সাম্প্রদায়িকতা ও ইসলাম : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ...
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ২৮ আগস্ট, ২০১৫, ০৫:২৯:০৩ বিকাল
সাম্প্রদায়িকতা কি?
সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে এক ধরনের মনোভাব। কোন ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচরণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)
সব মানুষই কোন না কোন সম্প্রদায়ের মানুষ। সবাই এক আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষ মহাপুরুষদের হেদায়াত ভুলে গিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধাচরণ করছে অজ্ঞতা এবং ক্ষমতা লিপ্সার কারণে। অনেক রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয়া হয়। আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে নিষিদ্ধের দাবী তোলা হয়। অথচ মুক্ত বিশ্বে, মুক্তচিন্তা-চেতনার কথা বলে অন্যের স্বাধীন মতকে অনেক সময় বাধাগ্রস্ত করা হয়। অসহনশীল হীন রাজনৈতিক মনোবৃত্তির কারণে সাম্প্রদায়িকতা লালন করে কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল নমুনা বিশ্বের জন্য। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেভাবে বর্ণবাদী দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলে, তা থেকে অনেকখানিই মুক্ত প্রিয় বাংলাদেশ। ৯০% মুসলমানের দেশ হওয়ায় এদশে সেক্যুলার রাজনৈতিক দলগুলোর মত ইসলামী রাজনৈতিক দলও রয়েছে বেশ ক’টি। তাই অনৈক সময় হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অজুহাতে ইসলামকে সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট করা অপপ্রয়াস চলে। অথচ বর্তমান বিশ্বের সর্বাধুনিক জীবনাদর্শ ইসলামের কোথাও সাম্প্রদায়িকতার কথা নেই। এ ব্যাপারে ইসলামের নবী তাঁর অনুসারীদের সতর্ক করে দিয়েছেন বহু হাদীসে।
ইসলাম ও সাম্প্রদায়িকতা :
ISLAM = I SHOULD LOVE ALL MANKIND
ইসলাম হচ্ছে এ পৃথিবীর মানুষের জন্য সর্বশেষ আসমানী হেদায়াত। হযরত মুহাম্মদ (সা)এর মাধ্যমে অন্য কোন বিধান নাযিল চিরতরে তিরোহিত হয়েছে। মানবতার জন্য শাশ্বত, ন্যায়ভিত্তিক ও কল্যাণকর বিধান কেবলমাত্র ইসলামই। এতে কোন বর্ণবাদ, জঙ্গীবাদ, গোষ্ঠীবাদ বা সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। অন্য সম্প্রদায়ের উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ইসলাম কখনও অনুমোদন করে না। আমাদের উচিত কাউকে সাম্প্রদায়িক অপবাদ দেয়ার আগে চিন্তা করা যে আসলে তা কতটুকু হীন মনোভাব আছে! অবশ্য অন্য ধর্মের লোকদের প্রতি অন্যায় আচরণ না করে নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণে ভুুমিকা রাখা কখনো সাম্প্রদায়িকতা হতে পারে না।
অন্যতম উল্লেখযোগ্য হাদিস সংকলন সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত হাদিসটি এক্ষেত্রে খুবই প্রণিধানযোগ্য। প্যান ইসলামের প্রবক্তা মনীষী জামালুদ্দীন আফগানীর বিশিষ্ট সহকর্মী মিশরের শায়েখ এবং মুফতী আব্দুহু উক্ত হাদিসটি তাঁর লেখা “ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ” নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন। হাদিসটি নিম্নরূপ:
লাইছা মিন্না মান দাআ’ইলা আ’সাবিয়্যাহ, ওয়া লায়ছা মিন্না মান কাতালা আ’লা আ’সাবিয়্যাহ ওয়া লায়ছা মিন্না মান মাতা আলা আসাবিয়্যাহ।
“যারা সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীবাদের প্রতি মানুষকে আহ্বান জানায় তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। যারা সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাদের জন্যে লড়াই করে বা যুদ্ধ করে তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। যারা সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাদের জন্যে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করে তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।”
অনেকে কথায় কথায় বলে ফেলেন ইসলাম সাম্প্রদায়িক!.. । কোন ব্যক্তির সাম্প্রদায়িকতার জন্য ইসলামকে সাম্প্রদায়িক বলা উচিৎ নয়। ইসলাম সাম্প্রদায়িকতার ঘোরতর বিরোধী। ইসলামে সাম্প্রদায়িতার কোন স্থান নেই। হযরত শুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জুশুম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদা আমাদের উদ্দেশ্য ভাষণ দিলেন। অতঃপর বললেন তোমাদের মধ্য সেই ব্যক্তিই উত্তম যে নিজ গোত্রের অন্যায় অপরাধকে দমন করে ততক্ষণ পর্যন্ত সে অপরাধ না করে। (মিশকাত ৪৬৮৭/২৬৭)
সুতরাং মহানবী হাদীস অনুয়ায়ী বলা যায় ইসলামে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী কোন চিন্তা-চেতনা, অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধচরণ করা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলাম নামের যে ধর্মটি আল কোরআন হযরত মুহাম্মদ (স এর মাধ্যমে প্রচারিত তার উদ্দেশ্য একটি নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের, নির্ধারিত একটি জনগোষ্ঠী নয় বরং গোটা বিশ্বমানব সম্প্রদায়ই হলো কোরআনের উদ্দেশ্য। তাতে বহুবার হে মানব জাতি, হে মানব সমাজ, হে মানবমন্ডলী, হে মানবগোষ্ঠী প্রভৃতি নামে মানুষকে আল্লাহ সম্বোধন করেছেন। অন্যদিকে মুসলমানদেরকে আল্লাহ তাদের নিজস্ব বিচার বুদ্ধিকে জাগ্রত রাখার তাগিদ দিয়ে বলেছেন, “এমনিভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় হিসেবে সৃষ্টি করেছি যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলীর জন্য এবং যাতে রাসূল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য।” (সূরা বাকারা : ১৪৩ )
আল্লাহ মুসলমানদেরকে মধ্যপন্থী একদল সম্প্রদায় বা জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে বলেছেন এবং সীমা লঙ্ঘন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ চান তার পছন্দনীয় দ্বীন ইসলামের প্রতিষ্ঠা, যারা জালেম ও কাফের তাদের এটা পছন্দ নয়। তাই আল্লাহ মুমিনদেরকে ঐসব কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। “আর লড়াই কর আল্লাহর রাস্তায় তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।" (সূরা বাকারা : ১৯০) গত চৌদ্দশ বছর ধরে কোরআন আল্লাহর অনুরাগীদের মধ্যে যে ঐশী প্রেরণা ও বাস্তব চিন্তার খোরাক যুগিয়ে এসেছে-তার মধ্যে একটি সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়ার দৃষ্টান্ত নিশ্চয় নেই। বরং ঐশী কিতাবধারী ইহুদী ও খৃষ্টানদের লক্ষ্য করে কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, “হে আহলে কিতাবীগণ ! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহর শানে নিতান্ত সঙ্গত বিষয় ছাড়া কোন কথা বল না।”
(সূরা নিসা : ১৭১)
যে ধর্মের উদ্দেশ্য মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের সর্বাধিক কল্যাণ সে ধর্ম মানুষের মধ্যে হানাহানির বিষ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে পারে না। যদি তা কোন ধর্মের অনুসারীরা করে তাহলে বুঝতে হবে তারা ঐ ধর্মের সীমা অতিক্রম করেছে এবং তারা তাদের নিজস্ব ধর্মকে মানছে না। ইমাম জাসসাস, আহকামুল কোরআনে লিখেছেন, ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করার অর্থ তার ন্যায়সঙ্গত সীমারেখা অতিক্রম করা। হযরত মুহাম্মদ (স নিজেই বলেছেন, ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকে দূরে থেকো। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতসমূহ ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করার কারনে ধ্বংস হয়ে গেছে। আল্লাহ সত্যি মহান। তিনি মধ্যপন্থি হিসেবে মুসলিম সম্প্রদায়কে বেছে নিলেন, তাদের প্রতি মহান স্রষ্টাও শিক্ষকের ন্যায় আচরণ করলেন। বললেন, "যারা মসজিদ থেকে তোমাদের বাধা প্রদান করেছিল, সেই সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন তোমাদেরকে সীমা লঙ্ঘনে প্ররোচিত না করে। সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর।” (সূরা মায়েদাহ : ২)
যারা ইসলামকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয় তাদের সম্পর্কে ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাবেক সচিব শাহ আবদুল হান্নান বলেন, “ তবে তাদের সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কিত বক্তব্যগুলো ইঙ্গিতপূর্ণ। আমরা সহজেই সেসব বক্তব্য বা কথাবার্তা থেকে এটা অনুমান করতে পারি যে, এসব সাধারণভাবে ধর্ম ও ধর্মীয় শক্তির বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে বিশেষভাবে তা ইসলামী শক্তির বিরুদ্ধে। তারা কি এর দ্বারা সহনশীলতা বোঝান? অসহিষ্ণুতা দূর করতে চান? প্রকৃতপক্ষে এসব লোকের আচরণই সবচেয়ে অসহিষ্ণু। ধর্ম তো কোনোভাবেই অসহিষ্ণুতা প্রচার করে না, কিংবা অসহিষ্ণুতার সপক্ষে কথা বলে না। অন্তত এ যুগে তো নয়ই। ইসলাম প্রকৃতপক্ষে সহনশীলতা, সহমর্মিতার কথাই বলে। ইসলাম ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। স্বাধীন ধর্মচর্চার পক্ষেই কথা বলে। কিন্তু কিছু লোক ‘সাম্প্রদায়িকতা’র বিরুদ্ধে কথা বলে প্রকৃতপক্ষে ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। .....সাম্প্রদায়িকতার স্লোগান মূলত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইসলামের বিরুদ্ধে দেয়া হয়ে থাকে। তারা আসলে চান ইসলামী দলগুলো নিষিদ্ধ হোক অফিসিয়াল অর্ডার দ্বারা বা সংবিধানের মাধ্যমেই ইসলামী দল নিষিদ্ধ করে। এটা অনৈতিক ও অগণতান্ত্রিক। এই সেকুলার শক্তিগুলো ইসলামী শক্তিগুলো কাজ করুক তা চান না, তাদের কাজ করতে দিতেও চান না। তারা ভয় পান, ইসলামী দলগুলো যদি কাজ করতে পারে তাহলে ক্ষমতায় না গেলেও তারা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করবে। তারা কোনো প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা পছন্দ করেন না। সেজন্য তারা তাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী থাকুক, তা চান না।”
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ-বাংলাদেশ :
আবহমান কাল থেকেই এদেশে মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান বা অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে চমৎকার সম্প্রীতি বিদ্যমান। এখন ও তা অব্যাহত আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে এ কথা কেউ বলতে পারবে না। বদরুদ্দীন উমর বলেন, “এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, সম্প্রতি হিন্দুসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সব থেকে মারাত্মক দৃষ্টান্ত হল, কক্সবাজারে ২০১২ সালে বৌদ্ধ মন্দিরগুলোর ওপর আক্রমণ। কিন্তু দেখা যাবে, সেই আক্রমণ বাস্তবে কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনা ছিল না। সাম্প্রদায়িকতার কারণ ও রাজনৈতিক চরিত্র বিষয়ে যারা অজ্ঞ, তারাই কোনো সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর যে কোনো ধরনের আক্রমণকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে থাকে। মতলববাজরা যে এ কাজ করে থাকে এটা সবারই জানা।” (যুগান্তর : ২৫ মে ২০১৪)
কাজেই কুচক্রীদের থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, ফায়দা লুটার জন্য সাম্প্রদায়িক উস্কানী বন্ধ হওয়া উচিত। নাহলে সাম্প্রদায়িকতার লালনকারীদের কোপানলে পড়ে ভয়াবহ দাবানল ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে সব ধর্মের ধর্মীয়বেত্তাদের ভুমিকা সবসময় পজিটিভ থাকা একান্ত প্রয়োজন।
======
বিষয়: সাহিত্য
২৪৩৪ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন