নিবন্ধ-৭ : রোজার উদ্দেশ্য, রাসূল (সা)এর রমজান এবং আমাদের করণীয়
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১৭ জুন, ২০১৫, ০৮:০৯:০০ রাত
মানবজাতির হেদায়েতের একমাত্র প্রামাণ্য গ্রন্থ আল্ কোরআনে এরশাদ হয়েছে, “অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এই মাসটি (রমজান) পাবে সে যেন এই মাসে রোজা রাখে, (তবে) অসুুস্থ হয়ে পড়লে কিংবা সফরে থাকলে, সে পরবর্তী (কোনো) সময়ে সেই পরিমাণ দিনগুলোকে গুণে গুণে আদায় করে নেয়। (এই সুযোগ দিয়ে) আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে আসান করে দিতে চান। আল্লাহতায়ালা কখনো তোমাদের জীবনকে কঠোর করে দিতে চান না। আল্লাহতায়ালার উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমরা যেন গুণে গুণে সংখ্যাগুলো পূরণ করতে পার। আল্লাহ তোমাদের যে জীবন পদ্ধতি শিখিয়েছেন তার জন্য তোমরা মাহাতœ্য বর্ণনা করতে পার এবং তার কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পার।” (সূরা বাকারা-১৮৫) এই সূরার ১৮৩ থেকে ১৮৭ আয়াত পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য রোজার বিধান দিয়েছেন। সুতরাং রোজার ফরজিয়াত সম্পর্কে কোন সন্দেহ বা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই।
রোজার উদ্দেশ্য :
রোজা ফারসি শব্দ। আরবীতে সাওম বলা হয়। যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, সংযত থাকা, দূরে থাকা, পরিত্যাগ করা, অবিরাম প্রচেষ্টা করা এবং আতœসংযম করা। রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ১৮৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।” তাকওয়াবান বা পরহেজগার বা খোদাভীতি অর্জন করতে পার। তাকওয়া এবং মুত্তাকী সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে এক বিশাল গ্রন্থ হয়ে যাবে। সংক্ষেপে কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাকওয়া কি এ সম্পর্কে হযরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ(র) বলেন, “তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহতায়ালা যা করতে বলেছেন তা যথাযথভাবে করা, আর যা করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকা।” এরশাদ হয়েছে, “আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ করে নাও। নিঃসন্দেহে খোদাভীতিই হচ্ছে সর্বোত্তম পাথেয়। হে জ্ঞানীগণ! তোমরা আমাকেই ভয় কর।” (সূরা বাকারা-১৯৭) সূরা আলে ইমরানে এরশাদ হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর, যেমনভাবে ভয় করা উচিত। আর তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’ (আয়াতÑ১০২) রাসূল (সা) বলেছেন, “তাকওয়া গ্রহণ করো। এটা সমস্ত কল্যাণের উৎস।” (তিবরানী) আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে রয়েছেন। (সূরা তাওবা ৩৬ এবং ১২৩ আয়াত) মুত্তাকীরাই হেদায়াত প্রাপ্ত এবং সফলতার অধিকারী সূরা বাকারা (২-৫)। কাজেই আমাদেরকে অবশ্যই একজন মুত্তাকী হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। রোজার মাধ্যমে তা সম্ভব, আল্লাহও এটাই চান। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম বলেন, রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে, “মানুষ যেন তার স্বভাব ও কামনার জিঞ্জির থেকে মুক্ত হতে পারে। তার জৈবিক চাহিদা শক্তির মধ্যে যেন ভারসাম্য তৈরী হয় এবং এরই মাধ্যমে যেন চিরন্তন কল্যাণ ও সৌভাগ্যের পথে নিজেকে পরিচালিত করতে পারে এবং এ উদ্দেশ্যে নিজের আতœাকে পরিশুদ্ধ করতে পারে।” (যাদুল মাআ’দ, ১ম খন্ড পৃ. ১৫২)
রাসূল (সা)এর রমজান :
রমজানের রোজার মূল উদ্দেশ্য হাসিল করতে হলে আমাদেরকে রাসূল (সা) রমজানের সময় কি করতেন তা জানা থাকা দরকার। হাদীস এবং সীরাত গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মাহে শা’বান থেকেই রাসূল (সা) রমজানের প্রস্তুতি শুর” করে দিতেন। শা’বান মাসের প্রায় পুরোটাই রোজা রাখতেন। রমজানে হযরত জিবরাইল (আ)এর কাছে কোরআন শিখতেন। তাঁর দান-সদকা করার পরিমাণ বেড়ে যেত। তিনি রাত্রে ইবাদতের জন্য পরিধেয় বস্ত্র শক্তভাবে বেঁধে নিতেন এবং পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে তুলতেন। দেরী করে সেহরী খেতেন এবং তাড়াতাড়ি ইফতার করতেন। রমজানের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। ওফাতের বছর তিনি ২০দিন এতেকাফ ছিলেন এবং জিবরাইল (আ) দু’বার কোরআন পেশ করেন। লাইলাতুল কদরে তিনি বেশি বেশি এই দোয়া পাঠ করতেন, “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী।’’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি মহীয়ান, ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতেই তুমি ভালবাসো, আমাকে ক্ষমা কর। তিনি (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাস ও নেকী লাভের আশায় রমজানের রোজা রাখে, এর বিনিময়ে তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ (ছগীরাহ) মাফ করে দেয়া হয়। (মুয়াত্তা) অন্য হাদীসে আছে, রাসূল (সা)বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানকে পেয়েও নিজের গুনাহ থেকে মুক্তি পেল না, সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক। আসুন আমরা মাহে রমজানে রাসূল (সা)এর দেখানো পথে রোজা রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করি।
একজন রোজাদারের করণীয় :
পরকালীন পাথেয় সংগ্রহের মৌসুম হল মাহে রমজান। এ মাসকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য মুমিনের পেরেশানীর শেষ নেই। জিন্দেগীর কৃত গুনাহের থাকা মাফের এ সুযোগ আর নাও পেতে পারি রোজাদারকে তাই ভাবতে হবে। তাই আমাদের উচিত পুরো রমজানে অন্ততঃ একটি বার হলেও কোরআন অধ্যয়ন করা (অর্থসহ বুঝে তাফসীরসহ হলে আরো উত্তম) এবং বিশুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত শেখার চেষ্টাও করতে হবে যারা বিশুদ্ধ কোরআন তেলাওয়াত জানে না। প্রতিদিন তারাবীহ সালাত আদায় করা। অসহায়, দুঃস্থদের এবং আতœীয়দের দান-সদকা এবং সহযোগিতার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া। রমজানে অহেতুক গাল-গল্প, পরদোষ চর্চা এবং শপিংয়ের নামে অতিরিক্ত মার্কেটে ঘুরাঘুরির প্রবণতা বন্ধ করা। অসহায়, দুঃস্থদের ইফতারে শরীক করানো। লাইলাতুল কদরের তালাশে ২০শে রমজানের পর প্রতি বেজোড় রাতে ইবাদতের চেষ্টা করা। রোজা ভঙ্গকারী যে কোন কাজ থেকে দূরে থাকা বা পরিহার করা। অধীনস্থদের কাজের বোঝা হালকা করে দেয়া। সম্ভব হলে এতেকাফ থাকা। সময়-সুযোগ পেলে ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন, দাওয়াতী কাজ, পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। রোজার প্রয়োজনীয় মাসলা-মাসায়েল জানাও আবশ্যক। আতœশুদ্ধি ও আতœগঠনের লক্ষ্যে যাবতীয় তৎপরতা চালাতে হবে।
রমজানের পবিত্রতা রক্ষা এবং কতিপয় বিদআতের বর্জন প্রসঙ্গ :
রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে ঃ দিনের বেলা হোটেল, রেস্তোরা, চায়ের দোকান বন্ধ রাখার জন্য জনগণকে সচেতন করে তোলা, মিডিয়াসমূহ যাতে অশ্লীল প্রোগাম প্রচার না করে সেজন্য জনমত গড়ে তোলা, সিনেমা হল, যাত্রামঞ্চ, থিয়েটার প্রভৃতি বন্ধ রাখা, দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতায় রাখার জন্য ব্যবসায়ীদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে সতর্ক করে দেয়াসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা, অতিঘুম না দিয়ে ইবাদতের মাধ্যমে রোজা পালনের চেষ্টা করা, রাজনৈতিক দমন নিপীড়ন করে জনগণকে ভীতসন্ত্রস্ত না করে সিয়াম সাধনায় সহযোগিতা প্রদান করা। যারা কয়েদী, জেলে বা হাজতে আছে তাদের প্রতি সহানুভুতিশীল হওয়াও যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত।
এছাড়া জনগণের মাঝে প্রচুর পরিমাণ লোক বিদআতে লিপ্ত, যারা না বুঝে ইবাদত মনে করে ছওয়াবের উদ্দেশ্যে রোজাও অন্যান্য সময় করে থাকে। যেমনঃ নাওয়াইতুআন আসুমা গাদাম .. বলে নিয়ত করা (আল্লাহর নামে রোজা রাখছি বললে নিয়ত হয়ে যায়), ইফতারের সময় সতর্কতাস্বরূপ দেরী করা, আগে ভাবে সেহরী খাওয়া, রোজার কারণে একেবারে কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দেয়া, তারাবীহ সালাতে ৪ রাকাআত পর পর “সুবহানা যিল মুলকি ..বলে দোয়া পড়া। লাইলাতুল কদরের রাত্রিতে গুনাহ মাফের উদ্দেশ্যে গোসল করা, কদর রাতে বিভিন্ন পদ্ধতিতে, নির্দিষ্ট সূরা দিয়ে সালাত ইত্যাদি। যা সুন্নাতে রাসূলের (সা)এর মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ নয় তা বর্জন করা উচিত। আসুন আমরা নাজাতের উদ্দেশ্যে রাসূল (সা)এর দেখানো পদ্ধতিতে মাহে রমজানের রোজা পালন করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে প্রচেষ্টা চালাই।
========
বিষয়: সাহিত্য
২০৯৬ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আলহামদুল্লিলাহ। ভাল লাগলো।
ফজিলতের পাশাপাশি বিদাআত করা হয় এ বিষয় গুলো উল্লেখ করার জন্য শুকরিয়া ভাই। আল্লাহ আমাদের রমাদানের সঠিক হক আদায় করার তৌফিক দান করুন! জাযাকাল্লাহু খাইর!
জাযাকাল্লাহু খাইরান !
তারাবীহ সালাতে ৪ রাকাআত পর বিশ্রামের সময় কি পড়া উচিৎ একটু জানাবেন কি?
আপনাকে ধন্যবাদ। আমিন।
আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন