নিবন্ধ -৬ : সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সালাতের গুরুত্ব
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১১ জুন, ২০১৫, ০৯:০৩:৩০ রাত
ইসলামী জীবন-ব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে সালাত বা নামাজ। কিতাবুল্লাহতে ৮২ বার সালাত প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেয়া হয়েছে। সালাত রাসূল (সা)এর মি'রাজে প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ উপহার, যা উম্মতের নাজাতের জন্য সবচেয়ে বড় উপায়। সালাতের মাধ্যমে ব্যক্তির অন্ত:করণ পরিশুদ্ধ হয়, ব্যক্তির জীবনে শৃঙ্খলা ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সালাত আল্লাহর সাথে বান্দার সংযোগের প্রধান পদ্ধতি। দৈনন্দিন ৫ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা মুসলমানদের জন্য ফরজ। এটা আল্লাহর গোলামের পরিচায়ক। সালাত আদায় ব্যতীত মুসলমান হওয়া যায় না। কারণ আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, মুসলমান এবং কাফিরের মধ্যে পার্থক্য হল সালাত। সালাতের হেফাজতকারীরাই দ্বীন ইসলামের হেফাজতকারী। সালাত জান্নাত লাভের উপায়, জান্নাতের চাবি, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়, মাগফিরাতের উপায়, কিয়ামতের দিন সালাত হিসাব নেয়া ছাড়া আদম সন্তানকে এক পাও নড়তে দেয়া হবে না, দ্বীন ইসলামে সালাতের অশেষ গুরুত্ব ও ফজীলত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) জামায়াতে সালাত আদায়ের জন্য বেশি বেশি তাগিদ দিয়েছেন।
আল্লাহপাক কোরআনে বিভিন্ন স্থানে এরশাদ করেছেন,
"যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামায কায়েম করে এবং যে রিজিক আমি দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।" (সূরা বাকারা-৩)
"তোমরা সালাত আদায় করো, যাকাত প্রদান করো এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো।" (সূরা বাকারা-৪৩)
"তোমরা সালাত আদায় করো, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করো।" (সূরা আহযাব-৩৩)
"আমি আপনাকে মনোনীত করেছি। অতএব ওহীর কথাগুলো কান পেতে শুনুন। নিশ্চয়ই আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। সুতরাং আমার ইবাদত করুন এবং আমার স্মরণে সালাত প্রতিষ্ঠা করুন।" (সূরা ত্বোয়াহা : ১৩-১৪)
সালাতের ব্যক্তিগত ও সামাজিক গুরত্ব :
১। সালাত ব্যক্তিতে পরিশুদ্ধ করে :
সালাতের গুরুত্ব উল্লেখ করতে গিয়ে রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, "তোমাদের কারো বাড়ীর সামনে যদি নদী থাকে এবং সে যদি ঐ নদীতে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে তাহলে তার শরীরে কোন ময়লা থাকতে পারে কি"? সাহাবাগণ বললেন, "তার শরীরে কোন ময়লাই থাকতে পারে না"। রাসূল (সা) বললেন, "পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের দৃষ্টান্তও তাই। এগুলোর দ্বারা আল্লাহ সকল পাপ মোচন করে দেন। (বুখারী ও মুসলিম, হযরত আবু হোরায়রা থেকে বর্ণিত)
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, "তোমাদের সব কাজের মধ্যে আমার নিকট সালাতের গুরুত্ব বেশি। যে ব্যক্তি সালাতের সংরক্ষণ করবে এবং করাবে সে তা দ্বীনের সংরক্ষণ করবে। আর যে ব্যক্তি সালাতকে ধ্বংস করবে সে অন্য সব জিনিস সবচেয়ে বেশি ধ্বংসকারী বলে প্রমাণিত হবে।" (মিশকাত, হযরত উমর ইবনে খাত্তাব থেকে বর্ণিত)
"যে ব্যক্তি সঠিকভাবে সালাত আদায় করবে কিয়ামতের দিন তার জন্য তৈরি হবে এক নূর (আলো), এক দলিল এবং মুক্তির মাধ্যম। যে ব্যক্তি সঠিকভাবে সালাত আদায় করবে না তার জন্য তৈরি হবে না নূর (আলো), দলিল এবং মুক্তির উপায়।" (মিশকাত, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস থেকে বর্ণিত)
২। সালাত ব্যক্তিকে সময়ানুবর্তিতা ও শিষ্টতা শিক্ষা দেয় :
সময়ানুবর্তিতা মানুষের জীবনকে সুন্দর করে তোলে। আল্ কোরআনে এরশাদ হয়েছে, "নিশ্চয়ই মু'মিনদের জন্যে সালাত লিখে (ফরয) করে দেয়া হয়েছে, সময় ও নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে।" (সূরা আন্ নিসা-১০৩)
আরো এরশাদ হয়েছে, "সালাত সংরক্ষণ কর বিশেষ করে মধ্যবর্তী সালাত এবং আল্লাহর সামনে শিষ্টাচার ও আত্নসমর্পণের মূর্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়াও।" (সূরা বাকারা-২৩৮)
সঠিক সময়ে সালাত আদায় করাকে রাসূল (সা) সর্বোত্তম আমল বলে ঘোষণা করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা) বলেন, আমি নবীজী (সা)কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, সর্বোত্তম আমল কোনটি? নবীজী (সা) বললেন, সঠিক সময়ে সালাত আদায় করা। তারপর কোনটি? পিতামাতার সেবা করা। তারপর কোনটি? আল্লাহর পথে জিহাদ করা।" (বুখারী) বারবার জামাআ'তে সালাত আদায়ের ফলে সময়ের একটি অভ্যাস গড়ে উঠে। ঠিকমত অযু, মসজিদে যাওয়া, ইমামের আনুগত্য করার ফলে একটা সুশৃংখল মানসিকতা তৈরী হয়।
৩। সালাত ব্যক্তিকে বিনয়ী করে :
বিনয় এমন এক গুণ যা দেখে কেউ হিংসা করতে পারে না। ব্যক্তিগত জীবনে সালাত আদায়কারীরা অনেক উদার, সহনশীল এবং সংযত। এরশাদ হয়েছে, "নিশ্চিত সফল হয়েছে সেসব মু'মিন, যারা তাদের সালাতে বিনয় ও একাগ্রতা অবলম্বন করে।" (সূরা আল্ মু'মিনুন : ১-২)
৪। সালাত অশ্লীলতা ও অন্যায় থেকে বিরত রাখে :
সালাতের প্রভাবে ব্যক্তির জীবনে আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়, যার প্রতিফলন ঘটে সমাজ জীবনেও। এরশাদ হচ্ছে, " নিশ্চয়ই সালাত মানুষকে পাপাচার ও অন্যায় থেকে বিরত রাখে।" (সূরা আনকাবুত-৪৫)
৫। সালাত মানুষকে ধৈর্য শিক্ষা দেয় :
কথায় বলে-ধৈর্যই ধর্ম। এরশাদ হচ্ছে, "হে ঈমানদারগণ! তোমরা সবর এবং সালাতের দ্বারা সাহায্য গ্রহণ করো, আল্লাহ সবর কারীদের ভালবাসেন।" (সূরা বাকারা-১৫৩)
৬। সালাত আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্তির উপায় :
সালাতের মাধ্যমে মানুষ তাঁর প্রভুকে চিনে এবং সাথে সাথে একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে। এরশাদ হয়েছে, "আর আল্লাহকে সিজদা কর এবং তাঁর নিকটবর্তী হয়ে যাও।" (সূরা আলাক-১৯)
"বান্দা যখন সিজদায় থাকে, তখন সে তার প্রভুর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়।" (মুসলিম)
সালাতে আল্লাহর সাথে সঙ্গোপনে কথা বলা হয়। "অবশ্য অবশ্যই তোমাদের কেউ যখন সালাত আদায় করে তখন সে তার প্রভুর সাথে কথা বলে।"(বুখারী)
৬। সালাতের মাধ্যমে মানুষের প্রকৃত রবের স্বীকৃতি দেয়া হয় :
সালাতে সূরা ফাতিহা আমরা দিনে অনেকবার তেলাওয়াত করি। এ ছাড়া 'সুবহানা রাব্বিয়াল আ'লা এবং সুবহানা রাব্বিয়াল আ'যিম' বলার মাধ্যমেও কয়েকশবার আল্লাহকে রবের স্বীকৃতি দেয়া হয়। অর্থাৎ আল্লাহই একমাত্র আমাদের রব। আল্লাহকে রব বলে স্বীকার করার অর্থ জীবনের কোন ক্ষেত্রে আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম মানব না। মসজিদ থেকে বেরিয়ে সকল প্রতিষ্ঠানে, তা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক যাই হোক না কেন?
৭। সালাত বংশ, গোত্র, উঁচু-নীচু ও সকল অহংকার, ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দেয় :
সালাতে যখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাতার বেঁধে দাঁড়ায়, তখন কে আমীর ক ফকির, কে রাষ্ট্রপতি, কে মজুর তার মধ্যে কোন প্রভেদ থাকে না। মূলত, ইসলাম এভাবে সাম্যনীতিকে তুলে ধরেছে। যা অন্য কোন ধর্মে নেই। এখানে নেই কোন বর্ণ প্রথা-সাদা-কালোর ব্যবধান। সবাই সমান, ইন্না আকরামাকুম ইনদাল্লাহে আতকাকুম। "তোমাদের মধ্যে সেই অধিক মর্যাদাবান, যে অধিক ভয় করে আল্লাহকে।" সালাতের মাধ্যমেই এর প্রমাণ মিলে।
সালাত রাজনৈতিক গুরুত্ব (রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব):
সালাত প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আল্ কোরআনের ঘোষণা, "যখন আমি জমিনে তাদেরকে ক্ষমতা দান করি (কোন দেশে ক্ষমতাসীন হয়) তারা চারটি কাজ সম্পাদন করে। সালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করে, সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎকাজ থেকে মানুষকে বিরত থাকে।" (সূরা হজ্ব-৪১) আহলে বুঝা যাচ্ছে যে, সালাত কোন ব্যক্তিগত বিষয় নয়। কেউ কেউ বলেন, ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা যে চরম অসত্য যার প্রমাণ উপরোক্ত আয়াত। কোন দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তাদের প্রথম কাজ হবে সালাত প্রতিষ্ঠা করা। হযরত উমর খেলাফতে অধিষ্ঠিত হবার পর সরকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে লিখিত নির্দেশনামায় বলেছেন, "আমার কাছে তোমাদের যাবতীয় বিষয়ের মধ্যে সালাত সবচেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে ব্যক্তি সালাতের রক্ষণাবেক্ষণ করলো এবং তার পুরোপুরি হক আদায় করলো, সে তার গোটা দ্বীনকে রক্ষণাবেক্ষণ করলো, আর যে ব্যক্তি তার সালাত নষ্ট করলো, সে অবশিষ্ট সবকিছুই আরো নষ্ট করে ফেলবে।" (মালেক)
আসলে সালাতের মাধ্যমে রাষ্ট্রগঠন, রাষ্ট্রপরিচালনার সকল উপাদান আছে। একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য মূল যে চারটি উপাদান প্রয়োজন তা হল: একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, নির্বাচিত প্রতিনিধি ও সার্বভৌমত্ব। সালাতে সেই চারটি উপাদান নিবদ্ধ রয়েছে। মনে করুন, মসজিদকে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, মুসল্লীদের জনসমষ্টি, মসজিদ পরিচালনা কমিটিকে সরকার এবং মসজিদের জন্য জমি বা স্থান দানকারীর যেমনি ভাবে মালিকানা বাতিল হয়ে যায় এবং সবার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায় তেমনি সার্বভৌমত্ব। তাহলে সালাতের মাধমে কিভাবে দেশ পরিচালনা করা হবে তার শিক্ষা রয়েছে। সুতরাং সালাত ব্যক্তিগত বিষয় হতে পারে না এটা রাষ্ট্রের ব্যাপার, সরকারের ব্যাপার। এর মাধ্যমেই আল্লাহর ভয় ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়, অপরাধ প্রবণতা তিরোহিত হয়ে যায়, সমাজ হয় পাপ পঙ্কিলতা মুক্ত,সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত।
জামাআ'তে সালাতের গুরুত্ব :
ইকামাতে সালাত মানে সালাত কায়েম বা প্রতিষ্ঠা। কোরআন-হাদীসের কোথাও সালাত পড়ো একথা বলা হয়নি। সালাম প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। তাই জামাআ'তে সালাতের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। এরশাদ হয়েছে, "হে নবী! যখন আপনি তাদের (মুসলমানদের) সাথে থাকবেন তখন আপনার নেতৃত্বে তাদের সালাত পড়িয়ে দেবেন।" (সূরা নিসা-১০২) "একাকী সালাত আদায় করার চেয়ে জামাআ'তে সালাত আদায় করার সওয়াব সাতাশ গুণ বেশি।" (বুখারী ও মুসলিম, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে বর্ণিত) "যে ব্যক্তি আযান শুনে ওজর ব্যতীত মসজিদে না গিয়ে একাকী সালাত আদায় করে তার এ সালাত কবুল করা হবে না।" লোকেরা বললো, "ওজর কি?" তিনি বললেন, "ভয় ও রোগ।" (আবু দাউদ, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত, "আমরা সালাতের জামাআ'তে অনুপস্থিত ব্যক্তিকে মুনাফিক অথবা রোগী ছাড়া আর কিছু ভাবতাম না।" (বুখারী) রাসূল বলেছেন, তিন ব্যক্তিকে আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন। (১) যে ব্যক্তি জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নেতা হয়। (২) যে নারীর ওপর স্বামী অসন্তুষ্ট অবস্থায় রাত অতিবাহিত হয়ে যায়। (৩) যে আযান শুনেও জামাআ'তে যায় না। বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে আরো আছে, "আমার ইচ্ছা হয়, সালাতের জামাআ'ত অনুষ্ঠিত হোক, তাতে আমি একজন ইমাম নিয়োগ করি। অতঃপর শুকনো কাঠ বহনকারী একদল লোক সাথে নিয়ে যারা জামাআ'তে আসেনি তাদের বাড়ীতে গিয়ে আগুন লাগিয়ে দিই।" (যদি বৃদ্ধ, অসুস্থ ও শিশু না থাকলে তাই করতেন বলে অন্য বর্ণনায় আছে)
=====
বিষয়: সাহিত্য
৩৫০৬ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মনে হল যেন পরিপূর্ন একটি লিখা পড়লাম। মাশাআল্লাহ্। আল্লাহ আপনাকে উপযুক্ত পুরুষ্কারে পুরুষ্কৃত করুন এবং আমাদের জন্য জামায়াতে সালাত আদায় করা - সহজ করে দিন।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন