বিজয়ের মাস রমজান : এক অপ্রতিরোধ্য বীর মুসলিম জাতির আবির্ভাবে আলোকিত বিশ্ব
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ২৩ জুন, ২০১৬, ০৩:৫০:২৬ দুপুর
হিজরী ২য় বর্ষে (৬২৪ খৃষ্টাব্দ) ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ “বদরের যুদ্ধ” সংগঠিত হয়। সেদিন ছিল ১৭ই রমজান। মাত্র ৩১৩ জন আল্লাহর পথের সৈনিক হাজারোধিক কাফের সৈন্যের বিরুদ্ধে আল্লাহতায়ালার নির্দেশে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং বিজয়ী হন। এছাড়া মক্কা বিজয় হয় তাও এই রমজান মাসে। ৬২৮খৃষ্টাব্দে. হুদায়বিয়া সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করে ইসলাম বিরোধীরা। শুধু তাই নয়, মুসলিমদের উপরও দমন-নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু করে। এমতাবস্থায় রাসূল (সা) ৮ম হিজরীতে ১০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা করেন। ২১শে রমজান আল্লাহর রাসূল (সা) মক্কা বিজয় করে মহান আদর্শ ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামের ইতিহাসে বদরের যুদ্ধ এবং মক্কা বিজয় এ রমজান মাসেই সম্পন্ন হয়। মাহে রমজান নফসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোও শ্রেষ্ঠ জিহাদ। কিন্তু খোদাদ্রোহী ও তাগুতী শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য রমজান মাসই উপযুক্ত মাস। এই বিজয়ের মাস রমজানেই এক অপ্রতিরোধ্য বীর মুসলিম জাতিসত্তার আবির্ভাব হয়ে বিশ্বকে আলোকময় করেছিল।
ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ: বিজয়ের সোনালী সোপান
ইসলাম গ্রহণকারী নও মুসলিমদের উপর জুলুম নির্যাতন দিন দিন বাড়তে থাকল। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী নাযিল না হওয়ায় রাসূল (সা)কে সাহাবীদের কোন অনুমতি দিচ্ছিল না। আল্লাহর রাসূল অপেক্ষায় থাকলেন। হিজরত করে মদীনায় চলে যাওয়াও কাফেররা বরদাশ্ত করলো না। ইসলামকে সেখানেই অংকুরে বিনষ্ট করে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে কোরাইশ বাহিনী। রণপ্রস্তুতি নিয়ে ছুটলো মদীনার দিকে। আল্লাহতায়ালাও নাযিল করলেন যুদ্ধ ঘোষণার অহী।
أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللَّهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ
“যাদের বিরুদ্ধে (কাফেরদের পক্ষ থেকে) যুদ্ধ চালানো হচ্ছিল, তাদেরকেও (এখন যুদ্ধ করার) অনুমতি দেয়া গেল। কেননা তাদের উপর সত্যিই জুলুম করা হচ্ছিল; নি:সন্দেহে আল্লাহতায়ালা এ (মজুলমদের) সাহায্য করতে সক্ষম। (সূরা হজ্ব-৩৯)
মহান আল্লাহপাক আরো এরশাদ করেন,
كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَّكُمْ وَعَسَى أَن تَكْرَهُواْ شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ وَعَسَى أَن تُحِبُّواْ شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَّكُمْ وَاللّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ
“তোমাদের উপর যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে, অথচ তা তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়, সম্ভবত একটি বস্তু তোমাদের কাছে অপ্রিয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা (তোমাদের জন্য) কল্যাণকর।” (সূরা বাকারা-২১৬)
অন্যত্র আরো এরশাদ হয়েছে,
قَاتِلُوهُمْ يُعَذِّبْهُمُ اللّهُ بِأَيْدِيكُمْ وَيُخْزِهِمْ وَيَنصُرْكُمْ عَلَيْهِمْ وَيَشْفِ صُدُورَ قَوْمٍ مُّؤْمِنِينَ
“তোমরা যদি (জিহাদের জন্য) বের না হও তাহলে আল্লাহ তোমাতেরকে কঠিন শাস্তি দিবেন এবং তোমাদের স্থলে অন্য কাউকে ক্ষমতায় বসাবেন, তার কোন ক্ষতিই তোমরা করতে পারবে না। আল্লাহ সব কিছু করতে সক্ষম।” (সূরা-তাওবা-১৪)
وَمَا لَكُمْ لاَ تُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللّهِ وَالْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاء وَالْوِلْدَانِ الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هَـذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَاجْعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ وَلِيًّا وَاجْعَل لَّنَا مِن لَّدُنكَ نَصِيرًا
“কি হয়েছে তোমাদের! তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে না অসহায় নারী ও শিশুদের জন্যে? যারা ফরিয়াদ করছে, হে আল্লাহ, এ জনপদ যার অধিবাসী জালিম হতে আমাদেরকে অন্য কোথাও নিয়ে যাও; তোমার নিকট হতে কাউকে আমাদের অভিভাবক করো এবং কাউকে সাহায্যকারী পাঠাও।” (সুরা নিসা:৭৫-৭৬)
বদরের প্রান্তরে এই অসম লড়াইয়ে মুসলমানদের খতম করে দেবে এমন ভাব নিয়ে কুরাইশ বাহিনী উপস্থিত। নবীজী (সা)ও জানবাজ ৩১৩ জন সাহাবী নিয়ে ছুটে চললেন তাদের রুখে দিয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে রক্ষায়। অপর দিকে কোরাইশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা এক হাজার। রাসূল (সা) সাহায্য চাইলেন মহান জাত পাকের দরবারে। “প্রভুর আজ যদি তোমার প্রতি ঈমান আনয়নকারীরা পরাজিত হয়, তবে এই দুনিয়ায় তোমার নাম বুলন্দ করার আর কোন লোক থাকবে না, তুমি আমাদের প্রতি সাহায্য করো।” রাসূল (সা) বদরের যুদ্ধের আগের রাত্রি দোয়ারত অবস্থা কাটিয়ে ছিলেন। সকালে তিনি শত্রুদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছ থেকে বিশ্ববাসীর জন্য সুসংবাদ নিয়ে আসেন। এরশাদ হচ্ছে,
بَلِ السَّاعَةُ مَوْعِدُهُمْ وَالسَّاعَةُ أَدْهَى وَأَمَرُّ ¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬¬.سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّونَ الدُّبُرَ
“এই দল শীঘ্রই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে। অধিকন্তু কিয়ামত উহাদের শাস্তির নির্ধারিত কাল এবং কিয়ামত হবে কঠিনতর ও তিক্তকর।” (সূরা কামার: ৪৫-৪৬)
প্রিয় হাবীবের এই মোনাজাত বিফলে যায়নি। যুদ্ধে দামামা বেজে উঠলো এবং আল্লাহর সাহায্যও এসে গেল। অবশেষে কাফেররা পরাজিত হল। ৭০ জন কাফের জাহান্নামে চলে গেল এবং ৭০ জনকে বন্দী করা হল। মুসলমানদের ১৪ জন শাহাদাত বরণ করে জান্নাতে চলে গেলেন।
মক্কা বিজয়: মহাবিশ্বের ইতিহাসে এক রক্তপাতহীন সফল বিপ্লব
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বিপ্লব আর কখনো ঘটবে বলে আশা করতে পারি না। এক রক্তপাতহীন বিপ্লব, যা রাসূলুল্লাহর নেতৃত্বে ৮ম হিজরীতে সংগঠিত হয়েছিল। হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করে কুরাইশরা নবীজী (সা)এর অনুসারী খোজায়া গোত্রের লোকদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করতে লাগল। এমনকি তারা কাবা শরীফেও আশ্র্রয় গ্রহণ করে রক্ষা পায় নি। বনু খোজায়া গোত্র তাদের দুরবস্থা পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর রাসূল (সা)এর সাহায্য চাইলেন। রাসূল (সা) কুরাইশ ও বনু বকর গোত্রদেরকে এ অন্যায় কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। সব চেষ্টা বিফলে যাওয়ার পর রাসূল (সা) সিদ্ধান্ত নিলেন মক্কায় অভিযান চালাবেন। ১০ই রমজান থেকে গোপনে অভিযান শুরু করলেন তিনি। ১৮ই রমজান মক্কাবাসী অবাক বিস্ময়ে ১০,০০০ হাজার মুসলিম সেনাবাহিনী দেখে ভড়কে গেলেন। প্রতিরোধ করার কোন স্পৃহা বা প্রচেষ্টা দেখা গেল না মরু মুষিকদের। কুরাইশ দলপতি আবু সুফিয়ান অবশেষে আত্মসমর্পণ করলেন। যে মুহাম্মদ একজন সঙ্গী নিয়ে গোপনে মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করলেন। আজ সমগ্র মক্কা তার করতলে। কিন্তু দয়ার নবী কোন প্রতিশোধ নিলেন না। অথচ নুবুওয়াত লাভের পর থেকে নবীজী এবং তার সাহাবীদের যে অবর্ণনীয় নির্যাতন, নিষ্পেষণ, দেশ থেকে বের করে দেওয়াসহ এহেন কোন অপরাধ বাকি ছিল না, যা কুরাইশরা করে নি। বিশ্বনবী (সা) মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “হে কুরাইশগণ! তোমরা কি জান আমি তোমাদের সাথে কি ব্যবহার করব? ভীত কম্পিত কুরাইশরা বলল, আমরা আপনার নিকট কল্যাণ ও সদ্বব্যবহারের আশা করি। কারণ আপনি আমাদের সম্মাণিত ভ্রাতা এবং সম্ভ্রান্ত ভ্রাতার পুত্র। আজ আপনি সমুচিত শাস্তি প্রদানে সমর্থ। যদিও আমরা অপরাধী, তবুও আপনার নিকট আমরা সদ্ব্যবহারের আশা রাখি।” শান্তির দূত ও মানবাধিকারের প্রবক্তা মহানবী (সা) বললেন, “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা মুক্ত ও স্বাধীন।” এই যে, চিরশত্রুদের ক্ষমা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক ঘটনা বিশ্বে আর কখনো কি ঘটবে? বিজয়ের মাসে ক্ষমা করে বিজয় সুসংহত করে মহানুভবতার পরিচয় দিলেন। এই বিজয়ের মহত্ত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব কোন দেশ বা রাষ্ট্রকে দখল করে নয়, বরং শত্রুভাবাপন্ন মানুষের হৃদয়কে বিজয় করার মধ্যে।
পবিত্র মাসে কেন এই যুদ্ধ?
ইসলামের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, প্রতিটি যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক। আরবের প্রাচীন রীতি অনুযায়ী দেখা নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ। ইসলামের দুশমনেরা একে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। আত্মরক্ষার অধিকার সবরই আছে। রমজান আত্মশুদ্ধির মাস। তাই আল্লাহর রাসূল রমজানকে আত্মশুদ্ধি ও আত্মজাগৃতির মাস হিসেবে নয়, আত্মরক্ষার মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনে বাধা দানকারী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। তাই নিষিদ্ধ মাস পবিত্র মাসের ধোঁয়া তুলে শত্রুরা মুসলমানদের ধ্বংস করবে আর মুসলমানরা নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবে তা হতে পারে না।
এরশাদ হচ্ছে, “নিষিদ্ধ মাসের বদলায় নিষিদ্ধ মাস এবং সকল নিষিদ্ধ আচরণের বদলা আছে। সুতরাং কেউ যদি তোমাদের সাথে বাড়াবাড়ি করে তাহলে তোমরাও তার সাথে সেই পরিমাণ বাড়াবাড়ি কর। তবে আল্লাহকে ভয় কর। জেনে রেখ আল্লাহকে যারা ভয় করে আল্লাহ তাদের সাথে আছেন।” অন্যস্থানে আরো এরশাদ হয়েছে, “(হে নবী) আপনাকে নিষিদ্ধ মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হচ্ছে? বলুন, ঐ সময় যুদ্ধ করা দুষনীয় কিন্তু মানুষকে আল্লাহর পথে জীবন যাপনে বাধা দান, আল্লাহর প্রতি কুফরী করা। আল্লাহর বান্দাদের জন্য মসজিতুল হারামে আগমনের পথ বন্ধ করে দেয়া এবং হারাম শরীফের বাসিন্দাদেরকে সেখান হতে বিতাড়িত করা আল্লাহর নিকট অধিকতর দুষণীয়। এসব অত্যাচার রক্তপাতের চেয়েও জঘন্য।” সুতরাং মক্কার কাফের মত বর্তমান সময়েও মুসলমানদের বিরুদ্ধে একই অস্ত্র ভিন্নরূপে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিজয়ের মাস মাহে রমজান :
আজ এই বাংলার প্রান্তর পর্যন্ত এবং বিশ্বের আনাচে-কানাচে ইসলামের এই ছড়িয়ে পড়াকে বদরের প্রান্তরে বিজয়ের ফলশ্রুতি নয়? যদি বদরের প্রান্তরে মুসলমানরা পরাজিত হতেন তাহলে আমরা কোনদিন মুসলমান হয়ে গর্বিত হতে পারতাম না। যেটা বদরের পূর্ব রাত্রে আল্লাহর কাছে আল্লাহর রাসূল মুনাজাতে বলেছিলেন। আর মক্কা বিজয় না হলে আল্লাহর ঘর কোন দিন মুশরিক মুক্ত হত না। মুসলিম জীবনের এক তাৎপর্যময় ঘটনা যে মাসে সংঘঠিত হয়েছিল তা রমজান। বিজয়ের মাস নিয়ে সাধারণত আমাদেরকে একশ্রেণীর মানুষ অন্য একটি মাস নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়ে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু তাদের কাছে মুসলিম হিসেবে রমজান নিয়ে কোন চেতনা নেই। বিজয় ও জিহাদের প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে রমজানের তাৎপর্য ও শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারলে আমরা আবার বিশ্বের সমস্ত শয়তানী পরাশক্তিকে পরাজিত করতে সক্ষম হবো। আমাদের সামনে কেউ দাঁড়াতে দুঃসাহস করবে না। ফিরে পাবো আবার পূর্বের শৌর্য-বীর্য। জাতি হিসেবে আবার নবঈমানী শক্তিতে বলীয়ান হবো। তাই বিজয়ের মাস হিসেবে বিনাবাক্য ব্যয়ে সকল মুসলমানকে স্বীকার করতেই হবে যে, কেবলমাত্র বিজয়ের মাস রমজান, শুধুমাত্র বিজয়ের মাস রমজান এবং একমাত্র বিজয়ের মাস রমজান।
(পূন : পোস্ট)
বিষয়: বিবিধ
১৪২৮ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন