বিশ্বের প্রথম মহাশূন্য অভিযাত্রী হিসেবে রাসুল (সা)এর অভিযান...
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ০৪ মে, ২০১৬, ১২:২৫:১১ দুপুর
রাসূল (সা)এর মদীনায় হিজরতের এক বছর পূর্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মি’রাজ সম্পন্ন হয়েছিল। এটা স্বপ্নে হোক বা সশরীরে হোক। এখানে সংশয়বাদীরা ছাড়া সকলেই সশরীরে মি’রাজের ঘটনা বিশ্বাস করেন। আল্ কোরআনের সূরা ইস্রা বা বনী ইসরাইলের ১ নং আয়াতে এবং সূরা আন্ নজমের ৬ নং ১৩ থেকে ১৮ নং আয়াতের মি’রাজের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। আয়াতগুলোর শাব্দিক অর্থ সরলভাবে বুঝার চেষ্টা করলে সশরীরে মি’রাজের ব্যাপারে সন্দেহ থাকে না। আল্লাহপাক কোরআনুল করীমে এরশাদ করেছেন, “পরম পবিত্র ও মহামহিম সত্তা তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে (মোহাম্মদ সা.কে) নৈশকালে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি। যাতে আমি তাঁকে কুদরতের নিদর্শনসমূহ দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা বনী ইসরাইল-১) আরো এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই তিনি (মোহাম্মদ সা.কে) তাঁকে হযরত জিবরাইল(আ)কে আরেকবার দেখেছিলেন সিদরাতুল মুনতাহার কাছে। যার কাছে অবস্থিত জান্নাত। যখন বৃক্ষটি দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার তদ্ধারা আচ্ছন্ন ছিল। তাঁর দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি এবং সীমালঙ্ঘনও হয়নি। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছেন।” (সূরা আন্ নাজম : ১৩-১৮)
মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা) এর নুবুওয়াতী জিন্দেগীর দ্বাদশ বর্ষে পবিত্র রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে (মতান্তর আছে) সম্পন্ন হয় মিরাজ। আমরা সাধারণভাবে যদিও মি’রাজ বলি আসলে এখানে দু’টি অংশ রয়েছে: এক. ইসরা ও দুই. মি’রাজ।
ইসরা : ইসরা অর্থ নৈশভ্রমণ। যেহেতু মহানবী (সা)এর উর্ধ্বালোক ভ্রমণ হয়েছিল রাতে, তাই এর নাম ইসরা। মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণকে ইসরা বলা হয়।
মি’রাজ : উরূজ শব্দ থেকে মি’রাজের উৎপত্তি। এর অর্থ : সিঁড়ি বা সোপান, আরোহণ করা, উপরে চড়া বা উর্ধ্বগমন করা। উপরের আয়াতগুলোতে যা এরশাদ হয়েছে।
ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় পবিত্র রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে জিবরাইল (আ) মারফত আল্লাহতায়ালার অনুমতি প্রাপ্ত হয়ে মহানবী (সা) জান্নাতী বাহন বোরাক দ্বারা আরোহন করে পবিত্র কাবা চত্বর তথা বায়তুল্লাহ শরীফ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসে উপনীত হয়ে সেখানে ফেরেশতা-নবী-রাসূলদের উপস্থিতিতে সালাতে ইমামতি করে সেখান থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে আরো উর্ধ্বে গমন করে মহান আল্লাহপাকের দরবারে উপনীত হয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ ও প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে আবার ধূলির ধরায় ফিরে আসার ঘটনাকে মি’রাজ বলে। মি’রাজ রাসূল (সা) এর অন্যতম সেরা মুজিযা বা অলৌকিক ঘটনা।
মি’রাজের সংঘটনের সমকালীন পরিবেশ-পরিস্থিতি :
রাসূল (সা) আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠাকল্পে মক্কাবাসীদের থেকে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে তায়েফে যান। সেখানে আরো প্রচন্ড বিরোধিতা ও হামলার শিকার হন। সঙ্গী-সাথীদের উপরও জুলুম-অত্যাচারের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। আগে কিছু লোককে আবিসিনিয়ায় হিজরত করানো হয়। তায়েফ থেকে মক্কায় ফিরে এসে অবস্থান করা আরো দুঃসাধ্য হয়ে উঠে। প্রাণপ্রিয় সহধর্মিনী হযরত খাদিজা (রা) ও বড় আশ্রয়স্থল পিতৃব্য আবু তালিবের ইন্তেকাল রাসূলের জন্য ছিল বড়ই প্রতিকুল অবস্থা ছিল। আল্লাহর কুদরতী ইশারা বুঝা বড় ভার। মক্কা থেকে দূরে মদিনায় শুরু হতে থাকে রাসূলের দাওয়াত কবুলের অনুকুল পরিবেশ। মক্কার চরম প্রতিকুলতা ও প্রতিবন্ধকতার যাঁতা কলে নিষ্পিষ্ট মুষ্টিমেয় ঈমানদার লোকদের মদীনায় হিজরতের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন নবী মোহাম্মদ (সা) এর নেতৃত্বে বিজয়ী হওয়াই কুদরতের ফয়সালা। সেই বিজয়ের আগে
ঘটনাবহুল মি’রাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
মহানবী (সা) ঐ রাতে তাঁর চাচাতো বোন উম্মে হানী বিনতে আবি তালিব এর ঘরে (মতান্তরে কা’বা চত্বরে) নিদ্রিত অবস্থায় ছিলেন। এমনি সময় আল্লাহর নির্দেশক্রমে হযরত জিবরাইল (আ) এলেন, সাথে ছিলেন হযরত মিকাঈল (আ) ও হযরত ইসরাফিল (আ)। রাসূল (সা)কে জাগ্রত করে তাঁদের আগমনের হেতু জানালেন। রাসূল (সা) দু’রাকাত নফল নামাজ পড়েন। অতঃপর ফেরেশতারা তাঁকে জমজম কুপের কাছে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে সীনা মোবারক থেকে কলব বের করে পবিত্র পানি দ্বারা ধৌত করলেন। দু’কাঁধের মাঝখানে নুবুওয়াতের সীল মেরে মহাশূন্যে ভ্রমণ উপযোগী করে বোরাকের উপর বসিয়ে বোরাককে চলা শুরুর নির্দেশ দিলেন। বোরাক ছুটে চলল মহানবী (সা)কে নিয়ে, প্রথমে মদীনা মনোওয়ারা, তারপর সিনাই পর্বত, হযরত ঈসা (আ) এর জন্মস্থান ‘বায়তুল লাহম’, হয়ে পবিত্র মসজিদুল আকসায় উপস্থিত হন। সেখানে নবী-রাসূলদের সাথে নিয়ে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। তিনি নামাজের ইমামতি করেন, অতঃপর উপস্থিত সকল নবী-রাসূলগণের সাথে পরিচয় করে দেওয়া হয়। এইটুকু পর্যন্ত হল কোরআনের বর্ণিত ইসরার ঘটনা।
এরপর শুরু হয় মি’রাজ বা উর্ধ্বগমনের পালা। যাত্রাপথে রাসূল (সা) নভোমন্ডলে আল্লাহর সৃষ্টির অপূর্ব নিদর্শন দেখে অভিভুত হন। তিনি প্রথম আসমানে হযরত আদম (আ), দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা (আ) ও হযরত ইয়াহইয়া (আ), তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আ), চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আ) পঞ্চম আসমানে হযরত হারূন (আ), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আ) এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইবরাহীম (আ)কে পর্যায়ক্রমে দেখেন। কুশল বিনিময় শেষে ফেরেশতাদের কিবলা বায়তুল মামুর এ গিয়ে উপস্থিত হলে তিনি দেখতে পান অসংখ্য ফেরেশতা তাওয়াফ করছেন। বায়তুল মামুরে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশেতা প্রবেশ করে, কিয়ামত পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকবে। বায়তুল মামুর বরাবর নিচে পবিত্র কাবা ঘর অবস্থিত। এরপর হযরত জিবরাইল (আ) নবীজীকে সঙ্গে করে বেহেশত-দোজখ পরিদর্শন করে সিদরাতুল মুনতাহায় ফিরে আসেন। সেখান থেকে ‘রফরফ’ নামক বাহনে করে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে লাভ করেনযে ঘটনাটি ছিল একান্তই প্রয়োজনীয় ও অপরিহার্য, সেটিই সংঘটিত হল হিজরতের পূর্বে।
মি’রাজকে নিয়ে সন্দেহ-সংশয় :
মি’রাজ থেকে ফিরে আসার পর সর্বসাধারণকে তিনি যখন তা অবহিত করলেন, তখন অনেকেই মি’রাজ অবিশ্বাস্য বলে ঠাট্টা-বিদ্রুপ বলে উড়িয়ে দিল। এত কম সময়ের মধ্যে কিভাবে তা সম্ভব তার জন্যে সন্দিহান হল তো বটেই, একে মোক্ষম সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করল কাফের-মুশরিকরা। তাদের অপপ্রচারের দূর্বল ঈমানের মুসলমানদেরও মনে সন্দেহ হল। মি’রাজের ঘটনা শোনা মাত্রই হযরত আবু বকর (রা) কোন সন্দেহ ছাড়াই বিশ্বাস করলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) সাথে সাথেই তাঁকে “সিদ্দিকে আকবর বা মহাসত্যবাদী” বলে উপাধি দিলেন। এছাড়া মি’রাজ কি স্বপ্নে না স্বশরীরে সংগঠিত হয়েছিল তা নিয়েও বির্তক হয়। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তা সম্ভব কিনা তার সম্ভাব্যতা নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। আমরা না দেখে আল্লাহকে বিশ্বাস করি, তাঁর সৃষ্টি দেখে তার অস্তি¡ত্ব অনুভব করি। কোরআন আল্লাহর কিতাব তাও বিশ্বাস করি। তাই কোরআনে যা আছে তা কি বিশ্বাস করতে হবে না? মি’রাজের কথা কোরআনে পাকে আছে, যেহেতু কোরআন বিশ্বাস করি, তাই কোরআনে যা আছে তাও বিশ্বাস করতে হবে। আল্লাহ চেয়েছেন আল্লাহর হাবীবকে কাছে পেতে, তিনি ডেকে নিয়ে গেছেন। কিভাবে নিয়ে গেছেন, সেটা মহান জাত পাকের ব্যাপার। যে আল্লাহ এই বিশ্ব-পরিমন্ডল সৃষ্টি করতে পারেন, তাঁর জন্যে রাসূল (সা)কে মি’রাজ করানো কি কঠিন ব্যাপার। আল্লাহ তো কোনো কিছু করতে চাইলে শুধু মাত্র “কুন বা হও” বললেই তো হয়ে যায়? মানুষ আজ মহাশূন্যে মানুষ যাচ্ছে-তাই মি’রাজও অসম্ভব বা অবাস্তব কোনো ঘটনা ছিল না।
রাসূল (সা)এর মি’রাজ স্বপ্নে, আধ্যাত্মিকভাবে না সশরীরে হয়েছিল?
এ নিয়ে কারো মধ্যে সন্দেহ-সংশয় থাকলেও মুসলমানদের মধ্যে থাকা ঠিক নয়। কোরআনে বর্ণিত আয়াতগুলো অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে চাইলে মি’রাজ যে সশরীরে হয়েছে তা দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে। সূরা বনী ইসরাইলের আয়াতে বলা হয়েছে, “যিনি তাঁর বান্দাকে (মোহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নৈশকালে ভ্রমণ করিয়েছেন’’ এবং মি’রাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, “যাতে আমি তাঁকে কুদরতের নিদর্শন সমূহকে দেখিয়ে দিই।’’ আবার সূরা আন্ নজমের আয়াতে বলা হয়েছে, “এবং তিনি (রাসূল সা.) সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছলেন, তারপর আল্লাহর নিকটবর্তী হলেন, এমন কি দু’ধনুকের জ্যা অথবা তার চেয়ে কাছে”। আবার বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই তিনি (মোহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে হযরত জিবরাইল (আ)কে আরেক বার দেখেছিলেন সিদরাতুল মুনতাহার কাছে।” সূরা বনী ইসরাইলের আয়াতে কারীমার প্রথমেই ‘সুবহানাল্লাজি আসরা’ দিয়ে শুরু হয়েছে। যার অর্থ পবিত্র ও মহামহিম সেই সত্তা, যাতে কেউ হীনমন্যতা, সংকীর্ণতা ও সংশয়ে না ভুগেন এবং এই ঘটনাকে ও অসম্ভব মনে না করেন। কারণ তিনি তো সকল প্রকার দুর্বলতা, অপারগতা ও অক্ষমতা থেকে মুক্ত। একজন প্রকৃত মুসলমানের জন্য উল্লেখিত আয়াতগুলোই সশরীরে মি’রাজ হয়েছে বলে বিশ্বাস করার জন্য যথেষ্ট।্ মি’রাজ যদি স্বপ্নে ঘটত তাহলে তিনি সাহাবীদের বলতে পারতেন গতরাতে আমি এরকম একটি স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু তিনি তা বলেন নি। অতএব আমাদের ঈমান বলে যে, সশরীরে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছে আল্লাহর রাসূল (সা)এর। তাফসীরে ইবনে কাছীর, তাফসীরে কুরতুবী, ফতহুল বারী প্রভৃতি জগদ্বিখ্যাত কিতাবে মি’রাজ সশরীরে হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইমাম ইবনে কাছীর তাঁর তাফসীরে ২৫জন সাহাবীর নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “ইস্রার হাদীস সম্পর্কে যাদের কাছ থেকে এসব রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে, তাঁদের সম্পর্কে সকল মুসলমানের ঐক্যমত রয়েছে। শুধু ধর্মদ্রোহী জিন্দিকরা এটা অস্বীকার করে থাকে”। বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘ফতহুল বারী’তে আল্লামা ইবনে হাজার আস্কালানী বলেন, “বিশিষ্ট ওলামায়ে কেরামের অভিমত, নবী করিম (সা)এর ইস্রা ও মি’রাজ নিঃসন্দেহে নবুওয়াত প্রাপ্তির পর জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে একই রাত্রে সংঘটিত হয়েছে। এ হাদীসটি প্রসঙ্গেক্রমে প্রণিধধানযোগ্য। হযরত আবু যর গিফারী (রা) বলেছেন, আমি নবী (সা)কে জিজ্ঞেস করেছিলাম (মি’রাজের সময়) তিনি আল্লাহকে দেখেছিলেন কিনা? জবাবে তিনি বললেন, আমি তাঁকে (আল্লাহকে) নুররূপে দেখেছি। তাঁকে (আল্লাহর সত্তাকে) কিভাবে দেখবো? (মুসনাদে আহমাদ) সুতরাং মি’রাজ যে সশরীরে সংঘটিত হয়েছে এতে কোন সন্দেহ-সংশয় থাকলে ঈমান থাকবে না।
মি’রাজকালে মহানবী (সা) যা যা অবলোকন করেন তা সংক্ষেপে এই :
মসজিদুল আকসার পথে : ফরজ নামাজে অবহেলা কারীর শাস্তি, যাকাত অনাদায় কারীর শাস্তি, ব্যভিচারে লিপ্ত নর-নারীর শাস্তি, ডাকাতি ও ছিনতাইকারীর শাস্তি, মানুষের হক ও আমানত খিয়ানতের শাস্তি, গীবতকারীর শাস্তি, সুদখোরের শাস্তি।
উর্ধ্বলোকের পথে : বেহেশতের হুর, বেহেশতের নুর, দোজখ, আকাশ পথে সাত আসমান, জান্নাতের তিনটি ঝরণা, শিঙ্গা, কিয়ামতের আলামত, ভাগ্য ও জন্ম-মৃত্যু লিখার কলম।
নভোচারী মোহাম্মদ (সা) বিজ্ঞানের বিস্ময়!
আজকের বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রার পেছনে মি’রাজই অনুপ্রেরণার উৎস। অনেকের ভাবনা বিজ্ঞানের আলোকে সম্ভব কিনা মি’রাজ? তাও গবেষণা-ব্যাখ্যায় সম্ভব বলে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ সব বিজ্ঞানের বড় বিজ্ঞান তো মহাগ্রন্থ আল্ কোরআন। কোরআন বলছে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছে এবং তা সশরীরে। তারপরও বিজ্ঞানের আলোকে সংক্ষেপে আলোচনা করা যায়। মি’রাজের সময় রাসূল (সা)এর বাহন ছিল বোরাক এবং রফরফ। এ দু’টি ছিল মূলত নভোযান। বোরাক শব্দটি এসেছে বার্ক শব্দ থেকে। বার্ক অর্থ হল বিদ্যুত। বোরাক ছিল একটি বৈদ্যুতিক দ্রুতগতি সম্পন্ন যান। আকাশে বিদ্যুতের চমক আমরা দেখি, মুহুর্তেই মিলিয়ে যায়। আমরা জানি আলোর গতি প্রতি সেকে- ১,৮৬, ০০০ (এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার) মাইল। বোরাকের গতি ছিল রকেটের গতির চেয়েও বেশী। আমাদের মহানবী (সা)এর দেহ ছিল আল্লাহর খাস কুদরতি পোশাকে আচ্ছন্ন। গ্রহ-নক্ষত্র অতিক্রম করে নবী করিম (সা) নক্ষত্র-জগতের শেষ প্রান্তে সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছেন। সেখানে বাহন পরিবর্তন করেন, যার নাম রফরফ। এর গতি আলোর গতির চেয়ে লক্ষ লক্ষ গুণ বেশী।
আমরা আমাদের ঈমানের বলেই মি’রাজকে বিশ্বাস করি। কাফের, মুশরিক, নাস্তিক্যবাদীরা তা স্বীকার করতে চান না। তাদের যুক্তি জড় জগতের মানুষের মহাকাশের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভেদ করতে পারবে না। কারণ শূন্যে অবস্থিত কোন স্থূল বস্তুকে পৃথিবী সর্বদাই নিুদিকে আকর্ষণ করে থাকে। মাত্র ১,২০০ মাইল উপরে উঠলেই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অতিক্রম করা যায়। তবে ঘন্টায় যদি ২৫,০০০ মাইল বেগে উর্ধ্বে উঠা যায় তবে এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অতিক্রম করা সম্ভব হয়। অথচ মহানবী (সা)এর বাহন বোরাকের গতিবেগ এর চেয়ে অনেক বেশী ছিল। আজ সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে মি’রাজের ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। টেলিগ্রাম, টেলিফোন, রেডিও, টেলিভিশন, রকেট, বিভিন্ন নভোযান ইত্যাদি যার মধ্যে অন্যতম। বিজ্ঞানের বিস্ময় হলেও তা আল্লাহরই কুদরতে সম্পন্ন হয়েছে। এতে বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু নেই এবং বিজ্ঞানের জন্য মি’রাজ একটি মাইলফলক বটে।
ইসলামী রাষ্ট্রের চৌদ্দ দফা রূপকল্প (VISSION):
মি’রাজের অন্যতম উপহার হচ্ছে রাসূল (সা) আনিত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বিশেষ রূপকল্প। সূরা বনী ইসরাইলের ২য় ও ৩য় রুকুতে ধারাবাহিকভাবে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের ১৪ দফা মূলনীতি ঘোষণা হয়েছে। মক্কী যুগের শেষ লগ্নে এবং মাদানী যুগের পূর্বে মি’রাজ আল্লাহতাআ’লার এক সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা ছিল, যাতে মদীনা একটি নতুন ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে। আল্ কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, “তোমার রব ফায়সালা করে দিয়েছেন যে, তোমরা কারো ইবাদত করো না, একমাত্র তারঁই ইবাদত করো। পিতামাতার মাথে ভাল ব্যবহার করো। যদি তোমাদের কাছে তাদের কোন একজন বা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে, তাহলে তাদেরকে ‘উহ্’ পর্যন্তও বলো না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিয়ো না বরং তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে কথা বলো। আর দয়া ও কোমলতা সহকারে তাদের সামনে বিনম্র থাকো এবং দোয়া করতে থাকো এই বলে : হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। তোমাদের রব খুব ভাল করেই জানেন তোমাদের মনে কি আছে। যদি তোমরা সৎকর্মশীল হয়ে জীবন যাপন করো, তাহলে তিনি এমন লোকদের প্রতি ক্ষমাশীল যারা নিজেদের ভুলের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে বন্দেগীর নীতি অবলম্বন কারা দিকে ফিরে আসে। আয়কে তার অধিকার দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকের তাদের অধিকার দাও। বাজে খরচ করো না। যারা বাজে খরচ করে তারা শয়তানের ভাই, আর শয়তান তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ। যদি তাদের থেকে (অর্থাৎ অভাবী, আত্মীয়-স্বজন, মিসকীন ও মুসাফির) তোমাকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয় এ জন্য যে, এখনো তুমি আল্লাহর প্রত্যাশিত রহমতের সন্ধান করে ফিরছো, তাহলে তাদেরকে নরম জবাব দাও। নিজের হাত গলায় বেঁধে রেখো না এবং তাকে একেবারে খোলাও ছেড়ে দিয়ো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অক্ষম হয়ে যাবে। তোমার রব যার জন্য চান রিযিক প্রশস্ত করে দেন আবার যার জন্য চান সংকীর্ণ করে দেন। তিনি নিজের বান্দাদের অবস্থা জানেন এবং তাদেরকে দেখছেন। দারিদ্র্যের আশংকা নিজেদের সন্তান হত্যা করো না। আমি তাদেরকেও রিযিক দেবো এবং তোমাদেরকেও। আসলে তাদেরকে হত্যা করা একটি মহাপাপ। যিনার কাছেও যেয়ো না, ওটা অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য পথ। আল্লাহ যাকে হত্যা করা হারাম করে দিয়েছেন, সত্য ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করো না। আর যে ব্যক্তি মজলুম অবস্থায় নিহত হয়েছে তার অভিভাবককে আমি কিসাস দাবী করার অধিকার প্রদান করেছি। কাজেই হত্যার ব্যাপারে তার সীমা অতিক্রম করা উচিত নয়, তাকে সাহায্য করা হবে। এতিমের সম্পত্তির ধারে কাছে যেয়ো না, তবে হ্যাঁ সদুপায়ে, যে পর্যন্ত না সে বয়োপ্রাপ্ত হয়ে যায়। প্রতিশ্রুতি পালন করো, অবশ্যই প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে। মেপে দেবার সময় পরিমাপ পাত্র ভরে দাও এবং ওজন করে দেবার সময় সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করো। এটিই ভাল পদ্ধতি এবং পরিণামে উৎকষ্টতর। এমন কোন জিনিসের পেছনে লেগে যেয়ো না যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই। নিশ্চিতভাবেই চোখ, কান ও দিল্ সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। জমিনে দম্ভভরে চলো না। তুমি না জমিনকে চিরে ফেলতে পারবে, না পাহাড়ের উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারবে। (আয়াত : ২৩-৩৭) সংক্ষেপে ১৪ দফা রূপকল্পগুলো নিম্নরূপ :
১। মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর ইবাদত করা।
২। পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ ও তাদের সেবা-শুশ্রুষা করা।
৩। নিকটাত্মীয় এবং অসহায় দরিদ্র লোকদের প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালন করা।
৪। ধন-সম্পদ অপচয় না করা।
৫। মিতব্যয়ী হওয়া।
৬। ব্যয়ে ভারসাম্যমূলক পন্থা অবলম্বন ও আল্লাহর দেওয়া রিযক ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম সংকট তৈরী না করা।
৭। দারিদ্র্যের কারণে সন্তান হত্যা না করা।
৮। ব্যভিচারের পথে না যাওয়া।
৯। আল্লাহর নির্ধারিত বিধির বাইরে মানুষ হত্যা না করা।
১০। বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ইয়াতীমের সম্পত্তির হেফাজত করা।
১১। ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন করা।
১২। ওজনে কম না দেওয়া।
১৩। অসম্ভবের পেছনে লেগে না থাকা।
১৪। আল্লাহর জমিনে দাম্ভিকের মত না চলা।
রাসূলুল্লাহর মি’রাজ উম্মতের জন্য সুসংবাদ বয়ে এনেছেন। মি’রাজের রাতে আল্লাহর সাথে তাঁর হাবীবের সাক্ষাতে মহামূল্যবান কিছু উপঢৌকন দেন। এক. পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, দুই. সুরা বাকারার শেষাংশ এবং তিন. যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোন শরীক করবে না-তার কবীরাগুনাহ্ সমূহ মাফ করে দেবে। অর্থাৎ কাফের-মুশরিকদের মত চিরকাল দোজখে নিক্ষিপ্ত হবে না। মি’রাজ রাসূল (সা)এর অন্যতম সেরা একটি মুজিযা। যার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সুদুর প্রসারী। এতে কোনরূপ সন্দেহ না করা ঈমানের পরিচায়ক। মি’রাজে প্রাপ্ত উপহার সালাত মুমিন জীবনে অত্যন্ত গুরূত্ববহ। রাসূল (সা) আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি সালাত তরক করলো, সে কুফরী করলো। আর ঈমান আনার পর কুফরী করার পরিণতি কি হবে আল্লাহতা’আলা পরিষ্কারভাবে আল কোরআনে জানিয়ে দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, “যে ব্যক্তি ঈমান আনার পর কুফরী করল, কিন্তু এ কাজে তাকে বাধ্য করা হয়েছিল, অথচ মন তার ঈমানের উপর নিশ্চিত ছিল, তা হলে তাকে মাফ করা হবে। কিন্তু যে সন্তুষ্ট চিত্তে কুফরী অবলম্বন করবে, তার জন্যে আল্লাহর গজব এবং শাস্তি রয়েছে।” (সুরা আন নহল-১০৪) অতএব রাসূলুল্লাহ(সা)এর স্বচক্ষে দেখা মি’রাজের ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে কোরআনের পথে, ইসলামের পথে চলাই হোক আজকের দৃপ্ত অঙ্গীকার। রাসূল (সা)এর মি’রাজ থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা বেশী বেশী করা। আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য জানার চেষ্টা করা। চন্দ্র অভিযানের যাত্রীদের নভোচারী বলা হয়। অথচ আল্লাহর রাসূল (সা)ই ছিলেন বিশ্বের প্রথম নভোচারী। ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালনা করতে তার শিক্ষাও আছে মি’রাজে। রাসূল প্রতীকীভাবে জান্নাত-জাহান্নাম অবলোকন করেছেন। আমরা আমলে সালেহ করে জান্নাত যাওয়ার এবং জাহান্নামে পতিত না হওয়ার পথ পরিহার করতে পারি।
(আমার প্রবন্ধ সংকলন "রাসূল (সা) আমার ভালবাসা”গ্রন্থের- মি’রাজ সংক্রান্ত দু’টি লেখা অবলম্বনে)
=======
:আরো জানতে পড়ুন : রাসূলুল্লাহ (সা)এর মি’রাজ উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য
বিষয়: সাহিত্য
১৭৮৬ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন