প্রবন্ধ-৩ : রমজানুল মোবারক : অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত একটি মাস
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ২৬ জুন, ২০১৫, ০৫:৩০:৩৭ বিকাল
মাহে রমজান আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে বান্দার জন্য অফুরন্ত কল্যাণ, নেয়ামত ও বরকতের উৎস। আল্লাহপাককে রাজী করিয়ে জান্নাত লাভের উপায় হিসাবে রমজানের আগমন। রোজাদারদের জন্য এ মাস খুশীর আনন্দে ভেসে যাবার মাস। হাদীস মতে, এ মাসে জান্নাতের দরজা সমুহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। অভিশপ্ত বিতাড়িত শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। এ মাসের ফজীলত বলে শেষ করা যাবে না। সত্যি রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে প্রতি বছর মুসলিম সমাজে রমজান আসে। কবির ভাষায়-“মাহে রমজান এলো বছর ঘুরে, মু’মিন মুসলমানের দ্বারে দ্বারে, রহমতেরই বাণী নিয়ে, মাগফিরাতের পয়গাম নিয়ে, এলো সবার মাঝে আবার ফিরে।” এ আল্লাহর এক অপার রহমত মু’মিন বান্দাদের জন্য।
মাহে রমজানের অনন্য বৈশিষ্ট্য :
১। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস :
আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, রমজান মাসের প্রথম দশদিন আল্লাহর রহমত নাজিল হয়, দ্বিতীয় দশদিন মাগফেরাত এবং তৃতীয় দশদিন দোজখ থেকে মুক্তি দেয়া হয়। যে ব্যক্তি এতে আপন অধীনস্থ দাস-দাসী ও চাকর-বাকর হতে কাজের বোঝা হালকা করে দেয়, আল্লাহপাক তাকে ক্ষমা করে দেবেন এবং দোজখের আগুন থেকে নাজাত দেবেন। (বায়হাকী)
২। বরকতের মাস :
সকল মাসের সর্দার রমজান। এ মাসে মু’মিনদের রিজিক বৃদ্ধি(বরকত) করা হয়। (মিশকাত) আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আপন ইচ্ছায় কোনো নফল ইবাদত করবে, অন্যান্য মাসের ফরজ সালাতের সওয়াব হবে। আর যে ব্যক্তি একটি ফরজ আদায় করবে, অন্যান্য মাসের সত্তরটি সওয়াবের হকদার হবে। (মিশকাত)
৩। আল্ কোরআন নাজিলের মাস :
আল্লাহপাক এরশাদ করেছেন, “রমজান সে-ই মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে আল্ কোরআন, যা মানুষের জন্য দিশারী এবং সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। অতএব তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পায় সে যেন রোজা রাখে।” (সূরা বাকারা-১৮৫)
৪। দরিদ্র-অসহায়দের সহযোগিতার (দান-খয়রাত) মাস :
রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, এই মাস দরিদ্র-অসহায়দেরকে সহযোগিতার মাস, যার উসিলায় মু’মিনদের জীবিকা বাড়তে থাকে। অন্য হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) সবচেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন, রমজান এলে তাঁর দান ও বদান্যতা আরো বেড়ে যেত, এমনকি তাঁর দানশীলতা প্রবল বেগে বহমান বাতাসের চেয়েও বেশী হয়ে যেত। সদকা (যাকাত), দান-খয়রাতের জন্য কোন মাস নির্দিষ্ট নেই, তবু মাহে রমজান এলে লোকজন সত্তর গুণ সওয়াব লাভের আশায় দান করে থাকেন। এ ব্যাপারে হাদীসে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
৫। তাকওয়া অর্জনের মাস :
মহাগ্রন্থ আল্ কোরআনে এরশাদ হয়েছে, “হে ঈমানদাররা! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল, তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’’ (সূরা বাকারা-১৮৩) তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনের জন্য আল্লাহপাক কোরআনে অনেক আয়াত নাজিল করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তাকওয়া ব্যতীত মু’মিন, মুত্তাকী, পরহেজগার হওয়া যায় না। রাসূল (সা)কে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কোন্ আমল মানুষকে বেশী জান্নাতে প্রবেশ করাবে? তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর ভয় (অর্থাৎ তাকওয়া) ও স্বভাব। (তিরমিযী) অন্য হাদীসে আছে, সর্বাধিক উত্তম ব্যক্তি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে, জবাবে তিনি বলেন, যে আল্লাহকে বেশী ভয় করে এবং আতœীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখে। ইবনে উমর (রা) বলেন, “মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত তাকওয়ার স্তরে উন্নীত হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে অন্তরে সংশয় সৃষ্টিকারী কাজ পরিহার না করে।”
৬। সালাতুত তারাবীর (কিয়ামূল লাইল) মাস :
তারাবী সালাত রমজান মাসেই পড়া হয়। তারাবীর সালাত (কিয়ামূল লাইল) নারী-পুর”ষ উভয়ের জন্য সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। বিনা ওজরে তারাবীর সালাত ত্যাগ কঠিন গুনাহ। হাদীসে তারাবীর সালাতকে মাগফেরাত লাভের উপায় হিসাবে রাসূল (সা) বলেছেন। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি রমজানের রাতগুলোতে ঈমানী প্রেরণা এবং আখেরাতের প্রতিদানের নিয়তে তারাবীহ সালাত পড়লো, তার কৃত সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”
৭। বদরের মাস :
হিজরী ২য় বর্ষে (৬২৪ খৃ.) ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদর অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন ছিল ১৭ই রমজান। মাত্র ৩১৩ জন আল্লাহর পথের সৈনিক হাজারোধিক কাফের সৈন্যের বির”দ্ধে আল্লাহতায়ালার নির্দেশে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং বিজয়ী হন।
৮। দোয়া কবুলের মাস :
এ মাসে রোজাদারের দোয়া বিশেষ ভাবে কবুল করা হয়। রাসূল (সা) বলেছেন, তিন শ্রেণীর লোকের দোয়া সঙ্গে সঙ্গে বা বিশেষভাবে কবুল করা হয়। এক. রোজাদারের দোয়া, দুই.মজলুম বা অত্যাচারিতের দোয়া এবং তিন. মুসাফিরের দোয়া। (বায়হাকী)
৯। রিপু দমনের মাস :
রোজা কুপ্রবৃত্তি থেকে মানুষকে হেফাজত করে। মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলেন, “আর যে ব্যক্তি নিজের রবের সামনে এসে দাঁড়াবার ব্যাপারে ভীত ছিল এবং নফস্কে খারাপ কামনা থেকে বিরত ছিল, তার ঠিকানা হবে জান্নাত।” (সূরা আন্ নাযিআ’ত ঃ ৪০-৪১) হাদীসে রাসূলে বলা হয়েছে, রোজা হচ্ছে ঢাল স্বরূপ। যতক্ষণ না একে ছিন্ন করা হয়। কুকর্ম থেকে বিরত না থাকে।
১০। আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাস :
রমজান মাস তাহাজ্জুদ পালনের উৎকৃষ্ট সময়। তাহাজ্জুদ সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ সুগম হয়। রমজানে শেষ দশকে এতেকাফ রাখা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। সমাজ থেকে কাউকে না কাউকে রাখতেই হবে। না হলে সবাইকে গুনাহগার হতে হবে। এতেকাফের মাধ্যমেও আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করা যায়। আল্লাহপাক নিজেই বলেছেন, “রোজা আমার জন্য অর্থাৎ বান্দা আমার নৈকট্য লাভের জন্যই রোজা রেখেছে। কাজেই আমি আল্লাহ নিজেই এর পুরষ্কার দেব।” (হাদীসে কুদসী)
১১। এতেকাফের মাস :
হযরত আয়েশা (রা) বলেছেন, হুজুর পাক (সা) রমজানের শেষ দশকে এতেকাফ করতেন। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত এ নিয়ম তিনি পালন করেছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণ এতেকাফের এ সিলসিলা জারী রাখেন। (বুখারী) হযরত আবু হোরায়রা (রা) বলেছেন, রাসূল (সা) প্রতি রমজানে শেষ দশদিন এতেকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বছর বিশ দিন এতেকাফ করেন। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)
১২। যাকাত ও দান-সদকা বেশী বেশী দেয়ার মাস :
যাকাত ও দান-সদকা দেয়ার নির্দিষ্ট কোন মাস নেই। যে কোন দিনে, মাসে দেয়া যায়। যেহেতু রমজান মাসের ইবাদতে সত্তর গুণ সওয়াব বেশী লাভ করা যায়, এজন্য লোকেরা এ মাসকেই বেছে নেয় যাকাত ও দান-সদকা করার জন্য। হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) হচ্ছেন সমগ্র মানবকুলের মধ্যে সর্বাধিক উদার ও দানশীল। রমজান মাস এলে মহানবী (সা)এর দানশীলতা বেড়ে যেত। রাসূল (সা) বলেছেন, “উপরের হাত নীচের হাতের চেয়ে উত্তম, আর যারা তোমার অধীনে আছে তাদের থেকেই দান শুর” কর। আর উত্তম দান হচ্ছে তা, যা প্রাচুর্য থেকে প্রদান করা হয়। আর যে ব্যক্তি যাঞ্চা থেকে পবিত্রতা চায় আল্লাহ তাকে পবিত্র রাখেন। আর যে ব্যক্তি অন্যের কাছ থেকে অমুখাপেক্ষী হতে চায়, আল্লাহ তাকে অমুখাপেক্ষী করেন।” (বুখারী ও মুসলিম)
১৩। মক্কা বিজয়ের মাস :
৬২৮খৃ. হুদায়বিয়া সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করে ইসলাম বিরোধীরা। শুধু তাই নয়, মুসলিমদের উপরও দমন-নির্যাতন শুর” করে। এমতাবস্থায় রাসূল (সা) ৮ম হিজরীতে ১০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা করেন। ২১শে রমজান আল্লাহর রাসূল (সা) মক্কা বিজয় করে মহান আদর্শ ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন।
১৪। জিহাদের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাস :
ইসলামের ইতিহাসে বদরের যুদ্ধ এবং মক্কা বিজয় এ রমজান মাসেই সুসম্পন্ন হয়। নিজের নফসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ও শ্রেষ্ঠ জিহাদ। কিন্তু খোদাদ্রোহী ও তাগুতী শক্তির বির”দ্ধে জিহাদে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য রমজান মাসই উপযুক্ত মাস।
১৫। গুনাহ থেকে ক্ষমা ও মুক্তি লাভের মাস :
রোজার বিনিময়ে রোজাদার গুনাহ থেকে মুক্তি পায়। রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাস ও নেকী লাভের আশায় রমজানের রোজা রাখে, এর বিনিময়ে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ (ছগীরাহ) মাফ করে দেয়া হয়। (মুয়াত্তা) অন্য হাদীসে আছে, রাসূল (সা)বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানকে পেয়েও নিজের গুনাহ থেকে মুক্তি পেল না, সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক।
১৬। চরিত্র গঠনের মাস :
মিথ্যা বলা মহাপাপ। এটি একটি ভয়ানক ব্যাধি। মিথ্যা কথা না বলা চরিত্রবানের সুলক্ষণ। রমজানের রোজা রাখার মাধ্যমে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করল না-সে ব্যক্তির পানীয় দ্রব্য পরিত্যাগে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারী) তিনি আরো বলেছেন, রোজা পাঁচটি জিনিস নষ্ট করে ঃ মিথ্যা কথা, পরনিন্দা, কুটনামী, মিথ্যা শপথ ও কামভাব দৃষ্টিপাত। এসব দোষাবলী বর্জন চরিত্র গঠনে সহায়ক।
১৭। ধৈর্য-সহানুভুতির মাস :
রোজার মাধ্যমে কে কত অপরের প্রতি ধৈর্যশীল ও গরীব দুঃখীর প্রতি সহানুভুতিশীল তা বুঝা যায়। সমাজের বিত্তবানেরা ক্ষুধা এবং অভাবের তাড়না কতটুক ুতা বুঝতে পেরে এ মাসে দান-সদকা-যাকাতের প্রতি যতœবান হয়ে দান করতে উদ্বুদ্ধ হয়। বিপদ-মুছিবতে ধৈর্য ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা রদ করতেও রোজার গুর”ত্ব অপরিসীম। রাসূল (সা) বলেছেন, কেউ যদি তোমার সাথে ঝগড়া করতে চায়, তবে বলো “আমি রোজাদার।”
১৮। লাইলাতুল কদরের মাস :
আল্ কোরআনে এরশাদ হয়েছে, “নিশ্চয়ই আমি এই (গ্রন্থ) টিকে নাজিল করেছি এক মর্যাদাপূর্ণ রাতে। তুমি কি জানো সেই মর্যাদাপূর্ণ রাত কি? এই মর্যাদাপূর্ণ রাতটি হচ্ছে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।” (সূরা আল্ কদর : ১-৩) কদরের রাতটিও রমজান মাসের মধ্যে।
১৯। আতœশুদ্ধি ও আতœসংযমের মাস :
রোজার আমাদের আতœশুদ্ধি ও আতœসংযম শিক্ষা দান করে। রমজানে কঠোর শৃংখলার ফলে মানুষ দিনের বেলায় যথেচ্ছ ভোগের প্রতি মনোনিবেশ করতে পারে না। নিয়মানুবর্তিতা ও নিয়ন্ত্রণের ফলে সে পূর্ণ মু’মিন হওয়ার সুযোগ লাভ করে থাকে। ফলে আতœা কলুষমুক্ত ও পরিশুদ্ধতার পথে এগিয়ে যায়। দেহ ও মনকে ষড়রিপুর হাত থেকে বাঁচিয়ে সংযমী হতে সহায়তা করে। রোজার সংযম পালনে মূলত আমাদের জিহ্বাকে সংযত করতে হবে। রাসূল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের উপর ঈমান রাখে সে যেন কথা বললে ভাল কথা বলে কিংবা চুপ করে থাকে। (বুখারী ও মুসলিম) হাদীস থেকে জানা যায়, জবান বা জিহ্বার ১৫টি দোষ আছে, যথা ঃ ১. মিথ্যা কথা বলা, ২। ঠাট্টা বিদ্র”প করা, ৩. অশ্লীল ও খারাপ কথা বলা, ৪. গালি দেয়া, ৫. নিন্দা করা, ৬. অপবাদ দেয়া, ৭. গীবত করা, ৮. চোগলখুরী করা, ৯. বিনা প্রয়োজনে গোপনীয়তা ফাঁস করা, ১০. মোনাফিকী করা, ১১. ঝগড়া-ঝাটি করা, ১২. বেহুদা ও অতিরিক্ত কথা বলা, ১৩. বাতিল ও হারাম জিনিস নিয়ে কথা বলা, ১৪. অভিশাপ দেয়া, ও ১৫. সামনা-সামনি কারো প্রশংসা করা।
২০। আতœত্যাগ ও আতœজাগৃতির মাস :
প্রবাদ আছে-ভোগ নয়, ত্যাগই সুখ। রোজা আতœত্যাগের কঠোর অনুশীলন ও অন্তরাতœাকে জাগিয়ে তোলার মাস। রোজা সকল প্রকার ইন্দ্রিয় ও জাগতিক সুখ-ভোগ থেকে বিরত রেখে সিয়াম সাধনায় নিয়োজিত করে। এটা উচ্চ শ্রেণীর সিয়ামের লক্ষণ। নবী, সিদ্দিক ও আল্লাহর নিয়ামত প্রাপ্তদের সিয়াম উচ্চশ্রেণীর সিয়াম।
ইমাম গাজ্জালী (র) বলেন, উচ্চ শ্রেণীর সিয়াম হল সে সিয়াম, যে সিয়ামে দৈহিক সংযমের সাথে অন্তরের সংযম কার্যকরভাবে অনুসৃত হয়। অন্তরে যখন আখেরাত ও আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন চিন্তা প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয় না, কোন স্বার্থ মুখ্য না হয়ে পরার্থে জীবন উৎসর্গীকৃত তার সিয়ামই প্রকৃত ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জল।
২১। পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও সামাজিকতা বৃদ্ধির মাস :
রোজা মুসলমানদেরকে ঐক্য, সাম্য ও প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও সমবেদনা বাড়ায়। ধনী-গরীব সমভাবে একই সময়ে রোজা এবং এক কাতারে সালাত আদায়ের ফলে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব, মমত্ব ও সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করে। রাসূল (সা) বলেছেন, এ মাস সহানুভুতি ও সহমর্মিতার মাস। (মিশকাত)
২২। কোরআন তেলাওয়াত করে পূণ্য হাসিলের মাস :
কোরআন নাজিলের এই মাসে কোরআন তেলাওয়াত ও শ্রবণ করা খুবই পূণ্যের কাজ। হাদীসে আছে, তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে নিজে কোরআন শিখে এবং অপরকে শিখায়। হাদীসে আরো এসেছে, হযরত জিবরাইল (আ) রমজানের প্রতি রাতে রাসূল (সা)কে কোরআন শিক্ষা দিতেন। (বুখারী ও মুসলিম) হযরত ফাতেমা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত জিবরাইল (আ) প্রতি বছর রমজান মাসে একবার রাসূল-এ-খোদা (সা)কে কোরআন পুনরাবৃত্তি করতেন। কিন্তু রাসূল (সা)এর ওফাতের বছর দু’বার কোরআন পেশ করেন। তাই এ মাসে কোরআন তেলাওয়াতে মনোযোগী হতে হবে এবং তারাবীর সালাতে অংশ গ্রহণ করে কোরআন শুনে আমল করতে হবে।
২৩। দাওয়াতে দ্বীনের মাস :
এ মাস দ্বীনের দাওয়াতের জন্য খুবই গুরূত্বপূর্ণ। কোরআন নাজিলের এই মাসে কোরআনের দাওয়াতকে সম্প্রসারনের লক্ষ্যে সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। কোরআন বলছে, “তার কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকে, নেক আমল করে, এবং ঘোষণা করে আমি একজন মুসলমান।” (সূরা হা-মীম-সাজদাহ : ৩৩) অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, “ডাক তোমার প্রভুর দিকে হিকমত ও উত্তম নসীহত সহকারে, আর (লোকদের সাথে) বির্তক কর উত্তম পদ্ধতিতে।” (সূরা আন্ নহল-১২৫) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, ‘‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত জানলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’’ (বুখারী)
২৪। জুমাতুল বিদার মাস :
রমজানের শেষ জুমাকে জুমাতুল বিদা বলা হয়। এর গুরূত্ব, তাৎপর্য ও মাহাতœ্য অপরিসীম। দিন হিসাবে শুক্রবার বা জুমাবারের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। মহানবী (সা) এক জুমুআ’র দিনে খুতবা প্রদানকালে জুমাবারকে ঈদের দিন বলেও আখ্যায়িত করেন। আলেম-ওলামাদের মতে, বছরের দিবস সমুহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিবস হচ্ছে আরাফাতের দিবস ও সপ্তাহের দিবস সমুহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দিবস জুমুআ’র দিবস। জুমুআ’র রাতও তেমনি। যেহেতু এ দিন রমজান মাসে তাই এর গুরূত্ব আরো অনেক অনেক বেশী হওয়া উচিত মুসলমানদের কাছে।
২৫ । আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের শপথ নেয়ার মাস :
এই মাস কোরআনের আইন বাস্তবায়নের শপথ নেয়ার মাস। আল্ কোরআনে এরশাদ হয়েছে, যারা আল্লাহর নাজিল করা আইন অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করে না তারা কাফির। (সূরা মায়েদা-৪৪), আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, সে অনুযায়ী যারা ফয়সালা করে না, তারা জালিম। (সূরা মায়েদা-৪৫), আর আল্লাহ যা নাজিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা ফয়সালা করে না তারা ফাসিক। (সুরা মায়েদা-৪৭)। কোরআনের কথানুযায়ী বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী, দেশের আইন-আদালত, বিচার-ফয়সালা, দেশ পরিচালনা না হলে মুসলমান দাবী করা সত্ত্বেও কাফির, জালিম ও ফাসিক। আল্লাহর হুকুম অমান্য করা কত বড় গর্হিত কাজ একবার ভাবুন তো!
কাজেই রমজানের এই সুযোগসমুহকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে আমাদেরকে পুরো মাস ঈমান ও এহতেসাবের সাথে রোজা রাখতে হবে। আরো কিছু আমল বা কাজ করতে হবে যা আল্লাহর অত্যন্ত পছন্দনীয়। দু’টি আমল হচ্ছে কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করা এবং বেশী বেশী করে তওবা-এস্তেগফার করা। আর মু’মিনের জন্য জর”রী এই যে, জান্নাতের আশা করা এবং দোজখ থেকে পানাহ চাওয়া।
এছাড়া কোরআন নাজিলের এই বরকতময় মাসে প্রত্যহ কোরআন পাঠের অভ্যাস করতে হবে। সেই মোতাবেক জীবন-গঠন করে আল্লাহর জমীনে আল্লাহর কোরআনের আইনকে প্রতিষ্ঠার বলিষ্ঠ শপথ নিতে হবে। রমজানের শেষ দিবসে শবে কদর লাভের জন্য বেজোড় রাতগুলোতে ইবাদতে মগ্ন থাকতে হবে। গরীব-অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত (দান-সদকা-যাকাত প্রদানের মাধ্যমে) প্রসারিত করতে হবে। কারণ রমজানকে পেয়েও আমরা যদি গুনাহ মাফ করতে না পারি এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কি হতে পারে? তাই মাহে রমজানের হেদায়েতকে কাজে লাগিয়ে নাজাতের পথ খুঁজে নিতে হবে।
বিষয়: সাহিত্য
২১২৮ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
রমজানের প্রকৃত অর্থ এখন আমরা ভুলে গেছি। রমজান এখন কেবল ইফতারি খাওয়ার মাস হয়ে গেছে যেন!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন