"ট্যালেন্ট গ্রামার স্কুল" আয়োজিত মহান বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় আমার বক্তব্য.. ..
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০২:০০:২৮ দুপুর
গতকাল ১৬ই ডিসেম্বর ”ট্যালেন্ট গ্রামার স্কুল” এর মহান বিজয় দিবস-১৫ এবং বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। এতে আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যকে আরেকটু বর্ধিত করে লিখা হল।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যার একান্ত মেহেরবাণীতে কিছু বলার সুযোগ পেয়েছি। মানবতার মহান শিক্ষক মহানবী (সা)এর প্রতি দরূদ ও সালাম জানাচ্ছি। এই মহতী অনুষ্ঠানের আয়োজক, স্কুলের পরিচালনা কমিটি, অভিভাবকবৃন্দ,ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ এবং এলাকাবাসীকে সালাম জানিয়ে সংক্ষিপ্ত কথা শুরু করছি। সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা এবং মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদের রূহের মাগফেরাত কামনা করছি।
প্রথমইে আসা যাক শিক্ষা কি?
ইংরেজি ভাষায় শিক্ষার প্রতিশব্দ হলো Educate. Educate শব্দের সাধারণ আভিধানিক অর্থ হলো : শিক্ষাদান ও প্রতিপালন, শিক্ষাদান, শিক্ষা। Educate মানে : to bring up and instruct, to teach, to train অর্থাৎ প্রতিপালন করা ও শিক্ষিত করে তোলা, শিক্ষা দেওয়া, অভ্যাস করানো। শিক্ষা সম্পর্কে ইংরেজ কবি জন মিল্টন বলেছেন, Education is the harmonious development body, mind nad soul অর্থাৎ শিক্ষা হচ্ছে শরীর, মন এবং আত্মার সুষম উন্নয়ন।
আমরা কেন পড়ালেখা করব? ঊা লেখাপড়া পড়িয়ে আমাদের মা-বাবাদেরই বা কি লাভ? এক্ষেত্রে সন্তানদের প্রতি তাদের দায়িত্ব-ই বা কি? আসুন এক এক করে জানি।
দেখা যাক, শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মনীষীরা কে কি বলেছেন :
মনীষী জন ডিউই বলেছেন, “শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো আত্মোপলদ্ধি।” অর্থাৎ নিজেকে জানাই হলো শিক্ষা।
কিন্ডার গার্টেন পদ্ধতির উদ্ভাবক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ফ্রোয়েবেল এর মতে : “শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য ও পবিত্র জীবনের উপলব্ধি।”
প্লেটোর মত হলো : “শরীর ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা সবই শিক্ষার উদ্দেশ্য অন্তর্ভূক্ত।”
জ্যাক রুশোর মতে : সুঅভ্যাসে গড়ে তোলাই শিক্ষার হচ্ছে উদ্দেশ্য।
দার্শনিক সক্রেটিসের মতে : “শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার।”
এরিস্টোটল বলেছেন : “শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যে হলো ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা।”
শিক্ষাবিদ জন লকের মতে, “শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুস্থ দেহে সুস্থ মন প্রতিপালনের নীতিমালা আয়ত্বকরণ।”
বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হার্বার্ট বলেছেন : “শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুর সম্ভাবনা ও অনুরাগের পূর্ণ বিকাশ ও তার নৈতিক চরিত্রের প্রকাশ।”
কমেনিয়াসের মতে : “শিশুর সামগ্রিক বিকাশই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর মানুষের শেষ লক্ষ্য হবে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্যে সুখ লাভ করা।”
পার্কার বলেছেন : “পূর্ণাঙ্গ মানুষের আত্ম প্রকাশের জন্যে যেসব গুনাবলী নিয়ে শিক্ষার্থী এ পৃথিবীতে আগমন করেছে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সেসব গুণাবলীর যথাযথ বিকাশ সাধন।”
Bartrand Russell এর মন্তব্য হলো :.......The education system we must aim at producing in the future is one which gives every boy and girl an opportunity for the best that exists.
স্যার পার্সীনান বলেছেন : “শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো চরিত্র গঠন, পরিপূর্ণ জীবনের জন্য প্রস্তুতি এবং ভালো দেহ ভালো মন গড়ে তোলা।”
ড. হাসান জামান বলেছেন : “প্রত্যয় দীপ্ত মহত জীবন সাধনায় সঞ্জিবনী শক্তি সঞ্চার করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।”
ড: খুরশীদ আহমেদের মতে : স্বকীয় সংস্কৃতি ও আদর্শের ভিত্তিতে সুনাগরিক তৈরি করা এবং জাতির ধর্ম ও সংস্কৃতিক সংরক্ষণ ও উন্নয়ন হওয়া উচিত শিক্ষার উদ্দেশ্য।
আল্লামা ইকবালের মতে : পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হিসেবে তৈরি করাই হবে শিক্ষার উদ্দেশ্য।
বিখ্যাত দার্শনিক ও ইসলামী চিন্তানায়ক সাইয়েদ মওদূদী (রা) বলেন :
মানুষ কেবল চোখ দিয়েই দেখেনা, এর পেছনে রয়েছে তার সক্রিয় মন ও মগজ। রয়েছে তার একটা দৃষ্টিভংগি ও মতামত। জীবনের একটা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আছে তার। সমস্যাবলী নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার একটা প্রক্রিয়া তার আছে। মানুষ যা কিছু দেখে, শুনে এবং জানে, সেটাকে সে নিজের অভ্যন্তরীণ মৌলিক চিন্তা ও ধ্যান ধারণার সাথে সামঞ্জস্যশীল করে নেয়। অতপর সেই চিন্তা ও ধ্যান ধারণার ভিত্তিতেই তার জীবন পদ্ধতি গড়ে উঠে। এই জীবন পদ্ধতিই হলো সংস্কৃতি। যে জাতি একটা স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আকিদা বিশ্বাস ও উদ্দেশ্য লক্ষ্যর অধিকারী এবং যাদের রয়েছে নিজস্ব জীবনাদর্শ, তাদেরকে অব্যশ্যি তাদের নতুন প্রজন্মকে সেই স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, আকিদা বিশ্বাস, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও জীবনাদর্শের রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার বিকাশ ও উন্নয়নের যোগ্য করে গড়ে তোলা কর্তব্য। আর সে উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করেই গড়ে তুলতে হবে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।
এছাড়া দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ১। দেশবাসীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সচেতন করে তোলা।
২। ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের নৈতিক, মানবিক ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকল্পে শিক্ষার্থীদের মেধা-মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা।
মনীষীদের কথা থেকে বুঝা যায়, শিক্ষার উদ্দেশ্যে হলো মোটামুটি ভাবে, চরিত্র গঠন, আত্মার উন্নয়ন, সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালবাসা এবং তাঁর সন্তুষ্টি, সুনাগরিক হওয়া, সত্যকে ধারণ করা। কিন্তু তারপরও প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থার কোথায় গলদ যে এভাবে দেশে নাস্তিকতা তৈরি হবে? আমার বুঝে আসে না। জগতের এতবড় বড় মনীষীরা কি তাহলে কম বুঝত?
শিক্ষার মান এবং পরিবেশ নিয়ে কিছু কথা :
শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার। একটি দক্ষ, মর্যাদাবান ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই। সন্ত্রাস এবং লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির কারণে আজ শিক্ষাঙ্গনুগলো একেকটা মিনি ক্যান্টনমেন্ট। কর্তৃপক্ষ পারছেনা তাদের লাগাম টেনে ধরতে। তাই সচেতনভাবে ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবকদেরকেই এ ব্যাপারে ভুমিকা থাকতে হবে। কোচিং, টিউশন এবং শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার শিক্ষার মানকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। ছাত্ররা যাতে কোন হীন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে না পড়ে এবং কোন সহিংসা রাজনীতিতে না জড়ায়, এ ব্যাপারে অভিভাবকদের কড়া নজর রাখা দরকার।
শিক্ষার জন্য ইসলামের তাগিদ :
মহানবীর কাছে প্রথম ওহীই ছিল ইকরা বা পড়। জ্ঞান অর্জন সকল মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ। কলম আরবী শব্দ। যার দ্বারা আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন। হযরত ইদ্রিস (আ)এর সময়ে থেকে প্রথম কলমের ব্যবহার শুরু হয়। এসব তথ্য আমরা জানি। তারপরও আমরা কেন পিছিয়ে আছি ভাবতে হবে।
মানবতার মহান শিক্ষক রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, তোমাদের সন্তান যখন কথা বলতে শুরু করে, তখন তাকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ শিখিয়ে দাও। এর পরে সে কবে মরে, তার পরওয়া করো না। শিশুর যখন দুধের দাঁত পড়ে যায়, তখন তাকে সালাত পড়তে বলো। (তিরমিজী, যাদুল-মাআদ)
মহানবী (সা) আরো বলেছেন, ‘‘পিতা নিজের সন্তানকে যত কিছু দান করে, তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম দান হলো সন্তানকে ভালো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ।” তিনি আরো বলেছেন, “সন্তানের সাথে প্রীতি ও স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করো। তাদের উত্তম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দাও।”
আমীরুল মোমেনীন হযরত আলী (রা) বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিনটি বিষয় শিক্ষা দাও। তন্মধ্যে রয়েছে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা।” শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে গার্ডিয়ানের অবহেলা বা উদাসীনতা সন্তানকে বিপথগামী করে দেয়। আল্লামা ইবনুল কাইযুম বলেন, “যে ব্যক্তি তার সন্তানকে ইলম শিখার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখালো, তাকে এমনিতেই ছেড়ে দিলো, তার প্রতি অবিচার করল। আর অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে নষ্ট হওয়ার পেছনে পিতা-মাতার অবহেলা, উদাসীনতা এবং দ্বীনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান সম্পর্কে মূর্খ রাখাই দায়ী।
বিজয় দিবস পালনের উদ্দেশ্য তখনই সফল হবে যখন আমরা অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং নিরক্ষরতার অভিশাপমুক্ত দেশ উপহার দিতে পারব।
শেষকথা :
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। জাতি গঠনে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। একজন মনীষী বলেছেন, মানুষকে সভ্য করে তোলার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছেন, আমাকে একজন আদর্শ মা দাও, আমি একটি জাতি উপহার দেব। মায়েদের তত্ত্বাবধানে থাকলে সন্তান সুশিক্ষা পেতে বাধ্য। আমি স্কুল কমিটিকে অনুরোধ করব আপনারা স্কুলের জন্য বেশি বেশি মহিলা শিক্ষক রাখবেন। ট্যালেন্ট গ্রামার স্কুলের মত আরো অনেক স্কুল চাই, যাতে শিশুরা সুশিক্ষা পায়। আমি এ স্কুলের উত্তরোত্তর উন্নতি ও সাফল্য কামনা করি।
একটি ছোট গল্প বলে আলোচনার ইতি টানছি-
“যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ফ্রান্সিস উইলিন্ডার পার্কার এক শিশু সমাবেশে শিশু শিক্ষা বিষয়ে বক্তৃতা করছিলেন। তার বক্তৃতা শেষ হবার পর হরে। এক মহিলা তাকে প্রশ্ন করলো, ‘আমার শিশুকে আমি কখন থেকে শিক্ষা দেবো?’ তিনি বললেন, ‘আপনার শিশু কবে জন্ম নেবে?’ মহিলা অবাক সুরে বললেন, ‘জন্ম নেবে কি! তার বয়স তো পাঁচ বছর! ফ্রান্সিস উইলিন্ডার পার্কার বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে! আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আমার সাথে কথা বলছে! আর ওদিকে মূল্যবান পাঁচটি বছর শেষ হয়ে গেছে?”
সবাই ধন্যবাদ।
ওয়ামা তৌফিক-ই ইল্লাবিল্লাহ। আস সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ।
বিষয়: বিবিধ
১৯২৭ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পড়লাম,
দোয়া করি, জাযাকাল্লাহ..
ওয়া বারাকাল্লাহ ফীকুম..
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ..
ধন্যবাদ আপনাকে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন