প্রিয়তম নবী (সা) সম্পর্কে সঠিক বিশ্বাস এবং মর্যাদা ? ?
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৬:২২:৪৩ সন্ধ্যা
বর্তমান মুসলিম জাতির অনেক সদস্য তাদের জ্ঞানের দৈন্যতার কারণে এবং সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের প্যাঁচে পরে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন না। এ কারণে জ্ঞান থেকে দুরে সরে যাওয়া তথা মুর্খতা এবং অজ্ঞানতায় পেয়ে বসেছে। অথচ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা মু’মিনের হারানো সম্পদ এবং যেখানে পাবে কুড়িয়ে নিতে বলেছেন মানব জাতির শিক্ষক প্রিয় রাসূল (সা)। কুরআন-হাদীসের পরতে পরতে জ্ঞান অন্বেষণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। সকল মু’মিন নর-নারীর জন্য যেটা ফরজ বা অবশ্য করণীয়। জ্ঞান উদ্দীপনামূলক প্রথম বাণীই ছিল, ‘পড়, পড়, এবং পড়।’ কলম দ্বারা মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার কথাও বলেছেন। তারপরও আমরা কেন জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে? জাহিলিয়াতের করাল গ্রাস, বিভিন্ন খোদাদ্রোহী ও ভোগবাদী মতবাদের ছোবল, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ঈমান, অন্ধ আনুগত্য, শিরক ও বিদআতের ভয়াল রাজত্বে কিংকর্তব্যবিমূঢ় তারা। আল্লাহ, রাসূল (সা), ফেরেশতা, জীন, এমন কি শয়তান, ইসলামের শত্র“-মিত্র সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব রয়েছে। আমরা কুরআন-হাদীসের অনুসরণ না করে, মুরব্বীরা কি বলে তা-ই মানি। ফলে অন্ধ অনুকরণ চলছে খেয়ালখুশী মত। এভাবে কুরআন-হাদীস বর্জন করে গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছি। হাদীসে রাসুলে বলা হয়েছে, “তোমরা কখনো গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট হবে না, এ দু’টি জিনিস দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরলে : তা হল এই, কালামুল্লাহ এবং আমার সুন্নাহ।”
আল্লাহর প্রিয় হাবীব (সা) মুনষ্যত্ব সম্পর্কে আমরা এখনো গোমরাহীতে আছি। এখন অনেক মুসলিম আছেন, যারা রাসূল (সা)কে মানুষ বলতে চান না, তিনি গায়েবের মালিক মনে করেন, তাকে সর্বদা হাজির নাজির বলে মনে করেন, কুরআনকে অন্যান্য ধর্মীয় কিতাবের ন্যায় মনে করেন, ইসলামকে অন্যান্য ধর্মের মত গতানুগতিক মনে করেন, রাসূল মুহাম্মদ (সা)কে অন্যান্য ধর্মীয় নেতার মত মনে করেন। এছাড়া আরো অনেক মারাত্মক বিভ্রান্ত আকিদা পোষণ করেন-যা মুসলমানিত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। অনেক নামে মুসলমান আছেন যারা আল্লাহ, নবী-রাসূল, আখেরাত-বিচার, হাশর, জান্নাত-জাহান্নামেও বিশ্বাস রাখেন না। তারা সবার কাছে নাস্তিক হিসেবে পরিচিত। এ নিবন্ধে রাসূল (সা) সম্পর্ক সঠিক ধারণা এবং তাঁর আল্লাহ প্রদত্ত মর্যাদা সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের আলোকে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হবে। মনে রাখতে হবে আল্লাহ হচ্ছে খালিক বা স্রষ্টা, আর বিশ্বজগতে যা কিছু আছে সবই সৃষ্টি। সুতরাং স্রষ্টার সমান কাউকে মনে করা বা তাঁর গুণাবলী কারো কাছে আছে মনে করা সম্পূর্ণ শিরক। রাসূল (সা) হচ্ছেন সৃষ্টি এবং আল্লাহ হচ্ছেন স্রষ্টা। আল্লাহ তাঁকে যেই পজিশন বা মর্যাদা দিয়েছেন এর চাইতে বেশিও করা যাবে না, কমও না। সীমা অতিক্রম কখনো যাবে না। রাসূল (সা) সম্পর্কে সঠিক মর্যাদা বা ধারণা জানতে হলে কুরআন-হাদীসের কাছে যেতে হবে। আল্লাহপাক নবী-রাসূল কেন পাঠিয়েছেন? তাঁেদর কেন অনুসরণ করতে হবে? তাঁেদর দাওয়াত কি ছিল? দাওয়াত পেশ করার পর সমকালীন অবিশ্বাসীরা কি ধরনের আচরণ করেছিল? তাদের কেন বিশ্বাস করতে হবে? রাসূল(সা)এর সমকালীন লোকেরা মনে করত কোন নবী মানুষ হতে পারে না। আর বর্তমানকালে একশ্রেণীর লোকেরা মনে করছে নবীকে মানুষ বলা যাবে না। কী অদ্ভুত মিল!
রাসূল মুহাম্মদ (সা) মানুষ ছিলেন, একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে :
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টি সেরা জীব। জগতে যত সৃষ্টি রয়েছে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। বনী আদমকে আল্লাহ সম্মাণিত করেছেন কুরআনে ঘোষিত হয়েছে। মানুষ সৃষ্টিগত ভাবে মাটির তৈরি, ফেরেশতারা নুরের তৈরি এবং জীন আগুনের তৈরি। মাটির তৈরি মানুষই নুরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ তা নুরের তৈরি ফেরেশতাদের সিজদার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। আর ফেরেশতার মর্যাদা মানুষের চেয়ে বেশি কখনো নয়। ফেরেশতাদের স্বাধীনভাবে করার কিছু নেই, তারা সবকিছুতে আল্লাহর আদেশ মেনে চলেন। সুতরাং নবীকে আল্লাহ মানুষ হিসেবে পাঠিয়ে আমাদের প্রতি কত বড় এহসান করেছেন-তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ আমাদের মুসলিম সমাজে এক শ্রেণীর লোক নবীকে নুরের তৈরি মানুষ বলে মনে করেন এবং যারা নুরের নয় বলেন তাদের জন্য কঠোর ভাষা প্রয়োগ করে মুসলিম জাতির মর্যাদা থেকে খারিজ করে দেন। এমনকি তাদের মুসলমানিত্ব নেই বলে ফতোয়া দেয়া হয়! কত বড় জাহেল! কুরআন কি বলে হাদীস কি বলে দেখেন না!
আল কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “তারা (কাফেররা) বলে, এ কেমন রাসূল যিনি আহার করেন, হাটে বাজারে চলাফেরা করেন, তাঁর নিকট কেন ফেরেশতা নাযিল হয় না, যে তাঁর সাথে থেকে সতর্ক করবে অর্থাৎ নবী হিসেবে সত্যায়ন সরবে?” (সূরা ফুরকান : ৭) দেখুন, তখনকার কাফেরা মনে করত কোন ফেরেশতাই তাদের নবী হবে। যিনি আহার করেন, বাজারে যান, বিয়ে-শাদী করেন তিনি কেমন করে নবী হবেন?
কাফিরদের জবাবে অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “বলুন, যদি পৃথিবীতে ফেরেশতারা বসবাস করত তাহলে আমি ফেরেশতাদেরকে রাসূল বানিয়ে পাঠাতাম।” (সূরা বনী ইসরাইল : ৯৫)
এর চেয়ে সহজ কথা আর কি হতে পারে? যেহেতু পৃথিবীতে মানুষই বসবাস করে তাই মানুষের মধ্য থেকেই নবী বানিয়েছি। মানুষের সমস্যা তো মানুষই লাগবে সমাধান করতে, ফেরেশতারা কি বুঝবে মানুষের সমস্যা সম্পর্কে?
অন্য আয়াতে আরো বলা হয়েছে, “আপনার পূর্বে আমি মানুষদেরকেই রাসূল করেছিলাম, যাদের উপর ওহী আসত। যদি তোমরা না জান জ্ঞানীদের কাছ থেকে জেনে নাও।” (সূরা আম্বিয়া : ৮)
আল্লাহ তাঁর নবীকে আরো পরিষ্কার করে বলার জন্যে বলছেন, “বলুন, আমি তোমাদের মতই মানুষ এবং আমার প্রতি ওহী নাযিল হয় এ মর্মে যে, তোমাদের ইলাহ বা মা’বুদ একমাত্র মা’বুদ।” (সূরা কাহফ :১১০ এবং হা-মীম-সিজদা :৬)
এটা কেবল আমাদের নবীই নন, বরং বিগত সকল নবীই স্ব স্ব কওমের উদ্দেশ্যে একথা বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের মত মানুষ মাত্র’ (ইবরাহীম ১৪/১১)। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, ‘আমি তো একজন মানুষ। আমিও তোমাদের মত ভুলে যাই। সুতরাং আমি (সালাতে কিছু) ভুলে গেলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ো’ (বুখারী হা/৪০১; মুসলিম হা/৫৭২; মিশকাত হা/১০১৬ ‘সিজদায়ে সহো’ অনুচ্ছেদ)। তিনি বলেন, আমি একজন মানুষ। আমি তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে কোন কিছু আদেশ করলে তা গ্রহণ করবে। আর নিজস্ব রায় থেকে কিছু বললে আমি একজন মানুষ মাত্র। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে আমারও ভুল হ’তে পারে (মুসলিম হা/২৩৬৫, মিশকাত হা/১৪৭)। বস্তুতঃ ফেরেশতারা হ’ল নূরের তৈরি, জিনেরা আগুনের তৈরি এবং মানুষ হ’ল মাটির তৈরি। (মুসলিম হা/২৯৯৬; মিশকাত হা/৫৭০১; মুমিনূন ২৩/১২, আন‘আম ৬/২)। উল্লেখ্য যে, রাসূল (সা) নূরের তৈরী ছিলেন মর্মে সমাজে কিছু হাদীছ প্রচলিত রয়েছে। যেমন ‘আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেন’। এ মর্মে বর্ণিত সব বর্ণনাই জাল (আজলূনী, কাশফুল খাফা হা/৮২৭; সহীহা হা/৪৫৮ দ্রষ্টব্য)।
আমাদের মনে রাখতে হবে, এ পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে মানুষই আশরাফুল মাখলুখাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। আর নবী-রাসূলরা ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানুষ, আদর্শ মানুষ। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী বা রাসুল হলেন মুহাম্মদ (সা)। সমস্ত মানুষ এসেছে মাটির তৈরি প্রথম নবী ও মানুষ হযরত আদম (আ) থেকে। মানুষের গঠন উপাদান শুধু মাটি নয় আরো অনেক পদার্থ আছে। তারপরও সাধারণভাবে মানুষ মাটির তৈরি, ফেরেশতারা নুরের তৈরি এবং জ্বীন হলো আগুনের তৈরি। মানুষ তৈরি মানুষই আল্লাহ কাছে মর্যাদার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ। রাসূল (সা) মাটির তৈরি মানুষ হলে কি সমস্যা হতে পারে? তিনি মানুষের থেকে জন্মগ্রহণ করেছেন অর্থাৎ ঔরসজাত সন্তান, তাঁর আব্বার নাম আবদুল্লাহ, মাতার নাম আমিনা, দুধ মাতা হালিমা। তায়েফে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে তিনি রক্তাক্ত হয়েছেন, উহুদের ময়দানে দাঁত মোবারক শহীদ হয়েছে। খিদেয় তিনি কষ্ট পেতেন, রোগে ভুগেছেন-একজন মানুষ হিসেবে মানবীয় সকল গুণাবলীই ছিল। তাঁকে পাঠানো হয়েছে মানুষকে সঠিক পথ দেখানো জন্য। যারা তাঁকে মানুষ হিসেবে মানে না, তারা আবার রাসূল (সা)কে সালাম দেয়ার সময় বলি, “খায়রুল বশর কো লাখো সালাম। অর্থাৎ “সর্বোত্তম মানুষ”কে লাখো সালাম। তাহলে আরবীতে বাশার বলা যাবে আর বাংলায় মানুষ বলা যাবে না-এতবড় মুর্খও থাকতে পারে? ভাবতে অবাক লাগে!
তিনি নুরের তৈরি না মাটির তৈরি?
আগের আলোচনায় বুঝা গেল যে সমস্ত নবীরাই মানুষ। যদি প্রিয়নবীকে মানুষ বলে মেনে নিই তাহলে এ কথা বুঝতে সহজ হবে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, সকল মানুষই আদমের সন্তান আর আদম হলো মাটির তৈরি। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘‘কুল্লুকুম মিন আদম ওয়া আদম মিন তরাব’’। তোমরা সকলেই আদম থেকে উদগত আর আদম হলো মাটির তৈরি। এতো গেল সকল মানুষের গঠনতত্ত্ব। প্রতিটি মানুষের গঠনতত্ত্ব বা প্রকৃতি সম্পর্কে আল্লাহর বর্ণনা নিম্নরূপ : ‘‘ইন্নি খালেকুল ইনসান মিন ত্বীন’’ । ‘‘হে নবী বলে দিন) নিশ্চিতভাবে আমি (আল্লাহ) মানুষকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি।’’
(সূরা ছোয়াদ : ৩৮:৭১)
আলেমদের একটি অংশ বিশেষত: এক শ্রেণীর তরিকাপন্থী ওয়ায়েজীন বলছেন রাসূলুল্লাহ (সা) হচ্ছেন নূরের তৈরি। অন্যপক্ষ বলছেন তিনি হচ্ছেন মাটির তৈরি। উভয়পক্ষ কুরআন হাদিস থেকে স্ব স্ব সমর্থনে দলিল পেশ করছেন। সূরা আল মায়েদার ১৫নং আয়াতে মুহাম্মদ (সাঃ) যে নূরের তৈরি সে কথা বলা হয়েছে বলে সরল প্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, এ আয়াতটি হচ্ছে ‘‘ক্বাদ যা আকুম মিনাল্লাহী নুরুন ও কিতাবুন মুবিন।’’ অর্থাৎ ‘‘আল্লাহর পক্ষ থেকে অবশ্যই তোমাদের কাছে ‘নূর' এবং স্পষ্ট বিধান গ্রন্থ এসেছে’’। এখানে আল্লাহর রাসূলকে নুর বলা হয়েছে এবং স্পষ্ট বিধান হল কুরআন। আরেকটি আয়াত সূরা আহযাবের ৪৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে নবী আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারীরূপে, উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।” (‘দায়িয়ান' ওয়া ‘সেরাজাম' মুনিরা)।
নুর এবং সিরাজাম মুনিরের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা :
নূর অর্থ আলো-জ্যোতি। মুনির অর্থ উজ্জ্বল, সেরাজ অর্থ বাতিবা প্রদীপ। সেরাজাম মুনিরা অর্থ উজ্জ্বল বাতি। এ দু'টি আয়াতের সাদামাটা অর্থ হলো তোমাদের কাছে আলো এসে গেছে। আর এসে গেছে উজ্জ্বল বাতি। আলোর কাজ হলো অন্ধকার দূর করা। পবিত্র কুরআনে চাঁদের আলোকে বলা হয়েছে নূর, আর সূর্যের আলোকে বলা হয়েছে ‘দিয়া'। (সূরা ইউনুস: ১০:৫)। অন্ধকার ঘুচানোই আলোর কাজ। জাহেলিয়াতের অন্ধত্বই প্রকৃত অন্ধকার। এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, জাহেলিয়াত দূরীকরণের মহৌষধ হলো দ্বীন ইসলাম। অতএব, সূরা আল মায়েদায় বর্ণিত নূর যে সাধারণ অর্থে নয় এবং তা মুহাম্মাদ (সা.) নন বরং তা ইসলাম, এটিই যুক্তিযুক্ত এবং বাস্তবও বটে। আল্ আহযাবে বর্ণিত সেরাজাম মুনিরা (উজ্জ্বল বাতি) দ্বারা মুহাম্মাদ (সা)-এর গুণাবলী বা দায়িত্ব বুঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে, নবী মুহাম্মদ(সা) হচ্ছেন সাক্ষী, সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী, আল্লাহর নির্দেশের প্রতি দাওয়াতদানকারী এবং আল্লাহর অবাধ্যতাজনিত পাপাচারের অন্ধকার বিদূরিতকারী উজ্জ্বল বাতিস্বরূপ। এ আয়াতদ্বয়ের কোথাও কাউকে নূরের তৈরি বলা হয়নি।
ইসলামকেও কুরআনে বিভিন্ন স্থানে নুর বলা হয়েছে। সূরা সফের ৮ ও ৯নং আয়াতে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি ইসলামের দিকে আহুত হয়েও আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলে; তার চাইতে অধিক যালেম আর কে? আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না। তারা মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।” এই আয়াতে ইসলামকে নুর বা আলো বলা হয়েছে।
নূর পবিত্র কুরআনের ২৪টি নামের একটি নাম। সূরা আ‘রাফ ১৫৭ আয়াতে কুরআনকে ‘নূর’ বলা হয়েছে। সেরাজাম মুনিরা মুহাম্মাদ (সা)কে দেয়া আল্লাহর একটি স্নেহময়ী নাম- যেমনটি মোজাম্মিল, মোদাচ্ছির। পবিত্র কুরআনে কিছু কিছু শব্দ ব্যবহার হয় রূপক অর্থে উপমা হিসেবে। যেমন হামজাতু আসাদুল্লাহ ওয়া আসাদ রাসূলিল্লাহ অর্থাৎ হামযা হচ্ছেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সিংহ। এখানে সিংহ মানে হিংস্র জানোয়ার অর্থে নয়। বরং অতীব সাহসী হিসেবে বুঝানো হয়েছে। তেমনি মুহাম্মাদ (সা.) হচ্ছেন উজ্জ্বল বাতি। অতএব, এ বাতির সংশ্রবে আসতে পারলেই দূরীভূত হয়ে যাবে যাবতীয় জাহেলিয়াত যুক্ত অন্ধকার। মায়েরা তাদের অতি আদর-স্নেহে সন্তানদের সোনার ছেলে, মানিক রতন, আঁধার ঘরের বাতি বলে অভিহিত করে থাকেন। তাই বলে কি সন্তানটা কি সোনার তৈরি? আঁধার ঘরের বাতি বললে কি আসলে অন্ধকার দুরীভুত হবে। আসলে এর দ্বারা একটা অবলম্বন বুঝানো হয়েছে। সন্তান সুযোগ্য হয়ে সংসারের হাল ধরবে।
আবার নূর দ্বারা সমস্ত আসমানি কিতাব এবং ইসলামকেও বুঝানো হয়েছে। যেমন: আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চিতভাবে আমি নাযিল করেছি তাওরাত তাতে আছে হেদায়েত এবং নূর। (আল মায়েদা, ৫:৪৪, আল নিসা, ৪:৯১)। অতএব ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর রাসূলের প্রতি এবং নূরের (কুরআন) প্রতি যা আল্লাহ নাযিল করেছেন (আল তাগাবুন, ৪:৮) নূর অর্থ আল্লাহ প্রদত্ত বিধান ও বিধান গ্রন্থ। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘এটি হচ্ছে একটি কিতাব একে আমি নাযিল করেছি, যাতে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে (মিনাজ যুলুমাতে ইলান নূর) আনা যায়।' (ইবরাহীম, ১৪:১, আল ছাফ ৬১:৮)'। নূর মূলত: আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে আর তিনি নিজেই নূর। যেমন আলোর উপর আলো যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তার আলোর প্রতি পরিচালিত করেন। (আল নূর ২৪:৩৫)
আল্লাহ-রাসূল-ইসলাম-কুরআন সবই নুর :
এ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বুঝা গেল যে, আল্লাহ নিজেই নুর। আবার মুহাম্মদ (সা)কে যেমন নুর বলা হয়েছে, তেমনি কুরআনকে নুর বলা হয়েছে এবং ইসলামকেও নুর বলা হয়েছে। এ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। তাঁকে যদি নুরের তৈরি হিসেবে মানতে হয় তাহলে শৈশবে তার দুধ পান করা, তায়েফের ময়দানে রক্তাক্ত অবস্থা, উহুদের দাঁত মোবারক ভাঙ্গা, ক্ষুধায় জর্জরিত হওয়া, তাঁর চুল দিয়ে ইহুদীদের জাদু টোনা করা, অন্তিম সময়ে রোগাক্রান্ত হওয়া সবকিছু বিবেচনায় আনতে হবে। তাই রাসূল (সা)কিসের তৈরি এই প্রশ্ন অবান্তর ? তাঁকে মানতে হবে আদর্শ মানব হিসেবে এবং তাঁর প্রদর্শিত বিধানকে। মহানবী (সা.) এর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ। বিশেষ করে তাঁর স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ, কথা-বার্তা, হুকুম-আহকাম। এগুলো অনুসরণ করলে শুধু সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যাবে তা নয়। বরং আল্লাহর কাছে সঞ্চিত উত্তম প্রতিদানে ধন্য হওয়া যাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন : “নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ, যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।” (সূরা-আহযাব-২১) প্রকৃতপক্ষে তিনিই মানুষকে সঠিক ও সরল পথের সন্ধান দিয়েছেন। তার সার্টিফিকেট স্বয়ং আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন : “আপনি তো অবশ্যই সরল পথ প্রদর্শন করেন”। (সূরা আশ শূরা-৫২) আবার আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে রাসূল (সা.) এর ইত্তেবা বা অনুসরণ করতে হবে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন : “হে রাসূল (সা.)! আপনি তাদের বলে দিন তোমরা যদি প্রকৃতই আল্লাহকে ভালোবেসে থাক তাহলে আমার অনুসরণ কর, তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন”। (সূরা আলে ইমরান-৩১) আমরা যেহেতু ঈমানদার বলে নিজেদের দাবী করি তাহলে আর অনুসরণের মাধ্যমেই একমাত্র মুক্তি সম্ভব। তাই সকলেরই উচিত মুসলিম সমাজে ফেৎনা-ফ্যাসাদ তৈরি না করে কুরআন এবং হাদীসের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়া প্রয়োজন। নুরের তৈরি না মাটির তৈরি এধরনের বিবাদ কাম্য নয়, পরিতাজ্য। এতে মুসলিম সমাজের সংহতি, শৃঙ্খলা, চিন্তা-চেতনা ও ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়।
=====
বিষয়: সাহিত্য
২৩৩০ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন