টিচার
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ২৩ মার্চ, ২০১৬, ০৩:১২:১৫ দুপুর
সাদমানকে বাসায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটু আগেও বাসায় ছিল। টিচার এসেছিল, পড়তে বসে নি। তাই মায়ের বকুনীসহ পিটুনি খেয়েছে। সবাই খুঁজতে থাকে। বারান্দা, বেলকনি, গেস্টরুম, বেডরুম, বাথরুম, রিডিং-ড্রইং-ডাইনিং সবখানে খোঁজা শেষ। পাশের বাসায় গেল বড় বোন মালিহা। সেখানেও নেই। নিচে বন্ধুদের সাথে প্রতিদিন বিকেলে খেলত। ছেলেদের হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। মালিহা দেখে এসেছে নিচেও।
সালেহা বেগম বলে, নিচেও নেই? আমার ছেলে কই গেল? হাঁপাতে থাকে।
: দোকানে যা, তাড়াতাড়ি। ওখানে গিয়ে দেখ।
: যাচ্ছি। মালিহা বের হয়ে গেল।
নেই কোথাও। কিংকর্তব্যবিমুঢ় সালেহা বেগম।
তোর আব্বুকে রিং দে। মালিহা বাটন টিপতে থাকে, কবির সাহেবও ফোন রিসিভ করে না।
: আম্মু এককাজ করলে হয় না? আন্টিকে ফোন করে দেখ। মালিহা বলে।
: কোন আন্টি?
: রাহীর আম্মু।
ও দে দে, তাড়াতাড়ি ফোন দে।
আস্ সালামু আলাইকুম। ফোন রিসিভ করে রাহীর মা।
: ভাবী কেমন আছেন? উদ্বেগের স্বরে সালেহা বেগম বলে।
: আল্হামদুলিল্লাহ! আপনি কেমন আছেন ?
: আছি ভালো। ওখানে সাদমান গেছে?
: হ্যাঁ। আছে তো, কেন কী হয়েছে? আপনাকে এত উত্তেজিত দেখাচ্ছে কেন?
সালেহা বেগম রাহীর আম্মুকে সংক্ষেপে সব বলে। ও এসেছে মিনিট দশেক হল। আমিও আপনাকে রিং দিচ্ছিলাম। বলে এসেছে কি না জিজ্ঞেস করলে মাথা নিচু করে ছিল, তাই সন্দেহ হচ্ছিল। আর কোন দিন তো একা আসে নি। থাকুক এখানে ঘন্টা খানেক পর মালিহাকে পাঠাবেন, ও নিয়ে যাবে। এখন তো ওরা খেলছে।
মাঝে মাঝে মাকে বলে সাদমান মাকে রাহীদের বাসায় যেত, রাহীও আসতে তার মাকে নিয়ে। উভয়ের বাসা বেশি দূরে না রাস্তার ওপারে। ছাদ থেকে বিল্ডিংটি দেখা যায়।
সালেহা বেগম ঠিক করলেন মালিহা নয়, তিনি নিজে যাবেন।
সালমান সেই সকালে বেরিয়েছে তার কোন ইয়ত্ত্বা নেই। ওর জন্য চিন্তা করতে করতে মাথা পাগল প্রায়। মালিহা বলে, আম্মু সাদমানকে খুজঁতে যখন বেরিয়েছি, তখন গলির মাথায় ছিল, আমাকে দেখে সরে পড়ে।
: আর কে কে ছিল ওখানে?
: মিজান, সজীব, রায়হান, রানা এবং নতুন আরেকটা ছেলে। নাম জানি না।
চিন্তা করে দেখ, বাসার পাশে থাকলেও দুপুরে ভাত খেতে আসেনি। আমি আর পারি না! মোবাইলে রিং দিলেও ধরে না, কেটে দেয়। সারাদিন ফেসবুক, ফেসবুক! আরও কত কি? আগে সাইবার ক্যাফে গিয়ে আড্ডা দিত, তাই তোর আব্বু মোবাইল কিনে দেয়। তোর আব্বুকে কত নিষেধ করেছি মোবাইল সেট কিনে না দিতে। তোর আব্বু বলে, ও যখন চাইছে, না দিলে যে কোন প্রকারে যোগাড় করে ফেলবে। তখন হিতে বিপরীত হবে। আজ কাল কার ছেলে, তাছাড়া মোবাইল থাকলে ও সুতোটা আমার হাতে থাকছেই। বাসা থেকে বের হবে না। আমার কথা রাখলে তো তোর আব্বু? আজ জুমাবার, নামাজও পড়ে নি। তোর আব্বুটা বাসায় না থাকার সুযোগ নিচ্ছে সে।
কলিং বেলের আওয়াজ শুনে সাদমান লুকিয়ে গেছে। পেছন পেছন রাহীও যায়।
: জোরে চিৎকার দিয়ে বলে, আন্টি দরজা খুলবেন না। মনে হয় আম্মু আসছে। আমাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে আবার মারবে । আমি বাসায় যাব না। সাদমান বলে।
: অসুবিধা নেই। আমি আছি না? রাহীর আম্মু বলে।
বিকেল ৫টা। রাহীর টিচার আসার সময় হয়েছে।
কাজের মেয়েটি দরজা খুলে দিল। রাহীর টিচার এসেছে।
রাহীকে জানায় কাজের মেয়েটি ওর টিচার আসার কথা। টিচার সোজা রিডিং রুমে গিয়ে রাহীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রাহী আসছে না দেখে মৃদু স্বরে রাহীর নাম ধরে ডাকতে থাকে।
রাহী তার রুমে আসে পড়তে।
রুমে ডুকে টিচারকে সালাম দেয়। টিচার কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর অযু করে আসছে কি না জানতে চায়?
রাহী সাদমানের সাথে খেলারত ছিল বিধায় অযু করে পড়তে বসে নি। টিচার বলে অযু করে আসতে।
কিছুক্ষণ পর সাদমানের আম্মু এলো রাহীদের বাসায়। রাহী-সাদমানের মা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ড্রইং রুমে গিয়ে বসে। রাহীর মা জানায় রাহী টিচারের কথা। সাদমান রাহীর আম্মুদের বেড রুমে ছিল। আম্মু আসার খবর পেয়ে কাছে ঘেঁষছে না। না বলে রাহীদের বাসায় আসাতে আবার পিটুনি দেবে এই ভয়ে। আপনি বসেন আপা আমি একটু আসি। সাদমানের মা বুঝতে পারে তাকে আপ্যায়িত করার জন্য কিচেন রুমে যাচ্ছে। নিষেধ করে সাদমানের মা। বলে আমি একটু আগে দুপুরের খাওয়া খেয়েছি। তবুও চলে যায় রাহীর মা। মেহমানদারী করাটা নবীজীর সুন্নত। এই সুযোগ তিনি হাতছাড়া করতে চান না।
রাহীর টিচার প্রতিদিন পড়া শেষে একটি করে গল্প শোনায়। আমাদের প্রিয়নবী (সা)এর শৈশব-কৈশোরর গল্প, কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-ভভিযানের গল্প, কুরআন-হাদীস থেকে বিভিন্ন শিক্ষণীয় গল্প, সাহাবীদের সোনালী দিনের কাহিনী, হযরত লুকমানের ছেলেকে দেয়া উপদেশ, বায়েজিদ বোস্তামীর মাতৃভক্তির গল্প, আবদুল কাদের জিলানীর সত্যবাদিতার গল্প, শেখ সাদীর গল্প, পড়া-লেখার গুরুত্ব, বড়দের সাথে আদব রক্ষা, ছোটদের সাথে স্নেহপূর্ণ ব্যবহার, মেধাবী ও সৎ ছাত্র কিভাবে হওয়া যায় ইত্যাদি।
টিচার বলে, গতকালের দোয়াটা শিখেছ?
: জি, টিচার।
: আমাদের নবীজীর নাম শুনলে কি বলতে হয়?
: সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। অর্থাৎ তাঁর উপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।
: ভেরি গুড। আগের শিখা দোয়াগুলো মনে আছে। তাউজ, তাসমিয়া, ঘুমানো আগে, ঘুম থেকে উঠার পর, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় দোয়া, কারো বাসায় ডুকার দেয়া, মুসাফাহা করার দোয়া, সালামের উত্তরে কী বলতে হয় ?
: জি, টিচার।
ঠিক আছে। এই দোয়ার বইটি এবং একটি কুরআন শরীফ আনতে বলবে আম্মুকে। আমি নাম লিখে দিচ্ছি।
ড্রইং থেকে কিচেনের দিকে যাওয়ার সময় রিডিং রুমের দরজায় উঁকি দিয়ে টিচারের কথাগুলো শুনতে পায়। প্রথমে মনে করেছিল বসে বসে নিছক গাল-গল্প করছে। শেষ দিকে আবার সব পড়া রিভিউ করলে তার ভুল ভাঙে। টিচারকে তার পছন্দ হয়। তার পড়ার কৌশল বেশ চমকপ্রদ। আসলে ছেলেদের গল্পে গল্পে শেখালে আগ্রহ বাড়ে। ভাবে রাহীর মাকে বলে এই টিচারের কাছে সাদমানকে পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যে টিচার এখন পড়ার তাকে খুব একটা ভালো লাগে না। অবশ্য তার ছেলেও তো বেশ দুষ্ট, পড়তে বসতেই চায় না। শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সাদমানের আম্মু বলে, আমার বড় ছেলেটার কারণে ছোট ছেলেও ইচঁড়ে পাকা হয়ে গেছে। বাসায় এক মুহুর্তও থাকতে চায় না। সারা দিন টো টো। কিছু বললে জিনিস পত্র ছুঁেড় মারে। দিনে ওদের আব্বু থাকে না। ছেলেদের সামলানো দায় হয়ে পড়ে। সালমানকেও নিযে এখন নানা খারাপ কথা শুনা যাচ্ছে, বখাটে ছেলেদের সাথে চলা-ফেরা করে, কী কী যেন খায়। সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন আপা!
রাহীর মা বলেন, আপা সন্তান হচ্ছে আল্লাহর দেয়া নেয়ামত। মা-বাবার নয়নের কাজল, হৃদয়ের ধন। ছোটকাল থেকেই তাদের সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার। এদের গড়ে তোলা আমাদের সবার দায়িত্ব। তাদের সযত্মে প্রতিপালন করলে তবেই চরিত্রবান হবে। এ জন্য গার্ডিয়ানদের সতর্ক থাকতে হবে। ছেলে কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, কখন যাচ্ছে, কখন আসছে-এসব তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য রাখতে হবে। ওরা যাতে বুঝতে না পারে-আর কোন কোন কাজ নেগেটিভ করলে সাথে সাথে র্অ্যািক্ট করা যাবে না। কারণ রাগের সময় শয়তানের প্রভাব থাকে। খারাপ কিছুু তখন ঘটে যেতে পারে।
রাহীর মা বলতে থাকেন, মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসুবক আসক্তি আমাদের সমাজে নিদারুণ ভাবে ঝেঁকে বসেছে। ছেলে-বুড়ো কেউই বাদ যাচ্ছে না। এর করালগ্রাসে নৈতিকতা বিপর্যস্ত। ক্ষেত্র বিশেষে ভার্চুয়াল জগতের নেগেটিভ ইফেক্টটা এটম বোমার চেয়েও ভয়াবহ। তাই সন্তানদের সাথে কোমল ব্যবহারের মাধ্যমে গণ্ডীতে আবদ্ধ রাখতে হবে। যখন তখন মারধর করবেন না। আপনি চেষ্টা করুন, আর আল্লাহর দুয়ারে ধর্না দিয়ে চাইতেও হবে। সন্তানরাই আমাদের সব। তারা যদি উচ্ছনে যায় তাহলে দুনিয়া-আখেরাত আমাদের জন্য বরবাদ হয়ে যাবে।
: চেষ্টা তো করে যাচ্ছি আপা, ধৈর্য্যের বাধঁ আর কত টিকে থাকে?
: আস্তে আস্তে নামাজে আগ্রহী করে তুলুন, বয়স তো এখন নামাজে তাগিদ দেয়ার।
: সাদমানের আম্মু বলেন, আজ আসি আপা। সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে।
: ঠিক আছে আপা, আসরের সালাতের সময়ও আর বেশি বাকী নেই। আবার আসবেন। সাদমানের দিকে তাকিয়ে বলেন, আর আম্মু বকা দেবে না, তুমি ভাল করে পড়াশানা করবে। আম্মুর কথা শুনবে, আম্মুকে না জানিয়ে কোথাও যাবে না। ঠিক আছে?
: সাদমান মাথা নাড়ে।
: আল্লাহ হাফেজ বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রাহীর মা।
টিচারের সেল নম্বরটা সাদমানের মাকে নেয়। সময় করে ফোন দেবেন।
সন্তানদের ভাল মানুষরূপে গড়ে তোলার দায়িত্ব মা-বাবার পর টিচারের উপর অনেকটা নির্ভর করে। অনেক সময় ভাল টিচার পাওয়াও কঠিন। রাহীর টিচার খালেদকে ঠিক করে দিয়েছিলো স্কুর ফ্রেন্ড রাহনুমা। বেশ ভালই পড়াচ্ছে টিচার। গতবছরও ভাল রেজাল্ট করেছিল রাহী। টিচারটার উপর আস্থা রাখা যায়।
আসরের সালাত শেষে মুনাজাত করেন রাহীর মা। জুমাবার আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময়টা দোয়া কবুলের সময়। দু’হাত তুলে মনিবের দুয়ারে দোয়া করতে থাকেন-
“রাব্বানা হাব্লানা মিন আযওয়াযিনা ওয়ার্জুরিয়াতিনা র্কুরাতা আইনিঁও ওয়াজাআলনা লিল্ মুত্তাকীনা ইমামা”।
@@@@
বিষয়: সাহিত্য
১৩৩৩ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক সময় দেখা যায়, বহুদিন পর ভাই বোন বাবা মা এক সাথে বসেছে কিছু আলাপচারিতার জন্য, কিন্তু সবার হাতেই মোবাইল আর সবাই নিজ নিজ মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত।
এভাবে আমাদের সংসারেগুলো ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছে।
সুন্দর পোষ্টটির জন্য শুকরিয়া।
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া ।
গুরুত্বপূর্ণ লিখাটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন