আত্মশুদ্ধি অর্জনে এক মাসব্যাপী ট্রেনিং কোর্স রমজান...
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ২০ জুন, ২০১৬, ০২:৪৮:৪৭ দুপুর
‘রমজ’ শব্দের অর্থ দাহ করা, ভস্মীভুত করা, জ্বালিয়ে দেয়া ইত্যাদি। রমজানের একমাসের ট্রেনিং বা সিয়াম সাধনায় মানুষ যেভাবে প্রশিক্ষিত হয় তা আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনে সহায়ক। মুসলিম জাহানের প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক সদস্য এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সমান সুযোগ পায়। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ যাবতীয় পাপাচার থেকে মুক্তি লাভ করে বলে এই মাসের নাম রমজান। মানুষ পাপ করে অভিশপ্ত শয়তানের খপ্পরে পড়ে। এই মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয় বলে হাদীসে বর্ণিত তাই মানুষ পাপের জগতে অনুপ্রবেশ কিছুুটা হলেও বাধাপ্রাপ্ত হয়। অনেকটা নিয়ন্ত্রিত জীবনে অভ্যস্ত হয় সকলে। হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
إذا جاء رمضان فتحت أبواب الجنة، وغلقت أبواب النار، وصفدت الشياطين.
যখন রমযান মাসের আগমন ঘটে, তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।(সহীহ বুখারী, হাদীস-১৮৯৮, সহীহ মুসলিম, হাদীস-১০৭৯ (১), মুসনাদে আহমদ, হাদীস-৮৬৮৪)
রমজান মাস আল্লাহর তরফ থেকে বান্দার জন্য রহমত, বরকত ও মাগফেরাত হিসেবে আভির্ভূত হয়। আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য রমজান মাসটি অনন্য। রাসূলে এ কারীম (সা)এর এই নিম্নোক্ত হাদীসটি যথেষ্ট চিন্তার উদ্রেককারী। রমজানের সিয়ামকে পেয়েও যে ব্যক্তি গুনাহ থেকে মুক্ত হতে পারলনা তার ধ্বংস হোক। পুরো হাদিসটি হল: “হাদীস শরীফে (সহীহ বুখারী, সহীহ তিরমিযী, ইমাম হাম্বল, ইবনে কাসীর, প্রভৃতি) বর্ণিত রয়েছে, বিশেষ করে সাহাবী ক্কাআব বিন আজুরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার জুমার খুৎবা দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সা.) যখন মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখেন, তখন বলেন আমীন, দ্বিতীয় সিঁড়িতে যখন পা রাখেন, তখন বলেন আমীন, একইভাবে তৃতীয় সিঁড়িতে পা রেখেও বলেন, আমীন।
সালাত শেষে সাহাবীরা রাসূলুল্লাহকে (সা.) তিনবার অস্বাভাবিকভাবে আমীন বলার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি যখন মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখি, তখন জিব্রাইল (আ.) ওহি নিয়ে আসেন এবং বলেন, ধ্বংস হয়ে যাক, সেই ব্যক্তি, যে রমজান মাসের রোজা পেল অথচ গুনাহ মাফ করাতে পারল না, এর জবাবে আমি বললাম, আমীন। দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখার সময় জিব্রাইল (আ.) বললেন, হয়ে যাক, সে যার সামনে আমার নাম নেওয়া হলো অথচ দরুদ শরীফ পড়ল না, জবাবে বলেছি আমীন। তৃতীয় সিঁড়িতে যখন পা রাখলাম, জিব্রাইল (আ.) বললেন, ধ্বংস হয়ে যাক, সে যে বা যারা তার মা-বাবা কিংবা উভয়ের যে কোনো একজনকে পেল অথচ তাদের খেদমত করে জান্নাত হাসিল করতে পারল না, জবাবে বলেছি আমীন। রমজানের এই মহাসুযোগকে কাজে লাগিয়ে মুক্তির দিশা পেতে হবে।
আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনে মাহে রমজানে এই বিষয়গুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। রমজানই এর প্রকৃষ্ট সময় এবং পন্থা। আর কোন পন্থা এর চাইতে কার্যকর বলে প্রমাণিত নয়।
১। তাকওয়া ভিত্তিক জীবন পরিচালনা
২। সবর বা ধৈর্য ধারণ
৩। কুপ্রবৃত্তি বা নফসকে দমন
৪। চারিত্রিক দৃঢ়তা অবলম্বন
৫। তাওবা-ইস্তেগফার
১। তাকওয়া ভিত্তিক জীবন পরিচালনা :
তাকওয়া এক ব্যাপক অর্থবোধকশব্দ। যার অর্থ খোদাভীতি বা পরহেজগাবী অবলম্বন করা। রোজার মুল উদ্দেশ্যে তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়া সমস্ত কল্যাণের উৎস। এর মাধ্যমেই সার্বিক মুক্তি ও কল্যাণ লাভ সম্ভব। কুরআন নাযিল হয়েছে তাকওয়াবানদের জন্য, আর মানুষকে তাকওয়াবান বানানোই রোজার উদ্দেশ্য। তাকওয়াভিত্তিক জীবন পরিচালনা করলে দেশ ও সমাজ সুন্দররূপে গড়ে উঠে, মানুষ আল্লাহর বিধান মানতে পারে সহজভাবে। মুলত: এটাই চান আল্লাহতায়ালা।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلاَ تَمُوتُنَّ إِلاَّ وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিত ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।” (সূরা আলে ইমরান-১০২)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنظُرْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
“মু'মিনগণ, তোমরা আল্লাহ তা’আলাকে ভয় কর। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামী কালের জন্যে সে কি প্রেরণ করে, তা চিন্তা করা। আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করতে থাক। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা’আলা সে সম্পর্কে খবর রাখেন।” (সূরা হাশর-১৮)
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
“নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সেই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেজযগার। নিশ্চয় আল্লাহ র্সবজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।" (সূরা হুজুরাত-১৩)
প্রকৃতপক্ষে রোজা রাখার মাধ্যমে তাকওয়া সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহতায়ালাকে মানুষ সঠিকভাবে ভয় করতে থাকে এবং আল্লাহর কাছে তাকওয়াবান ব্যক্তিই সবচেয়ে মর্যাদাবান। মানুষের পরকালীন মুক্তি এবং জীবনের সফলতা নির্ভর করে ব্যবহারিক জীবনের তাকওয়ার প্রয়োগের উপর। তাই তাকওয়ার গুণটি আত্মশুদ্ধি লাভে মানুষের যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২। সবর বা ধৈর্য ধারণ :
ধৈর্য্য মু’মিনের এক অপরিহার্য গুণ। কথায় বলে, “ ধৈর্যই ধর্ম।” ধৈর্য বা সহনশীলতা না থাকলে জীবন সংগ্রামে সফলতা আসতে পারে না। রমজানের এই ট্রেনিং কোর্সের মাধ্যমে রোজাদারগণ ব্যাপক ধৈর্য্যরে পরাকাষ্ঠা দেখান। রোজার প্রতিটি মুহুর্ত রোজাদার সবরের প্রশিক্ষণ পায়, প্রচন্ড ক্ষুধা, পিপাসা, ঘুমের অনিয়ম, দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রচলিত নিয়মের বাইরে তারাবী সালাত, মেজাজের ভারসাম্য রক্ষা করা-অনেক কষ্টসাধ্য ও ত্যাগের ব্যাপার। রোজা ধৈর্য্য বা সংযম শিক্ষাদানের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির রাজপথ অবারিত করে।
৩। কুপ্রবৃত্তি বা নফসকে দমন :
মহাগ্রন্থ আল কুরআনের এরশাদ হয়েছে :
وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَىفَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দন্ডায়মান হওয়াকে ভয় করেছে এবং নফস বা প্রবৃত্তি (খেয়াল-খুশী) থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখেছে, তার ঠিকানা হবে জান্নাত। (সূরা আন নাযিআত : ৪০-৪১)
রোজা সারাদিন মানুষের ষড়রিপুকে অবদমিত করে তথা নফসের তাড়নাকে ভষ্ম করে, সমস্ত কুলালসা, কামনা বাসনাকে দাহ করে রোজা তবেই ক্ষান্ত হয়। কুপ্রবৃত্তিকে দমনে রোজার চেয়ে কার্যকর পন্থা আর হতে পারে না। মানুষের মাঝে বিদ্যমান কুপ্রবৃত্তিগুলো হলো : কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা ও মাৎসর্য। মানব জীবন ধ্বংসকারী এই কুপ্রবৃত্তিগুলো নিয়ন্ত্রণে রোজা অত্যন্ত কার্যকর।
৪। চারিত্রিক দৃঢ়তা অবলম্বন :
রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করল না-সে ব্যক্তির পানীয় দ্রব্য পরিত্যাগে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারী) তিনি আরো বলেছেন, রোজা পাঁচটি জিনিস নষ্ট করে : মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, কুটনামী, মিথ্যা শপথ ও কামভাব দৃষ্টিপাত। এসব দোষাবলী বর্জন চরিত্র গঠনে সহায়ক।
রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান রাখে সে যেন কথা বললে ভাল কথা বলে কিংবা চুপ করে থাকে। (বুখারী ও মুসলিম) হাদীস থেকে জানা যায়, জবান বা জিহ্বার ১৫টি দোষ আছে, যথা : ১. মিথ্যা কথা বলা, ২। ঠাট্টা বিদ্রুপ করা, ৩. অশ্লীল ও খারাপ কথা বলা, ৪. গালি দেয়া, ৫. নিন্দা করা, ৬. অপবাদ দেয়া, ৭. গীবত করা, ৮. চোগলখুরী করা, ৯. বিনা প্রয়োজনে গোপনীয়তা ফাঁস করা, ১০. মুনাফিকী করা, ১১. ঝগড়া-ঝাটি করা, ১২. বেহুদা ও অতিরিক্ত কথা বলা, ১৩. বাতিল ও হারাম জিনিস নিয়ে কথা বলা, ১৪. অভিশাপ দেয়া, ও ১৫. সামনা-সামনি কারো প্রশংসা করা।সুতরাং আপনি রোজা রেখে যদি এসব পাপ-পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত থাকেন তাহলে রোজা থেকে উপবাস থাকার প্রয়োজনই বা কি? রোজা রাখার মাধ্যমে পাপ-প্রবৃত্তি বিদুরিত হবে বলেই তো রোজা রাখা হয়। তাই রোজার মাধম্যে আল্লাহ ঘোষিত পুরষ্কার পেতে চাইলে গর্হিত কাজসমূহ বর্জন করতে হবে। এর মাধ্যমে আত্মা পরিশুদ্ধ জীবন লাভে সমর্থ হয়।
৫। তাওবা-ইস্তেগফার :
নফসের তাড়না, শয়তানের অসঅসা এবং বিবিধ মানবীয় দৃর্বলতার কারণে মানুষ পাপে নিমজ্জিত হয়। আল্লাহ নাফরমানির কারণে অপরাধের চরম সীমায় গিয়ে পৌঁছে। মহান রাব্বুল আলামীনের দুয়ারে আত্মসমর্পণ করে চোখের পানি ফেলে তওবা করলে তিনি কবুল করেন। কারণ তাঁর রহমতের ভান্ডার অফুরন্ত। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের এরশাদ হয়েছে :
وَالَّذِينَ عَمِلُواْ السَّيِّئَاتِ ثُمَّ تَابُواْ مِن بَعْدِهَا وَآمَنُواْ إِنَّ رَبَّكَ مِن بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
“আর যারা মন্দ কাজ করে, তারপরে তওবা করে নেয় এবং ঈমান নিয়ে আসে, তবে নিশ্চয়ই তোমার পরওয়ারদেগার তওবার পর অবশ্য ক্ষমাকারী, করুণাময়।” (সূরা আ’রাফ-১৫৩)
আল্লাহর রাসূল (সা) মাহে রমজানে এই চারটি কাজ বেশি বেশি করতে বলেছেন : ১. কলেমায়ে শাহাদাত পাঠ করা, ২. বেশি বেশি তাওবা-ইস্তেগফার করা। এই দু'টি কাজ আল্লাহর কাছে বেশি পছন্দনীয়। ৩. জান্নাত লাভের আশা করা এবং ৪. জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রার্থনা করা।” (ইবনে খুযাইমা)
আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে রমজানের এই ট্রেনিং-এর মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করে নাজাত লাভের তৌফিক দিন। আমিন।
=====
বিষয়: বিবিধ
১৬৫১ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গুরুত্বপূর্ণ একটি লিখা মাশাআল্লাহ।
মূল্যবান লিখাটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
হে আল্লাহ সারা বিশ্বের মুসলিমদের মাফ করে দাও, বাকী রামাদান তোমার ইবাদাতে কাটানোর তাওফীক দান করো।
জাযাকাল্লাহ খাইরান ভাই।
আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে রমজানের এই ট্রেনিং-এর মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করে নাজাত লাভের তৌফিক দিন। আমিন।
জাজাকাল্লাহ খায়ের ভাইয়া ।
জাজাকাল্লাহ খায়ের ভাইয়া ।
ভাল লাগল। যাবললাম তা অনেকের ধারণা। ধন্যবাদ।
শুধু বলি, এক্সক্লুসিভ হয়েছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন