গল্পে গল্পে ইন্টারভিউ..
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ০২ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৬:১০:০১ সন্ধ্যা
বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে কতক্ষণ পা দোলায়, আবার উঠে পায়চারি করে কবি আবু সালফি। সকাল বাজে পৌণে ন’টা। দূর দৃষ্টিতে কারো পানে চেয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সাড়ে ৮টায় আসার কথা ছিল সাহিত্য পত্রিকা ‘ইদানীং’এর সিনিয়র সাংবাদিক মারুফ রেজা। কাজের মেয়ে চা এনে দেয়, চুমুক দেয়।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লনের উপর হাঁটতে থাকে। সবুজ চিকন চিকন ঘাসের উপর কদম ফেলে। সেন্ডেলগুলো একপাশে রাখে, ঘাসের নরম অনুভুতি পেতে চায়। বাগানের সুন্দর সুন্দর ফুল ফুঠেছে। বর্ষা শেষের দিকে, শরতের আগমন ধ্বনি। কিছুক্ষণ পূুর্বে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বাগানও স্যাতস্যাঁতে, তাকায় রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, বেলী ফুলের দিকে। সাদা বেশী ফুলের আবেশে মন হারিয়ে যায়। এক ভক্ত লিখেছিল ‘সামান্য বেলী ফুলের মালা দিয়ে’ একটা কবিতা লেখার জন্য। লিখেছিলও একসময়, পান্ডুলিপিটা কখন কোথায় হারিয়ে গেছে। প্রথম দিকের কবিতা কিন্তু ‘মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন’ কাব্যগ্রন্থেও নেই। মারুফ কেন এত দেরী করছে, এমন তো হওয়ার কথা নয়। আমার সাক্ষাতকারের জন্য, কিছু একটা লেখার জন্য কত জাতীয়, স্থানীয় পত্রিকা, ম্যাগাজিনের সম্পাদকেরা সিডিউল পায় না। ১০টায় হাইস্কুলের আরেকটা প্রোগ্রাম আছে। পরের দিন পাশ্ববর্তী একটা সিনিয়র মাদ্রাসায় বার্ষিক সভারও প্রধান অতিথি। বড় ব্যস্ত সময়ে নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের এতক্ষণ লেট বেমানান বটে। বাসায় যেই ডুকল, ড্রেস চেঞ্জ করে স্কুলের প্রোগ্রামের জন্য অমনি কলিং বেলের আওয়াজ কানে আসল। কবির নাতনী দরজা খুলে দেয়।
কাকে চান? লাবনী বলে।
এটা কবি..? মুখ থেকে বের করতে পারল না! সাংবাদিক মারূফ রেজা।
জি হ্যাঁ। আপনি ভেতরে আসুন। ড্রইং রূম দেখিয়ে দেয় লাবনী।
দাদুর রুমের দিকে যায় লাবনী। ফরমায়েসী ভঙ্গিতে দাদু বিছানা শুয়ে।
লাবণী বলল, দাদু আপনাকে চায়। নাম মারুফ বলল।
দাদু বলল, ড্রইং রুমে বসতে বল।
প্রায় ১৫ মিনিট পর আবু সালফি ড্রইংরুমে আসল এবং করমর্দন করল মারুফের সাথে। দেখ মারুফ, তুমি তো আরো এক ঘন্টা আগে আসার কথা ছিল। এতক্ষণে আলাপ শেষ হয়ে যেত।
মারুফ দেরী হওয়ার কারণ দর্শিয়ে কবির মন গলাতে পারল কিন্তু সময়ের শাসনে বাধা তিনি। বলল, হেডমাস্টার সাহেব ১০টা দিকে ফোন করার কথা। উনার ফোনের অপেক্ষায় আছি। সেল ফোনটা বেজে উঠে হেড মাস্টার সাহেবের ফোন। স্যার বললেন, মাননীয় কবি মহোদয় আমরা আপনাকে আরো কিছুক্ষণের মধ্যে পাব আশা করি। চেয়েছিলাম ১০টায় আমাদের সহকারী শিক্ষক আবদুল্লাহ সাহেবকে পাঠাব। কিন্তু এই মাত্র টিএনও সাহেব জানালেন, উনার আরো ঘন্টা দুয়েক দেরী হবে। আমরা আপনাকে ঠিক ১২টায় আনতে পাঠাব। কবি মনে মনে খুশীই হলেন। নাস্তা নিয়ে আসে কবি নাতনী লাবণী।
কুশল বিনিময়ের পর কবি বলেন, মারুফ সাহেব শুরু করা যায় আমাদের আলাপ চারিতা। জি হ্যাঁ মান্যবর, আমরা শুরু করি। কাঁেধ ঝুলানো ব্যাগ থেকে নোট করার কাগজ, কলম এবং অডিও রেকর্ডারটা নিতে নিতে বললেন সাংবাদিক মারুফ রেজা।
মারুফ : আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু জানান দয়া করে।
কবি : যদিও ব্যক্তিগত জীবন বলি, কিন্তু নিজস্বতা বলে কিছু আছে? সবাইকে নিয়ে যখন সবকিছু, ব্যক্তিগত জীবন বলে আলাদা করতে চাই না। বয়স তো আর কম হলো না, এখন তাঁর ডাকের অপেক্ষায় আছি। পরপারের খাতা তো শূন্য মনে হয়।
মারুফ : আপনার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশের স্মৃতি সম্পর্কে জানতে চাই।
কবি : সেটা অনেক এক্সাইটিং বিষয়। আমি কি ভেবেছি আমি এভাবে লিখে যাব! আমার প্রথম গ্রন্থ লিখাটা কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়। বন্ধুরাও অনেকে আগে উৎসাহ যোগাত তারা এখন কাছে নেই। সবাই বিত্ত-বৈভবের মালিক। ভীষণ ব্যস্ত, আমার মত সামান্য কবির জন্য কে চিন্তা করবে? “হৃদয়ে বাংলাদেশ” প্রবন্ধ সংকলনটা আমার প্রথম বই। আসলে প্রথম বই প্রকাশটা লেখালেখির মোড় পবির্তন করে দেয়। সবাই লেখার জগতে বিপুলভাবে অভিষিক্ত করে। সবাই যেন একে একে চলে যাচ্ছে, লেখালেখিটা তবে কার জন্যে?
মারুফ : শৈশবের এমন কিছু স্মৃতির কথা জানান, যা মনে পড়লে অজান্তে হাসি পায়।
কবি : অনেক স্মতি আছে কোনটা বাদ দিয়ে কোনটা বলি? আজকে তো সময় কম আরেক দিন বলার জন্য
তুলে রাখি মনের খাঁচায়।
মারুফ : আপনার প্রিয় লেখক কারা?
কবি : প্রিয় লেখক বা কবির সংখ্যা তো অনেক। তাদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ,আল্ মাহমুদ, মতিউর রহমান মল্লিক, আবুল আসাদ, হুমায়ুন আহমেদ, জীবনানন্দ দাশ রয়েছেন। দেশের বাইরেও আছেন কয়েকজন।
মারুফ : আপনার লেখায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী একটা মনোভাব পরিলক্ষিত হয়, কিভাবে এটার প্রকাশ ঘটে?
কবি : আসলে বিশ্বে যত অশান্তি কারণ তা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের কারণে। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ, অবশ্য সবাই শান্তিপ্রিয় বলে দাবী করে। শান্তিপ্রিয় দাবী করলে হবে না। এটা নিজের থেকেই শুরু করতে হবে। আর সাম্রাজ্যবাদীরা এখন দেশ দখল করে না, চিন্তা-চেতনা ডুকিয়ে দেয়, সাংস্কৃতিক ভুত চাপিয়ে দেয়।
মারুফ : ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু জানান।
কবি : সবই অপরিকল্পিত পরিকল্পনার ফসল। পরিকল্পনা কাজের অর্ধেক হলেও, অনেক সময় অপরিকল্পিতভাবে পুরো কাজই নিষ্পন্ন হয়ে যায়! কী বলেন? তারপরও যদি লেখালেখির কথা বলেন তাহলে বলতে হয়-প্রিয় জন্মৃভুমির স্বাধীনতা নিয়ে একটা নিরপেক্ষ ইতিহাস লিখতে চাই, এ পর্যন্ত যা হয়েছে তা দলী দৃষ্টিকোণ থেকে! সর্বকালের সেরা মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা)কে নিয়ে একটা সীরাত লেখার চেষ্টায় আছি। এখনও পড়ালেখা করছি এ ব্যাপারে। কুরআন নিয়েও চিন্তা ভাবনা আছে, যেহেতু অনুবাদগুলো সমকালীন পরিবেশ নিয়ে লিখা। বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ, বিজ্ঞান ভিত্তিক একটা সহজ অনুবাদ করার চিন্তাও মাথায় আছে। সমাজের অভাবী ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার জন্য কিছু করারও ইচ্ছা আছে। জানি না আল্লাহ ততদিন বাঁচিয়ে রাখেন কিনা?
আলাপ চারিতা চলতে থাকে। এরি ফাঁকে লাবণী উঁিক দেয়। দাদাকে স্কুলের প্রোগ্রামের কথা ইশারায় স্মরণ করিয়ে দেন। দাদু হাত দিয়ে ওকে জানায়। মারূফও দরজার দিকে তাকালে চোখাচোখি হয়। লাবনী পর্দা টেনে দেয়। ঈষৎ লজ্জিত হয়ে ওখান থেকে চলে যায়। স্কুলের প্রোগ্রামে সে ও যাবে। রেডি হতে হতে এখন হয়নি। দশম শ্রেণীতে পড়ে, স্কুল নেই, দাদুর সফরসঙ্গী হবে।
মারুফ : আপনার ‘প্রিয় ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ’ সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
কবি : আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা)। আদর্শ তো নবী-রাসূলদেরটাই সবার হওয়া দরকার। বার্তাবাহক বা নবীরা আল্লাহর নির্দেশনায় উম্মতের জন্য আলোকবর্তিকা স্বরূপ-তাদের পথে চলা ব্যতীর পরকালীন মুক্তি অসম্ভব। সংক্ষেপে তো বললে হবে না! আগেই বলেছি একটা সীরাত লিখছি, ওখানেই সব বলা হবে।
মারুফ : অবসর সময় কিভাবে কাটে?
কবি : অবসর কই, পাই না তো। লেখালেখি,সেল ফোনের যন্ত্রণা, টিভি, নেট, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-বাইরে যাওয়া-সময় আছে? ছোট ছোট কয়েকজন নাতি-নাতনী আছে, তাদের নিয়ে চলে যায় দিন।
মারুফ : বর্তমানে কি লেখালেখি করছেন এবং আগামীতে কোন বই পাবলিশ করছেন?
কবি : আমার লেখার নির্দিষ্ট কোন বিষয় নেই। যখন মনে যা আসে লিখি। এবারের বই মেলাতে ২/৩টি বই প্রকাশ হতে পারে। কয়েকজন প্রকাশক পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেল। সময় হলে জানতে পারবে।
মারুফ : কর্ণফুলীর তীরে আপনার বাড়ী, এই কর্ণফুলী নিয়ে জাতীয় কবিসহ অনেকেই কবিতা লিখেছেন। তো কর্ণফুলীর প্রতি এই ভালবাসার কারণ কি?
কবি : কবি আল্ মাহমুদের অনেক কবিতায় কর্ণফুলীর সৌন্দর্য বর্ণনা করা হয়েছে। কবি যখন লিখেন, “সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে কর্ণফুলীর কুলটায়/ দুধ ভরা ওই চাঁেদর বাটি ফেরেশতারা ওল্টায়।” কিংবা যখন বলেন, “কোথায় পাবো লঙ্কাবাটা, কোথায় আতপ চাল/ কর্ণফুলীর ব্যাঙ ডাকছে হাঁড়িতে আজকাল।’ আমি তখন স্থির থাকতে পারিনা। কেমন যেন কর্ণফুলীর প্রতি আমি বিমোহিত হই। আমাকে কর্ণফুলী কেন এত টানে বুঝি না? আসলে আমি কর্ণফুলীর প্রেমিক।
“মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন” কাব্যগ্রন্থে একটি ছড়াও আছে কর্ণফুলী নিয়ে।
“নদীর জলে উছলে উঠে/কর্ণফুলীর বাঁধ/নদীর মতো হতাম আমি/পূর্ণ হতো সাধ।” .. ..
সেই নদীতে সাতাঁর কেটে/ বইতো সারাবেলা/ফুল-পাখিদের সঙ্গে নিয়ে/হতো নানান খেলা।’’
কর্ণফুলীর তীরে বেড়ে উঠার এই কথা মালা সব শৈশবকে ঘিরে। আজও মানসপটে সেই সে স্মৃতিগুলো কেমন ভেসে বেড়ায়।
কথায় কথায় সময় শেষ হয়ে যায়। মারূফ ধন্যবাদ জানিয়ে কবি থেকে বিদায় নেন। কোনদিন সময়-সুযোগ হলে আবার আলাপচারিতার কথা দেন কবি। স্কুলের সহকারী শিক্ষকও বাসায় আসে গাড়ী নিয়ে। কবি চলে যান শিক্ষক আবদুল্লাহর সাথে। পিছনের সিটে নাতনী লাবনীও।
মারূফ রেজা বাইক নিয়ে এসেছিলেন। পথিমধ্যে সেল ফোন বেজে উঠলে এক জায়গায় দাঁড়ায়। ইদানীং সম্পাদকের কল। কল এটেন করলে সম্পাদক জানাল স্কুলের প্রোগ্রামে যেতে। বাইক স্কুলগামী করে দেয় মারূফ রেজা।
=====
বিষয়: সাহিত্য
১৪৯৬ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সবগুলা জবাবেই কেমন যেন দুই নম্বর গন্ধ!!
প্রত্যাহার করার অনুরোধ রইলো, নইলে ১০০ কোটি টাকার মানহানি মামলা হবে।
সবগুলা জবাবেই কেমন যেন দুই নম্বর গন্ধ!
হি..হি..হি বুঝে ফেলেছি ভাইয়া ।
-মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন!!!
এমন কবি ও সাংবাদিকরাই জাতির দিক নির্দেশনায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে!
'কবি'র প্রতি উত্তর গভীর থেকে ভাবতে বাধ্য করে!
জাযাকুমুল্লাহু খাইর মুহতারাম ভাই!
কিন্তু বর্তমানে তারা বেশির ভাগই বিবেক বন্ধক রেখেছেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন