এবং দুর্ভাগ্যক্রমে বিজয়ী যদি কর্তার মনোপুত না হয় তবে প্রার্থী এবং জেলখানার মধ্যে অদ্ভুত এক মহাকর্ষ, মাধ্যাকর্ষণ এবং মহাজাগতিক মায়া-মমতার বন্ধন পয়দা হয়ে যায়।”
মনে মনে হসে উঠে আনাস। রনি কি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিল নাকি! যেভাবে নিউটনের সূত্রের উদাহরণ টানছেন।
“ .. ..পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনই এমন ‘বিজলা বিজলা’ হয়ে গেছে যে, কাউকে ধরা যাচ্ছে না, কাউকে বোঝা যাচ্ছে না এবং কাউকে চেনাও যাচ্ছে না। সর্বত্রই এক নিবিড় আলো-আঁধারির খেলা। এ খেলায় চুল পাকা অধ্যাপক ও অধ্যাপিকারা তার কিশোর-কিশোরী ছাত্রছাত্রীদের মতো রাজনৈতিক নেতার পেছনে সারাক্ষণ ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছেন। কবি কবিতা লেখা বাদ দিয়ে রাজনৈতিক কর্মী হওয়ার জন্য জীবন মরণ যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন। ইদানীং গায়কেরা গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন, নৃত্যশিল্পীরাও নর্তন-কুর্দন করেন না। অন্য দিকে, অভিনেতারা নেতা হওয়ার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। কলা বিক্রেতা হেলিকপ্টার কেনার স্বপ্ন দেখেন, সাইকেলের মিস্ত্রি মনে করেন তার পক্ষে সেভেন ফোর সেভেন জাম্বো জেট বিমান মেরামত অসম্ভব নয়। চোর চিন্তা করে কিরূপে উত্তম ডাকাত হওয়া যায় আর ডাকাতেরা এখন অনেক কিছুর মালিক হওয়ার পর চিন্তা করছে কিরূপে জননন্দিত নেতা হওয়া যায়।”
শরীফ বলে, এত মন দিয়ে কী পড়ছিস?
আনাস সেটা খেয়াল করে না। রনির বিশ্লেষণ তার অসাধারণ লাগছে। সত্যি নির্বাচনী ব্যবস্থটা ভেঙ্গে পড়েছে। বাড়ী থেকে বেরিয়ে রাস্তায় সাবেক মেম্বার রফিক চাচার সাথে দেখা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, দেশটা অন্ধকারে দিকে যাচ্ছে। উনার কথায় সায় দেয় নি আনাস। বলে কী বেটা! মুরব্বী মানুষ কথার পেছনে কথা বলার দরকার নেই। মুরব্বী মানুষ বলেছে একটা কথা। কান না দিয়ে চলে এসেছে। দেখতে পাচ্ছে উনার কথার বাস্তবতা।
“.. ..আমাদের রাজনীতির নিয়মকানুন, দর্শন ও গন্ধ বোঝার জন্য আলাদা মস্তিষ্ক দরকার। আর এ কারণেই বিদেশীরা আমাদের রাজনীতি সম্পর্কে কিছু না বুঝে হুদাই বেহুদা কথাবার্তা বলে থাকেন। লন্ডনের মেয়রকে ঢাকা শহরের মেয়র বানানো হলে দু-তিন দিনের মধ্যেই পাগল হয়ে যাবেন। এ জন্য খুব বেশি কিছু করার দরকার পড়বে না। একদিন তাকে দুপুরে মুরগির রোস্ট, খাসির রেজালা এবং গরুর কালো ভুনা গোশত-পোলাও দিয়ে আচ্ছামতো খাওয়াতে হবে। তারপর তার সামনে খাবারের বিলটা তুলে ধরতে হবে। বিল দেখে প্রথমে ভারী আশ্চর্য হবেন এবং একটু পর মুচকি হেসে বলবেন, ‘চমৎকার! এত অল্প টাকায় চমৎকার খাবার খেলাম। ঢাকার মেয়র না হলে এমন সুখ কোনো দিনই পেতাম না। উফ্! কেন যে এতটা দিন লন্ডনে থেকে জীবনটা নষ্ট করলাম!’ তার কথা শুনে অফিসের আর্দালি বলবে, স্যার, আপনি খুব হিসাব করে চলেন তো! এ জন্যই আপনার জন্য একটু হিসাব-কিতাব করে বিশেষ দোকান থেকে সস্তায় মজাদার খাবারের ব্যবস্থা করেছি। মেয়র তখন পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলবেন, তা বেশ! এবার বলো তো কিভাবে করলে? আর্দালি বলবেন, শহরে অনেক দোকান রয়েছে যেগুলোতে নিয়মিত মরা গরু, মরা খাসি এবং মরা মুরগির মজাদার খাবার তৈরি হয় এবং খুব কম দামে বিক্রি করা হয়!
আর্দালির কথা শোনামাত্র মেয়রের পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তিনি তার অফিস থেকে শুরু করেন ভোঁ দৌড়। তারপর সদরঘাট গিয়ে ঝাঁপ দেন বুড়িগঙ্গায়। নদী সাঁতরে তিনি যখন কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার কালিগঞ্জ বাজারে ওঠেন, তখন তার সাদা ধবধবে চামড়া বুড়িগঙ্গার পানির স্পর্শে কুচকুচে কালো বর্ণে রঞ্জিত হয়ে যায়। তার বেসামাল লম্ফ-ঝম্ফ, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি এবং এলোমেলো কথাবার্তার কারণে লোকজন তাকে কালু পাগলা বলে সম্বোধন আরম্ভ করে দেয়। কালু পাগলা সারা দিন মনের সুখে পাগলামি করে এবং রাতে এর চেয়েও বেশি সুখানুভূতি নিয়ে মরা মুরগির গোশতের স্বাদ স্মরণ করে।”
এক নি:শ্বাসে পড়া শেষ করে। আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে। বিমর্ষ অবস্থায়ও রনির লেখা পড়ে মনে মনে হেসে ফেলে। কিভাবে রনি তার ভাবনাগুলোকে এভাবে ফুটিয়ে তুলল?
“কী দেখছিস, হা করে?” হায়দার বলে।
পত্রিকাটি এগিয়ে দেয় আনাস। বলে দেখ।
হায়দার বলে, "এখন না। বাড়ী গিয়ে পড়ব।"
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। মাগরিবের পর বাসায় গেলে মা বকা দেবে। চল রে আজ উঠি।
সত্যি আজ সবাই মরা মুরগীর মতই জীবন-যাপন করছি। গণতন্ত্রের নামে, নির্বাচনে মরা মানুষও ভোট দিচ্ছে। সেটাও দেখেছি। মরা মুরগীর রমরমা ব্যবসাও চলছে, মানুষও খাচ্ছে বাছ-বিচার ছাড়া। সত্যিই তন্ত্র-মন্ত্রের যাতাকলে পিস্ট হয়ে সবাই একেক জন মরা মুরগীর ন্যায় মৃতবৎ। গণতন্ত্রের সোনার হরিণের থেকে তৈরিকৃত সেই বড়ির কী যে কারিশমা!
=====
বিষয়: বিবিধ
১৫১৭ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সত্যিই সেলুকাস......
পরিবর্তিত শিরোনাম : সদরঘাটের কালু পাগলা ও মরা মুরগীর গল্প..
পড়েছেন আপনি? অনেক ধন্যবাদ..
(গতকালের নয়াদিগন্তে গোলাম মাওলা রনির কলামটা পড়ে ভাবনাটা এলো-লিখে ফেললাম)
যা বলেছেন। রণিকে কেরানীগঞ্জে পাঠানো দরকার। এখন অমন কথা বলার সময় নয়, আবার উনিতো ওদেরই একজন। এমন করে গুরুদের অসম্মান করাকি তার চলে? সে যাই হোক আপনার লেখা সাজানোটা উপাদেয় হয়েছে বলতেই হবে।ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন