নিবন্ধ-৫ : মি’রাজের শিক্ষা এবং ইসলামী রাষ্ট্রের চৌদ্দ দফা রূপকল্প (vision)
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১৬ মে, ২০১৫, ১২:৩২:৩৯ দুপুর
মদীনায় হিজরতের এক বছর পূর্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মি’রাজ সম্পন্ন হয়েছিল। এটা স্বপ্নে হোক বা সশরীরে হোক। এখানে সংশয়বাদীরা ছাড়া সকলেই সশরীরে মি’রাজের ঘটনা বিশ্বাস করেন। আল্ কোরআনের সূরা ইস্রা বা বনী ইসরাইলের ১ নং আয়াতে এবং সূরা আন্ নজমের ৬ নং ১৩ থেকে ১৮ নং আয়াতের মি’রাজের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। আয়াতগুলোর শাব্দিক অর্থ সরলভাবে বুঝার চেষ্টা করলে সশরীরে মি’রাজের ব্যাপারে সন্দেহ থাকে না। আল্লাহপাক কোরআনুল করীমে এরশাদ করেছেন, “পরম পবিত্র ও মহামহিম সত্তা তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে (মোহাম্মদ সা.কে) নৈশকালে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি। যাতে আমি তাঁকে কুদরতের নিদর্শনসমূহ দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা বনী ইসরাইল-১) আরো এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয়ই তিনি (মোহাম্মদ সা.কে) তাঁকে হযরত জিবরাইল(আ)কে আরেকবার দেখেছিলেন সিদরাতুল মুনতাহার কাছে। যার কাছে অবস্থিত জান্নাত। যখন বৃক্ষটি দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার তদ্ধারা আচ্ছন্ন ছিল। তাঁর দৃষ্টিবিভ্রম হয়নি এবং সীমালঙ্ঘনও হয়নি। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছেন।” (সূরা আন্ নাজম ঃ ১৩-১৮) ইস্রা মানে নৈশভ্রমণ, রাসূলকে রাত্রিকালে ভ্রমণ করিয়েছেন স্বপ্নে নয় বাস্তবে। আর মি’রাজ শব্দের অর্থ উর্ধ্বগমন বা মহাকাশ ভ্রমণ। যাতে তিনি কুদরতের নিদর্শনসমূহ দেখতে পারেন। এখানে কোরআনের আয়াত থেকে সশরীরে মি’রাজের কথাই প্রমাণিত হয়, যেহেতু কালামে রব্বানীর সকল কথাই আল্লাহর ওহী। তাই কোন আয়াতের প্রতিও সন্দেহ করা যাবে না। অনেক জলিলুল কদর সাহাবীর মি’রাজের ঘটনার হাদীস বর্ণনা করেছেন। তন্মেধ্যে হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা), হযরত আবু হোরায়রা (রা), হযরত আবুযর গিফারী (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা), হযরত আলী (রা), হযরত আয়েশা (রা), হযরত আবু সাঈদ খুদরী(রা) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) প্রমুখ অন্যতম। সীরাত এবং হাদীস গ্রন্থসমূহেও এ ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
হাদীসে রাসূলে মি’রাজ :
বুখারী শরীফের ‘কিতাবুস সালাত’ অধ্যায়ে মি’রাজের ঘটনার বর্ণনা আছে। হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা) বলেন, হযরত আবু যর বর্ণনা করতেন, রাসূলুল্লাহ (সা)বলেছেন, মক্কায় থাকাকালীন এক রাতে আমার ঘরের ছাদ বিদীর্ণ করা হলো এবং হযরত জিবরাইল (আ) অবতরণ করে আমার বক্ষ বিদীর্ণ করলেন। তারপর তা যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করলেন। অতঃপর জ্ঞান ও ঈমানে পরিপূর্ণ একটি স্বর্ণ পাত্র এনে আমার বক্ষে ঢেলে দিলেন। তারপর তা বন্ধ করলেন। তারপর তিনি আমার হাত ধরে আকাশের দিকে নিয়ে গেলেন। যখন আমি নিকটবর্তী আকাশে উপনীত হলাম, তখন হযরত জিবরাইল(আ)আকাশের দ্বার রক্ষীকে বললেন, দরজা খোল। সে বললো, কে? হযরত জিবরাইল(আ) বললেন, আমি। সে বললো, আপনার সাথে কেউ আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমার সাথে মোহাম্মদ (সা)। সে পুনরায় বললো, তাঁকে কি ডাকা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তারপর আমরা নিকটবর্তী আকাশে আরোহন করে দেখি, সেখানে একজন লোক বসে আছে এবং তার ডান ও বাম পাশে অনেকগুলো লোক। সে ডান দিকে তাকালে হাসে এবং বাম দিকে তাকালে কাঁদে। সে বললো, খোশ আমদেদ, হে পূণ্যবান নবী! হে পূণ্যবান সন্তান! আমি হযরত জিবরাইল(আ)কে জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? তিনি জবাব দিলেন, হযরত আদম আলাইহিস সালাম। ডানে এবং বামে এগুলো তাঁর সন্তানের আতœা। ডান দিকের গুলো জান্নাতী এবং বাম দিকের গুলো জাহান্নামী। এ জন্য তিনি যখন ডান দিকে তাকান হাসেন এবং যখন বাম দিকে তাকান কাঁেদন। তারপর তিনি আমাকে নিয়ে দ্বিতীয় আকাশে আরোহন করলেন এবং দ্বাররক্ষীকে বললেন, দরজা খোল। সে তাকে প্রথম দ্বাররক্ষীর ন্যায় জিজ্ঞাসা করলো। তারপর দরজা খুললো।
মতান্তরে হযরত আনাস (রা) বলেন, তিনি (হযরত আবু যর) বলেছেন, নবী (সা) আকাশসমূহে হযরত আদম (আ), হযরত মুসা (আ), হযরত ঈসা (আ) ও হযরত ইবরাহীম (আ)এর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। কিন্তু তিনি (আবু যর) তাঁদের নির্দিষ্ট অবস্থানের কথা বলেননি। শুধু এতটুকু বর্ণনা করেছেন, নবী (সা) হযরত আদম (আ)কে নিকটবর্তী আকাশে ও হযরত ইবরাহীম (আ)কে ষষ্ঠ আকাশে দেখেছিলেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, হযরত জিবরাইল(আ) নবী (সা)কে নিয়ে হযরত ইদরীস (আ)এর নিকট পৌঁছলে তিনি বললেন, খোশ আমদেদ, হে পূণ্যবান নবী! হে পূণ্যবান ভ্রাতা! আমি বললাম, ইনি কে? তিনি জানালেন, হযরত ইদরীস (আ)। তারপর হযরত মুসা (আ)এর নিকট গেলাম। তিনি বললেন, খোশ আমদেদ, হে পূণ্যবান নবী! হে পূণ্যবান ভ্রাতা! আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কে? তিনি জানালেন, হযরত মুসা (আ)। তারপর হযরত ঈসা (আ)এর নিকট গেলাম। তিনি বললেন, খোশ আমদেদ, হে পূণ্যবান নবী! হে পূণ্যবান ভ্রাতা! আমি বললাম, ইনি কে? তিনি জানালেন, হযরত ঈসা (আ)। তরপর হযরত ইবরাহীম (আ)এর নিকট গেলাম। তিনি বললেন, খোশ আমদেদ, হে পূণ্যবান নবী! হে পূণ্যবান সন্তান! আমি প্রশ্ন করলাম, ইনি কে? তিনি বললেন, হযরত ইবরাহীম (আ)। মতান্তরে ইবনে আব্বাস (রা) ও আবু হাব্বা আনসারী (রা) বলতেন, নবী (সা) বলেছেন, তারপর আমাকে উর্ধ্বে আরোহন করানো হলো এবং আমি এমন এক সমতল ভূমিতে পৌঁছলাম যেখানে কলমের ঘচ ঘচ শব্দ শোনা যেতে লাগল। মতান্তরে হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা) বলেন, নবী (সা) মহামহিম আল্লাহ আপনার উম্মতের ওপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। ফেরার সময় আমি হযরত মুসা (আ)এর নিকট পৌঁছলে, তিনি বলেন, আপনার উম্মতের ওপর আল্লাহ কি ফরয করেছেন? আমি জানালাম পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত। তিনি বললেন, আপনার রবের নিকট ফিরে যান। কেননা আপনার উম্মত এত সালাত আদায় করতে সক্ষম হবে না। আমি ফিরে গেলাম। আল্লাহ কিছু অংশ কম করে দিলেন। তারপর আবার মুসা (আ)এর নিকট ফিরে এসে বললাম, কিছু কম করে দিয়েছেন। তিনি পুনরায় বললেন, আবার যান। কেননা আপনার উম্মত তা আদায় করতে পারবে না। আকি আবার ফিরে গেলাম। আল্লাহ আবার কিছু মাফ করে দিলেন। আমি আবার তার নিকট ফিরে আসলে তিনি বললেন আবার যান। কেননা আপনার উম্মত এও আদায় করতে সক্ষম হবে না। আমি আবার গেলাম। আল্লাহ বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত এটিই (আসলে সওয়াবের দিক থেকে) পঞ্চাশ (ওয়াক্তের সমান!) আমার কথার পরিবর্তন হয় না। আমি আবার মুসার নিকট আসলে তিনি আবার বললেন, আবার ফিরে যান। আমি বললাম, আমার যেতে লজ্জা লাগছে। তারপর আমাকে ‘সিদরাতুল মুনতাহায়’ নিয়ে যাওয়া হলো। তা রঙে ঢাকা ছিল। আমি জানি না তা কি? অবশেষে আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হলো। আমি দেখি সেখানে মুক্তার হার এবং সেখানকার মাটি কস্তুরী।
( হাদীস নং-৩৩৬)
রাসূল (সা)এর যখন এই ঘটনাকে (মি’রাজকে) জনসমক্ষে প্রচার করল, অবিশ্বাস্য প্রতিপন্ন করল কাফেররা। আবু জেহেল বলেই ফেলল, কি মোহাম্মদ! আবার কি অদ্ভুত খবর নিয়ে এলে? কোরআনের ভাষায়, “ইন্না হাযা সিহরুম মুবিন’’ নিশ্চয়ই এটা সুস্পষ্ট যাদু। কিছু কিছু মুসলমানের ঈমানের ভিতও নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। কারণ তারা বিশ্বাস করতে পারছিল না রাসূলের মি’রাজ কি স্বপ্নযোগে হয়েছে না সশরীরে?
রাসূল (সা)এর মি’রাজ স্বপ্নে, আধ্যাতিœকভাবে না সশরীরে হয়েছিল?
এ নিয়ে কারো মধ্যে সন্দেহ-সংশয় থাকলেও মুসলমানদের মধ্যে থাকা ঠিক নয়। কোরআনে বর্ণিত আয়াতগুলো অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে চাইলে মি’রাজ যে সশরীরে হয়েছে তা দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে যাবে। সূরা বনী ইসরাইলের আয়াতে বলা হয়েছে, “যিনি তাঁর বান্দাকে (মোহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নৈশকালে ভ্রমণ করিয়েছেন’’ এবং মি’রাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, “যাতে আমি তাঁকে কুদরতের নিদর্শন সমূহকে দেখিয়ে দিই।’’ আবার সূরা আন্ নজমের আয়াতে বলা হয়েছে, “এবং তিনি (রাসূল সা.) সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছলেন, তারপর আল্লাহর নিকটবর্তী হলেন, এমন কি দু’ধনুকের জ্যা অথবা তার চেয়ে কাছে”। আবার বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই তিনি (মোহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে হযরত জিবরাইল (আ)কে আরেক বার দেখেছিলেন সিদরাতুল মুনতাহার কাছে।” সূরা বনী ইসরাইলের আয়াতে কারীমার প্রথমেই ‘সুবহানাল্লাজি আসরা’ দিয়ে শুরু হয়েছে। যার অর্থ পবিত্র ও মহামহিম সেই সত্তা, যাতে কেউ হীনমন্যতা, সংকীর্ণতা ও সংশয়ে না ভুগেন এবং এই ঘটনাকে ও অসম্ভব মনে না করেন। কারণ তিনি তো সকল প্রকার দুর্বলতা, অপারগতা ও অক্ষমতা থেকে মুক্ত। একজন প্রকৃত মুসলমানের জন্য উল্লেখিত আয়াতগুলোই সশরীরে মি’রাজ হয়েছে বলে বিশ্বাস করার জন্য যথেষ্ট।্ মি’রাজ যদি স্বপ্নে ঘটত তাহলে তিনি সাহাবীদের বলতে পারতেন গতরাতে আমি এরকম একটি স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু তিনি তা বলেন নি। অতএব আমাদের ঈমান বলে যে, সশরীরে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছে আল্লাহর রাসূল (সা)এর। তাফসীরে ইবনে কাছীর, তাফসীরে কুরতুবী, ফতহুল বারী প্রভৃতি জগদ্বিখ্যাত কিতাবে মি’রাজ সশরীরে হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইমাম ইবনে কাছীর তাঁর তাফসীরে ২৫জন সাহাবীর নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “ইস্রার হাদীস সম্পর্কে যাদের কাছ থেকে এসব রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে, তাঁদের সম্পর্কে সকল মুসলমানের ঐক্যমত রয়েছে। শুধু ধর্মদ্রোহী জিন্দিকরা এটা অস্বীকার করে থাকে”। বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘ফতহুল বারী’তে আল্লামা ইবনে হাজার আস্কালানী বলেন, “বিশিষ্ট ওলামায়ে কেরামের অভিমত, নবী করিম (সা)এর ইস্রা ও মি’রাজ নিঃসন্দেহে নবুওয়াত প্রাপ্তির পর জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে একই রাত্রে সংঘটিত হয়েছে। এ হাদীসটি প্রসঙ্গেক্রমে প্রণিধধানযোগ্য। হযরত আবু যর গিফারী (রা) বলেছেন, আমি নবী (সা)কে জিজ্ঞেস করেছিলাম (মি’রাজের সময়) তিনি আল্লাহকে দেখেছিলেন কিনা? জবাবে তিনি বললেন, আমি তাঁকে (আল্লাহকে) নুররূপে দেখেছি। তাঁকে (আল্লাহর সত্তাকে) কিভাবে দেখবো? (মুসনাদে আহমাদ) সুতরাং মি’রাজ যে সশরীরে সংঘটিত হয়েছে এতে কোন সন্দেহ-সংশয় থাকলে ঈমান থাকবে না।
মি’রাজ বিজ্ঞানের বিস্ময়!
আজকের বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রার পেছনে মি’রাজই অনুপ্রেরণার উৎস। অনেকের ভাবনা বিজ্ঞানের আলোকে সম্ভব কিনা মি’রাজ? তাও গবেষণা-ব্যাখ্যায় সম্ভব বলে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ সব বিজ্ঞানের বড় বিজ্ঞান তো মহাগ্রন্থ আল্ কোরআন। কোরআন বলছে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছে এবং তা সশরীরে। তারপরও বিজ্ঞানের আলোকে সংক্ষেপে আলোচনা করা যায়। মি’রাজের সময় রাসূল (সা)এর বাহন ছিল বোরাক এবং রফরফ। এ দু’টি ছিল মূলত নভোযান। বোরাক শব্দটি এসেছে বার্ক শব্দ থেকে। বার্ক অর্থ হল বিদ্যুত। বোরাক ছিল একটি বৈদ্যুতিক দ্রুতগতি সম্পন্ন যান। আকাশে বিদ্যুতের চমক আমরা দেখি, মুহুর্তেই মিলিয়ে যায়। আমরা জানি আলোর গতি প্রতি সেকেণ্ড ১,৮৬, ০০০(এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার) মাইল। বোরাকের গতি ছিল রকেটের গতির চেয়েও বেশী। আমাদের মহানবী (সা)এর দেহ ছিল আল্লাহর খাস কুদরতি পোশাকে আচ্ছন্ন। গ্রহ-নক্ষত্র অতিক্রম করে নবী করিম (সা) নক্ষত্র-জগতের শেষ প্রান্তে সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছেন। সেখানে বাহন পরিবর্তন করেন, যার নাম রফরফ। এর গতি আলোর গতির চেয়ে লক্ষ লক্ষ গুণ বেশী।
আমরা আমাদের ঈমানের বলেই মি’রাজকে বিশ্বাস করি। কাফের, মুশরিক, নাস্তিক্যবাদীরা তা স্বীকার করতে চান না। তাদের যুক্তি জড় জগতের মানুষের মহাকাশের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভেদ করতে পারবে না। কারণ শূন্যে অবস্থিত কোন স্থূল বস্তুকে পৃথিবী সর্বদাই নিুদিকে আকর্ষণ করে থাকে। মাত্র ১২০০ মাইল উপরে উঠলেই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অতিক্রম করা যায়। তবে ঘন্টায় যদি ২৫,০০০ মাইল বেগে উর্ধ্বে উঠা যায় তবে এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অতিক্রম করা সম্ভব হয়। অথচ মহানবী (সা)এর বাহন বোরাকের গতিবেগ এর চেয়ে অনেক বেশী ছিল। আজ সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে মি’রাজের ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে। টেলিগ্রাম, টেলিফোন, রেডিও, টেলিভিশন, রকেট, বিভিন্ন নভোযান ইত্যাদি যার মধ্যে অন্যতম। বিজ্ঞানের বিস্ময় হলেও তা আল্লাহরই কুদরতে সম্পন্ন হয়েছে। এতে বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু নেই এবং বিজ্ঞানের জন্য মি’রাজ একটি মাইলফলক বটে।
ইসলামী রাষ্ট্রের চৌদ্দ দফা রূপকল্প :
মি’রাজের অন্যতম উপহার হচ্ছে রাসূল (সা) আনিত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বিশেষ রূপকল্প। সূরা বনী ইসরাইলের ২য় ও ৩য় রুকুতে ধারাবাহিকভাবে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের ১৪ দফা মূলনীতি ঘোষণা হয়েছে। মক্কী যুগের শেষ লগ্নে এবং মাদানী যুগের পূর্বে মি’রাজ আল্লাহতাআ’লার এক সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা ছিল, যাতে মদীনা একটি নতুন ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে। আল্ কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, “তোমার রব ফায়সালা করে দিয়েছেন যে, তোমরা কারো ইবাদত করো না, একমাত্র তারঁই ইবাদত করো। পিতামাতার মাথে ভাল ব্যবহার করো। যদি তোমাদের কাছে তাদের কোন একজন বা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় থাকে, তাহলে তাদেরকে ‘উহ্’ পর্যন্তও বলো না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিয়ো না বরং তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে কথা বলো। আর দয়া ও কোমলতা সহকারে তাদের সামনে বিনম্র থাকো এবং দোয়া করতে থাকো এই বলে ঃ হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন। তোমাদের রব খুব ভাল করেই জানেন তোমাদের মনে কি আছে। যদি তোমরা সৎকর্মশীল হয়ে জীবন যাপন করো, তাহলে তিনি এমন লোকদের প্রতি ক্ষমাশীল যারা নিজেদের ভুলের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে বন্দেগীর নীতি অবলম্বন কারা দিকে ফিরে আসে। আতœীয়কে তার অধিকার দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরকের তাদের অধিকার দাও। বাজে খরচ করো না। যারা বাজে খরচ করে তারা শয়তানের ভাই, আর শয়তান তার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ। যদি তাদের থেকে (অর্থাৎ অভাবী, আতœীয়-স্বজন, মিসকীন ও মুসাফির) তোমাকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয় এ জন্য যে, এখনো তুমি আল্লাহর প্রত্যাশিত রহমতের সন্ধান করে ফিরছো, তাহলে তাদেরকে নরম জবাব দাও। নিজের হাত গলায় বেঁেধ রেখো না এবং তাকে একেবারে খোলাও ছেড়ে দিয়ো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অক্ষম হয়ে যাবে। তোমার রব যার জন্য চান রিযিক প্রশস্ত করে দেন আবার যার জন্য চান সংকীর্ণ করে দেন। তিনি নিজের বান্দাদের অবস্থা জানেন এবং তাদেরকে দেখছেন। দারিদ্র্যের আশংকা নিজেদের সন্তান হত্যা করো না। আমি তাদেরকেও রিযিক দেবো এবং তোমাদেরকেও। আসলে তাদেরকে হত্যা করা একটি মহাপাপ। যিনার কাছেও যেয়ো না, ওটা অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য পথ। আল্লাহ যাকে হত্যা করা হারাম করে দিয়েছেন, সত্য ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করো না। আর যে ব্যক্তি মজলুম অবস্থায় নিহত হয়েছে তার অভিভাবককে আমি কিসাস দাবী করার অধিকার প্রদান করেছি। কাজেই হত্যার ব্যাপারে তার সীমা অতিক্রম করা উচিত নয়, তাকে সাহায্য করা হবে। এতিমের সম্পত্তির ধারে কাছে যেয়ো না, তবে হ্যাঁ সদুপায়ে, যে পর্যন্ত না সে বয়োপ্রাপ্ত হয়ে যায়। প্রতিশ্র“তি পালন করো, অবশ্যই প্রতিশ্র“তির ব্যাপারে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে। মেপে দেবার সময় পরিমাপ পাত্র ভরে দাও এবং ওজন করে দেবার সময় সঠিক দাঁিড়পাল্লায় ওজন করো। এটিই ভাল পদ্ধতি এবং পরিণামে উৎকষ্টতর। এমন কোন জিনিসের পেছনে লেগে যেয়ো না যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই। নিশ্চিতভাবেই চোখ, কান ও দিল্ সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। জমিনে দম্ভভরে চলো না। তুমি না জমিনকে চিরে ফেলতে পারবে, না পাহাড়ের উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারবে। (আয়াত : ২৩Ñ৩৭)
সংক্ষেপে ১৪ দফাগুলো নিুরূপ :
১। মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর ইবাদত করা।
২। পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ ও তাদের সেবা-শুশ্র“ষা করা।
৩। নিকটাতœীয় এবং অসহায় দরিদ্র লোকদের প্রতি যথাযথ কর্তব্য পালন করা।
৪। ধন-সম্পদ অপচয় না করা।
৫। মিতব্যয়ী হওয়া।
৬। ব্যয়ে ভারসাম্যমূলক পন্থা অবলম্বন ও আল্লাহর দেওয়া রিযক ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম সংকট তৈরী না করা।
৭। দারিদ্র্যের কারণে সন্তান হত্যা না করা।
৮। ব্যভিচারের পথে না যাওয়া।
৯। আল্লাহর নির্ধারিত বিধির বাইরে মানুষ হত্যা না করা।
১০। বয়োপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ইয়াতীমের সম্পত্তির হেফাজত করা।
১১। ওয়াদা বা প্রতিশ্র“তি পালন করা।
১২। ওজনে কম না দেওয়া।
১৩। না জেনে অসম্ভবের পেছনে লেগে না থাকা।
১৪। আল্লাহর জমিনে দাম্ভিকের মত না চলা।
মি’রাজের শিক্ষা :
রাসূল (সা)এর মি’রাজ থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা বেশী বেশী করা। আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য জানার চেষ্টা করা। চন্দ্র অভিযানের যাত্রীদের নভোচারী বলা হয়। অথচ আল্লাহর রাসূল (সা)ই ছিলেন বিশ্বের প্রথম নভোচারী। ইসলামী রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালনা করতে তার শিক্ষাও আছে মি’রাজে। রাসূল প্রতীকীভাবে জান্নাত-জাহান্নাম অবলোকন করেছেন। আমরা আমলে সালেহ করে জান্নাত যাওয়ার এবং জাহান্নামে পতিত না হওয়ার পথ পরিহার করতে পারি।
সূত্র : রাসূল (সা) আমার ভালবাসা(২০১১)-মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম
=====
বিষয়: সাহিত্য
১৫৭৮ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মিরাজ সশরিরে না হলে সিনা চাক এর বিষয়টি আসার প্রয়োজন ছিলনা।
বিজ্ঞানের escape velocity মিরাজ কে প্রমান করার জন্য যথেষ্ঠ। কথা হল তারা বিজ্ঞান বুঝ কি না এবং মানে কিনা ?
রেফারেন্সের আলোকে আপনার তথ্যবহুল পোস্টটি পড়ে উপকৃত হলাম! শুকরিয়া!
মিরাজ দিবস ভিত্তিক পালন বা উদযাপনের কোন বিষয় নয় বরং এর আনীত শিক্ষাগুলো মুসলিমদের বাস্তব জীবনে প্রতিনিয়ত পালনের বিষয়! আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দিন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন