কাজী নজরুল ইসলামের ২৩ বৎসরের সাহিত্য আন্দোলন
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ২৪ মে, ২০১৬, ০৯:৪০:১৯ রাত
জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), তাঁর ৭৭ বৎসরের জীবন কালে মাত্র ২৩ বৎসরই সাহিত্য সাধনা করতে পেরেছিলেন। যেখানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ৮০ বৎসর জীবনকালে প্রায় ৭০ বৎসরই লিখতে পারার গৌরব অর্জন করেছিলেন। বৃটিশ উপনিবেশিক অপশক্তির বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় লিখে কারা নির্যাতিতও হয়েছিলেন। তাঁর শৈশব, কৈশোর ও জীবনের অধিকাংশ সময় ছিল চরম দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। তাঁর ডাক নাম দুখু মিয়া নামের যেন এখানেই সার্থকতা! সংগ্রামী জীবনের শুরু থেকেই তাই দু:খময় জীবনের এক ব্যাপক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। তিনি লিখেন :
“হে দারিদ্র, তুমি মোরে করেছো মহান!
তুমি মোরে দানিয়াছ খৃষ্টের সম্মান
কন্টক মুকুট শোভা।-দিয়াছ তাপস
অসঙ্কোচ প্রকাশে দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি; বাণী ক্ষুরধার,
বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার।”
দারিদ্রতাকে বরণ করে নিয়ে তিনি কিন্তু দমে যান নি। প্রতিনিয়ত বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেন বিশ্বময়। যার ফলে বৃটিশের তখতে তাউস নড়ে যায়। আমরা কাজী নজরুল ইসলামকে কেবল কবি হিসেবেই জানি, অথচ তিনি আরো বহু গুণে গুণান্বিত ছিলেন। ”তিনি একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, অনুবাদক, শিশু সাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার, গীতিনাট্য ও গীতিআলেখ্য রচয়িতা, স্বরলিপিকার, গায়ক, বাদক, চলচ্চিত্র কাহিনীকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, সাংবাদিক, লেখক, সম্পাদক, গবেষক, পত্রিকা পরিচালক, সৈনিক, মুয়াযযিন ও একজন আপোষহীন সংগ্রামী পুরুষ।তাঁর প্রতিভার বিচ্ছুরণ কবিতার কেন্দ্রভুমি থেকেই। কবিতার রশ্মি ও জল তাঁর সমস্ত শিল্পকর্ম সঞ্চালিত ও প্রবাহিত। তারপরও আবার এ সত্যি যে, এতো বিচিত্র ক্ষেত্রে এতো সাবলীল স্বচ্ছ্বলতা, আর তাও মাত্র সৃষ্টিশীল ২৩ বৎসরে (১৯১৯-১৯৪২) একটি প্রাকৃতিক ঘটনা বলেই মনে হয়। (কবি কাজী নজরুল ইসলাম জন্মশত বার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ-সম্পাদনায় আবদুল মান্নান সৈয়দ-পৃষ্টা : ১১)
তাঁর জীবন কালের মধ্য বয়সে এসে, যখন মানুষ একজন পূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন-ঠিক সে সময়ে তার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। ১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ এবং প্রায় নির্বাক হয়ে যান, এক অজ্ঞাত কারণে। যার রহস্য একদিন না একদিন উন্মোচিত হবেই। আমি তাঁর সাহিত্য আন্দোলনের পর্যায়কে ৩ ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম স্তর : সুস্থ অবস্থায়, দ্বিতীয় স্তর : অসুস্থ অবস্থায় এবং তৃতীয় স্তর : মৃত্যু পরবর্তী।
২৩ বৎসরের সাহিত্য আন্দোলনে তিনি সাহিত্যের সকল শাখায় আন্দোলিত করেন। আসলে তাঁর লেখনি কেবল মাত্র সাহিত্য চর্চা নয়। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ছিল এক প্রচণ্ড বিদ্রোহ। তিনি ২২টি কাব্য গ্রন্থ, ৩টি কাব্যানুবাদ, ২টি কিশোর কাব্য, ৩টি উপন্যাস, ৩টি গল্পগ্রন্থ, ৩টি নাটক, ২টি কিশোর নাটিকা, ৫টি প্রবন্ধগ্রন্থ, ১৪টি সঙ্গীতগ্রন্থ,৩টি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তাঁর রচিত অনেক গান ও নানা নাট্য রচনার প্রকৃত সংখ্যা কত তা এখনো নির্ণয় করা যায়নি। এখন তাঁর অনেক লেখা অগ্রন্থিত বা প্রকাশিত হয়নি। তাঁর বিশাল সাহিত্য ভান্ডারের হদিস গবেষখরা খুঁজে খুঁজে হয়রান। আমি অনেক গ্রন্থ অনুসন্ধান করে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের একটি তালিকা তৈরি করেছি, সাহিত্যপ্রেমী কাজে আসতেও পারে আগামী দিনে।
গ্রন্থের নাম-প্রকাশকাল :
১। অগ্নিবীণা (১৯২২)-সুস্থাবস্থায়
২। দোলন চাঁপা (১৯২৩)
৩। বিষের বাঁশী (১৯২৪)
৪। ভাঙার গান (১৯২৪)
৫। ছায়ানট (১৯২৫)
৬। পূবের হাওয়া (১৯২৫)
৭। চিত্তনামা (১৯২৫)
৮। সাম্যবাদী (১৯২৫)
৯। সর্বহারা (১৯২৬)
১০। ফণি মণসা (১৯২৭)
১১। সিন্দু-হিন্দোল (১৯২৭)
১২। জিঞ্জির (১৯২৮)
১৩। সঞ্চিতা (১৯২৮)-সংকলন
১৪। চক্রবাক (১৯২৯)
১৫। সন্ধ্যা (১৯২৯)
১৬। প্রলয় শিখা (১৯৩০)
১৭। রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ (১৯৩০)-অনুদিত গ্রন্থ
১৮। কাব্য আমপারা (১৯৩৩)
১৯। নির্ঝর (১৯৩৫)
২০। বুলবুল (১৯২৮)-গীতিগ্রন্থ
২১। চোখের চাতক (১৯২৯)
২২। নজরুল গীতিকা (১৯৩০)
২৩। চন্দ্রবিন্দু (১৯৩০)
২৪। জুলফিকার (১৯৩২)
২৫। বনগিিত (১৯৩২)
২৬। সুর সাকী (১৯৩২)
২৭। গুল বাগিচা (১৯৩৩)
২৮। গীতি শতদল (১৯৩৪)
২৯। গানের মালা (১৯৩৪)
৩০। মহুয়ার গান (১৯৩৫)
৩১। নতুন চাঁদ (১৯৪৫)-অসুস্থাবস্থায়
৩২। মরু ভাস্কর (১৯৫০)
৩৩। বুলবুল-২য় খন্ড (১৯৫২)
৩৪। শেষ সওগাত (১৯৫৮)
৩৫। রুবাইয়াত-ই ওমর খৈয়াম (১৯৫৯)- অনুদিত গ্রন্থ
৩৬। ঝড় (১৯৬০)
৩৭। রাঙা জবা (১৯৬৬)-সঙ্গীত
৩৮। গীতি মাল্য (১৯৬৯)
৩৯। সন্ধ্যা মালতী (১৯৭০)
৪০। অপ্রকাশিত নজরুল (১৯৮৯)-মৃত্যু পরবর্তী
৪১। নজরুল রচনাবলী -চার খন্ড (১৯৯৩)
৪২। বাঁধন হারা (১৯২৭)-পত্রোপন্যাস
৪৩। মৃত্যু ক্ষুধা (১৯৩০)
৪৪। কুহেলিকা (১৯৩১)
৪৫। ব্যথার দান (১৯২২)-ছোট গল্প
৪৬। শিউলি মালা (১৯৩১)
৪৭। রিক্তের বেদন (১৯২৪)
৪৮। আলেয়া (১৯৩১)-নাটক
৪৯। মধুমালা (১৯৫৮)
৫০। পুতুলের বিয়ে (১৯৩২)-নাটিকা
৫১। যুগবাণী (১৯২২) প্রবন্ধগ্রন্থ
৫২। রাজবন্দীর জবানবন্দী (১৯২২)
৫৩। দুর্দিনের যাত্রী (১৯২২)
৫৪। রুদ্রমঙ্গল (১৯২২)
৫৫। ঝিঙে ফুল (১৯২৬) শিশুকাব্য
৫৬। সঞ্চয়ন (১৯৫৫)-কিশোর পাঠ্য সংকলন
৫৭। পিলে পটকা ও পুতুলের বিয়ে (১৯৬৩)
৫৮। ঘুম জাগানো পাখি (১৯৬৪)
৫৯। নজরুল কিশোর সমগ্র (১৯৮৩)-মৃত্যু পরবর্তী
৬০। সাত ভাই চম্পা (১৯২৭)
৬১। ঝিলি মিলি (১৯৩০) নাটিকা
৬২। স্বরলিপি (১৯৩১)
৬৩। সুর লিপি (১৯৩৪)
৬৪। সুর মুকুর (১৯৩৪)
৬৫। মক্তব সাহিত্য (১৯৩৫)
৬৬। সাপুড়ে (১৯৩৯)-চলচ্চিত্র কাহিনী ও গান
৬৭। ধ্রুব- চলচ্চিত্র কাহিনী ও গান
৬৮। ঘুম পাড়ানি মাসী পিসি (১৯৬৫)
৬৯। পত্রাবলী (১৯৭০)
৭০। উন্নত শির (১৯৭২)-কাব্য ও গান
৭১। বিদ্রোহী বাংলা (১৯৭০)
৭২। অপ্রকাশিত নজরুল-১ (১৯৮৯)
৭৩। অপ্রকাশিত নজরুল-২ (১৯৮৯)
৭৪। বিদ্যাপতি (১৯৩৮)- চলচ্চিত্র কাহিনী ও গান
পত্রিকার সম্পাদক :
৭৫। দৈনিক নবযুগ (১৯২০)
৭৬। ধূমকেতু (১৯২২)
৭৬। লাঙল
ছোট গল্প : বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী, স্বামী হারা, হাসনা হেনা, মেহের নিগার, ঘুমের ঘোরে, অগ্নিগিরি ইত্যাদি। এছাড়া দুরন্ত পথিক, বনের পাপিয়া, পদ্ম গোখরো এবং রাক্ষুসী ছোট গল্প/অন্যান্য খোঁজ পাওয়া গেছে। বিষয় বস্তু কি তা জানার চেষ্টা চলছে। তাঁর পাঁচ হাজারেরও অধিক গান রয়েছে। আসলে নজরুলের সাহিত্য ভান্ডারের খোঁজ করা মানে বিদ্যাসাগরে নুড়ি পাথর অনুসন্ধানের ন্যায়।
প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য জীবন ২৩ বৎসরের এবং আমার প্রিয় নবী (সা)এর নুবুওয়াতী জীবনকালও ২৩ বৎসরের। এটা কাকতালীয় কিনা জানিনা। প্রিয় নবী অসত্যের বিরুদ্ধে বিপ্লব করে একটি শোষণ ও উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আর কাজী নজরুল ইসলাম বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং তার দোসরদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিদ্রোহ ঘোষণা করে ছিলেন। ফলে জেল-জুলুম-নির্যাতন সবই সইতে হয়েছে। আমি কাজী নজরুল ইসলামের লেখনিকে তাই আন্দোলন বলার দু:সাহস দেখিয়েছি। যদি আন্দোলনই বা না হবে তবে কেন তিনি সামাজিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, অন্যায়, অসত্য, জুলুম এবং কুসংস্কার ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন? আপোষহীনভাবে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম-বিদ্রোহ-বিপ্লব কিভাবে করতে হয় সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে তাই তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন। আসুন যেখানে অন্যায়, জুলুম এবং শোষণ জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসেছে সেখানেই কাজী নজরুল ইসলামের দেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করার চেষ্টা চালাই।
=====
বিষয়: সাহিত্য
২০০১ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এবার বলুন কোনটা সঠিক? [হতে পারে জাতীয় কবিকে তিনি বাংলাদেশের এনেছিলেন। তারপরও ব্ঙ্গবন্ধু যা করেছেন তা প্রশংসনীয়]
আবার ১৯৭৬ সালে তিনি "একুশে পদক" পান।
বাংলাদেশ-ভারত-শ্রী লংকা - পুরাই অস্থির
@ হতভাগা...
এবার বলুন কোনটা সঠিক? [হতে পারে জাতীয় কবিকে তিনি বাংলাদেশের এনেছিলেন। তারপরও ব্ঙ্গবন্ধু যা করেছেন তা প্রশংসনীয়]
আবার ১৯৭৬ সালে তিনি "একুশে পদক" পান।
-বিয়ে সম্পর্কে এটা মিথ্যাচার। নজরুল যখন কুমিল্লায় এলেন তখন নার্গিসের সাথে তাঁর বাগদান হয়। যে কোন কারণে তাঁর সে বিয়ে ভেঙে্ যায় (বিস্তারিত অন্য সময়ে পোসট করব ইনশাল্লাহ) পরবর্তীতে হিন্দু নারী প্রমীলার সাথে বিয়ে হয়। শেষ বয়সে নয়। একটাই মাত্র বিয়ে-ধন্যবাদ। নজরুল সম্পর্কে অনেক মিথ্যাচার এবং ষড়যন্ত্র ছিল এবং এখনও চলছে। ইনশাল্লাহ সে ষড়যন্ত্রের মুখোশ উ্ন্মোচিত করব।ধন্যবাদ।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম চলচ্চিত্রেও একজন পথিকৃত।
ঈমান পরিমাপের মানদন্ড হলো
"অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো"
দুনিয়ার জীবনের আকর্ষণ/মোহ যিনি ত্যাগ করতে পারেননা তাঁর জন্য এটা অসম্ভব!!
কাজী নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে উদাহরণ পেশ করে গেছেন!
জাযাকাল্লাহু খাইর প্রিয়
মন্তব্য করতে লগইন করুন