শিশুর সুন্দর এবং অর্থবহ নামের গুরুত্ব ও শিশু শিক্ষা প্রসঙ্গে কিছু কথা....
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১১ আগস্ট, ২০১৫, ০৭:৫০:১০ সন্ধ্যা
শিশুর সংজ্ঞা :
বাংলা উইকিপিডিয়াতে শিশুর সংজ্ঞা এভাবে দেয়া আছে। শিশু বা ইংরেজিতে চাইল্ড হচ্ছে ভুমিষ্ঠকালীন ব্যক্তির প্রাথমিক রূপ। যে এখনো যৌবন প্রাপ্ত হয় নাই। কিংবা বয়:সন্ধিক্ষণে পৌঁছে নাই। সে শিশু হিসেবে সমাজ এবং রাষ্ট্রে পরিচিত হবে। সাধারণত ১৫ বছরের নিছে অবস্থানকারীদের শিশু বলা হয়। জীববিজ্ঞানের ভাষায়-মনুষ্য সন্তানের জন্ম এবং বয়: সন্ধির মধ্যবর্তী পর্যায়ের রূপই হচ্ছে শিশু। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়-মায়ের মাতৃগর্ভে ভ্রুন আকারে অভুমিষ্ঠ সন্তানই শিশু। সুতরাং আমরা বলতে পারি যারা অপ্রাপ্ত বয়স্ক এবং বুদ্ধি-বিবেচনার কোন জ্ঞান রাখে না তারাই শিশু।
সুন্দর ও অর্থবহ নামের গুরুত্ব :
মানুষ মাত্রই সুন্দরের জন্য লালায়িত। কিটস্ বলেছেন, “সুন্দর জিনিস চিরকালের আনন্দ।” সুন্দরের প্রত্যাশী কিটস্ আরো বলেছেন, সৌন্দর্যই সত্য, সত্যই সৌন্দর্য।” শিলার বলেছেন, “সত্য জ্ঞানের জন্য বিদ্যমান থাকে আর সৌন্দর্য মানুষের অন্তরের পরিপূর্ণতা আনে।” তাই সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালের। একটি শিশু জন্ম গ্রহণের আগেই মা-বাবা একটি সুন্দর নামের খোঁজে সদা ব্যস্ত থাকেন। সুন্দর নাম রাখার চাইতে এই শিশুর জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার আর কিছু হতে পারে না। অবশ্য যে কোন জিনিসের জন্য নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নাম ছাড়া তার পরিচয় হতে পারে না। কার্ভেন্টিস বলেছেন, “অনেক ধন-সম্পদের চেয়ে একটা সুন্দর নাম ভাল।”
ইসলামের দৃষ্টিতে অর্থবহ এবং সুন্দর নাম বলতে বুঝায় ওই সমস্ত নাম, যে নামের মধ্য দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা, দাসত্ব প্রকাশ পায়। আল্লাহর প্রিয়পাত্র নবী-রাসুলদের বরকতময় নামসমূহ। অথবা পূণ্যবান মনীষীগণের নাম যারা মুসলিম জাতির সঙ্কটকালে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছেন। ইসলামী চেতনা পরিপন্থী কোন নাম রাখা উচিত নয়, যে নামের দ্বারা আল্লাহর রহমত, করুণা ও মহত্ত্ব ফুটে উঠে সে ধরনের নাম রাখা উত্তম।
সুন্দর নাম রাখা-ইসলামিক দৃষ্টিকোণ :
বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত ধর্মগ্রন্থ আল্ কুরআনে বলা হয়েছে,
“সুন্দরতম নাম সমূহের অধিকারী আল্লাহ, অতএব তোমরা সেসব নাম ধরে তাঁকে ডাকো। যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন করো, তাদের কৃত কর্মের ফল তাদেরকে দেওয়া হবে।” (সূরা আরাফ-১৮০)
এতো সুন্দর ভাবে সুন্দর নামে আল্লাহকে ডাকার ব্যাপারে বলেছেন। তাই নাম সুন্দর হওয়া এবং সুন্দরভাবে ডাকার কোন মতেই উপেক্ষার সুযোগ নেই। অন্যত্র বলেছেন, আল্লাহ নিজে সুন্দর, তাই তিনি সুন্দরকে ভালবাসেন। মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ)কে সৃষ্টি করে তিনি বিভিন্ন নাম শিক্ষা দিয়ে পরিচয় করে দিয়েছিলেন। কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে,
“তিনি (আল্লাহ) আদম (আ)কে যাবতীয় নামসমূহ শিক্ষা দিলেন, অত:পর সে সকল ফেরেশতার সামনে পেশ করলেন এবং বললেন এ সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। তাঁরা (ফেরেশতারা) বললেন, আপনি মহান, পবিত্র। আপনি আমাদের যা শিখিয়েছেন, তা ব্যতীত আমাদের তো কোন জ্ঞানই নেই। বস্তুত আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়। (সূরা বাকারা : ৩১-৩২)
তাই ইসলামে নামে গুরুত্ব সর্বাধিক, কারণ কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহপাক ব্যক্তির নাম এবং পিতার নাম ধরে ডাকবে। হযরত আবু দারদা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে ডাকা হবে তোমাদের নামে এবং তোমাদের পিতার নামে। অতএব তোমাদের নামগুলো সুন্দর করে রাখ। (আবু দাউদ, বায়হাকী ও মুসনাদে আহমদ)
রাসুল (সা) বলেন, যখন তোমরা কারো নাম মুহাম্মদ রাখবে, তখন তাকে তোমরা মারবে না এবং বঞ্চিত করবেনা।’ তিনি (সা) আরো বলেন, ‘‘তোমরা শিশুদের নাম মুহাম্মদও রাখবে আবার তাকে অভিশাপ ও গালাগালও দেবে?’ (অর্থাৎ এ নামের শিশুদের সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করবে না) এমনিতেও শিশুদের সাথে খারাপ ব্যবহার নিন্দনীয় কাজ। আর যদি মুহাম্মদ রাখা হয় তাহলে আরো সাবধান হওয়া দরকার। এর বাস্তবরূপ আমরা দেখি যখন আরবদেশ তথা মধ্যপ্রাচ্য সফর করি। অপরিচিত কাউকে সম্বোধন করা হয় তখন মুহাম্মদ বা আহম্মদ বলে ডাকে। হযরত আবু মুছা (রা) বলেন, ‘আমার প্রথম সন্তান ভুমিষ্ঠ হবার পরে আমি তাকে নবী (সা) এর কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি তার নাম রাখলেন ইবরাহীম। খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিলেন এবং খায়ের ও বরকতের জন্য দোয়া করে আমার নিকট ফিরিয়ে দেন।”
শাশ্বত জীবন বিধান ইসলামের শিশুর নাম রাখাটা তার অধিকার বলে উল্লেখ করেছেন। শিশুর জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। নাম অর্থবহ হওয়া নামের সৌন্দর্য। কেননা রাসুল (সা) অনেক অসুন্দর নামের পরির্বতন করে দিয়েছিলেন। বাজে অর্থহীন নাম তিনি পছন্দ করতেন না। অপছন্দ হলে পরিবর্তন করে তিনি উত্তম নাম দিতেন। হযরত আবদুর রহমান (রা) বলেন, “আমি রাসূল (সা)এর নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি প্রশ্ন করলেন? তোমার নাম কি? আমি বললাম, আমার নাম আবদুল উজ্জা। তিনি বললেন, ‘না তোমার নাম আবদুর রহমান, অন্য রেওয়ায়েতে আছে, আমার নাম আজিজ, মহানবী (সা) বললেন, ‘আজিজ তো আল্লাহ! (উজ্জা একটি মুর্তির নাম। আবদুল উজ্জা মানে হলো উজ্জার দাস এবং কাউকে আজিজ বলে ডাকাও নিষেধ। পুরো নাম আবদুর আজিজ এভাবে ডাকা উচিত। অনেকে নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে নিয়মমাফিক করার কথা বলে থাকেন বা নাম এভাবে হঠাৎ করে পরিবর্তন নিয়েও প্রশ্ন করেন? অথচ আল্লাহর রাসূল তাৎক্ষণিকই পরিবর্ত করে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে গড়িমসি কাম্য নয়।
বর্তমানে নাম দেখলে বুঝার কোন উপায় নেই যে, কোন ধর্মের? নামে কী অবস্থা! মুসলমানের নাম রাখি-গুড্ডু, গুল্লু, টিটন, মিল্টন, ডন, ময়না, টিয়া, ফুলি, গিটটু, আরো কত কি? অনেক সময় কাফের-মুশরিকদের নেতাদের নামে নাম রাখি। অনেক সময় হারাম এবং মাকরুহ নামও রাখি। যেমন-গোলাম রাসূল (রাসূলের দাস), আবদুল নবী (নবীর দাস) ইত্যাদি। আল্লাহর রাসূলের উম্মত দাবী করার পরও তারঁ নির্দেশনায় নাম রাখি না। তিনি বলেছেন, নবীদের নামে নাম রাখো। আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় নাম হলো আবদুল্লাহ এবং আবদুর রহমান। প্রিয় নাম হলো হারেস এবং হাম্মাম। অত্যন্ত অপছন্দের নাম হলো হারব ও মুররাহ। সুতরাং নাম ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতার পরিচায়ক, একে গুরুত্ব না দেয়া হলে জাতি হিসেবে আমরা পরিচিতি হারিয়ে ফেলব।
শিশুর শিক্ষা দান :
যে জাতির হেদায়েতের বিধান নাযিল হয়েছে জ্ঞান দিয়ে, সে জাতি কেন জ্ঞান চর্চায় এত পিছিয়ে? চিন্তার বিষয় কি নয়? প্রথম ওহীই ছিল পড়, পড়, এবং পড়। এর পর আল্লাহ বলছেন আমি মানুসকে কলম দ্বারা শিক্ষা দান করেছি। তাহলে সেই আরবী কলম, উর্দু কাগজ আমাদের হয়েও কেন শিক্ষা নিয়ে আমরা অসচেতন? তাই শিক্ষাদান করতে হবে শিশুকাল থেকেই। রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, তোমাদের সন্তান যখন কথা বলতে শুরু করে, তখন তাকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ শিখিয়ে দাও। এর পরে সে কবে মরে, তার পরওয়া করো না। শিশুর যখন দুধের দাঁত পড়ে যায়, তখন তাকে সালাত পড়তে বলো। (তিরমিজী, যাদুল-মাআদ) মহানবী (সা) আরো বলেছেন, ‘‘পিতা নিজের সন্তানকে যত কিছু দান করে, তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম দান হলো সন্তানকে ভালো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ।” তিনি আরো বলেছেন, “সন্তানের সাথে প্রীতি ও স্নেহপূর্ণ ব্যবহার করো। তাদের উত্তম শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দাও।”
হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা) বলেছেন, প্রতিটি শিশু তার স্বভাবজাত দ্বীন ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে। অত:পর তার মা-বাবা তাকে ইয়াহুদী, নাসারা বা অগ্নিপূজক হিসেবে গড়ে তুলে।” (বুখারী, হাদীস নং-১৩৫৮) অর্থাৎ পিতা-মাতাকে সে অনুকরণ-অনুসরণ করে। যা শেখায় তা শেখে এবং মনের কন্দরে তা গেঁেথ যায়। শিশুকে তাওহীদের শিক্ষাই প্রথমে দেওয়া দরকার। কারণ যে আল্লাহ তাকে দয়া করে এই পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন তাকে চেনা বা তাঁর নাম জানার জন্যই শিক্ষা দিতে হবে। হযরত আলী (রা) বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিনটি বিষয় শিক্ষা দাও। তন্মধ্যে রয়েছে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা।” শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে গার্ডিয়ানের অবহেলা বা উদাসীনতা সন্তানকে বিপথগামী করে দেয়। ইমাম ইবনুল কাইযুম বলেন, “যে ব্যক্তি তার সন্তানকে ইলম শিখার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখালো, তাকে এমনিতেই ছেড়ে দিলো, তার প্রতি অবিচার করল। আর অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে নষ্ট হওয়ার পেছনে পিতা-মাতার অবহেলা, উদাসীনতা এবং দ্বীনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান সম্পর্কে মূর্খ রাখাই দায়ী।”
শিশু শিক্ষার গুরুত্ব কতটুকু এ ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয়। আমরা কেন শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে আছি? কারণ জ্ঞানার্জনকে ফরয মনে করি, কিন্তু কাজে পরিণত করি না বা অবহেলা করি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ফ্রান্সিস উইলিন্ডার পার্কার এক শিশু সমাবেশে শিশু শিক্ষা বিষয়ে বক্তৃতা করছিলেন। তার বক্তৃতা শেষ হবার পর হরে। এক মহিলা তাকে প্রশ্ন করলো, ‘আমার শিশুকে আমি কখন থেকে শিক্ষা দেবো?’ তিনি বললেন, ‘আপনার শিশু কবে জন্ম নেবে?’ মহিলা অবাক সুরে বললেন, ‘জন্ম নেবে কি! তার বয়স তো পাঁচ বছর! ফ্রান্সিস উইলিন্ডার পার্কার বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে! আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আমার সাথে কথা বলছে! আর ওদিকে মূল্যবান পাঁচটি বছর শেষ হয়ে গেছে?’
উপরে রাসূল (সা)এর হাদীসে আছে শিশুকে কথা বলার পর থেকে শিক্ষা দান করতে হবে। আমরা করছি তার বিপরীত। আমাদের জীবন বিধান ইসলাম জ্ঞান অজর্নকে অবশ্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তার আমল করছে অন্য জাতি, ফায়দাও পাচ্ছে এবং জন্ম নিচ্ছে এক একজন বড় বড় খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব হিসেবে। সুতরাং জন্মের পর থেকেই জ্ঞান বা শিক্ষার জন্য অধিক গুরুত্ব না দিলে আমরা শুধু পিছিয়ে পড়বো না অস্তিত্বও হারিয়ে ফেলবো।
=====
বিষয়: সাহিত্য
৪০১৮ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চমতকার লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
এখন তো নাম রাখার নামে চলছে অদ্ভুত এক খেলা!!
জাযাকাল্লাহ খাইর
বর্তমানে ভারত উপমহাদেশে দুইয়ের অধিক নাম রাখা হয়, যদি পারতো হয়তো পৃথিবীর সব নাম এক সন্তানকেই দিয়ে দিত, সন্তানের প্রতি এমন পাগলা ভালোবাসার নজির ভুরিভুরি। মিনিমাম দুই নামতো থাকবেই, একটি আসল যেটি ইসলামীক মাইন্ডের হলেও এটি হাইড করা থাকে, স্কুলের ফর্ম পূরণ ও জন্ম নিবন্ধনের ব্যবহারের জন্য এই নামটি সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু সবাই যে নামে ডাকে সেটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হিন্দুদের নাম হয়।
আমাদের আশপাশের কিছু নাম দিচ্ছি, মানিক, সোহাগ, রুবেল, পারুল, রেখা, বৃষ্টি, পপি, শিল্পি, মিশু, মুমু, বাবু, বিফুল, শিউলি, কচি। এগুলো আমাদের বাড়িতেই অবস্থিত।
আশপাশের সবাই এসব নামেই চিনে।
শিক্ষার বিষয়েঃ বর্তমানে কেজি বেজির দাপটে ধর্মীয় শিক্ষা মৃত পায়।
সুতরাং জন্মের পর থেকেই জ্ঞান বা শিক্ষার জন্য অধিক গুরুত্ব না দিলে আমরা শুধু পিছিয়ে পড়বো না অস্তিত্বও হারিয়ে ফেলবো।
একদম সত্যি বলেছেন। সুন্দর পোষ্টটির জন্য শুকরিয়া।
জাযাকাল্লাহ খাইর
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন