হজ্ব সম্পর্কিত আল্লাহতায়ালার কতিপয় নিদর্শন....
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ২১ আগস্ট, ২০১৫, ১০:৩৪:৪৩ রাত
মহাবিশ্বে আল্লাহতায়ালার অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। আল্ কোরআন ও হাদীসে অনেক নিদর্শনের কথা উল্লেখ আছে। এসব নিদর্শন আল্লাহর অপার মহিমা ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করছে প্রতিনিয়ত, “আল্লাহু আকবর।” আমরা এ সব নিদর্শন দেখে বা এদের সম্পর্কে শুনে উজ্জীবিত, পুলকিত, শিহরিত ও ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হই। নিজেদের সৌভাগ্যবান ভাবি, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা চিত্তে সিজদা আদায় করি।
নিদর্শন কি?
নিদর্শন মানে চিহ্ন, স্তম্ভ, আলামত, চেনার উপায় বা মাধ্যম, স্মৃতি চিহ্ন। “কোন আধ্যাত্মিক মর্ম এবং কোন ধর্মীয় স্মৃতি অনুভব ও স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য নিদর্শন স্বরূপ যা নির্ধারিত হয় তাকে আরবীতে “শা‘আয়ের” বলা হয়। হারাম শরীফ ও তার পাশ্ববর্তী যেসকল পবিত্র স্থান আছে সেগুলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহতায়ালার নিদর্শন। ইসলামের ইতিহাসের সঙ্গে স্মৃতি-চিহ্নগুলোর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যেমন-বায়তুল্লাহ, হাজরে আসওয়াদ, সাফা-মারওয়া, মাকামে ইবরাহীম, হাদী বা কোরবানীর পশু, জবলে রহমত, জবলে নুর, জবলে সওর, জবলে আরাফা, জামারাত, রুকনে ইয়ামানী, মুলতাজাম, মাতাফ, মুজদালিফা, জমজম, মীকাতের স্থানসমূহ(যাতে ইরক্, যুলহুলায়ফা, কারনুল মানাযিল, ইয়ালামলাম, আল্ জুহফা), হাতিম, ওয়াদিয়ে মুহাস্সর, বাতনে আরানা ইত্যাদি আল্লাহতায়ালার নিদর্শন। হাজী সাহেবদের এগুলো সম্পর্কে অবগত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
আল্লাহতায়ালার নিদর্শনসমূহের সম্মান করার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে হজ্ব :
আল্লাহতায়ালার নিদর্শনসমূহ দেখলে বা এগুলো চিন্তা গবেষণা করলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। এ সকল নিদর্শনসমূহকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য আল্ কোরআনে বিশেষভাবে নির্দেশ এসেছে। এরশাদ হচ্ছে, “আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শন সমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলো, তা হবে অন্তরে তাকওয়ার অধিকারী হওয়ারই পরিচায়ক। উল্লেখিত নিদর্শনসমূহ পবিত্র হজ্ব কেন্দ্রিক হিসাবে চিহ্নিত। হাজীগণ হজ্বের মৌসুমে এর চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়ে এর যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন এবং আল্লাহর দরবারে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে রহমত ও মাগফিরাত কামনা করে থাকেন। নিম্নে কয়েকটি নিদর্শনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও গুরুত্ব পেশ করা হচ্ছেঃ
হাজরে আসওয়াদ :
হাজরে আসওয়াদ আল্লাহতায়ালার অন্যতম নিদর্শন। কাবা ঘরে হাজরে আসওয়াদ বসানো নিয়ে জাহেলি যুগে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। এই ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কয়েকদিন কেটে যায়। তারা সভার পর সভা চালিয়ে যায় সমাধানের লক্ষ্যে। কতিপয় ঐতিহাসিকের মতে আবু উমাইয়া বিন মুগীরা বিন আবদুল্লাহ বিন মাখযুম, যিনি কুরাইশদের মধ্যে বয়োবৃদ্ধ ও সম্মানিত ছিলেন, তিনি ঐ মতবিরোধ দূর করার লক্ষ্যে ঐ ব্যক্তির ফয়সালা গ্রহণ করা প্রস্তাব দিলেন, যে ব্যক্তি আগামীকাল প্রত্যুষে সর্বপ্রথম এই মসজিদে প্রবেশ করবে। তারা সকলে এ প্রস্তাব গ্রহণ করে নেয়। মহান আল্লাহর বিশেষ ইচ্ছায় সেদিন রাসূল (সা) সর্বপ্রথম এই মসজিদে প্রবেশ করেন। তারা যখন মোহাম্মদকে দেখে, বলে এতো আমাদের আল্ আমিন(বিশ্বস্ত), আমরা এঁর ফয়সালা মানতে রাজি। মোহাম্মদ (সা)এলে তাঁর কাছে বিষয়টি তারা বুঝিয়ে বলে। অতঃপর মোহাম্মদ (সা) বলেন, আমার কাছে একটা বড় কাপড় নিয়ে আসুন। কাপড় আনা হলে তিনি স্বহস্তে হাজরে আসওয়াদ ঐ কাপড়ে রাখেন এবং বলে সকল গোত্রের নেতাগণ কাপড়ের চতুষ্কোণ ধরে উঠান। তারপর তিনি নির্দিষ্ট স্থানে তা সেট করেন। এভাবে নবীজীর নেতৃত্বে এই সমস্যার সুরাহা হয়।
তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদ বরাবর দাঁড়িয়ে তাকবীর দিয়ে দুই হাত উপরে উত্তোলন করে তাওয়াফ করতে হয় (কালো লম্বা দাগ দ্বারা চিহ্নিত আছে) ইমাম আবু হানিফার মতে, কাঁধ পযন্ত হাত তোলা সুন্নত, এর বেশী নয়। হাজরে আসওয়াদকে সম্ভব হলে চুমু দেবেন, না পারলে স্পর্শ করবেন। যদি ভীড়ের কারণে তাও করতে না পারেন ইশারা করলেও হবে। এ সময় আল্লাহর হামদ এবং ছানা পাঠ করবেন এবং নবীজীর নামে দরূদ পাঠ করবেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত,রাসূল (সা) বলেন, হাজরে আসওয়াদ যখন জান্নাত থেকে নেমে আসে তখন দুধের চেয়েও সাদা ছিল; কিন্তু আদম সন্তানের পাপ তাকে কালো করে দেয়।” (তিরমিযী) হাজরে আসওয়াদ ধরা এবং চুমু দেওয়া সম্পর্কে ইমাম মুসলিম (র) হযরত নাফে (রা)এর হাদীসটি বর্ণনা করেন, “তিনি বলেন, আমি ইবনে উমরকে হাত দ্বারা চুম্বন করতে দেখেছি। অতঃপর ইবনে উমর বলেন, যখন থেকে আমি রাসূল (সা)কে এটা করতে দেখেছি, সে সময় থেকে এটা আমি কখনো ছাড়ি নি।” (মুসলিম) হযরত উমর ফারুক (রা) বলতেন, “আমি জানি তুমি পাথর মাত্র, তোমার লাভ-লোকসানের কোন ক্ষমতা নেই। আমি যদি রাসূল(সা)কে তোমায় চুম্বন দিতে না দেখতাম তাহলে আমি তোমাকে চুম্বন দিতাম না।” (বুখারী ও মুসলিম)
হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের ফজীলত :
যে ব্যক্তি হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন দিবে, কিয়ামতের দিন হাজরে আসওয়াদ সে লোকের ঈমানের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে। (তিরমিযী, ইবনে মাজা, দারেমীÑইবনে আব্বাস রা.) যে ব্যক্তি হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করবে, কিয়ামতের দিন হাজরে আসওয়াদ তার ব্যাপারে সুপারিশ করবে এবং সুপারিশ কবুল হবে। (রেহলাতুস সিদ্দীক-ইবনে আব্বাস থেকে ফিকহ্ মোহাম্মদী-আল্লামা মহিউদ্দীন পৃ.১৪১) হাজরে আসওয়াদে হাত লাগালে গুনাহ মাফ হয়। ( তিরমিযী-উবাইদ ইবনে উমাইর রা.)
মাকামে ইবরাহীম :
পবিত্র কাবা ঘর নির্মাণের সময় হযরত ইবরাহীম (আ) যে পাথরের উপর দাঁড়াতেন সেটাই মাকামে ইবরাহীম। এটিও আল্লাহতাআ’লার একটি নিদর্শন। এর গায়ে হযরত ইবরাহীম আ)এর পায়ের চিহ্ন এখনও বিদ্যমান। বর্তমানে তা সোনার খাঁচা বেষ্টিত অবস্থায় স্থাপন করা আছে। আল্ কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ’’নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম গৃহ নির্মাণ হয়েছিল মক্কায়; এটা বরকতময় ও সারাবিশ্বের হেদায়েতের কেন্দ্র। এতে আল্লাহর প্রকাশ্য নিদর্শনসমূহ বিদ্যমান, যেমন মাকামে ইবরাহীম। (সূরা আলে ইমরান-৯৬) তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহীমে দু’রাকাআ’ত সালাত আদায় করা সুন্নত। ভীড়ের কারণে যদি মাকামে ইবরাহীমে সালাতের স্থান পাওয়া না যায়, তবে মাকামে ইবরাহীম ও কাবা উভয়কে সামনে রেখে যে দূরত্বে আদায় করলে চলবে। এরশাদ হচ্ছে, “তোমরা ইবরাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে সালাতের জায়গা বানাও।” (সূরা বাকারা-১২৫) মুসনাদে আহমদে আছে, “মাকামে ইবরাহীম ও হাজরে আসওয়াদ এ দু’টি জান্নাতের জ্যোর্তিময় পাথর ছিল, আল্লাহ যদি এ দু’টির জ্যোতি বিলুপ্ত না করতেন তাহলে আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে অথবা পশ্চিম ও পূর্ব দিগন্তে যা আছে সবই আলোকিত হয়ে যেত।” দোয়া কবুলের স্থান সমূহের মধ্যে মাকামে ইবরাহীমও একটি।
সাফা-মারওয়া :
হাজীদের সাফা-মারওয়া সায়ী করা ওয়াজিব। আল্লাহতায়ালার অন্যতম নিদর্শন সাফা-মারওয়া পাহাড়। এরশাদ হচ্ছে, “নিশ্চয় সাফা-মারওয়া হচ্ছে আল্লাহতায়ালার নিদর্শন সমূহের অন্যতম। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা কাবা ঘরের হজ্ব বা উমরা করে, তাদের জন্য এ দু’টিতে প্রদক্ষিণ করায় কোন দোষ নেই।” (সূরা বাকারা-১৫৮) তাওয়াফের পর সায়ী করতে হয়। সায়ী সাফা থেকে শুরু করে মারওয়ায় গিয়ে শেষ করতে হয়। সাতবার সায়ী করতে হবে এবং উভয় পাহাড়ের প্রান্তে এলে বায়তুল্লাহর দিকে মুখ করে দু’হাত তুলে দোয়া করা ভাল।
সাফা-মাওয়ার মাঝখানে সবুজ চিহ্নিত স্থানে (পুুরুষ) দৌঁড়াবেন বা দ্রুত হাঁটবেন। যদি কখনো সায়ী অবস্থায় কোন ওয়াক্তের সালাতের ইকামত দেয়, তবে স্থগিত রেখে সালাতে শামিল হবেন। সালাত শেষে বাকী সায়ী সম্পন্ন করবেন।
জমজম:
জমজম কুপও আল্লাহতায়ালার নিদর্শন। এর সাথে জড়িত রয়েছে হযরত হাজেরা এবং জাতির জনক হযরত ইবরাহীম (আ)এর শিশু পুত্র হযরত ইসমাইল (আ)এর পূণ্য স্মৃতির। জমজমের উৎপত্তি সম্পর্কে আমরা কম-বেশী জানি। হযরত ইবরাহীম (আ)এর দোয়ার কল্যাণে জনমানবহীন স্থানে নিজ পরিবারকে ছেড়ে আসার সময় এ বলে প্রার্থনা করেনঃ “হে আমাদের রব! আমি আমার পরিবারকে চাষাবাদহীন উপত্যকায় ছেড়ে এসেছি। হে আমাদের প্রতিপালক! যাতে তারা সালাত কায়েম করে। সুতরাং আপনি কিছু মানুষের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন এবং তাদেরকে ফসল-ফলাদি দ্বারা রিজিক দান করুন। যাতে তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।” (সূরা ইবরাহীম-৩৭) জমজমের পানি মানুষের জন্য কল্যাণকর ও বরকতময়। হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা)বলেছেন, “ তিনি (বিবি হাজেরা) যদি জমজমকে প্রবাহিত হতে দিতেন অথবা বলেন, হাতের তালুতে দ্বারা পানি মশকে না ভরতেন তাহলে জমজম প্রবাহিত ঝরণায় পরিণত হত।”
তাবরানীতে উল্লেখ আছে, রাসূল (সা) বলেছেন, “ভুপৃষ্ঠের মধ্যে সর্বোত্তম পানি হচ্ছে জমজমের পানি। তাতে রয়েছে খাদ্য ও অসুখ থেকে আরোগ্য।” তিনি আরো বলেছেন, “যে নিয়তে জমজমের পানি পান করা হয় সে নিয়ত পূরণ হয়।” মিরাজের পূর্বে রাসূল (সা)এর বক্ষ বিদারণের সময় হযরত জিবরাইল (আ) জমজমের পানি দ্বারা তা ধৌত করেন।
হাদী বা কোরবানীর পশু:
হাদী বলা হয় কোরবানীর পশুকে। এটি আল্লাহর নিদর্শন। এরশাদ হচ্ছে, “ আর কোরবানীর উটগুলোকে তোমার জন্য আমরা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর একটি বানিয়ে দিয়েছি। এতে রয়েছে তোমাদের জন্য শুধু মঙ্গল আর মঙ্গল।” (সূরা হজ্ব-৩৬) হাজীদের জন্য কোরবানী করা ওয়াজিব। প্রকৃতপক্ষে কোরবানী আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের পরিচায়ক। আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা। যা করিয়ে দেখিয়েছিলেন মুসলমানদের জাতির জনক হযরত ইবরাহীম (আ)। তিনি স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দান করার পর আল্লাহ ফেরেশেতাদের মারফতে ঠিক তখনই কোরবানীর জন্য পশু পাঠিয়ে দেন। এরশাদ হচ্ছে, “আল্লাহ এভাবে পশুদেরকে তোমাদের বশীভুত করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাঁর দেয়া হেদায়াত অনুযায়ী তাঁর শ্রেষ্ঠত্ত্ব প্রকাশ কর।” (সূরা হজ্ব-৩৭) যারা আল্লাহর ঘরে হজ্ব করতে যান তারা এসব নিদর্শনসমূহের প্রতি সম্মান দেখানোর এক দুর্লভ সুযোগ পেয়ে থাকেন।
=====
বিষয়: সাহিত্য
২২০০ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো। জাজাকাল্লাহু খাইরান।
আল্লাহতায়লা যেন একবার হলেও নসিব করেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন