প্রবন্ধ-২/১ : সিরাতুল মোস্তাকিম : জান্নাতের রোডম্যাপ (ধারাবাহিক পর্ব-১)

লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১৪ মে, ২০১৫, ০৭:২৪:০২ সন্ধ্যা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সিরাতুল মোস্তাকিম। মানে সরল পথ, সোজা পথ, ইসলামের পথ, আল্লাহ ও রাসূল (সা)প্রদর্শিত পথ, আম্বিয়ায়ে কেরামের পথ, আলোর পথ, হেদায়েতের পথ, মুক্তি ও সফলতার পথ, কল্যাণের পথ, যে পথ ভ্রষ্টতা ও গোমরাহীর নয় ইত্যাদি বলা যায়। যে পথে চললে আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়া যাবে, বিনিময়ে চির সুখের জান্নাত পাওয়া যাবে। আল্‌ কোরআনে বহু স্থানে সিরাতুল মোস্তাকিমের কথা বলা হয়েছে। এর পাশাপাশি "সাওয়াউস সাবীল" বলেও কিছু আয়াতে সিরাতুল মোস্তাকিমকে বুঝানো হয়েছে। যার অর্থ সরল-সোজা পথ।

মহাগ্রন্থ আল্‌ কোরআনের সূরা ফাতিহায় এরশাদ হয়েছে, "ইহদিনাস্‌ সিরাত্বাল মোস্তাকিম। সিরাত্বাল লাজিনা আনআ'মতা আলাইহিম, গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ্‌ দোয়াল্লীন।" অর্থাৎ আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করো। তাদের পথ, যাদের উপর তুমি অনুগ্রহ করেছো। তাদের পথ নয় (তোমাকে অস্বীকার করার কারণে) যাদের উপর তুমি অভিশাপ (গজব) দিয়েছো, যারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। (আয়াত : ৫-৭) হে আল্লাহ! আমাদের সোজা রাস্তা চিনিয়ে দাও। হে আল্লাহ! এ পথ চিনিয়ে দেয়ার পর তাতে অটল থাকার শক্তি দাও। কেননা পথ চেনা এবং সে পথে টিকে থাকা এ দু'টোই আল্লাহতায়ালার হেদায়াত ও রহমতের ফলশ্রুতি মাত্র। এ ব্যাপারে আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট হওয়া এই বিশ্বাসেরই অপরিহার্য পরিণাম যে, আল্লাহতায়ালাই সাহায্যকারী এবং তিনিই মদদগার।

সিরাতুল মোস্তাকিম সঠিক পথের দিশাই সেই মহান নেয়ামত যা পাওয়ার জন্যে মুমিন আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে। সিরাতুল মোস্তাকিমের দিকে পথ নির্দেশই দুনিয়া আখেরাতের সৌভাগ্য নিশ্চয়তা বিধানকারী বিষয়। কেননা সঠিক পথের হেদায়াত হচ্ছে সঠিক অর্থে মানবীয় প্রকৃতির সেই খোদায়ী অভীষ্টের দিকে ধাবিত হওয়া যা মানুষ ও এই সৃষ্টি জগতের প্রতিটি চলন-বলনকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দিকে এককভাবে নিবিষ্ট রাখা। আমাদের সেসব লোকদের রাস্তা দেখাও যাদের ওপর তুমি তোমার অনুগ্রহ নাযিল করেছো। ওদের পথে নয়, যারা রাস্তাঘাট চেনার পরও তা থেকে সরে যাওয়ার অপরাধে তাদের ওপর গজব নাযিল হয়েছে। তাদের রাস্তায়ও নয়, যারা নীতিগতভাবেই কখনো সঠিক পথ পায়নি। শুধু ঐসব হেদায়াত প্রাপ্ত লোকদের রাস্তা, যারা সঠিক পথ পেয়েছে এবং এর ওপর চলা অব্যাহত রেখেছে। ( তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন, ১ম খন্ড, সূরা ফাতিহার ব্যাখ্যা, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ) মানুষকে সিরাতুল মোস্তাকিমের পথে চলার জন্য আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস বা প্রতিদান দিবসের প্রতি বিশ্বাস অপরিহার্য। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রতিটি ব্যক্তি এ কথাটি জেনে না নেবে যে, এই বৈষয়িক দুনিয়া ছাড়াও আরেকটি জীবন আছে যার জন্যে তার চেষ্টা সংগ্রাম করা দরকার এবং তাকে সত্য ও কল্যাণের জন্যে ত্যাগ ও স্বার্থপরতার উর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে যেন আখেরাতের কল্যাণ সে লাভ করতে পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানবতা আল্লাহ প্রদর্শিত 'সিরাতুল মোস্তাকিমের' পথে ধাবিত হতে পারে না।

ইসলামী জীবন ব্যবস্থাই সিরাতুল মোস্তাকিমঃ

ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত সহজ-সরল একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহতায়ালা মানুষকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছে, তার যথার্থতা হাসিলের জন্য ইসলামকে সকল মানুষের জন্য নিয়ামত হিসাবে দান করেছেন।

"আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, আর তোমাদের ওপর আমার (প্রতিশ্রুত) নেয়ামতকেও আমি পরিপূর্ণ করে দিলাম, ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা হিসাবে মনোনীত করলাম।"(সূরা মায়েদা, আয়াত-৩) দুনিয়াতে যত মতবাদ আছে তা মানুষের তৈরী। মানুষ মরীচিকার পেছনে ছুটছে, যারা তা অনুসরণ করবে তাদের জীবন ব্যর্থ। ইসলামই আল্লাহর মনোনীত দ্বীন।

এরশাদ হচ্ছে, "ইন্নাদ দ্বীনা ইনদ্দাল্‌লাহিল ইসলাম।" নিশ্চয়ই ইসলামই আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দ্বীন বা জীবন বিধান। (সূরা আলে ইমরান-১৯)

আরো এরশাদ হচ্ছে, "কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। এবং সে হবে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অর্ন্তভুক্ত।" (সূরা আলে ইমরান-৮৫)

ইসলামের মতে মানুষের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এতো ঠুনকো নয় যে, মনগড়া কতিপয় দর্শন তৈরী করে তাকে পাল্টে ফেলা যাবে। মানুষেরা যখন আল্লাহর প্রদর্শিত 'সিরাতুল মোস্তাকিমে' কদম রাখে তখন মূলতঃ সে তার প্রতিভা ও যোগ্যতা অনুযায়ী আল্লাহর বিধি-নিষেধের ওপরই চলতে শুরু করে এবং আস্তে আস্তে আল্লাহর পথে সে অগ্রসর হতে থাকে। ইসলামের এই পথ দীর্ঘ তবে সহজ ও সরল। খোদাতায়ালা এটা চান না যে, মানবীয় প্রকৃতিকে পদদলিত করে তার ওপর আধ্যাত্নিক কর্মের বোঝা চাপিয়ে ইসলামের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হোক। মানুষের তৈরী নতুন মতবাদগুলো মানুষকে যন্ত্রের মধ্যে কেবল ফেলে দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আদর্শের বাস্তবায়ন দেখে নিতে চায়। এতে যদি দুনিয়ায় রক্তের নদী বয়ে যায়, মানুষের সামাজিক জীবন কাঠামো তছনছ হয়ে যায় কিংবা তার অতীত ইতিহাসের অর্জিত পাওনাগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তাতেও কিছু আসে যায় না। ইসলাম মানুষের প্রকৃতির কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক সাথে মিলেমিশে উন্নতির পথে কদম রাখতে চায়। দরকার মত তাকে পথ প্রদর্শন করে অগ্রসর হতে চায়। এই প্রকৃতি যখন কল্যাণের দিকে পা বাড়ায় তখন ইসলাম তাকে আশ্রয় দেয়। আবার যখন অকল্যাণের দিকে ধাবিত হয় তখন এই প্রবণতা তাকে বাঁচিয়ে রাখে। মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যদি আল্লাহর পথে 'সিরাতুল মোস্তাকিম' অনুযায়ী কাটে এবং হেদায়েতের পথে থাকে তাহলে মানুষের প্রতিটি কাজই আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর বন্দেগীর শামিল। তাই ইসলামী জীবনাদর্শ মানুষকে যেমনি প্রশান্তি, উন্নতি, স্থিরতা এবং সত্যনিষ্ঠ আস্থা প্রদান করে তা অন্য কোন জীবন দর্শনে পাওয়া সম্ভব নয়। (তাফসীর ফী যিলালিল কোরআনের ভুমিকা, ১ম খন্ড, সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ)

সিরাতুল মোস্তাকিম-জান্নাতের রোডম্যাপঃ

মানুষের আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা)এর উপর ঈমান আনার মধ্য দিয়ে ''সিরাতাল মোস্তাকিমে'' চলার পথ নির্দেশিকা পায়। আর আল্লাহর হুকুম পালন করতে করতে, অর্থাৎ আনুগত্যের মাধ্যমে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ হয়। যেহেতু মানুষ তাঁরই খলিফা-তাই খলিফার কাজ বা দায়িত্ব খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। খেলাফতের দায়িত্ব কিভাবে পালন করবে সে সম্পর্কে সুষ্পষ্ট দিক-নির্দেশনা আছে কালামে রব্বানীতে। কালামে রব্বানীই সরল পথের দিশা। তাই সিরাতাল মোস্তাকিম পাওয়ার শর্ত কোরআনকে বুকে ধারণ করে পথ চলা। এটা একজন মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চলার পাথেয় বা রোডম্যাপ। যে আলোকিত পথের শুরু জান্নাতের মশাল দিয়ে এবং জান্নাতে গিয়েই তার পরিসমাপ্তি ঘটে। যারা ঈমানের দাবীদার তারা কখনো এ রোডম্যাপের বাইরে অন্যকোন জীবন-দর্শন খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করে না। এ পথ থেকে দুরে সরে যাওয়া মানে আল্লাহর অবাধ্যতা বা কুফরী। ফলে পথভ্রষ্ট হয়ে শয়তানের চোরাবালিতে আটকে পড়ে। তাই আল্লাহপ্রদত্ত জান্নাতের এ রোডম্যাপ আল্‌ কোরআন ভিত্তিক জীবন পরিচালনাই মুমিনের ঈমানের অনিবার্য দাবী।

আল্‌ কোরআন সিরাতুল মোস্তাকিম প্রদর্শনকারী :

মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিই হচ্ছে সিরাতুল মোস্তাকিমের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। মানুষের পক্ষে সিরাতুল মোস্তাকিম রচনা করা এবং তা চেনা সম্ভব নয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই এর যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী এবং তিনিই তা রচনা করতে সক্ষম। নবী-রাসূলগণ প্রেরণ করার মাধ্যমেই তিনি তা সম্পাদন করেছেন। আল্‌ কোরআন মানুষের জন্য আল্লাহপ্রদত্ত হেদায়াত গ্রন্থ ও সঠিক পথপ্রদর্শনকারী। যারা কোরআন যথাযথভাবে অনুসরণ করে, এই কোরআন কত সুন্দর ও নির্ভুুল পথপ্রদর্শন করে তা তাদের ব্যবহারিক জীবনে প্রকাশ পায়। তাদের জীবনে ঘটে যায় এক ব্যাপক বিপ্লব। আল্‌ কোরআন তাদের জন্য পথপ্রদর্শক ও সুসংবাদ নিয়ে আসে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, "এই কোরআন ঈমানদারদের জন্য সঠিক পথের সন্ধান ও সাফল্যের সুসংবাদ নিয়ে এসেছে।" (সূরা বাকারা-৯৭) কোরআন অবতীর্ণ করে আল্লাহপাক তাঁর সৃষ্টিসমূহের পথপ্রদর্শনের কাজ সুসম্পন্ন করেছেন, যাতে মানুষ সঠিক পথ খুঁজে পায়। আল্লাহপাকই যদি তাঁর সৃষ্টিকে পথের দিশা না দেন তো কে এমন আছে যে তা করবে? কোন্‌টি আলোর পথ কোন্‌টি অন্ধকার পথ, কোন্‌ শান্তির পথ আর কোন্‌টি অশান্তির পথ-তা সঠিক ভাবে বলে দেয় আল্‌ কোরআন।

(চলবে..)

=======

বিষয়: সাহিত্য

১৭৮৩ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

320098
১৪ মে ২০১৫ রাত ১১:০৪
চাটিগাঁ থেকে বাহার লিখেছেন : সুন্দর পোষ্ট শেয়ার করার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ।
১৫ মে ২০১৫ রাত ০১:০৪
261212
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : আপনাকেও আন্তরিক ধন্যবাদ,বাহার ভাই।
320175
১৫ মে ২০১৫ সকাল ০৫:৫২
শেখের পোলা লিখেছেন : আল্লাহ আমাদের সেই সিরাতাল মুস্তাকিমের সন্ধান দাও৷ ধন্যবাদ৷
১৭ মে ২০১৫ বিকাল ০৪:২০
261638
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : আমিন। আপনাকেও ধন্যবাদ।
320812
১৮ মে ২০১৫ বিকাল ০৫:২৩
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : খুবই গুরত্বপূর্ণ বিষয়।
আল্লাহ আমাদেরকে সরল সঠিক পথে পরিচালিত করুন।
১৮ মে ২০১৫ রাত ০৮:৩৯
261997
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : ধন্যবাদ লোকমান ভাই। সিরাতাল মোস্তাকিম আর ২/৩ পর্ব চলবে।।
আল্লাহ আমাদের সরল পথে পরিচালিত করো । আমিন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File