সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আধিপত্যবাদ বিরোধী কবিতা..
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৯:২৭:২৪ রাত
সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আধিপত্যবাদ বিরোধী কবিতা :
আধিপত্য মানে কর্তৃত্ব বা প্রভুত্ব বা দখলদারিত্ব। আমরা সাধারণত কোন দল আরেক দলের প্রতি আক্রমণ করলে বলি আধিপত্য বিস্তারের জন্য তা করেছে। কেউ যখন আধিপত্য বিস্তারকে ঠেকাতে অপারগ হয় তখন বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদের ধরনও শক্তির বিচারের হয়ে থাকে। মানববন্ধন, পোস্টারিং, মিছিল, লেখালেখি, জনমত গঠন ইত্যাদি উপায় এর মাধ্যম। এ তো গেল দেশের ব্যাপারে, কিন্তু যখন তা দেশের বাহির থেকে কোন দেশের বিরুদ্ধে করা হয় তখন আধিপত্যবাদকে আগ্রাসন রূপে বিচার করা হয়। আগ্রাসন রুখার জন্য দেশের সরকারকে অগ্রণী ভুমিকা রাখতে হয়। বিভিন্ন দেশ প্রতিরক্ষা বাহিনী সদা প্রস্তুত দেশের যে কোন আগ্রাসন রুখে দিতে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবাদ করে, সরকার কুটনৈতিক তৎপরতা চালায়, দেশের নাগরিক সমাজ বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদ করে-অভিনেতা অভিনয়ের মাধ্যমে, শিক্ষক ছাত্রদের শিক্ষার মাধ্যমে লেখকরা তাদের লেখনির মাধ্যমে করে থাকেন। আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লেখনিতে আমাদের জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চেয়ে বেশি ভুমিকা কেউ রাখতে পারেন নি। তিনি বৃটিশ আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে সদা তাঁর মসি চালিয়েছেন, তাদের ত্রস্ত করেছেন-তারাও কবির বিরুদ্ধে একশান নিয়েছেন, কারারুদ্ধ করেছেন। কারান্তরালেও তার লেখনি স্তব্ধ হয়নি, বরং আরও শাণিত হয়েছে।
“ভাঙার গান” কাব্যগ্রন্থে বজ্রনিনাদ গর্জে উঠে। তিনি লিখেন-
“কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট
রক্ত জমাট
শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী!
ওরেও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়–ক প্রাচী’র প্রাচীন ভেদি।”
“অগ্নি বীনা”র আগুনে বিদ্রোহের বাণী তিনি ছড়িয়ে দেন, জুলুমশাহীর বিরুদ্ধে সে এক প্রচণ্ড নির্ঘোষ-বিদ্রোহী কবিতায় তিনি লিখেন-
বল বীর-বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির।
-------------------
মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
অগ্নিবীণার কী অগ্নিশিখা! এই কাব্যগ্রন্থ নয় শুধু-বিষের বাঁশী, ভাঙার গান, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফণিমনসা, ঝিঞ্জির, প্রলয় শিখা প্রবৃতি কাব্যগ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছেন।
বর্তমান পৃথিবীতে আগ্রাসী তৎপরতার ধরন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। মার্কিন. রুশ, বৃটিশ আগ্রাসীদের পাশাপাশি আরও অনেক ছোট ছোট আঞ্চলিক শক্তি পাশ্ববর্তী দেশ সমূহে দাদাগিরি ফলিয়ে থাকেন। বিশ্বের এখনকার অশান্তিও উৎস ইয়াহুদীবাদী ইসরাইলের কারণেই অনেকটা। অবৈধ ইসাইলের বিরুদ্ধে নোবেল জয়ী জার্মান কবি গুন্টার গ্রাসের কবিতা আধিপত্যবাদের কাঁপন ধরিয়ে দেয়, তিনি “যে কথা বলতেই হবে” শিরোনামে কবিতাটি কয়েক চরণ এই :
“কিন্তু কেন আমি এতদিন নীরব থেকেছি?
আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম আমার নিজের অতীত
যে কালিমায় নোংরা তা তো কখনোই মুছে যাবে না।
যে ইসরায়েলের সাথে আমি এতটা নিবিড় কিংবা থাকব আগামীতে.
খোলামেলা সত্যের ঘোষণা সে যে মেনে নেবে সে আশাও নেই।
কেন এখন এই বুড়ো বয়সে
দোয়াতের অবশিষ্ট কালি দিয়ে বলতে হবে
ইসরায়েলের পরমানুশক্তি বিপন্ন করে তুলবে
এরই মধ্যে ভঙ্গুর বিশ্বশান্তিকে?
কারণ যে কথা বলতেই হবে, কাল সেটা দেরি হয়ে যাবে।”
কবিতা প্রকাশিত হয় জার্মান দৈনিক “সুড ডয়েচে যাইটুং”(Süddeutsche Zeitung)এ এবং ইংরেজিতে “হোয়াট মাস্ট বি সেইড”নামে। ফলে ইসরায়েল সরকার তাঁর প্রবেশাধিকার রদ করেছে ইসরাইলে। শুধু গুন্টার গ্রাস নয় বিখ্যাত লেখন নোয়াম চমস্কিকেও ইসরায়েলে প্রবেশ করতে নিষেধাজ্ঞা জানিয়েছিল ইয়াহুদী এই দেশটি।
বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি আল মাহমুদের কলম সর্বদাই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন তার কলম থামেনি, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অন্যায়ও তিনি মানেননি। তাঁর গল্প, কবিতা সময়ের প্রয়োজনে গর্জে উঠেছে। ইরাক-আফগানিস্তান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তুলোধুনো করেছেন “উড়াল কাব্য” কাব্যগ্রন্থের “ঈগল থাকবে ইতিহাস থাকবে না” কবিতায়। তিনি লিখেন-
পুঁজির শত্র“ কোথা চীন, কোথা রুশ?
সবার পাছায় থাপ্পড় মাড়ে বুশ।
জাতিসংঘও লেজ নাড়ে যথারীতি
তার কাজ শুধু ছড়ানো ভীতি,
মধ্যপ্রাচ্যে হামাসের দুরমুশ।
সবাই যেখানে আপোষে বাঁচে, বাঁচতে চায় তখনও কবির কলম বজ্রনির্ঘোষ। স্রোতস্রিনী বাংলাদেশের নদীগুলোর উজানে বাঁধ দিয়ে আগ্রাসী শক্তি পানিতে মারতে আজ উদ্যত হয়েছে। “দেশ মাতৃকার জন্য” কবিতায় সাহসী উচ্চারণ করেন-
“চারদিকে শকুনীর উড়াউড়ি দেখে ভাবি তোমার শস্য-শ্যামল প্রান্তর
হিংস্্র মাংসাশী পাখির বিষ্ঠায় আকীর্ণ বটবৃক্ষের মত কেন?
আমরা কি তোমাকে রক্ষা করতে পারব? অযোগ্য সন্তান আমরা।
তবুও তো তোমার শস্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে
তোমার রুদ্ধ নদীগুলোর ইশারায় আমরা কাঁপছি।”
“মাৎস্যন্যায়” কবিতায় তাদের স্বরূপ আরো প্রকটভাবে তিনি তুলে ধরেছেন-
“শক্ত চোয়ালওয়ালা রাঘবরা চায়
পদ্মা-যমুনার ভিতর দিয়ে হিমালয় পর্যন্ত একটা নিশ্চিত ট্রানজিট।
কিন্তু আমরা কালা-ধলা, সাদা ও সোনালীদের
হজম না করে তা কি করে সম্ভব?
-----------------------------
কিন্তু রাঘববোয়ালদের শক্ত চোয়াল ছিদ্র করার মতো কাঁটাওয়ালা মাছের ঝাঁক
আমরা যে আগেই খেয়ে বসে আছি।”
কবির কথা আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। আজ সকল প্রতিবাদী কন্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। যাতে কেউ আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে না পারে। কবিরা যে সমাজ বির্নিমানের জন্য সদা স্বপ্ন দেখেন তার পথে কি কি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে-তা বলার শক্তি যেন সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন। আজ রাঘববোয়ালদের রাজত্বে আমরা হা-পিত্যেশ করছি, ইয়া নফসী করছি। ত্রাতা কেউ নেই, সব কালা-ধলাদের গলাধ:করণ করে নি:শেষ করে দেয়া হয়েছে!
আশাবাদী কবির কলমে আশা জাগানিয়া পংক্তি বেরিয়ে আসে জনমুক্তির লক্ষ্যে। তিনি লিখেন “পৃথিবীতে ফের চাষ হবে” কবিতায়-
“তেজস্ক্রিয় মাটির পরত অসংখ্য লাঙ্গলের ঘায়ে উপড়ে
ফেলে পৃথিবীতে চাষ হবে ফের। কিন্তু নেই প্রকৃত রাখাল।
কল-কারখানার শব্দ থেমে গেছে। সভ্যতার উগড়ে দেওয়া
বর্জ্য ও উচ্ছিষ্টের ভাগাড় চাপা দিতে পৃথিবীতে চাষ হবে ফের।
জ্যোর্তিময় রৌদ্রের নীচে লক্ষ লক্ষ মহিষের ঘামে ভেজা
তেজষ্ক্রিয় মাটির ভিতরে মিসরের মমির বাক্সে রেখে যাওয়া
বীজ এনে পৃথিবীতে চাষ হবে ফের।”
বাংলাদেশের আরেক মানবতাবাদী কবি মোশাররফ হোসেন খানের কলমও গর্জে উঠেছে। তিনি ফিলিস্তিনের ২০১৪ সালের রমজান মাসের বর্বর বিমান হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে লিখেছিলেন, “ফিলিস্তিন-২০১৪” নামক কবিতায়।
“ ফিলিস্তিন এখন রক্তের লাল সমুদ্র
গাজা এখন মৃত্যু উপত্যকা
ইসরায়েলী হায়েনাদের বর্বরতা ছাড়িয়ে গেছে সকল সহ্যের সীমানা।
ইহুদী এখন মানুষ ও মানবতার বিপরীতে
ইহুদীরা এখন বন্যবরাহের চেয়েও নিকৃষ্ট
ইহুদীরা এখন ইতহাসের জঘন্যতম নরাধম ঘাতক
কোন্ উপমায় লিখব ইহুদীর নাম
কোন সব্য উপমা এবং ভাষা অবশিষ্ট নেই তাদের জন্য।”
আধিপত্যবাদ মূলত মানবতার শত্রু। প্রতিনিয়ত আমাদের বিরুদ্ধে সীমান্ত সন্ত্রাস চালাচ্ছে। কবি হাসান আলীমের কলমের তুলিতে তা ফুটে উঠেছে এভাবে।
“সীমান্তে দাঁড়িয়ে যাও সংক্ষুব্ধ পাহরাদার
অতন্দ্র প্রহরী
দেখ তারকাঁটা ছিড়ে মাটি খুঁড়ে ঢুকছে বন্যবরাহের দল।
ওরা ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবে ভিটে মাটি ফসলের ক্ষেত
স্বর্ণ কোটা করদ যৌবন।
প্রতিরোধ দুর্গ গড়
সীসা ঢালা প্রাচীরের মত ঐক্যের দেয়াল গড়
তুলে ফেল বিভেদের কাঁটা
ভুলে যাও পাওয়া না পাওয়ার জমা খরচ
ঐক্যের ভ্যানগার্ডে ঠেকাও দুর্বৃত্ত দস্যু হানাদার।”
সত্য ও ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পৃৃথিবীতে সৎ, চরিত্রবান ও সাহসী মানুষেরা মিথ্যার প্রাবল্যে প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। সত্যের উপর মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে কায়েমী স্বার্থবাদীরা। সত্য-মিথ্যার লড়াইয়ে মিথ্যা যেকোন উপায়ে জয়ী হলে মানুষের মাঝে মিথ্যাও সত্য মনে হতে পারে, কিন্তু তা সাময়িক। সত্যকে চিরতরে দাবিয়ে রাখা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। একদিন না একদিন সত্য দিবালোকের ন্যায় উদ্ভাসিত হবেই। যারা সাহস হারিয়ে মাঝ পথে ক্ষান্ত দিতে চান, বিজয়ের বন্দরে পৌঁছে জয়কে আলিঙ্গন করতে মনে শত দ্বিধা-তারা জানে না যে চেষ্টার মাধ্যমে অর্জন যে কত মধুর! হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। মেঘ যতোই কালো হোক না কেন? তার আড়ালে কিন্তু মুক্তির সূর্যটা সাহসীদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
মানবতবাদী কবিরা কখনো আপোষে বাঁচে না, আপোষকামিতা তাদের ধাতে নেই। নিজে জুলুমের শিকার হলেও তাদের পথ চলা থামে না। আসলে সাহিত্য তো হবে মানবতার মুক্তির জয়গান গাওয়ার জন্যেই। ঝঞ্জা-বিক্ষুব্ধ পৃথিবীটা আগ্রাসীদের দখলে চলে গেছে ফলে শান্তি সুদুর পরাহত। সত্যকে দাবিয়ে রাখতে মিথ্যা প্রচণ্ড লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে-সাথে জুলুম-নির্যাতনের খড়গ তো আছেই। আবু গারিব টর্চার সেল, গুয়ান্তানামো বে, ইরাক-আফগানে আরো কত অঘোষিত বন্দী শালা রয়েছে-তার হিসাব কারো আছে? এক অশুভ আগ্রাসী শক্তির অদৃশ্য হাতের নাটাইয়ে বিশ্ব শান্তি তিরোহিত-তাদের জন্য প্রচণ্ড ঘৃণার পাশাপাশি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া সময়ের অনিবার্য দাবী। নইলে মানবতা বলতে কিছুই থাকবে না এই সুন্দর ধরনীতে। কবিরা আমাদেরকে নিত্য সেই সাহস যুগিয়ে যাচ্ছে লেখনির মাধ্যমে।
======
বিষয়: সাহিত্য
১৯৮৪ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ধন্যবাদ
এই লেখা শুধু কি ভালো, এ যে মহা ভালো।
কিন্তু এখন কবিতা যত তেজোদীপ্ত, সুন্দরই হোক, কেন জানি মানুষকে জাগাতে পারেনা।
তবে আপনি কিন্তু খুব ভালো লিখেন। আল্লাহ্ আপনাকে আরও দিক।
আল্লাহ আমাকে ৩টা দিয়েছেন মানিক-রতন। আরো দেবেন?
মন্তব্য করতে লগইন করুন