নিবন্ধ -৩ : ইসলামে নারী শিক্ষার গুরুত্ব এবং অন্যান্য

লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১১ মে, ২০১৫, ১২:৩৮:৪৩ দুপুর

পুরুষ ও নারী সৃষ্টির উদ্দেশ্য :

সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। মানুষের মধ্যে দু'টি শ্রেণী। একটি হচ্ছে পুরুষ এবং অপরটি নারী। একে অপরের পরিপূরক। আল কোরআনের ভাষায়, "তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক।" (সূরা বাকারা-১৮৭) সৃষ্টির ধারাকে চিরজারি রাখার জন্যে, পরস্পরকে সুখী করার জন্য, দুনিয়া ও আখেরাতকে আলোকিত করার জন্য মহান আল্লাহ্‌পাক নর-নারী সৃষ্টি করেছেন। সূরা নিসায় আল্লাহ্‌পাক বলেন, "হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকেই সৃষ্টি করেছেন ও যিনি তা থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দু'জন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন এবং আল্লাহকে ভয় কর যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাঞ্চা কর এবং সতর্ক থাক আত্নীয়তার বন্ধন সম্পর্কে। আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখেন।" (আয়াত-১) অন্য আয়াতে নারী-পুরুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, "এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের অর্ধাঙ্গীনিদের যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।" (সূরা রূম-২১) এই আয়াতে কারীমা গুলো থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, ইসলামের দৃষ্টিতে নারী ও পুরুষের মর্যাদা সমান, পারস্পরিক প্রেম-ভালবাসার মাধ্যমে বিশ্ব সংসারকে অনাবিল শান্তিময় করে তোলার লক্ষ্যে আল্লাহপাকের পরিকল্পনা সুনিপুণ। তাঁর বিধান নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান, ন্যায়ানুগ, সুন্দর ও কল্যাণকর। আলোচ্য নিবন্ধে শিক্ষা, শিক্ষার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য, নারীশিক্ষা এবং এর গুরুত্ব কতটুকু, নারী সম্পর্কে অন্যান্য ধর্মের ধারণা, ইসলামের আলোকে তুলে ধরা হবে।

শিক্ষা ও শিক্ষার লক্ষ্য :

প্রথমেই শিক্ষা নিয়ে শুরু করা যাক। শিক্ষাকে আমরা বিদ্যা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিজ্ঞান অনেক নামেই অভিহিত করতে পারি। ইসলামের নবী (সা)এর প্রতি প্রথম ওহীই হল "ইকরা" বা পড়। ইসলামী বিধি-বিধান পুরুষ এবং নারী সকলের জন্যই সমান। তেমনি শিক্ষাও দু'জনেরই জন্য। ইসলাম বিদ্বেষীরা বলে নারীকে ইসলাম ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছে। শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে পদচারণা সঙ্কুচিত করে রেখেছে। এটা নির্জলা অপপ্রচার। নারীদের মধ্যে উম্মুল মোমেমীন হযরত আয়েশা (রা) সবচেয়ে বেশী হাদীস বর্ণনা করেছেন। এছাড়া হযরত মায়মুনা (রা), হযরত হাফসা(রা), হযরত উম্মে হাবিবা(রা) প্রমুখরা নারীরা হাদীস শাস্ত্রে যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। হযরত রাবেয়া বসরী আধ্যাত্নিক সাধনার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। এটা কি করে সম্ভব হলো? নিশ্চয় শিক্ষারই ফলে। এছাড়া জগতে আরো অনেক নারী শিক্ষার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। শিক্ষার মাধ্যমে মহোত্তম হতে রাসূল (সা) জ্ঞানার্জনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি যুদ্ধ বন্দীদেরকে জ্ঞান দান করে মুক্তির শর্ত বিবেচনা করেছেন। ইসলামই নারীকে শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগামী হতে বেশী বেশী উৎসাহিত করেছেন। রাসূল (সা) বলেছেন, দোলনা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞানার্জন কর। তিনি আরো বলেছেন, জ্ঞান অর্জন করা ইসলামে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ফরয বা অবশ্য কর্তব্য। সৃষ্টির শুরুতেই আমরা দেখতে পাই, হযরত আদম (আ) জ্ঞানের বলে চিরঅভিশপ্ত ইবলীসের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। লিও টলস্টয় যুব সমাজের প্রতি পরামর্শ স্বরূপ তিনটি কথাই বলেছেন-পড়, পড় এবং পড়। হযরত আলী (রা) বলেছেন, জ্ঞানের চেয়ে বড় চোখ আর নেই, সত্যের চেয়ে বড় তপস্যা আর নেই। প্রখ্যাত মিশরীয় দার্শনিক প্রফেসর মোহাম্মদ কুতুব বলেছেন, "শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের কাজ হলো পরিপূর্ণ মানব সত্তাকে লালন করা, গড়ে তোলা এমন একটি লালন কর্মসূচী যা মানুষের দেহ, তার বুদ্ধিবৃত্তি এবং আত্না, তার বস্তুগত ও আত্নিক জীবন এবং পার্থিব জীবনের প্রতিটি কার্যকলাপের একটিকেও পরিত্যাগ করে না, আর কোন একটির প্রতি অবহেলা করে না।" এখানে শিক্ষা বলতে কিন্তু এমন শিক্ষাকে বুঝানো হচ্ছে, যে শিক্ষাতে নৈতিকতা বিদ্যমান। যে শিক্ষা লাভের মাধ্যমে জীবন ও জগত সম্পর্কে সঠিক ও নির্ভুল ধারণা পাওয়া যাবে। তাই নারীর শিক্ষার জন্য আলাদা পাঠক্রমের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন আলাদা প্রতিষ্ঠানের। যাতে সহশিক্ষার লেশ মাত্র থাকবে না।

নারী শিক্ষার গুরুত্ব :

বর্তমানে নারী শিক্ষা, নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নের নামে অনেক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে পাশ্চাত্যের অনুকরণে। কত নীতিমালা রচিত হচ্ছে ও হবে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও নারী উন্নয়ন নীতি মালার নামে একটি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেছিল, কিন্তু দেশের ধর্মপ্রিয় মুসলমানদের প্রতিবাদের মুখে তারা ক্ষান্ত হয়। ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি মাঝে মাঝে শয়তানের খপ্পরে পড়ে শাসক শ্রেণী তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালায়। নীতিমালার একটা ধারা হল : জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার ১৫ পৃষ্ঠার ৯-১৩ উপ-ধারায় নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে, "নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরী বিষয়াদি যথা-স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবন-ব্যাপী শিক্ষা, কারিগরী শিক্ষা, তথ্য, উপার্জনের সুযোগ, সম্পদ, ঋণ, প্রযুক্তি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার ও সেই লক্ষ্যে নতুন আইন প্রণয়ন করা।" যেহেতু এখানে শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে, তাতেই সীমাবদ্ধ রাখতে হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার জন্য তো শুধু নারীকে আলাদা গুরুত্ব দেব কেন? সংবিধানই তো বলে সবার জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করতে। এভাবে আইন প্রণয়ন না করে সবার জন্য শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করলেই সুন্দর ব্যবস্থা যায়। কুচক্রীদের কুমতলব আছে, তারা ধর্মীয় ভাবসদ্ভাবে আঘাত করে ধর্মীয় উম্মাদনা তৈরী করতে চায়। যাতে ইসলামকে একটি বিশৃংখল ধর্ম বলে প্রচারণা চালাতে পারে। আমাদের নীতি নির্ধারকদের মনে রাখা উচিত, দেশের জাতীয় আদর্শ ও মূল্যবোধকেই শিক্ষানীতি তৈরী করার সময় প্রাধান্য দিতে হবে। নৈতিকতাহীন শিক্ষা, পরস্পর বিরোধী শিক্ষা, সহশিক্ষা, সেশনজট মুক্ত শিক্ষা পরিহার করে একটি জীবন ও জগতের পরিচ্ছন্ন ধারণানুযায়ী উৎপাদনশীল ও কর্মমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যা প্রযোজ্য হতে পারে।

নারী সমাজের চিন্তার বিষয় :

আরব জাহিলিয়াতের সময় নারী ও কন্যা শিশুদের অবস্থার কথা একবার চিন্তা করুন। নারীদের কোন মর্যাদা অধিকার ছিল কি? কন্যা শিশুদের কি জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলা হত না? ইসলামের সুমহান আদর্শ নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সা) এসে কিভাবে নারী ও কন্যা শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করলেন একটু চিন্তা করুন। অন্যান্য ধর্মে নারীদের মর্যাদা ও অধিকার পাঠ করে তুলনামূলক পর্যালোচনা করুন। ইসলামই যে নারীদের জন্য যথার্থ মর্যাদা দিয়েছে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। নবী মোহাম্মদ (সা)ই যে নারী মুক্তি ও নারী শিক্ষার অগ্রদূত তা প্রমাণিত হবে। একশ্রেণীর লোক নারীদেরকে ভোগবাদীরূপে গড়ে তুলে, জীবন যৌবন উপভোগ করার কুমন্ত্রণা দিয়ে জাহিলিয়াতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ প্রতারণা ও চাকচিক্যপূর্ণ এ ব্যবস্থাকে সাদরে গ্রহণ করে ভোগ বিলাসিতায় ডুবে যাচ্ছে, সমাজের অন্যান্য নারীদের পাপপঙ্কিলতায় উন্মত্ত ও বিষাক্ত করে তুলছে। নারীদের উগ্র চাল-চলন, পাতলা বস্ত্র পরিধান করে অলংকার সজ্জিত করা, টাইট-ফিট জিন্স জামা পরা, সুগন্ধি ব্যবহার করে পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এসব জাহিলি আচরণ। এ জাহিলিয়াত থেকে নারী সমাজকে ইসলামের শিক্ষায় আলোকিত হয়ে ফিরে আসতে হবে। মহানবী (সা) বলেন, "মিরাজের রাতে আমাকে দোজখ দেখানো হয়, আমি দেখেছি তাদের অধিকাংশ নারী।" এক রাতে স্বপ্নে নবীজীর ঘুম ভেঙ্গে গেলে বলে উঠেন-"সুবহানাল্লাহ আজ রাতে কত ফিতনা নাজিল হয়েছে, কত কত কোষাগার খোলা হয়েছে! ঘরবাসিনীদের সজাগ করবার কেউ আছ কি? এ জগতের অনেক বস্ত্র পরিধানকারী পরকালে নগ্ন থাকবে।" (বুখারী)

নারীদের আরো কিছু জাহিলি আচরণ :

রাসূল (সা) বলেছেন, "অচিরেই আমার উম্মতের মধ্যে এমন সব নারীর আর্বিভাব ঘটবে, যারা কাপড় পরেও নগ্ন থাকবে। তাদের মাথা হবে উটের পিটের কুঁজের মত। তাদের অভিশাপ দাও, কারণ তারা অভিশপ্ত।" (তাবারানী) এদের প্রতি সতর্ক করে তিনি আরো বলেছেন, এসব নারী কখনো জান্নাতে যেতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না। অথচ অনেক দূর পর্যন্ত জান্নাতের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়বে। অনেক নারী ও পুরুষ আছে তারা পোশাকের ক্ষেত্রে কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করে না। রাসূল (সা) বলেছেন, "যে নারী পুরুষের মত পোশাক পরে তারা অভিশপ্ত, যে পুরুষ নারীর কাপড় পরে তারা অভিশপ্ত।" ( আবু দাউদ, তিরমিযী ও মুসনাদে আহমদ) মৃতের জন্য বিলাপ করাও জাহিলি আচরণে মধ্যে গণ্য, নারীরা এ কাজটি বেশী করে। হযরত আবু মুসা আশয়ারী (রা) বর্ণিত রাসূল (সা) বলেছেন, যে সব নারী মৃতের জন্য বিলাপ করে কান্নাকাটি করে, তারা যদি মৃত্যুর আগে তাওবা না করে, তাহলে কেয়ামতের দিন তাদেরকে উঠানো হবে যে তার পরনে থাকবে আলকাতরা পরিধেয় এবং খুঁজটা পাচঁড়ার মত কামিস।"

সবশেষে বলতে হয়, শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলাম কোন বৈষম্য সৃষ্টি করেনি। এমনকি কোন ক্ষেত্রেই নয়। সেটা নারী-পুরুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যতেই বলা হয়েছে। সমাজে নারী-পুরুষ ভেদরেখা আমাদের তৈরী। আমাদেরকেই এ ভেদরেখা তুলতে হবে। নারীর অধিকার, মর্যাদা, শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার দায়িত্ব আমাদেরই। তাদেরকে এগিয়ে আনতে হবে এ সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণের জন্য। জাহিলি আচরণ ত্যাগ করতে হবে, শিক্ষিত হিসাবে গড়ে উঠতে হবে। ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে জ্ঞানাজর্ন করার ছাড়া গত্যন্তর নেই।

=======

বিষয়: সাহিত্য

৩৫৯৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

319387
১১ মে ২০১৫ দুপুর ০১:৩৮
চাটিগাঁ থেকে বাহার লিখেছেন : ভাল লেগেছে আপনার লেখাটি, আশা করি আরো লিখবেন । ধন্যবাদ আপনাকে
১১ মে ২০১৫ দুপুর ০২:১৪
260504
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : ধন্যবাদ স্যার আপনাকে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File