নিবন্ধ- ৪ : ইসলাম ও বৈরাগ্যবাদ

লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১২ মে, ২০১৫, ০১:৩০:০০ দুপুর

আল্ল¬াহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে ইসলামের বাইরে গিয়ে নিজেদের খেয়াল খুশী মত কতিপয় ধর্ম, দল, গোষ্ঠী এবং ব্যক্তি বিপদগামী তথা পথভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছে। তারা আতিœক উন্নতির নামে লোকালয় ছেড়ে বনে-বাদাড়ে গিয়ে দিনাতিপাত করে বেড়ায়। সমাজ-সংসার, দুনিয়াদারীর প্রতি তাদের কোন ঝোঁক প্রবণতা নেই। তাদের দৈহিক অবস্থা দেখলে মনুষ্যপদবাচ্যকিনা সন্দেহ জাগে। যেন জঙ্গল থেকে আগত কোন মনুষ্য নামের ইতর প্রাণী। ইয়া লম্বা দাঁড়ি, লম্বা চুল, গোঁফ মুখ মণ্ডল দেখার কোন জো নেই। ছেঁড়া কাপড়-চোপড়, ঠিকমত কাপড়ের বালাইও থাকে না। নগ্ন পা, কোথাও বসে বিড়বিড় করে কি যেন বলে। হক মাওলা! লোকেরা ভাবে, বাবা এসেছে বাবা। এই বাবার সাথে বেয়াদবী করিস না! জ্বলে যাবি, ক্ষতি হবে। কয়েকদিন একস্থানে অবস্থান করে এলাকার অবস্থা বুঝার চেষ্টা করে। শয়তানও বসে থাকে না বাবার শিষ্য-চেলাচামুণ্ডার ব্যবস্থা হয়ে যায়। বসে মদ, উলঙ্গ নৃত্য-গীত আর গাঁজার আসর। ভণ্ডরা এর নাম দিয়েছে আধ্যাতœবাদের নামে মারেফাত, যা আল্ল¬াহর সাথে সরাসরি নাকি সম্পর্কিত। এভাবে তথাকথিত আধ্যাতœবাদের নামে শাশ্বত আদর্শ ইসলামকে কুৎসিত রূপে তুলে ধরা হচ্ছে। এ গেল একটি দিক।

অন্যদিকে মানুষের প্রবৃত্তিকে বাদ দিয়ে খৃষ্ট, বৌদ্ধ, হিন্দু ধর্মগুলো কাম, ক্রোধের নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিয়েছে। এদের ধারণা বৈরাগ্য ও সন্ন্যাস ব্রতেই মনুষ্যত্বের কল্যাণ। ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ জীবন বিধান হিসাবে একে মোটেই প্রশ্রয় দেয় নেই। এভাবে অন্যান্য ধর্ম থেকে কালক্রমে সন্ন্যাস ব্রত ইসলামের নামে ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। হাদীসে রাসূলে হযরত উসমান ইবনে মাযউনের ঘটনা উলে¬খিত হয়েছে। তিনি একাগ্র নিবিষ্টে রাতদিন আল্ল¬াহর ইবাদতে মগ্ন থাকার জন্যে নারী সংস্রব পরিত্যাগ করেন এবং যৌন কামনা থেকে চির মুক্তি লাভের জন্য স্বীয় অণ্ডকোষ কর্তন করে নপুংশক হওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করেন। রাসূল (সা) এ কথা জানতে পেরে তাকে ডেকে পাঠিয়ে ঐ কুৎসিত সংকল্প প্রত্যাখান করার নির্দেশ দেন। হযরত উসমান ইবনে মাযউন (রা) রাসূল (সা)এর নিদের্শ মাথা পেতে নেন। (মিশকাত)

বুখারী শরীফের ইসলামে খাসী হওয়া নিষেধ অধ্যায়ে হযরত আবু হোরায়রা (রা)এর ঘটনা এভাবে বর্ণিত হয়েছে। একদা আবু হোরায়রা (রা) রাসূল (সা)এর কাছে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এক যুবক অসৎ কাজে লিপ্ত হওয়ার আশংকা আছে। এদিকে বিয়ের সামর্থও নেই। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল অণ্ডকোষ কেটে খাসী হওয়ার অনুমতি লাভ। রাসূল (সা) তাঁর কথার কোন উত্তর দিলেন না। পুনরায় আবু হোরায়রা (রা) একই ওযর পেশ করে খাসী হওয়ার অনুমতি চাইলেন। এবারও তিনি চুপ করে রইলেন। তৃতীয়বার আবু হোরায়রা (রা)তাঁর প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করলেন। এবার রাসূলে করিম (সা) নীরবতা ভঙ্গ করে বললেন, হে আবু হোরায়রা! তকদীরে যা লেখার তা পূর্বেই হয়ে গেছে। তুমি খাসী হও বা না হও। কাজেই তুমি অহেতুক এক কাল্পনিক আশংকার দরুণ এক ভ্রান্ত পদক্ষেপের অনুমতি চাচ্ছ?” বিয়ের সামর্থ না থাকলে এক্ষেত্রে ইসলাম রোজার পালনের নির্দেশ দানের মাধ্যমে কাম প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিয়েছে।

আল্ল¬াহর ইবাদত করার রীতি প্রত্যেক ধর্মের মধ্যে ছিল এবং আজও আছে। কিন্তু প্রাচীন ধর্মগুলোতে একটি বিভ্রান্তি বিস্তার লাভ করেছিল। তা হচ্ছে এই যে, ইবাদতের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেহকে কষ্ট দেয়া অথবা অন্য কথায় বলা যায়, তাদের মধ্যে এ ধারণা জন্ম নিয়েছিল যে, রক্ত মাংসের এ শরীরটিকে যত বেশী কষ্ট দেয়া হবে তত বেশী আধ্যাতিœক উন্নতি সাধিত হবে এবং হৃদয়ের অভ্যন্তরীণ স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা বৃদ্ধি পাবে। এরই ফলে হিন্দুদের মধ্যে সাধারণভাবে যোগবাদ ও খৃষ্টানদের মধ্যে ‘রাহবানিয়াত’ বা সন্ন্যাসবাদের উদ্ভব হয় এবং কঠোর কৃচ্ছ্র সাধনার প্রচলন হয়। একেই আধ্যাতিœক উন্নতির উপায় বলে মনে করা হয়। কেউ সারা জীবন গোসল করত না, কেউ বা সারা জীবন চট বা কম্বল পরিধান করত, কেউ সকল সময় এমন কি শীতের দিনেও দিগম্বর থাকত, কেউ সারা জীবন দাঁড়িয়ে থাকত, কেউ সারা জীবন গুহার মধ্যে বসে থাকত, কেউ সারা জীবন রৌদ্রে দাঁড়িয়ে থাকত, কেউ সারা জীবন কোন পাথরের উপর বসে থাকত, কেউ শপথ করত যে, সারা জীবন কেবল গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করবে, কেউ সারা জীবন কুমার থাকত এবং সন্তান উৎপাদন না করাকে ইবাদত মনে করত, কেউ একটি হস্ত শূন্যে উত্তোলিত রেখে তাকে শুকিয়ে ফেলত, কেউ শ্বাস রোধ করাকে ইবাদত মনে করত, কেউ গাছের ডালে উল্টা হয়ে ঝুলে থাকত। এ ছিল ভ্রান্ত ধর্মাবলম্বীদের আল্ল¬াহপরস্তির উন্নততর পর্যায় এবং আধ্যাতিœকতার সর্বাধিক উন্নত রূপ। মোহাম্মদুর রাসূলুল¬াহ (সা) এর পয়গাম তথা ইসলামী জীবনাদর্শ মানবতাকে এ সকল বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে এবং বলেছে যে, এগুলো আধ্যাতিœকতা নয়; বরং দেহের বিচিত্র কসরত। আল্ল¬াহ আমাদের দেহের কসরত পছন্দ করেন না বরং হৃদয়ের রং ভালবাসেন। ( পয়গামে মোহাম্মদীÑসাইয়েদ সুলায়মান নদভী, পৃ-১৯৪-১৯৫)

ইসলামের সুস্পষ্ট অবস্থান বৈরাগ্যবাদের বিরুদ্ধে। আল্ কোরআনে এরশাদ হয়েছে, “আর তাদের পরে ঈসা ইবনে মারয়ামকে পাঠিয়েছি এবং তাঁকে ইনজিল কিতাব দান করেছি। যারা তা মেনে চলেছে তাদের হৃদয়ে দয়া ও সহানুভুতি সৃষ্টি করে। আর রাহবানিয়াতÑবৈরাগ্যবাদ তারা নিজেরা উদ্ভাবন করেছে। আমি এটা তাদের উপর আবশ্যক করে দিইনি। অতঃপর তারা যথার্থভাবে তা পালনও করেনি। (সূরা হাদীদ-২৭) রাসূল (সা) বলেছেন, “লা রাহবানিয়াহ্ ফিল ইসলাম অর্থাৎ ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নেই।” (মুসনাদে আহমাদ) যারা বিয়ে করে সংসার জীবনযাপন বিরোধী বা নারী সংস্পর্শ বর্জিত থাকতে চায় তারা আল¬াহ্র রাসূলের (সা) দলভুক্ত বা উম্মত নয় বলে ঘোষণা করেছেন। এ ব্যাপারে বহুল পঠিত হাদীসটিও প্রনিধানযোগ্য ঃ “একবার তিন ব্যক্তির একটি দল নবীজী (সা)এর ইবাদত পদ্ধতি জানার উদ্দেশ্যে তাঁর স্ত্রীদের গৃহে এলেন। তাদেরকে এ ব্যাপারে জানানো হলে তারা এগুলিকে সামান্য মনে করলেন। তারা বললেন, কোথায় নবী করীম (সা) আর কোথায় আমরা? আল¬াহ তো তাঁর পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাদের একজন বললেন আমি আজীবন সারা রাত সালাত আদায় করব। দ্বিতীয়জন বললেন, আমি সারা জীবন প্রতিদিন রোজা রাখব। কখনো দিনের বেলা রোজা ভাঙব না ও খাব না। তৃতীয়জন বললেন, আমি নারী সংশ্রব বর্জন করব এবং সারা জীবন অবিবাহিত থাকব। এমন সময় নবীজী (সা) এসে পড়লেন। তিনি বললেন, এই ধরনের কথাগুলি কি তোমরাই বলছিলে? শুনে রাখ, আল¬াহর কসম, আমি তোমাদের চেয়ে বেশী আল্ল¬াহকে ভয় করি এবং অতি সতর্কতার সাথে তাঁর হুকুম মেনে চলি। কিন্তু এরপরও আমি দিনের বেলা রোজা রাখি, আবার রোজা ভেঙ্গেও থাকি। আমি রাত জেগে সালাত আদায় করি, আবার ঘুমাইও। আর আমি বিয়ে-শাদীও করেছি। কাজেই যারা আমার নীতি থেকে বিচ্যুত হবে তারা আমার দলভুক্ত নয়।” (বুখারী ও মুসলিম) এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল¬ামা বদরুদ্দীন আইনী লিখেছেন ঃ প্রমাণিত হল যে, বিয়ে করা নবীর সুন্নত বিশেষ। মনীষী মহ্লাব বলেছেন, বিয়ে ইসলামের অন্যতম রীতি ও বিধান। আর ইসলামে বৈরাগ্যবাদের কোন অবকাশ নেই। যে লোক রাসূলের সুন্নতের উপর অনাস্থা ও অবিশ্বাসের কারণে বিয়ে পরিত্যাগ করবে, সে অবশ্যই ভর্ৎসনার যোগ্য বিদআতী। কবিও যথার্থই বলেছেন, “বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়।”

সূরা হাদীদের ২৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদুদী (রহ) বলেন, রাহবানিয়াত অর্থ ভীত হওয়ার পথ ও পন্থা বা ভীতদের পথ ও পন্থা। এর পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে ভয়ের কারণে কোন ব্যক্তির (কারো জুলুম নির্যাতনের ভয়ে হোক বা দুনিয়ার ফিতনার ভয়ে হোক কিংবা নিজের প্রবৃত্তির দুর্বলতায় ভয়ে হোক) দুনিয়াত্যাগী হয়ে যাওয়া এবং দুনিয়ার জীবন থেকে পালিয়ে বন-জঙ্গলে বা পাহাড়ে আশ্রয় নেয়া কিংবা নির্জন নিভৃতে যেয়ে বসা। আর রাহবনিয়াত আমি তাদের উপর ফরয করেছিলাম না বা এ বৈরাগ্যবাদ আমার ফরযকৃত ছিল না। বরং তারা আল্ল¬াহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে তারা তা নিজেরাই নিজেদের উপর ফরয করে নিয়েছিল। সুতরাং আয়াতের মধ্যে সুস্পষ্ট করা হয়েছে যে, বৈরাগ্যবাদ একটি অনৈসলামিক রীতি। এটি কখনো দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। আল¬াহর পথে জিহাদই হচ্ছে বৈরাগ্যবাদ। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, “আল¬াহর পথে জিহাদই হচ্ছে এ উম্মতের বৈরাগ্যবাদ। (মুসনাদে আহমাদ) দুনিয়া বর্জন করা এ উম্মতের আধ্যাতিœক উন্নতির পথ নয়, বরং এর আধ্যাতিœক উন্নতির পথ হচ্ছে আল¬াহর পথে জিহাদ। আর এ উম্মত ফিতনার ভয়ে ভীত হয়ে বন-জঙ্গল ও পাহাড়ে-পর্বতে পালিয়ে যায় না বরং আল¬াহর পথে জিহাদের মাধ্যমে তার মোকাবিলা করে। (বৈরাগ্যবাদ এবং এর খৃস্টীয় ইতিহাস সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে হলে পড়–ন তাফহীমুল কোরআনÑ১৬ খন্ড, সূরা হাদীদের ৫২, ৫২ ও ৫৪ নং টীকা)

জিহাদই ইসলামের বৈরাগ্যবাদ। আমরা এর সার্থক রূপায়ন দেখতে পাই রাসূলের গড়া সাহাবীদের সংগ্রামী জীবনে। আল্ কোরআনে যার সার্টিফিকেট রয়েছে, এরশাদ হয়েছে, “মোহাম্মদ (সা) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরও পরিচয় হলÑতারা কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে বজ্র কঠিন। পরস্পরের প্রতি রহম দিল, তাদের দেখতে পাবে রুকু ও সিজদাবনত, আল¬াহর রহমত ও সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সর্বদা নিয়োজিত। (সূরা আল্ ফাতাহÑ২৯) রাসূল (সা)এর হাতে গড়া এই লোকদের ব্যাপারে ইসলামের দুশমনদেরও বক্তব্যঃ “তারা রাতে দরবেশ আর দিনে অশ্বারোহী মুজাহিদ, কর্মচঞ্চল বীরযোদ্ধা। তাঁরা কাউকে ধোঁকা দেয় না, তাঁেদরকেও কেউ ধোঁকা দিতে পারে না।” ইখওয়ানুল মোসলেমীনের সাবেক মোর্শেদে আ’ম সাইয়্যেদ ওমর তেলমেসানী বলেন, “সাহাবায়ে কেরামের সংযম সাধনা ছিল আদর্শস্থানীয়, তাদের কাছে দুনিয়া ত্যাগী কোন মনোভাব ছিল না। দুনিয়ার জীবনে নিজেদেরকে যোগীদের মত নির্যাতনে নিষ্পেষণে লিপ্ত করার কোন মানসিকতা ছিল না। দুনিয়াত্যাগী মনোভাব দ্বারা এটা মনে করার কোন কারণ ছিল না যে তারা মৃত্যু কামনা করতেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল এ রকম যে, যতদিন তাদের জীবন মঙ্গল ও কল্যাণ এবং আল্ল¬াহর সন্তুষ্টির মাধ্যম হতে পারে ততদিন তারা বেঁচে থাকবেন। যখনই মৃত্যু তাদের জন্যে কল্যাণকর হবে তখন তারা মৃত্যুবরণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তারা মনে করতেন জীবন অর্থ-সম্পদ এক কথায় জানমাল সবই আল্ল¬াহর আমানত। ত্যাগ ও কোরবানীর সময়ে তারা কখনো কষ্ট পেতেন না বা বিচলিত হতেন না। তারা ইহকাল ও পরকাল উভয় স্থানেই মঙ্গল প্রত্যাশী ছিলেন।” (শহীদে মেহরাব হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব, পৃ.৫৭)

বৈরাগ্যবাদ একটি দর্শনে রূপ নিয়েছে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের কাছে। নাটকে, যাত্রামঞ্চে, সাহিত্যে বৈরাগীদের বিভিন্নভাবে চিত্রায়িত করা তাদের কাছে জীবনটাই অনীহা, সংসারের প্রতি বিমুখ, ছন্ন ছাড়া জীবন। কেন তাদের সৃষ্টি করা হল এ জন্যে স্রষ্টার প্রতিও তারা বিরাগ। কায়েমী সমাজপ্রভুরা তাদের প্রতি দারুন পঞ্চমুখ। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে লালন ফকির, লেংটা ফকির, বদনা ফকিরসহ অনেক অজানা সমাজের নর্দমা। “তাদের আধ্যাতœবাদ বা বৈরাগ্যের চর্চার মাধ্যমে গুটি কতক সংসার বিরাগী সাধু-সন্ন্যাসী সৃষ্টি করা ছাড়া বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর জন্য কোন কল্যাণকর অবদান রাখতে পারেনি। বস্তুতঃ মানুষ যেমন দেহ সর্বস্ব নয়, তেমনি আতœা সর্বস্বও নয়। সুতরাং আতœাকে উপেক্ষা করে দেহের প্রয়োজন পূর্ণ করার একদেশদর্শী কার্যক্রম যেমন মানবতার জন্যে মনুষ্যত্বের জন্যে ক্ষতিকর, তেমনি আতœার প্রয়োজন করতে গিয়ে আতœার উন্নতি সাধন করতে গিয়ে, দেহের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করা, দেহকে শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়া অবলম্বন করাও মানবতার জন্য চরম ক্ষতিকর।” (আল্ল¬াহর নৈকট্য লাভের উপায়Ñ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, পৃ.১১)

বৈরাগ্যবাদের কুফল সম্পর্কে সম্পর্কে চুলচেরা বিশে¬ষণ করেছেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ অধ্যাপক মফিজুর রহমান। তিনি বলেন, “বৈরাগ্যবাদের নামে সর্বেশ্বরবাদ, অহিংসাবাদ ভিত্তিক যে সমস্ত দর্শন পৃথিবীতে আছে মানুষের জন্যে কতগুলো সুন্দর সুন্দর বাণী উপহার দিয়েছে। এ দর্শনগুলো মানুষের জৈবিক প্রয়োজনকে অস্বীকার করেছে। ধ্বংস করেছে মানুষের আতœাকে, আতœাকে পীড়নের ও মানুষের স্বাভাবিক সত্তাকে অস্বীকারকারী এ দর্শনগুলো কোন জীবন্ত জাতি গ্রহণ করতে পারে না। সংসার ধর্ম ত্যাগ করে গহীন বনে অরণ্যচারীদের আদর্শ মানবতার কোন কাজে আসবে না। ইহা সম্পূর্ণ মানব ফিতরাত ও স্বভাবের পরিপন্থী। ইহা সমাজ-জীবনের দায়-দায়িত্ব ও অনুভুতির ব্যাপারে উদাসীন। ইহা মানুষের কর্মতৎপরতা উদ্দীপনাকে চিরতরে ধ্বংস করে দেয়। পৃথিবীতে মানুষের আগমন কেন হয়েছে? স্রষ্টার সাথে মানুষের দায়িত্ব ও করণীয় কি? এ পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান কোথায়? কোথায় তার শেষ মঞ্জিল? দায়িত্ব পালনে আতœীয়, পরিবার, প্রতিবেশী, দুঃস্থ ও নিপীড়িত জনগণের প্রতি কোন অধিকার আছে কি না? ইত্যকার হাজার বিষয়ের ব্যাপারে বৈরাগ্যবাদী আদর্শের কাছে কোন জবাব নেই। মানব জীবন ও জীবনের প্রয়োজন দায়িত্ব-কর্তব্যের সাথে এ আদর্শের দূরতম সর্ম্পকও নেই। এটি একটি নেতিবাচক আদর্শ। এ সুন্দর পৃথিবী এত উপভোগ্য হাজার উপাদান, রূপ, রস, গন্ধ সবকিছুকে ঘৃণা উপেক্ষা করে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে এ আদর্শ কি দিতে এসেছে বোধগম্য নয়। (দাওয়াতে দ্বীন, পৃ.১৩১)

পাশ্চাত্যের খ্যাতনামা মনীষীরা খ্রীষ্ট, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের বৈরাগ্যবাদী নীতির সমালোচনা এবং ইসলামে বৈরাগ্যের বিরুদ্ধে অবস্থানকে বিজ্ঞান, দর্শন ও প্রগতিশীলতার সাথে তুলনা করে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। Arthur Anthony Macdonald তাঁর “Lectures on Comparative Religions” নামক পুস্তকে বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন, “Buddhism as a monastic and anti-social system with a pessimistic aversion to human activities is evidently unfitted for the role of inspiring and directly any progressive society.” অর্থাৎ সন্ন্যাস-প্রধান ও সমাজ-বিমুখ বৌদ্ধ ধর্ম মানবীয় কার্যাবলীর প্রতি ইহার বৈরাগ্য-সুলভ বিতৃষ্ণার জন্য প্রগতিশীল সমাজকে অনুপ্রাণিত ও চালিত করার জন্য স্পষ্টতই অনুপযুক্ত।” ইতিহাস ইহাই প্রমাণ করছে যে, আজ বৈরাগ্যের বিরুদ্ধে বিজ্ঞান ও দর্শনের অভিযান ইসলামী আদর্শেরই অনুসরণ মাত্র। বৈরাগ্যের প্রতি এই বিরাগ ও বিতৃষ্ণা বর্তমান সভ্যতার মূলে প্রেরণা যোগাচ্ছে। Arnold I Guillami, Legacy of Islam নামক পুস্তকের মন্তব্য দিয়ে শেষ করতে চাই ঃThe non-ascetic ideals of Islam assist us to liberate ourselves from the narrow and oppressive conceptions which would limit all that is significant in literature, thought and history to our small segment of the globe.অর্থাৎ যে সংকীর্ণ বেদনা দায়ক দৃষ্টিভঙ্গি সাহিত্য, ইতিহাস ও মানবীয় চিন্তাধারার মধ্যে যা কিছু মূল্যবান তাকে এ বিপুল বিশ্বে আমাদের এক ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চায়, ইসলামের বৈরাগ্য ও পৌরহিত্য-বিরোধী আদর্শই তা হতে আমাদেরকে মুক্ত রাখতে সাহায্য করে।” (হযরত মোহাম্মদ (দ) তাঁহার শিক্ষা ও অবদান- সৈয়দ বদরুদ্দোজা, পৃ, ২৪০-২৪১)

*****

বিষয়: সাহিত্য

২৬৯২ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

319553
১২ মে ২০১৫ দুপুর ০১:৫৬
চাটিগাঁ থেকে বাহার লিখেছেন : কপি পেষ্ট হওয়াতে কয়েকটি শব্দ ভেংগে গেছে । এডিট করে বানানগুলো ঠিক করে দিতে পারবেন মাছুম ভাই ।
ধন্যবাদ আপনাকে । Good Luck
319558
১২ মে ২০১৫ দুপুর ০২:১৯
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : ধন্যবাদ।বাহার ভাই।
319598
১২ মে ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:৩৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : বৈরাগ্যবাদ হচ্ছে মানবিক আচার এর বিরোধি। ইসলামের প্রকৃত সুফি রাও কেউ সন্যাসি ছিলেন না। অথচ সুফিবাদ এর নামে এই অপবিশ্বাস ছড়ান হচ্ছে।
১২ মে ২০১৫ রাত ০৯:৪৬
260744
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : xactly, Sabuj bhai..thank u very much..

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File