যে ঈমান ফাঁসির মঞ্চে অসংকোচে গায় জীবনের গান-২
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ০১ আগস্ট, ২০১৫, ০৪:১২:৪০ বিকাল
মহাগ্রন্থ আল্ কুরআনে এরশাদ হয়েছে,
“আম হাসিবতুম আন তাদখুলুল জান্নাতা ওয়ালাম্মা ইয়া’তিকুম্ মাছালুল্ লাযিনা খালাও মিন কাবলিকুম, মাছ্ছাতহুমুল বা’ছা’ঔ ওয়ার্দ্বা রাঔ ওয়াজুল জিলু হাত্তা ইয়া কুর্লা রাসূলু ওয়াল্লাযিনা আমানু মাআ’হু মাতা নাছরুল্লাহ, আলা ইঁন্না নাছরুল্লাহে কারিব।” (সূরা বাকারা-২১৪)
অর্থ : তোমরা কি মনে করেছো, এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের আগে যারা ঈমান এনেছিল তাদের ওপর নেমে এসেছিল কষ্ট-ক্লেশ ও বিপদ-মুছিবত, তাদেরকে প্রকম্পিত করা হয়েছিল (ভিত-শিহরিত হয়েছিল)। এমনকি সমকালীন রাসূল এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চিৎকার করে বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? তখন তাদের এই বলে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছিল, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য নিকটেই।
প্রিয় বন্ধুগণ! এই আয়াতে আলোকে বলা যায় ইসলামী জীবন বিধান প্রতিষ্ঠার কাজ কন্ঠকাকীর্ণ, কুসুমাস্তীর্ণ নয়। যারাই কলেমার দাওয়াত দেবে তাদের জন্যই নেমে আসবে আয়াতে বর্নিত জুলুম-নির্যাতন এবং ফাঁসির রশি। ফাঁিসর মঞ্চে জীবনে জয়গান তারাই গাইতে পারে যারা দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। দ্বীন প্রতিষ্ঠাকে জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাই এ পথে চলার জন্য যারা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদেরকে পার্থিব লোভ-লালসা, আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস সারা জীবনের তরে কপালে নাও জুটতে পারে। তাই তো কবি বলেছেন, “আল্লাহকে যারা বেসেছে ভাল দু:খ কী আর তাদের থাকতে পারে?”
শাহাদাতের তামান্না যাদের বুকে ধিকি ধিকি জ্বলে, সে চেরাগ শাহাদাতেরই মনোবাসনা পূর্ণ করা ছাড়া থামে না। যে জীবন শাহাদাতের জন্য সে জীবন কোন বাধা মানে না, মানতে পারে না। জাগতিক কোন শক্তি সেই তীব্র আকাঙ্খাকে নির্বাপিত করতে পারে না। শাহাদাত মানেই জীবনের স্পন্দন। আল্লাহ রাসূলের সাহাবীগণের কাছে শাহাদাতের তীব্র আশা কতটা ছিল বলার অপেক্ষা রাখে না। হযরত খুবাইব (রা) শাহাদাতের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,
“মা ইন উবালী হীনা উকতালু মুসলিমান আলা আইয়ি শিক্কিন আনা ফিল্লাহি মাছরায়ী, ওয়াজালিকা ফি জাতিল ইলাহী ওয়া ইয়া শা ইউবারেক আলা আওছালেন শিলওয়েন মুমাজজায়ি।”
অর্থ : আমি যেহেতু মুসলিম হিসেবে নিহত হচ্ছি তাই মৃত্যুর কোন পরোয়া করি না। আর মৃত্যুর পর যে পাশেই ঢলে পড়ি না কেন তাতেও কোন পরোয়া করি না। আমি যেহেতু আল্লাহর পথে শহীদ হচ্ছি, তাই তিনি যদি চান আমার ছিন্ন ভিন্ন দেহের প্রতি টুকরায় বরকত দান করবেন।
বৃটিশ তাগুতী শক্তির বিরুদ্ধে শাহাদাতের পেয়ালা হাতে যুবক মুহাম্মদ জাফর :
বৃটিশরা এদেশে ১৯০ নব্বই বছর অবৈধভাবে শাসন করার জন্য হাজার হাজার মুসলমানকে পাইকারীভাবে ফাঁসিতে ঝুলায় এবং অনেককে আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত করে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হযরত সৈয়দ আহমদ বেরলভী (র)। তাঁর কর্মীরা কিভাবে জানবাজী রেখে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছিল এবং ত্যাগ স্বীকার করেছিল তা ইতিহাসবিদ উইলিয়াম হান্টারের একটি মন্তব্যই যথেষ্ট। “ভারতের এমন কোন বটবৃক্ষ ছিল না যার শাখায় ২৫/৩০ জন আলেমের লাশ ঝুলন্ত ছিল না।”
হযরত সৈয়দ আহমদ বেরলভী (র)শাহাদাতের পর আজাদী আন্দোলনের কয়েকজন বিশিষ্ট নেতা যেমন মাওলানা ইয়াহ আলী আজীমাবাদী, মাওলানা আহমদ উল্লাহ, মাওলভী জাফর থানেশ্বরী,মাওলানা আবদুর রহীম সাদিকপুরী প্রমুখদের বিরুদ্ধে মামলা চলে। ১৮৬৪ সালের মে মাসের দ্বিতীয় দিনে ইংরেজ জজ এডওয়ার্ডস্ এর আদালতে হাজির করা হলো ১১ জন আসামীকে। এসব আসামীদের চেহারা থেকে নিষ্পাপ আলোর ঝলকানি প্রতিফলিত হচ্ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা হলেন প্রথম শ্রেণীর অপরাধী তালিকাভুক্ত আসামী। রায়ের এক পর্যায়ে ইংরেক জর্জ বললেন, “তোমরা এ কথা প্রমাণ করার চেষ্টা করনি যে, তোমরা সরকারের প্রতি বিশ্বস্ত ও অনুগত, সুহৃদ এবং কল্যাণকামী। এ জন্য আমি তোমাদেরকে ফাঁসি দিচ্ছি।”
১১ জনের একজন হলেন যুবক মুহাম্মদ জাফর। তিনি শান্ত, ধীর ও পরম গাম্ভীর্যের সাথে এ রায় শুনলেন। তাঁর মধ্যে কোনরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। রায় শুনে জাফর বললেন, “সমগ্র মানুষের জীবন আল্লাহর হাতে। তিনিই মৃত্যু ঘটান, তিনিই জীবন দান করেন। তোমাদের হাতে না জীবন দেয়ার ক্ষমতা আছে না মৃত্যুর দানের। আমাদের মাঝে মৃত্যুর স্বাদ কে আগে আস্বাদন করবে তা কি কেউ বলতে পারে?”
মুহাম্মদ জাফরের শাস্তির নির্দেশ শোনার গর থেকেই তাঁর চেহারা আনন্দ ও খুশীতে ঝলসে উঠে। লোকেরা তাঁর আনন্দ দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল! ঠিক এমন মুহুর্তে একজন ইংরেজ অফিসার জাফরের নিকট গিয়ে বলল, “আজ পর্যন্ত এমন দৃশ্য কেউ দেখে নি। তোমাকে ফাঁসির হুকুম শোনানো হয়েছে, অথচ তুমি নিশ্চিন্ত মনেহাসি-খুশি আছ?”
মুহাম্মদ জাফর জবাবে বললেন, “আমি কেনই বা খুশী হবো না যখন আল্লাহ আমার ভাগ্যে শাহাদাত লাভকে কার্যকরী করতে চলেছেন। এরা শাহাদাতের মর্যাদা কী বুঝবে?”
এভাবেই দিকে দিকে আল্লাহর পথের সংগ্রামকারীরা দ্বীন বিজয়ী করার মিশনে চক্রান্তের শিকার হয়ে বিনা অপরাধে ফাঁিসর মঞ্চে সাহসিকতার সাথে শাহাদাতের পেয়ালা পান করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছেন। ফাঁসির মঞ্চে শহীদী কাফেলা চলছে, চলতেই থাকবে।
=====
বিষয়: সাহিত্য
২২৬০ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কোরআনের আলোয় আলোচিত হোক দিগন্ত।
ধন্যবাদ
অনেক দিন জ্বালাময়ী এক তেজদ্বীপ্ত লিখা পড়লাম। সত্যিই অনেক ভালো লেগেছে। দিন দিন মুসলিমদের মাঝে মুনাফিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঈমানদারদের টিকে থাকাটাও আরো অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সুন্দর পোষ্টটির জন্য শুকরিয়া।
সত্যিই আজ পর্যন্ত ইসলামের শত্রুরা শাহাদতের মর্যাদা বুঝে নি।
যে কারনে মুসলমানদের কাছে জান্নাত পাওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ হল শাহাদত।
মন্তব্য করতে লগইন করুন