মাহে মহররম ও ইমাম হোসাইনের শাহাদত : গুরুত্ব, শিক্ষা ও করণীয়
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ২৩ অক্টোবর, ২০১৫, ০৪:৩৩:৫৩ বিকাল
(২১শে অক্টোবর সন্ধ্যায় পবিত্র হজ্জ-২০১৫ পালন করে দেশে আসার পর ব্লগে এটি প্রথম পোস্ট। হজ্জের অভিজ্ঞতা নিয়ে পরবর্তীতে পোস্ট করা হবে-ইনশাল্লাহ)
আরবী বর্ষ পরিক্রমায় মহররম প্রথম মাস। এ মাসটি বৎসরের চারটি হারাম মাসের অন্যতম। মাসগুলি হল : মহররম, রজব, জিলকদ এবং জিলহজ্ব মাস। ইসলামী শরীয়াতে মাসগুলোর বিশেষ সম্মান আছে। আল্ কোরআনে এরশাদ হয়েছে, “আকাশমণ্ডলী এবং পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্ল¬াহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় বারটি, যার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস রয়েছে।” (সূরা তাওবা-৩৬) সহীহ হাদীসে মহররম মাসকে আল্লাহর মাস বলে অভিহিত করা হয়েছে। মিল্লাতে মুসলিমায় মহররম ত্যাগের মহিমায় চিরভাস্বর একটি শোকাবহ মাস। এ মাসের ১০ তারিখ আশুরা হিসাবে বিশেষ সম্মানের সাথে পালিত হয়ে আসছে। নবীজী (সা)এর দৌহিত্র নবী দুলালী মা ফাতেমা (রা)এর নয়নের কাজল আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (রা) পুত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা)কে কুখ্যাত ইয়াজিদ বাহিনী কর্তৃক নির্মমভাবে শহীদ করে ১০ই মহররমে। তাই প্রতি বছর মহররম আসে আমাদের মাঝে শোকাকুল পরিবেশে ত্যাগের বার্তা নিয়ে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চেতনাকে শাণিত করতে।
মহররম মাসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা (তাদের মধ্যে অনেকগুলিই মিথ্যা কাহিনী নির্ভর, যার সাথে কোরআন-হাদীসের কোন সম্পর্ক নেই) বই-পুস্তককে ঘিরে রচিত হয়েছে। মুসলিম শরীফের হাদীস থেকে জানা যায়, রাসূল (সা) বলেছেন, “রমজানের পরে সর্বোত্তম সিয়াম হল আল্লাহর মাস মহররমের সিয়াম।” আরেকটি হাদীসে ১০ই মহররমের সিয়াম সম্পর্কে বলা হয়েছে, রাসূল (সা) বলেছেন, “এ দিনের সিয়াম গত এক বৎসরের গুনাহ মাফ করে।” (মুসলিম) আরেকটি সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা) বলেছেন, “এ দিনে আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রেরিত রাসূল হযরত মুসা (আ) ও তাঁর সঙ্গী-সাথী বনী ইসরাইলীদেরকে ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা করেন এবং ফেরাউন ও তার দলবলকে পানিতে ডুবিয়ে মারেন।” (মুসলিম) এর বেশী সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় না।
মহররমের তাৎপর্য :
মহররম শব্দের অর্থ হারাম বা নিষিদ্ধ বা পবিত্র। এটি আল্লাহর মাস হিসাবে স্বীকৃত। এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল বলে এটি অত্যন্ত পবিত্র বলে বিবেচিত। এর ফজীলত বা তাৎপর্য মাস হিসাবে অত্যধিক। এছাড়া হযরত ইমাম হোসাইন (রা)এর শাহাদাতের ঘটনা পরিপ্রেক্ষিতেই এর তাৎপর্য বলা বাহুল্য। পূর্বোল্লেখিত হাদীস থেকে জানা যায় আশুরার দিন রোজা রাখলে বিগত এক বৎসরের গুনাহর খাতা মাফ হবে। তাই সবাইকে ঐ রোজা রাখার চেষ্টা করতে হবে। এবার হযরত ইমাম হোসাইন (রা)এর শাহাদাতের ঘটনার দিকে নজর দিই। হিজরী ৬১ সনের ১০ই মহররম ইরাকের কারবালার প্রান্তরে আহলে বায়াতের ৭২ জনের শাহাদাতের ঘটনা কোন সাধারণ ঘটনা নয়। ইসলামী শাসন ব্যবস্থা তথা খেলাফতকে পাশ কাটিয়ে রাজতন্ত্র কায়েমের বিরুদ্ধে সে এক প্রচণ্ড প্রতিবাদ ছিল। নবীজী(সা)এর দৌহিত্র খেলাফতের মর্যাদা রক্ষায় সেদিন ইয়াজিদের বশ্যতা স্বীকার করেননি। ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (রা) পরিবার ফোরাত তীরে দারুণ তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধায় কাতর হয়েও সত্য ও ন্যায় বিসর্জন দেন নি। বীরের মত লড়াই করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছের পৃথিবীর বুকে। জুলুম শাহীর বিরুদ্ধে তাঁর এবং সঙ্গী-সাথীদের এ ত্যাগ সংগ্রামী চেতনার মানুষের কাছে পরম শ্রদ্ধার বিষয়। বিশ্বের মুসলিম দেশসমূহে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে জেঁকে বসা স্বৈরতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র থাকলেও আমরা নিশ্চুপ। হযরত ইমাম হোসাইনের সেদিনের শাহাদাত আমাদের আজীবন প্রেরণা যোগাবে। কবি যথার্থই বলেছেন, “ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হা কারবালা কি বাদ”- প্রত্যেক কারবালার পর ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হয়।
১০ই মহররম নিয়ে কতিপয় কুপ্রথা :
আশুরা নিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তি আছে সমাজে। ঐদিন পৃথিবীতে বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন বই-পুস্তকে লেখা আছে হাদীসের নামে। পৃথিবী সৃষ্টি, ধ্বংস, বিভিন্ন নবীর কাহিনী, বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া, ক্ষমতা ফিরে পাওয়া ইত্যাদি। অথচ সহীহ হাদীস গ্রন্থে এ সবের কোন উল্লেখ নেই। নিম্ন মানের কিছু বই এবং কতিপয় অসাধু পুস্তক ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে এসব বানোয়াট কাহিনী প্রচার হচ্ছে। আমাদেরকে কোরআন ও সহীহ হাদীস অধ্যয়ন করে মন-মস্তিষ্ক থেকে এসব ভুল ধারণার অপনোদন করতে হবে। হযরত মুসা (আ) ও ফেরাউনের ঘটনা ছাড়া আর কোন কিছুরই সত্যতা নেই। যা আছে তা জাল এবং দুর্বল হাদীস বলে মুহাদ্দিস তথা হাদীস বিশারদগণ বলেছেন।হযরত আলী (রা) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “তোমরা আমার নামে মিথ্যা বলবে না, কারণ যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা বলবে তার ঠিকানা জাহান্নাম।” (বুখারী) তাই আমরা কেন জাল এবং দুর্বল হাদীসের অনুসরণ করব? আমরা মহররমের আলোচনায় হযরত হোসাইন (রা)এর ত্যাগ থেকে শিক্ষা নেব এবং রাসূলের নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করব। ইবাদতের ব্যাপারে বাড়াবাড়িও পরিহার করব।
ইদানীং মহররম নিয়ে কিছু অতি উৎসাহী মুসলিম নামধারী ব্যক্তি কুপ্রথা এবং বাড়াবাড়ি ধরনের অনুষ্ঠান শুরু করেছে। যা অত্যন্ত গর্হিতকাজ। এরা তাজিয়া বানিয়ে রাজপথে মিছিল শোভা যাত্রা করে রঙ ছিটিয়ে হায় হোসেন! হায় হোসেন! রবে মাতম করে। কেহ কেহ মর্সিয়া বা শাহাদাত নামা পাঠ করে কান্নাকাটি, চিল্লাচিিল্লি ও হা-হুতাশ করে। এ ধরনের মর্সিয়া, পুঁথি সাহিত্য মনগড়া এবং তথ্য বিভ্রান্তিতে ভরপুর যা মানুষকে জিহাদী স্পিরিট থেকে দূরে ঠেলে দেয়। এরা বিভিন্ন ধরনের আসরের আয়োজন করে, শহীদের সন্তুষ্টির জন্য শরবত পান করে। অনেকেই এ মাসে বিয়ে-শাদী করাকে খারাপ মনে করে এবং সন্তান জন্ম নিলে অশুভ লক্ষণ মনে করে। অথচ আল্লাহর কাছে মহররম একটি পবিত্র মাস। এ ধরনের লৌকিকতা ও আড়ম্বরময় অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করা উচিত।
মহরমের শিক্ষা :
হযরত ইমাম হোসেন (রা) এর ইসলামের জন্য এ আত্মত্যাগ শুধুমাত্র খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে জুলুম শাহীর বিদায় ঘন্টা বাজানো। কারবালার এই হৃদয় বিদারক শাহাদাতের ঘটনা থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই, ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়া
মাওলানা আবুল হোসেন ভট্টাচার্য তাঁর কলমের তুলিতে এভাবে তুলে ধরেন- “ইসলামে পার্থিব ও অপার্থিব নেতৃত্ব একই হাতে থাকার কথা, ছিলও তাই। ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা হতেন যিনি, তিনিই জামে মসজিদের খতীব হতেন, চার খলিফার শাসনে সেটাই দেখেছি। দেখেছি পরবর্তী কালের খলিফার সময়েও কম-বেশী এর অনুবর্তন। তবে কারবালার ট্র্যাজেডির পর শক্তি ও বিভক্তি যে আলাদা হল, কদাচিৎ তা এক হবার সুযোগ পেল। সেদিন শক্তি চলে গেল দামেস্কে আর ভক্তি পড়ে থাকল মদীনায়। যাকে ভক্তি করা গেল, তাঁকে শক্তি দেয়া গেল না। আর যার হাতে শক্তি চলে গেল, তাকে ভক্তি করা হল না। খ্রীষ্ট জগতের পোপ আর সিজারের মত শক্তি আর ভক্তির এই ভাগাভাগি ঈসায়ী ইসলামের (খৃষ্টানদের) মত মোহাম্মদ (সা)এর ইসলামকে করল পঙ্গু আর দুর্বল।”ইমাম হোসেনে সার্থক অনুসারী বিদ্রোহী সত্ত্বার রূপকার কবি কাজী নজরুল ইসলামের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে হয়-
কত মহররম এলো, গেল চলে বহুকাল
ভুুলিনি গো আজো সেই শহীদের লোহু লাল।
মুসলিম! তোরা আজ জয়নাল আবেদীন,
ওয়া হোসেনা-ওয়া হোসেনা কেঁদে তাই যাবে দিন!
ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা
ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’’
=====
বিষয়: সাহিত্য
২১৫৬ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আশাকরি সুস্থ ও সুন্দরভাবে হজ্ব থেকে ফিরে এসেছেন।
পোস্টের জন্য শুকরিয়া!
আপনি হজে গেলেও সর্বোচ্চ মন্তব্যের ঘরটি আপনার অবস্থান ধরে রেখে আপনার উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলো।
নিশ্চয়ই ভালো আছেন।
হজ্বের অভিজ্ঞতা জানার অপেক্ষায় রইলাম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন